রবিবার, ৭ মার্চ, ২০১০

দৃক : দ্বিতীয় সংখ্যা (সম্পূর্ণ)


দৃক 
সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ত্রৈমাসিক ছোট কাগজ 
২য় সংখ্যা, মার্চ ২০০৮, ফাল্গুন ১৪১৪

সম্পাদক: মাইনুল ইসলাম, সহ-সম্পাদক: হেলাল মোর্শেদ, সৌরভ বড়ুয়া

প্রচ্ছদ: জিলানী আলম (সৃষ্টি ধ্বংস কর্ম সময়)

বর্ণবিন্যাস: মো.মোশাররফ হোসাইন মিন্টু

নেপথ্য মুখ: মেহেদী, জহির শান্ত, ভুট্টু, রোমন, তানভীর, পিন্টু, পলাশ, রিয়াজ, জয়, কৌশিক, জাবেদ, রিফাত, ফরহাদ, খালেদ, তারেক, অজিত, সিমেকবন্ধু-রথিন, আলম, জনি, চয়ন, দেলোয়ার, শাখি, আসলাম, ইরফান বাবু, সুমন। 

যোগাযোগ: রুম নং-৪০৮, ৪র্থ তলা, সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস, লাকসাম রোড, কুমিল্লা। 
অথবা, 'মাতৃছায়া'; ১৬৩, জংলি বিবি মসজিদ রোড; ছোটরা; কুমিল্লা। 
ফোনঃ ০১৭১৬-৫৬৭৯০৮, ০১৭১৭-৫১৮৭১৯, ০১৭১৮-৬৩৮২৯৯ 
email: drik_littlemag@yahoo.com

মুদ্রণ: ইন্ডাস্ট্রীয়েল প্রেস, পুরাতন চৌধুরীপাড়া, কুমিল্লা

প্রাপ্তিস্থান: লিপিকা/স্বরলিপি, ভিক্টোরিয়া কলেজ রোড, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা। 
মেঘবার্তা, লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ, শ্রাবণ, জনান্তিক, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা। কারেন্ট বুক সেন্টার (চট্টগ্রাম)

মূল্য ৩০ টাকা। 

_________________________________________________

সম্পাদকীয়

খড়ি হাতে স্লেটে এলোপাথারি আঁকিয়ে ক্ষুদে শিশুরাই একদিন স্বাক্ষর হয়ে ওঠে। সাহিত্যের নবীন আঁকিয়েদের স্লেটের অভাব খুব। আমরা হতবুদ্ধ নই- অনেক সীমাবদ্ধতা ও সংশয় কাটিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো এসেছি। 

ইতিহাসের প্রতি আমাদের এক রকমের মুগ্ধতা আছে। মাঝে মাঝে এই মুগ্ধতার মোহভঙ্গ ঘটে। কিছু কিছু উদ্দীপনা সাহসের পিঠে চড়ে ক্রান্তির দ্বারে এসে পৌঁছায়। সাম্প্রতিক দেশীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন, অগাস্টের ছাত্র বিক্ষোভ, পাটকল-পুরাকীর্তি নিয়ে নয়ছয় ইত্যাদি ঘটনা সামগ্রিক জীবনের মাত্রিক ও আঙ্গিকগত পরিবর্তনের উপাদান বহন করছে। ক্ষমতার হস্তান্তর নয়, রূপান্তরটাই এই মুহুর্তের প্রয়োজন। বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানি সমূহের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন, আধিপত্য ও আগ্রাসন নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। 

যাদের সহযোগিতা ও উৎসাহ 'দৃক' এর ধারাবাহিক প্রকাশে আমাদের প্রাণিত করছে প্রত্যেককে ধন্যবাদ। 

_________________________________________________

সূচি

প্রবন্ধ: ফিরোজ আহমেদ, হরিধন দাস, গোঁসাই পাহলভী, মো.মোজাম্মেল হক, ফরহাদ হোসেন মাসুম

কবিতা: সৌরভ বড়ুয়া, নীড় দত্ত মজুমদার, কায়সার হেলাল, মাইনুল ইসলাম, খালেদ চৌধুরী, জহির শান্ত, সৈয়দ আহমাদ তারেক, মাহমুদ কচি

গল্প: কায়সার হেলাল, মোস্তফা সরওয়ার খান

মুক্তগদ্য: পিয়াস মজিদ

গ্রন্থালোচনা: লায়লা ফেরদৌস ইতু

_________________________________________________
প্রবন্ধ
_________________________________________________

বাঙলা ভাষার আশাঃ মুক্তির ভাষার সন্ধানে 
ফিরোজ আহমেদ

এক. বাংলা ভাষার আশা কী? এই ভাষাকে কেন্দ্র করে যে জনগোষ্ঠী, তারইবা ভরসা কী? কিংবা প্রশ্নটাকে অন্যভাবেও করা যায়: বাংলাভাষার আলাদা করে কোন আশা থাকার দরকারটা কী? আমরা তো এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করি, পুরো পৃথিবীটাই নাকি একটা গ্রামস্বরূপ। সেখানে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত কয়েকটা আন্তর্জাতিক ভাষা তো আছেই, আর দেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা তো সেগুলো শিখে দেশ-বিদেশে ভালোই আছে তারা গবেষণা করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এবং পড়াচ্ছে, এমনকি মূর্খ-অজ্ঞ সাধারণ লোকজন পর্যন্ত দেশের বাইরে গিয়ে সেখানকার ভাষা শিখে গতর খাটিয়ে বেশ দু'পয়সা আয়-রোজগারও করছে। কথাটাকেই আরেকটু প্যাচ কষে এভাবেই বলা যায়: বাকি দুনিয়া আমাদের থেকে কতদূর এগিয়ে! আমাদের ভাষা যতই স্নেহ-মধুর হোক, 'মা' বুলির মাধুর্য নিয়ে কবিরা যতই হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিক, আবেগ দিয়ে কি দিন চলবে? বিজ্ঞান কী দর্শনের জটিল ভাব কি বাংলায় প্রকাশ করা যাবে? ব্যক্তিগতভাবেও কেউ সফল হতে চাইলে বিদেশি ভাষায়, বিশেষতঃ ইংরেজিতে কাবিল না হলে চলবে কী করে? 

সংক্ষেপে প্রশ্নটা দাঁড়িয়েছে এই বাংলাভাষা কি জনতার আটপৌরে ভাষা হিসেবেই রয়ে যাবে, কিংবা কোন এক দূর অন্তিমে কি তা প্রত্মবস্তুতে রূপান্তরিত হবে? নাকি এরও ক্ষমতা আছে তাকে কেন্দ্র করে যে জনগোষ্ঠী, তার কোন বিপ্লবী রূপান্তরের ভাষা যোগাবার; এমন রূপান্তর যা সেই জনগোষ্ঠীর সকল অস্ফুট কিংবা এখনও কল্পনাতীত সকল সম্ভাবনায় এমন আশ্চর্য যাদুর ছোঁয়ায় প্রাণ সঞ্চার করবে যে, ইতিহাসের ঘটে যাওয়া মহৎ পর্বগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা যেমন বলে থাকি, তেমনটিই আবারও বলব: তাইতো, এটাই তো ঘটার ছিল! তাইতো, তাইতো!!

দুই. মানবিক উৎকর্ষগুলোর মাঝে শ্রেষ্ঠ গুণ ভাষা। একদিন মানুষ পশুকূলের অন্যান্যদের মতই ভাষাহীন ছিল। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী যে প্রকৃতির ওপর সচেতন ক্রিয়ায় সক্ষম, যেখানে আর সকলেই প্রকৃতির শৃঙ্খলে বন্দি। প্রকৃতির ওপর ক্রম কর্তৃত্বের আয়োজনের সাথে সাথে, নিত্য নতুন হাতিয়ার ও সামাজিক সম্পর্কের বিবর্তনের পথে পরস্পর যোগাযোগ অধিকতর গূরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, ভাষারও কাঠামো জটিলতর হয়ে উঠল। এক একটি স্বতন্ত্র এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী এভাবে স্বতন্ত্র ভাষার জন্ম দিল, আর উৎপাদন সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের ভিত্তিতে ভাষা জন্ম দিল এক একটি জাতিগোষ্ঠীর। ভাষার বিকাশের এই পর্বটি অনেকটাই সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত। মানুষ তখন উৎপাদনের ক্ষেত্রে জটিল কোন হাতিয়ার ব্যবহার করতো না, ফলে উৎপাদনও ছিল সীমিত। সবগুলো ভাষাই আদি পর্বের এই সহজাত বিকাশের স্তর পাড়ি দিয়ে এসেছে। সঙ্গত কারণেই, সীমানাবর্তী জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষার মাঝে সাদৃশ্যও থাকত প্রচুর। 

ভাষার বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়টিতে ঘটে রাজনৈতিক অভ্যুদয়। এই পর্বটি উৎপাদন পদ্ধতির আরও বিকাশ ও বাড়তি সম্পদ সৃষ্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। যেমন প্রাচীন মিশরে কৃষির বিস্তারের সাথে সাথে সেচব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে ব্যবস্থাপক-নেতাদের আবির্ভাব ঘটায়, কালক্রমে তাই আদি ক্ষুদ্র সর্দার বা ক্ষুদ্র রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয়। তারপর প্রথমে কয়েকটি বৃহৎ প্রতিযোগী রাজবংশ দাঁড়ায়, পরিশেষে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। এক্ষেত্রে কিন্তু মিশরের বাকি এলাকাগুলোর ভাষা আঞ্চলিক ভাষায় পর্যবসিত হয়। একটি কেন্দ্রীয় ভাষাও তৈরি হয়, তৈরী হয় কেন্দ্রীয় ধর্ম ও ক্ষমতার বিধি। শুধু কি তাই? এই উৎপাদনের বিকাশের পর্যায়টিতে বাড়তি জনশক্তির প্রয়োজনে দুর্বল বহু জাতিকে আংশিক বা পূর্ণাঙ্গভাবে দাসেও পরিণত করা হয়। এই পুরো রাজনৈতিক ঐক্যের প্রক্রিয়াই আবার উল্টোদিকে ভাষায় ধর্ম, রাজনীতি, প্রযুক্তি, শাসন ও শৃঙ্খলাবিধি সম্পর্কে নতুন নতুন ধারণা ও পদ্ধতির, নতুনতর শব্দের জন্ম দেয়। ক্রমে ভাষা এত জটিল হয়ে ওঠে যে, আগের মত আর সহজাত ভাবে তার পুরোটা আয়ত্ব করা যায় না, নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলার প্রয়োজন হয়। আসে ব্যাকরণবিদ্যা। তবে, সবগুলো ক্ষেত্রে বিজয়ী গোষ্ঠীর ভাষাই ক্ষমতার ভাষা হয়নি, বহু ক্ষেত্রে শাসকরা শাসনের জন্য ভিন্ন কোন সুবিধাজনক ভাষাকেই বেছে নিয়েছে। যেমন মোঙ্গলরা মধ্য এশিয়া ও চীন উভয়টিই দখল করলে চেঙ্গিস খানের বংশধররাই তাদের প্রজাদের ধর্ম অনুযায়ী দুটি পৃথক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়। চীনে তারা যেমন চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে, মধ্য এশিয়াতে তারা গ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম ও প্রধানত ফার্সি ভাষা। আবার এই ফার্সি ভাষাও একটি বিশাল পর্ব জুড়ে তার চেয়ে কম ঐতিহ্য সম্পন্ন আরবি ভাষার ছায়াতলে থেকেও ক্রমশ ইসলামি আইন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বাহনে পরিণত হয়, তার পুনর্জাগরণ ঘটে। 

ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষার এই রাজনৈতিক অভ্যুদয় পর্বের সাথে আর্য আগমনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর নগরগুলোর পুরাতাত্ত্বিক অনুসন্ধাণে আর্যদের আগমনের আগেই নগর সভ্যতার অবক্ষয়ের সুস্পষ্ট ছাপ দেখা গিয়েছে। কিন্তু সকল বিচারেই বিজয়ী পশুপালক আর্যদের চেয়ে তারা সভ্যতায় বহুদূর অগ্রসর ছিল। আর্যদের আক্রমণে পতনোম্মুখ সিন্ধুসভ্যতার নগরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে প্রাচীন অধিবাসীরা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের নগরগুলোর দূরবর্তী কোন কোনটি হয়তো টিকে যায়। কালক্রমে আর্যরা নিজেরাও কৃষি ও নগর সভ্যতায় অভ্যস্ত হয়, তাদের অধীনস্ত অঞ্চলের সীমাও সিন্ধু ছাড়িয়ে ক্রমে মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতের সীমানা পর্যন্ত পৌছায়। এবার কিন্তু তারা নগর, কৃষি ও বাণিজ্যকেন্দ্রীক নতুন সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন ধর্ম রাতারাতি তৈরি না করে পুরনো জাতিগুলোর রীতিই বহুলাংশে গ্রহণ করে। জাতি হিসেবেও আর্যরা এ পর্বে নিজেরাই আর কেন্দ্রীভূত থাকেনি। এই পরবর্তী পর্বে স্তরে সমরবলে নতুন নগর ও এলাকা অধিকৃত করারও বাস্তবতা আর পুরোপুরি অক্ষুণ্ন থাকেনি। বরং আর্যদের এক ধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, সীমানাবর্তী বহু জাতি আর্য সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার কোন কোনটা গ্রহণ করে, নানান রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ ও বাস্তবতা থেকে আর্যরাও তাদের নিজ বলয়ে অঙ্গীকৃত করে নেয়। এভাবে ভারতবর্ষের ঐ পর্বে আমরা পাই আর্য সংস্কৃতির আধিপত্যযুক্ত অনেকগুলো আঞ্চলিক ভাষা, আর উচ্চতর প্রয়োজনে সাধারণ ভাষা হিসেবেসংস্কৃতকে। কিন্তু একটি পর্বে সংস্কৃতের বন্ধন অনেকটাই ছিন্ন হয়ে আসে, মধ্যযুগে তুর্কিদের এদেশে আসার আগেই আমরা দেখতে পাই সংস্কৃত কাব্যে প্রবল আঞ্চলিক ঝোঁক। সেই যুগের সংস্কৃত ভাষায় লেখা বহু কবির কবিতাকে মনে হয় বাঙলা ভাষারই হাতছানি।

একই মূল ভাষার উপভাষাগুলোর মাঝে এই প্রতিযোগিতাগুলো কিভাবে চলে তার একটি দৃষ্টান্ত আরবি, অন্যটি রুশ ভাষা। পুরাকালে আরব সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র ছিল আধুনিক ইয়েমেন। ইথিওপিয়া, রোম, ভারত ও পারস্যের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক রক্ষিত হতো এডেন বন্দর থেকে। কালক্রমে সমুদ্র বাণিজ্য ধ্বংসগ্রস্থ হলে তার সমৃদ্ধি ক্রমে কমে আসতে থাকে, অন্যদিকে পূর্বে অগম্য মরুপথে উটের ক্যারাভানে মাল সরবরাহ শুরু হয়। এবার কিন্তু মক্কা একটি প্রভাবশালী বাণিজ্য পথ হিসেবে আর্বিভূত হয়, কাবার গূরুত্বও বৃদ্ধি পায়। একই সাথে ইয়েমেনি ধর্মীয় তীর্থস্থানগুলোরও রমরমা কমে আসে। প্রাচীন পৃথিবীতে সবগুলো গূরুত্বপূর্ণ মেলা ও বাণিজ্যকেন্দ্রই ধর্মীয় দিক দিয়েও গূরুত্বপূর্ণ ছিল। ইয়েমেনের একটি মন্দিরের কথিত অবমাননার প্রতিশোধ নিতে আবরাহা বাদশার মক্কায় আগমনের ঘটনা এই বিরোধেরই জের। মক্কাবাসীদের কোন প্রতিরোধ না করে পলায়নও তাদের তখন পর্যন্ত তুলনামূলক হীনবল অবস্থাকেই প্রতিপাদিত করে। কিন্তু সমুদ্র বাণিজ্যের অধোগতি এক সময়ে ইয়েমেনের সকল যশকে অতীতে পরিণত করে, আরবি ভাষার পরবর্তী বিকাশের ইতিহাস যেমন ইসলাম ও তৎসংলগ্ন এলাকার আরবি বর্ণমালারই বিকাশের ইতিহাস।

কিন্তু শুধু আঞ্চলিক ভাষার প্রতিযোগিতার ইতিহাসেই নয়, বিশ্বইতিহাসেও ভাষার রাজনৈতিক অভ্যুদয়ের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক আরবি ভাষার বিকাশ। মুসলমানরা মিশর, সিরিয়া, পারস্য দখল করে তাদের ভূ-সাম্রাজ্য স্থাপনের সাথে সাথে এমন প্রজাদের মুখোমুখি হল যাদের রয়েছে অপেক্ষাকৃত পুরনো ও দৃঢ়তর ধর্ম-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য। একদিকে ধর্মীয় প্রশ্নে তাদের মোকাবেলা, অন্যদিকে উন্নতর প্রজাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করা শাসকদের জন্য একটি বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আরবি ভাষার গোটা একটি যুগকে তাই চিহ্নিত করা যায় তার দু'টি বৈশিষ্ট্য দিয়ে, একদিকে বিপুল পরিমাণ অনুবাদ কর্মের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর জ্ঞান-দর্শন নিজের ভাষায় নিয়ে আসা; অন্যদিকে সমান গুরুত্বের সাথে নিজেকে খোঁজা, সারা দেশে প্রচলিত শব্দভাণ্ডার, ব্যবহারবিধি খুটিয়ে খুটিয়ে বের করা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বিন্দুগুলোকে চিহ্নিত করা। ঐ সময়ের দামেস্ক কিংবা বাগদাদ (এই পর্বটিই বেশি সমৃদ্ধ, যদিও পুরাতন পর্বেই কাজটি শুরু হয়) নগরে একদিকে যেমন দেখা যাবে সারা পৃথিবীর জ্ঞানী-গুনীদের সমাবেশ, অনারব-আরব পণ্ডিতদের এক অভূতপূর্ব অনুবাদ-যজ্ঞ; একই সময়ে দলে দলে ছাত্ররা ছড়িয়ে পড়ছে বেদুঈন পল্লীতে, দিনের পর দিন তাদের মুখের শব্দমালা সংগ্রহ করে ফেরত আসছে শহরে। আরব ইতিহাসের গৌরবকাল বলতে আমরা যা বুঝি, তা আসলে এই পর্বের ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। 

ভাষার ইতিহাসে আর একটি চিত্তাকর্ষক বিবর্তন ঘটেছে রুশ ভাষার। এককালে বর্তমান ইউক্রেন এর রাজধানী কিয়েভ ছিল রুশ সংস্কৃতির কেন্দ্র। কিয়েভের প্রিন্স বাকি সকল শাসককে পর্যুদস্ত করে কেন্দ্রীয় শাসক বা জার হয়েছিলেন। মোঙ্গল আক্রমণে কিয়েভ বিপর্যস্ত হলে রুশ জাতি তাদের অধীনস্ত হয়। বহু পরে মস্কোর প্রিন্স মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, তাদের রুশভূমি ত্যাগ করতে হয়। এবার নতুন কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় মস্কো। কিয়েভ শিগ্গিরই তার অধীনস্ত হয়। এবার কিন্তু মস্কোতে ঘাঁটি গাড়া জার ইউক্রেনি ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করতে রীতিমতো নির্যাতনের আশ্রয় নেন। বিশাল এক ভূ-সাম্রাজ্যে পরিণত হয় রাশিয়া। ইউরোপের উত্তর ও পূর্ব অংশ মধ্য এশিয়ার অনেকগুলো জাতিকে অধীনস্ত করে নেয়। এহেন রুশ ভাষার পরবর্তী পরিণতি হয় অধীনস্ততা, কিছুটা পরেই আমরা সে আলোচনায় ফিরছি। 

রাজনৈতিক ক্ষমতার বাহন হিসেবে একটি ভাষার বিকাশের পরও বহু ক্ষেত্রেই আর একটি ঘটনা বহুবার আমরা দেখতে পাই। সেটা হলো কোন কারণে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ভাঙন ও দুর্বলতার সাথে সাথে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর বিকাশ এবং প্রায়শই সেই আঞ্চলিক শক্তিগুলোর নিজেদের ক্ষমতাকে দৃঢ় করার চেষ্টায় কথ্যভাষাগুলোকে গুরুত্ব প্রদান। এ ঘটনা মধ্যযুগে ইউরোপে পোপের কেন্দ্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে রাজাদের উত্থানে সবচেয়ে দৃষ্টিগ্রাহ্য। এ সময়েই সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি দরবার ও ধর্মীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে। রাজনৈতিক সংঘর্ষই ভাষাকেন্দ্রিক জাতিগুলোর বিকাশে এভাবে সহায়তা করেছে। এ ধারাতেই ইংরেজি, জার্মান, ফরাসিসহ আধুনিক ইউরোপীয় ভাষাগুলো ক্ষমতার কেন্দ্রে হাজির হয়েছে। 

তিন. উপনিবেশ পর্বে কিন্তু একেবারে নতুন ধরনের ঘটনা ঘটল। উপনিবেশের প্রযুক্তি আর উৎপাদন পদ্ধতির জেরে পরাধীন জাতিগুলো তাদের স্বস্থিতি হারাল। এর আগের যত ধরনের রাজ্যাধিকার আমরা দেখেছি, প্রতিটিতেই অধীনস্ত জাতির উৎপন্ন উদ্বৃত্ত হরণই (খাজনা আদায়) ছিল শোষণের মূল ধরন। এবার কিন্তু নতুনতর ধটনা ঘটল। এমনকি সনাতন অর্থে উপনিবেশ বা কলোনি বলতে নতুন নতুন এলাকায় বাড়তি জনগোষ্ঠীকে স্থাপিত করাই বোঝাত। কিন্তু সপ্তদশ-অষ্টদশ শতকের উপনিবেশন প্রক্রিয়া বলতে গেলে এক একটা অঞ্চলের মর্মমূলে আঘাত শুরু করে। পূর্ব এশিয়া, ভারত ও আফ্রিকার উপনিবেশগুলো থেকে তারা শুল্ক ও মুনাফা রূপে অধীনস্ত জাতির উৎপন্নের বৃহদাংশ সরাসরি পাচার শুরু করে। স্থানীয় জীবন ও জীবীকার সকল স্বাভাবিক পন্থাকে উচ্ছেদ করে; বস্ত্র-লবন-চিনিসহ প্রতিদ্বন্দ্বী সকল কুটির শিল্প ধ্বংস করে তারা নিজেদের মুনাফা নিশ্চিত করে। এ কথা ভাবা অন্যায় যে, ইউরোপীয় শিল্প সর্বদা গুণ, শ্রেষ্ঠত্ব ও সুলভ মূল্যের জোরে বাজার দখল করেছিল। বরং প্রতিকূল আইন (লবন উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, শ্রেষ্ঠ জমিগুলোকে নীল চাষে বাধ্য করা হয়েছিল) ও বিপুল হারে করের দায় (নিম্নমানের মিলের কাপড় বাজারে প্রচলনের জন্য স্থানীয় কাপড়ের ওপর বিপুল অঙ্কের কর বসান হয়েছিল, তাঁতশিল্প এমনভাবে বাঁধাপ্রাপ্ত হয়েছিল যে, তাঁতীদের নগর ঢাকার লোকসংখ্যা বিপুল হারে কমে গিয়েছিল উনিশ শতকের শুরুর অর্ধে) চাপিয়েই কেবল তারা এটা হাসিল করতে পেরেছিল। 

এখন আমাদের বিবেচনা করা দরকার, ভাষার অগ্রগণ্যতার প্রশ্নটি সর্বদাই ক্ষমতার প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত। এর পূর্বের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় ভাষাগুলো দরবারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাকে ছিন্ন বা গৌণ করে। কিন্তু উপনিবেশের আমলে অধীনস্ত দেশগুলোর গোটা উৎপাদন পদ্ধতিই উপনিবেশের সাথে এমন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে যে, অধিকাংশ সাবেক উপনিবেশে তার জের এমনকি রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের পরও কাটেনি। ভাষার প্রশ্নটা সেইখানে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। উপনিবেশের গোটা কালটা জুড়ে যে জাতিগুলো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল ক্রমশ, আর ওতপ্রোতভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাথে অধীনস্ততার সম্পর্কে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। 

মাতৃভাষার প্রশ্নে প্রায় একই রকম একটা অবস্থায় ইউরোপীয় ভাষাগুলোর মাঝে রুশদের অভিজ্ঞতাই সবচেয়ে সাম্প্রতিক। বিরাট ভূ-সাম্রাজ্য হয়েও অর্থনৈতিকভাবে তারা ছিলেন ফরাসি, জার্মান ও বৃটিশ পুঁজিপতিদের অধীনস্ত। এই অধিনস্ততাই ভাষার ক্ষেত্রেও অধীনস্ততা নিয়ে এসেছিল। মোটে এক শতাব্দী আগেকার রুশ উপন্যাসের চরিত্রেরা নিজেদের মাঝে ফরাসি ভাষায় কথা বলে আরাম পেতেন, সামরিক বাহিনীতে জার্মান ভাষার দাপট ছিল জার্মান যুদ্ধকৌশল আর প্রকৌশল বিভাগে তাদের পারঙ্গমতার জন্য। সমকালীন দার্শনিক আলোড়নগুলোর ভক্তদের অনেকেই পছন্দ করতেন ইংরেজি। দাস-দাসী আর নিম্নশ্রেণীর মানুষের সাথেই চলত কেবল রুশভাষা, অর্থাৎ স্বয়ং মাতৃভাষাটি। রুশ ভাষা কি মার্গীয় ভাব প্রকাশে সক্ষম? নিত্যদিনের প্রশ্ন ছিল এটি। 

এই ঘটনাটির একটি বড় পরিবর্তন আসে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের বাকি ইউরোপ ওলট-পালট করে রাশিয়া আক্রমণের ঘটনায়। অভিজাতদের একটা বড় অংশই বোনাপার্টকে সমর্থন করেছিলেন ইতোপূর্বে। কিন্তু এ সময়ে ফরাসিভাষী কিংবা ফরাসি উচ্চারণে রুশ বলা অভিজাতরা রাস্তা-ঘাটে নিগৃহীত হতে শুরু করলেন; আর শেষে রুশ অভিজাতরা বাধ্য হয়ে গৃহশিক্ষক রেখে রুশ ভাষা শেখা শুরু করলেন! রুশদেশে অভিজাতরা এরপরও বিদেশী ভাষায় ভাব প্রকাশ অব্যাহত রেখেছিলেন। কিন্তু রুশ জনগণের মাঝে এটা একটা অসাধারণ জাতীয়তাবাদী তাড়নার জন্ম দিল। রুশ চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, তরুণ ছাত্র নিজ ভূমি ও ভাষার সম্ভাবনা উদ্ঘাটনে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। এরই ফলাফল অষ্টাদশ ও ঊনিশ শতকের রুশ সাহিত্য ও বিপ্লবী তৎপরতা।আর এরই শেষ ফলাফল রুশ বিপ্লব। বিপ্লবের পর ভাষা কিন্তু ক্ষমতারও কেন্দ্র হয়ে উঠল, আর রুশ ভাষায় মৌলিক চিন্তার সীমা সমাজবিজ্ঞান ছাড়িয়ে বিজ্ঞানেও প্রভাব সৃষ্টি করল। 

চার. বহু দিক দিয়েই বাংলা ভাষার শঙ্কাটি রুশ ভাষার সাথে সমতুল্য। হারিয়ে যাওয়া প্রাণ খুঁজে পেল একটি জাতিগোষ্ঠী। এই নিজেকে হারিয়ে ফেলাকে সংক্ষেপে বর্ণনা করা যায় এভাবে: ক. তার গোটা উৎপন্ন আত্মপুষ্টি সাধনের জন্য আর নয়, বরং অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোর কাঁচামাল রফতানিকারক ও তাদের পাকামাল আমদানীকারক হিসেবে ভূমিকা পালনে ব্যবহৃত হল। খ. তার শিক্ষা-সংস্কৃতি-জীবন যাপনে সবকিছুতেই প্রভূদের বৈশিষ্ট্যসমূহ অধিকতর আকাঙ্খিত বলে গণ্য হল। গ. এমন একটি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র জন্ম নিল, যা এই উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা, তাকে পাহারা দেয়ার কাজটি করে এবং পাশাপাশি ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সেটাকেই ক্রমাগত পুনরুৎপাদন করে। 

এ সবগুলো নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন আলোচনা হতে পারে, কিন্তু আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় ভাষার প্রশ্নটি। ভাষার বিকাশ হয় ব্যবহারে। আজকে যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলা ভাষার বিকাশে কারা সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছেন? বাংলাদেশের উচ্চ আমলাতন্ত্র? বিচার বিভাগ? ধনিক-বনিক অংশটি? সংস্কৃতি জগতের পাণ্ডারা? প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ উত্তর হচ্ছে: না। এই যে আমরা বারংবার শুনি, ইংরেজি না শিখলে পিছিয়ে পরব, আমাদের বাস্তববাদী হতে হবে, শিল্প-সাহিত্যওয়ালারা বেশ লাজুক লাজুক মুখে বলেন, "আমি তো আসলে বাংলা মিডিয়মেই দিতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু ও বলে..., আসলে যে যুগ পড়েছে...। "একে শুধু হীনমন্যতা কিংবা সুবিধাবাদিতা দিয়েই ব্যাখ্যা করলে চলবে না, যদিও এগুলোও মূল প্রক্রিয়ারই স্বাভাবিক উপজাত। আসলে আমরা এমন একটা জাতির সদস্য, যাদের শাসকরা স্বজাতিভুক্ত হলেও স্বজাতির প্রতিনিধি নন। জনগণের স্বার্থের নয়, তারা প্রতিনিধিত্ব করেন নিজ জাতিকে যে সকল স্বার্থ হীনবল করে রেখেছে, তাদের সম্ভাবনাকে দাবিয়ে রেখেছে এবং তাদের সকল সম্পদকে কেবল নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী ব্যবহার করছে - সেই বহুজাতিক বেনিয়া পুঁজির। 

জাতির সম্ভাবনা বলতে কি বোঝায়? প্রথমত যে কোন জাতির ক্ষেত্রেই এটা সাধারণভাবে সত্য যে, একটি জাতীয়তাবাদী উত্থান তার জনগোষ্ঠীর উৎপাদন সম্ভাবনাকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে বিকশিত করে। সেখানে উৎপাদন সম্ভাবনাকে বাঁধাগ্রস্থ করে এমন সকল কিছুকে উৎখাত না করে সেটা ঘটতে পারে না। আজকের যুগে উৎপাদন সম্ভাবনাকে আটকে রাখে এমন শক্তির মাঝে থাকতে পারে ভূমিকেন্দ্রিক সামন্ত জমিদার কিংবা বিদেশি এমন স্বার্থ যা ঐ বিকাশকে রুদ্ধ করে ফায়দা লোটে। কিন্তু কোন ভাবে যদি এদের অবসান ঘটে, তাহলেই জাতির যে মুক্তি ঘটে, তা শুধু যে তার অর্থনৈতিক উৎপাদনই বৃদ্ধি ঘটায়, তা কিন্তু নয়। সেই জাতির শিল্প-সাহিত্য-কৃষ্টি, সর্বোপরি ভাষা ব্যবহারের সকল ক্ষেত্রে তা মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে, যেন পুরনো খোলসের ভেতরে নতুন এক প্রাণ জেগে ওঠে। এই জেগে ওঠা প্রাণ প্রথম যে দু'টি কাজটি করে, তা হল প্রথমত নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা, জনগণের সকল অংশের মাঝে তার প্রসার এবং বিকাশের ব্যবস্থা করা; দ্বিতীয়ত সারা বিশ্বের জ্ঞানজগতকে নিজেদের ভাষায় অনুদিত করে তাকে নিজের ভাষায় আত্মস্থ করা। পরভাষা আত্মস্থ করে জাতি হিসেবে আত্মঅবলম্বী হবার কোন নমুনা নেই, বরং প্রায় সকল মুক্ত জাতির ক্ষেত্রেই দেখা যাবে মাতৃভাষা সেখানে ভাবপ্রকাশের প্রধান অবলম্বন। 

সার্থক যে কোন কবিই একা কিন্তু তার সময়ের কাব্যভাবনা বা কাব্যআলোড়নকে প্রতিনিধিত্ব করেন না, তার পাঠক, তার সমালোচক, তার সতীর্থ কবিকুল(যাদের অনেকেই হয়তো প্রচলিত অর্থে সফল হননি), সর্বোপরি যে সমাজ থেকে তিনি রসদ আহরণ করেন, অর্থাৎ তার প্রতিবেশ-কোন কবিই এই সব শর্তের বাইরে নন। অর্থাৎ কোন সমাজের সাহিত্যচিন্তার অল্প ক'জন প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যক্তিরা বিচ্ছিন্ন কেউ নন, তাদের পেছনে এবং পাশে যারা আছেন, তারাও ওই ইতিহাসের অনিবার্য ও অপরিহার্য অংশ। সমাজে, বিজ্ঞান এবং দর্শন চর্চার ক্ষেত্রেও একই কথা কিন্তু সমানভাবে প্রযোজ্য। একজন নিউটন, আইনস্টাইন কিংবা সত্যেন বোস এর পেছনে কাজ করে গোটা সমাজের আলোড়ন, কোন বিশেষ সমস্যা নিয়ে বহু মানুষের লিপ্ততা। এভাবেই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত বহু মেধা সচেতন বা অসচেতনভাবে একটা জটিল সামাজিক-গাণিতিক যন্ত্রের মতো সমষ্টিগতভাবে ক্রিয়াশীল থাকে, অবশেষে গুটি কতেক হয়তো ঐ সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধানগুলো হাজির করেন। এটি কিন্তু সমাজবিদ্যা, অর্থনীতিবিদ্যাসহ বিদ্যার আর সব মানবিক বিষয়ের জন্যও সাধারণ ভাবে প্রযোজ্য। অর্থনীতির প্রাতিষ্ঠানিক মহলের বাইরেও আরও বহু মানুষ যখন এ বিষয়ে সন্ধানী হন এমনকি প্রায় সবগুলো ধর্মের ইতিহাসেও দেখা যাবে, কাছাকাছি সময়ে সাদৃশ্যমূলক (কোন কোন ক্ষেত্রে অস্তিত্বের সংঘাতে লিপ্ত, কিন্তু একই ধরনের সামাজিক সংকট থেকেই উদ্ভুত) প্রচারকের উপস্থিতি। সার কথা এই, সমস্যাটি যাই হোক না কেন, যথাসম্ভব বেশি মানুষের তার সাথে যুক্ততার সুযোগ থাকা চাই। এই যুক্ততার ক্ষেত্রেই মাতৃভাষা প্রধানতম মাধ্যম। 

এই যুক্তির বিপক্ষে একেবারেই প্রথমে যে প্রশ্নটি আসবে সেটি হলো: যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশের এই যুগে সমসমস্যা নিয়ে ভাবিত লোকগুলোকে আমার চায়ের আড্ডার প্রতিবেশী হতেই হবে, তার কী কারণ? প্রথম আলোতেই তো নিত্য নিত্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংবাদ পাচ্ছি, তাদের অনেকেই এমনকি ভালো বাংলাও বলতে পারেন না! বিষয়টি ঐখানেই। পরভাষা আয়ত্ত করে ব্যক্তিগত সাফল্য কেউ পেতেই পারেন, কিন্তু এর সাথে নিজ সমাজের বিকাশের প্রায়শই কোন যুক্ততা থাকে না, বহু ক্ষেত্রেই ঐ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বরং জাতীয় বিকাশের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। কীভাবে? প্রথমত সমস্যায় যে নির্দিষ্ট মানুষেরা আক্রান্ত, তারা যখন সমাধানের যোগ্য হয়ে ওঠেন, সেটিই একমাত্র ন্যায্য সমাধানের সম্ভাবনা। কিন্তু নিজ জনগোষ্ঠীর সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত নন, এমন একজন পণ্ডিত হয় অনিচ্ছাকৃত ভুল করবেন, নয়তো নিজের আখের গোছাবেন। যেটিই ঘটুক না কেন, চাপিয়ে দেয়া সমাধানটি নিত্য নতুন সমস্যারই জন্ম দিতে থাকবে, আর ফলস্বরূপ চাপিয়ে দেয়া বোঝার পরিমানও বাড়বে ক্রমশই। এরই একটা ধ্রুপদী উদাহরণ হলো আমাদের দেশের নদী-শাসন প্রকল্পগুলো। প্রথম পর্যায়ে বিদেশি লগ্নিকারী আর তাদের দেশি-বিদেশি পরিকল্পকরা নানা রকম অবকাঠামো নির্মাণ করে নদীর স্বাভাবিকত্ব ধ্বংস করলো। বিনিময়ে লগ্নিকারী তার লগ্নির মুনাফা তুলে নিল, পরিকল্পকরা পেলো রাজকীয় ইনাম, জনগণের ভাগ্যে জুটলো উত্তরোত্তর দারিদ্র। দ্বিতীয় পর্যায়ে তারা সেই অস্বাভাবিক প্রকৃতিতে কী করে বেঁচে থাকতে হবে তার জন্য নতুনতর প্রকল্প নিয়ে হাজির হলো: মাটি লবনাক্ত হয়ে গেছে? জৈব প্রযুক্তির বীজ কেনো। সুপেয় পানির অভাব? পানির উৎস ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দাও। জলাশষ কমে গেছে? হাইব্রিড মাছ চাষ কর। কেনো ভ্যাকসিন, সার, কীটনাশক, বীজ। দিন শেষে আবারও চাষার শূণ্য থলি। মাঝখান দিয়ে লোপাট হয়েছে মাছ ধরার নদী-খাল, উপকারী সব কীটপতঙ্গ আর পাখি, গোচারণভূমি। প্রকৃতিকে নিজের কাজে লাগানোর বিরোধী কোন বিবেচক মানুষই নন, কিন্তু এই পুরো সমাধানের প্রক্রিয়াতে যদি এদেশের মানুষের অভিজ্ঞতা, তাদের স্বার্থ আর আকাঙ্খার প্রতিনিধিত্ব থাকত, পুরো বিষয়টিই নিশ্চয়ই অন্য রকম হতো। 

আরেকটা উদাহরণ দেই, এটা আরো মজার। আমরা কি জানি, শুধু গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিদিন কত টাকা মুনাফা বাবদ নরওয়েতে পাঠায়? কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত উদ্যোক্তাকে প্রথম আলো পরিচয় করিয়ে দিয়েছে গ্রামীণ ফোনের পরিকল্পক হিসেবে। তিনি আসলেই প্রতিভাবান, স্বীকার করতেই হবে। তিনি নরওয়ের টেলেনর আর বাংলাদেশের গ্রামীন ব্যাংককে নিশ্চিত করতে সক্ষম হন যে, বাংলাদেশের লোকেরা গরিব হলেও এখানে মোবাইলের বিশাল সম্ভাবনাময় বাজার আছে। লাগ্ ভেলকি লাগ। শুধু এই পরিকল্পনা রূপায়নের কাজটি করে তিনি পেলেন বেশ বড় একটা ভাগ, শেয়ার। টেলেনর পেল বিশাল এক মাছ, যেটাকে নিজের তেলে ভাজা যায়। প্রাথমিক সামান্য বিনোগের বিশাল মুনাফা পুনর্বিনিয়োগ করে গোটা দেশ তাদের যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতায়। গ্রামীণ পেল আরেকটা গৌণ শেয়ার। খুব দ্রুতই আমাদের প্রতিভাবান বাঙালি তার শেয়ারটুকুও টেলেনর-এর কাছে বেঁচে দিলেন। তার ভাষাকে আমরা আমাদের মতো পাঠ করতে পারলে দাঁড়াবে: তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই থাকেন, এ রকম মওকা মাফিক দাঁও মারতেই কেবল মাঝে মাঝে দেশে আসেন। পুরো বিষয়টিকেই কয়েকটা (হতে পারতো এমন) সম্ভাবনা দিয়ে বিচার করা যেতে পারে। বাংলাদেশে টিএন্ডটি বোর্ড বহু সমালোচনার পর নিজেই এখন মোবাইল সেবা দিচ্ছে। লাভের পরিমান উঁচু, এবং নিন্দুকেরা বলেন অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর উপঢৌকনের বিনিময়েই তার কথাবলার খরচ কমানো যাচ্ছে না। আমাদের প্রথম আলোর নায়ক কিন্তু একেবারে শুরুতেই টিএন্ডটি কে রাজি করতে পারতেন এই বাজারটি ধরার জন্য। তিনি সে চেষ্টা করেন নি। হয়তো তিনি সে চেষ্টা করেননি, কেননা তিনি হয়তো মনে করেন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ভাল সেবা পাওয়া যায় না, কিংবা তারা আদৌ রাজি হতো না। কিন্তু, আমরা ভেবে অবাক হতে পারি গ্রামীণ কেন নিজেরাই এই উদ্যোগটি নেয়নি? সে ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্টস কর্মীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে আয় করা বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার শুধু মোবাইল কোম্পানিগুলোর মারফতই নিমেশেই বিদেশে পাচার হয়ে যেত না। প্রতিদিন মধ্যপ্রাচ্যে, মালয়েশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে অমানুষিক পরিশ্রম করে, গোপনের সীমানা অতিক্রমের সময়ে ডুবে মরার কিংবা গুলিতে প্রাণ হারাবার ঝুঁকি মাথায় করে, বিদেশ-বিভূইয়ে নিত্য পুলিশের চোখ এড়িয়ে, ঘুষ দিয়ে, অবমাননাকর জীবন যাপন করে বৈধ কিংবা অবৈধ প্রবাসী শ্রমিকরাই এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় বৈদেশিক মুদ্রার উৎস, তারপরই গার্মেন্ট শ্রমিকরা। আর তাদের এই রক্ত পানি করা বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ আবারও বিদেশে চলে যায় শুধুমাত্র মোবাইল কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাবদ।

খেয়াল করা দরকার, বর্তমান বাস্তবতায় প্রতিদিন কোটি শিশুর শিক্ষাজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইংরেজি মুখস্থ করায় ব্যয় হচ্ছে, যা তার গণিত, সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞান ও ইতিহাস অধ্যয়নে ব্যয়িত হলে শিক্ষার গুণগত মান বহু গুণ বৃদ্ধি পেত। ইংরেজিভাষী কারও সাথে হয়তো জীবনভর সাক্ষাতের কোন প্রয়োজন এই কোটি শিক্ষার্থীদের ঘটবে না। অর্থাৎ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিক দিয়ে বিবেচনায় এই বারো বছরের ইংরেজি শিক্ষা প্রায় বিফলেই যায়। অথচ উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে বহু ছাত্রই বছর খানেকের ভেতর কোনদিন চর্চা না করা জার্মান, জাপানি বা চীনা ভাষা রপ্ত করে ফেলে। এমনকি উচ্চশিক্ষার স্তরে যারা আসেন, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় একদিকে ইংরেজি খুব খারাপ জানার কারণে যারা মৌলিক গ্রন্থ অধ্যয়নে ব্যর্থ হন, অন্যদিকে বাঙলায় ভাল পাঠ্যবই না থাকার কারণে চোথা মুখস্ত করেন। অথচ ঐ গ্রন্থগুলোর মানসম্মত অনুবাদ থাকলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ সংকট একেবারেই ঘুচে যেত। 

ঐ যে উপরে উল্লেখ করা হলো আমাদের শাসন করছে এমন একটা শাসক শ্রেণী, যারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে না, তারই একটা ফল হলো ইংরেজি ভাষাজ্ঞানকেও তারা তাদের আধিপত্য অব্যাহত রাখার একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মানসম্মত বিদেশি ভাষায় শিক্ষা দেয়া কখনোই সম্ভব না, কিন্তু তাদের নিজেদের সন্তানদের পূর্ণ পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত করার সামর্থ্য তো তাদের ভালোই আছে। মধ্যবিত্তের অন্যান্য অংশও তাই এই দৌঁড়ে সামিল হয়ে সাধ্যমত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানদের পড়াচ্ছে। নিম্নবিত্তদের জন্যও চালু হয়েছে ভেজাল, মানহীন ইংরেজি স্কুল। এদের মধ্যে গুটিকয়েক হয়তো শাসকশ্রেণীর বলয়ে স্থান পাচ্ছে, অধিকাংশই না শিখছে বাংলা, না ইংরেজি। আর বাংলামাধ্যম স্কুলগুলো প্রায় পরিত্যক্ত হচ্ছে দিনকে দিন। এ থেকে যা বোঝা যায়, তা হলো ইংরেজি এখানে সমাজে শ্রেণী আধিপত্যেরই প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। যদি আমরা বৈশ্বিক জ্ঞানের জগতের কথা ভাবি, ইংরেজি ভাষা শিক্ষাই কিন্তু যথেষ্ট নয়, দর্শন-বিজ্ঞান-চিকিৎসা শাস্ত্র-সাহিত্য ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ সব প্রকাশনা প্রতিবছর হয়। কিন্তু সেগুলোর সাথে পরিচিত হবার উপায় কি শুধু ইংরেজি ভাষা? 

আসলে আমরা যদি একটা আদর্শ অবস্থার কথা কল্পনা করি, তাহলে এই অনুবাদ কর্মের জন্যই প্রয়োজন বিশেষায়িত শিক্ষা এবং গুরুত্বপূর্ণ রচনা হচ্ছে, এমন প্রতিটি ভাষায় দখল সম্পন্ন জনশক্তি। আর সেটার জন্যও শিশুকাল থেকে বাধ্যতামূলক পাঠের প্রয়োজন নেই, উচ্চাশিক্ষার স্তরে তা পাঠই যথেষ্ট। 

আরেকটি প্রসঙ্গ তোলা যাক, সেটা হলো ইউরোপীয় অধিকাংশ দেশেই কখনো প্রয়োজন না হলেও ছাত্রদের অন্য যে কোন একটি ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ভাষাগত সাদৃশ্যের কারণেই সেটা অস্বাভাবিক ঠেকে না। কোন দিন যদি এমন ঘটে যে, বাংলাদেশ তেমন একটি মুক্তি অর্জন করে, যে মুক্তি তার জনগণের জীবনের বিচিত্রতর সমৃদ্ধির দরজা খুলে দেবে, এবং এটা ঘটে আসে পাশের সবগুলো জাতির ক্ষেত্রে, যদি আমাদের তেমন কোন মুক্তি ঘটে যে পশ্চিমা সভ্যতার সাথে আমাদের কোন হীনতার সম্পর্ক নেই এটা কিন্তু ভাবার কারণ নেই যে শিক্ষার্থীরা দলে দলে আর ইউরোপীয় জ্ঞান শিখতে যাবে, সেই ভাবিকালের ছাত্রেরা হয়তো অহমীয়া বা উড়িয়া ভাষা মন দিয়ে পড়বে, বোঝার চেষ্টা করবে কিভাবে এই ভাষাবোনেরা বিকশিত হলো; তারা হয়তো ফার্সি আর সংস্কৃত পড়বে, আমাদের সাহিত্য আর ইতিহাসের বহু গোপন রহস্য উদঘাটনের আশায়; তারা হয়তো তামিল সাহিত্য পাঠ করে আমাদের আরো ভালভাবে জানাবে আমাদের ভক্তি আন্দোলনে তাদের প্রভাব কি; আর এই জ্ঞানই আমাদের আরাধ্য হবে রাজা রিচার্ডের জীবনীর খুঁটিনাটি জানা কারও কাছে সে হীনবোধ করবে না। 

আসলেই আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের কত কম জানি! কিন্তু আমাদের নদীগুলো অভিন্ন, পরিবেশ আর প্রকৃতি সাদৃশ্যপূর্ণ, আমাদের ইতিহাস কত কাছাকাছি। আমরা এখন আলাদা আলাদা হয়ে তৃতীয় এক পক্ষের অধীনস্ত, কাজেই পরস্পরের প্রতি বহু ক্ষেত্রে শত্রুভাবাপন্নও। কিন্তু মুক্তভাবে আমরা হতে পারি একে অপরের নিকটজন। আমাদের সকলের বিকাশই তাতে বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে। 

প্রশ্নটা তাই শুধু অগ্রাধিকার এর নয়: পাশাপাশি শেখারও নয়। প্রশ্নটা নিজের অর্থনীতি, নিজের জীবন, নিজের সংস্কৃতির ওপর কতৃত্ব ফিরে পাওয়ার, তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া কী আমরা শিখতে চাই, কী শেখা আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের যুগ অনৈতিহাসিক হয়ে গিয়েছে, আধিপত্যমূলক বিকাশের যুগ আমরা পাড়ি দিচ্ছি, যে যুগটি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি উভয়টির সম্ভাবনাই ধ্বংস করে টিকে রয়েছে। নিপীড়িত ও অমুক্ত একটি ভাষা কি আজ আর নতুন করে আধিপত্য সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে বিকশিত হতে পারবে? না। কেননা, আজ আর দুনিয়া দখলের লক্ষ্য নিয়ে নতুন কোন জাতি ইতিহাসে উত্থিত হতে পারছে না। বরং আজকে পৃথিবীর সকল দমিত ভাষার সংগ্রাম আধিপত্য অবসানের সংগ্রামের সাথেই একসূত্রে গাঁথা। 

কাজেই বাঙলা ভাষার আজকের লড়াই নিজেকে মুক্ত করা এবং অন্যদের মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হওয়া। বাঙলার একমাত্র আশা এটিই। ভাষার স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের যুগ অতিক্রান্ত, আধিপত্যের যুগটির অবসান একমাত্র সর্বভাষার সাম্য এবং মৈত্রীর মধ্যেই সম্ভবপর।

________________________________________________

অনুন্নতবিশ্বে বিজ্ঞান শিক্ষার অন্তরায় 
হরিধন দাস


অনুন্নতবিশ্বঃ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেঃ দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে অনুন্নত বিশ্বের সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। সম্ভবত শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চায় অনগ্রসর দেশগুলোকে অনুন্নত বিশ্ব বলা যায়। বিংশ শতাব্দীতেও অনুন্নত বিশ্ব এই কলঙ্ক বহন করছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ। উন্নত বিশ্বের তুলনায় এদেশগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা ও সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় এসব দেশই যুগেযুগে বিশ্বকে উপহার দিয়েছে ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানের অভিনব অধ্যায়সমূহ। বিশ্বের সকল ধর্মের উৎপত্তি ও প্রসার এ সকল দেশ থেকেই ঘটে। বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার লীলাভূমি যেমন মিশরীয়, ভারতীয়, ব্যবিলনীয় ও চৈনিক সভ্যতা এ অঞ্চলেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। আজকের উন্নত বিশ্বের অসাধারণ উন্নতির মূলে যে কারণগুলো জানা যায় তার অন্যতম ছিল প্রাচ্য দর্শন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসাবিদ্যার অবদান। স্পেনের মধ্যদিয়ে প্রাচ্য বণিকদের সাহায্যে জ্ঞানের এ প্রবাহ ইউরোপে প্রসারিত হয়। কালক্রমে যে সকল দেশে শিক্ষা ও সভ্যতার প্রদীপ দেদীপ্যমান ছিল, ইতিহাসের বিবর্তনে সে দেশগুলোই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় এবং যে সকল দেশ জুলিয়াস সিজারের ভাষায় অসভ্য বর্বরের দেশ, সে সকল দেশই বিংশ শতাব্দীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। 

মানব সভ্যতার ইতিহাসকে তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম অধ্যায় হল যুক্তিহীন বিশ্বাসের যুগ, দ্বিতীয় অধ্যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষাহীন দর্শনের যুগ, এবং তৃতীয় অধ্যায় হল বিজ্ঞানের যুগ। উন্নত বিশ্ব বিজ্ঞানের যুগে প্রবেশ করেছে কয়েক শতক আগে। প্রাচীন গ্রীসেই ইউরোপের বিজ্ঞান চর্চার সূত্রপাত ঘটে। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল, সক্রেটিস ও প্লেটোর মুক্ত চিন্তার পথধরে জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্মেষ ঘটে। কিন্তু এরিস্টটলের পরীক্ষা-নিরীক্ষাহীন দর্শন বিজ্ঞানকে বেশিদূর এগুতে দেয়নি। গ্রীক-রোমান যুগের পর ইউরোপে বিস্তার লাভ করে নিউ টেস্টামেন্ট ইউরোপে মুক্তচিন্তার দ্বার রুদ্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থা চলে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত। দ্বাদশ শতাব্দীতে মধ্যপ্রাচ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত ছিল। ওমর খৈয়াম, খারিজমী, আল হাজেন, ইবনে সিনা প্রমুখ বিজ্ঞানীর সাধনায় বিজ্ঞান এক বিশেষ স্তরে পৌঁছে। এসময় মধ্যপ্রাচ্যের সাথে স্পেনের মাধ্যমে ইউরোপের যোগাযোগ হয়। এ পথেই ভারতীয় গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা মধ্যপ্রাচ্যের বীজগণিত ও চিকিৎসা বিজ্ঞান ইউরোপে বিস্তৃত হয়। মূলত প্রাচ্যের প্রভাবে নতুন করে ইউরোপে বিশেষত ইটালিতে শিল্প ও বিজ্ঞান চর্চা আরম্ভ হয়। ধর্মীয় বাঁধার জন্য, প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে শিল্পী ও বিজ্ঞানীদের কাজ করতে হয় গোপনে। এভাবেই আবির্ভাব ঘটে কোপার্নিকাস এবং গ্যালিলিওর। এরা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রচার করেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে। কিন্তু ইউরোপের সমাজ তখন টলেমির পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বের ধারণায় বিশ্বাসী। এই ধারণার সমর্থনে ছিল এরিস্টটলের দর্শন এবং বাইবেলের শিক্ষা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই সময় ছিল এক যুগসন্ধিক্ষণ। গ্যালিলিও কে ফাঁসির আসামি করে চাপের মুখে গির্জায় নিয়ে তার মতবাদ ত্যাগ করতে বলা হয়। কিন্তু যুক্তিহীন বিশ্বাসের বিপরীতে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। বাঁধার প্রাচীর ভেঙ্গে বিজ্ঞানের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ইউরোপে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আবিভূর্ত হন অসংখ্য কবি, দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। আবির্ভূত হন শেক্সপিয়ার, নিউটন, ডারউইন, গ্যাটে, কার্ল মার্ক্স, ফ্যারাডে, ম্যাক্স প্লাঙ্ক, স্রডিঞ্জার এবং আইনস্টাইন। এই ধারাবাহিকতাই ইউরোপের পুনর্জাগরণ। এই পুনর্জাগরণই বিশ্বকে উপহার দিয়েছে আধুনিক সভ্যতা। অপরদিকে, বিভিন্ন কারণে প্রাচ্যের জ্ঞানবিজ্ঞান ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। ইউরোপ যখন পুনর্জাগরণের জোয়ারে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আজকের অনুন্নত বিশ্বের কি অবস্থা দেখা যাক। 

প্রথম এলিজাবেথের রাজত্বকাল ছিল ১৫৬৩-১৬০৩। এই সময়কে বৃটেনের স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই সময়ে আবির্ভূত হন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার। নিউটনের যুগ ছিল ১৬৪৩-১৭২৭। মাইকেল ফ্যারাডের সময়কাল ১৭৯১-১৮৬৭। প্রথম প্রলিজাবেথের রাজত্বকালে হুমায়ূন দিল্লীর মুঘল সম্রাট ছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ। ভারতে তখন ভোগ বিলাসের উন্নয়ন চলছে। কিন্তু যুগযুগ ধরে ইউরোপের সাথে প্রাচ্যের যোগাযোগ ছিল। প্রাচ্যের সভ্যতা শুধু দানই করে গেছে, বাইরে থেকে কিছু গ্রহণ করতে শিখেনি। তাই আমরা দেখতে পাই মুঘল রাজপ্রাসাদে ইউরোপীয় চিকিৎসক পর্দার অন্তরালে রোগিনীকে দেখে চিকিৎসা করেন কিন্তু কোন মুঘল চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার জন্য ইউরোপে যায়নি। সুদূর ভিয়েনা থেকে পর্যটক মার্কোপোলো এশিয়ার জ্ঞানবিজ্ঞান অন্বেষণ করতে আসেন কোন এশীয় তা করেনি। এই আলোকে অনুন্নত বিশ্বের বিজ্ঞান শিক্ষার অন্তরায় গুলো আলোকপাত করা যাক। 

প্রাচ্যের সামাজিক বিবর্তনঃ প্রাচ্যের সমাজ পূর্বে উল্লেখিত যুক্তিহীন বিশ্বাস ও পরীক্ষা নিরীক্ষাহীন দর্শনের গন্ডিকে অতিক্রম করতে পারেনি। চিন্তার জগতে এখানে কোন সর্বাত্মক বিপ্লব হয়নি। যেমন হয়েছে ইউরোপে যুগে যুগে ফরাসি বিপ্লব এবং সোভিয়ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। ফলে ইউরোপ আমেরিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠত হয়েছে। প্রাচ্যে তা হয়নি। তাই অনুন্নত বিশ্বে পাশাপাশি অবস্থান করছে সুপ্রাচীন যুক্তিহীন বিশ্বাস, পরীক্ষা নিরীক্ষাহীন দর্শন এবং এখানে সেখানে আধুনিক জীবন দর্শন। যে ভারতে একদিকে সুপার কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্মেষ ঘটছে, সে ভারতেই অস্পৃশ্যতা সতীদাহ প্রথাও বর্তমান থাকছে। একদিকে আছে সি. ভি. রমন, অধ্যাপক সালাম ও চন্দ্র শেখরের মতো নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী অন্যদিকে আছে মধ্যযুগীয় মানসিকতা। 

অনুন্নত বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাঃ যুগযুগ ধরে এ দেশগুলোতে সুস্থিত রাজনৈতিক অবস্থা অনুপস্থিত ছিল, সাথে ছিল বৈদেশিক আক্রমণ ও পরাধীনতা। এশিয়াতে জাপান বিদেশি শাসনের শিকার হয়নি কিন্তু ইউরোপীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে যোগাযোগ রাখে। জাপানের অসাধারণ উন্নতির মূলে এটি অন্যতম কারণ। 

শিক্ষা ব্যবস্থার বিবর্তনের ধারাঃ অনুন্নত বিশ্বে যৎকিঞ্চিৎ শিক্ষার প্রচলন ছিল রাজা, জমিদার ও ধর্মীয় প্রয়োজনে। টোল ও মক্তবের শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল ধর্মগ্রন্ধ মুখস্থ করা এবং হাটবাজারের হিসাবের জন্য করাকিয়া ও গন্ডাকিয়া। ভারতে বৃটিশ আমলে বৃটিশের কেরানি তৈরীর জন্য অতি অল্প সংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। জমিদার ও ইংরেজ আমলার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় অতি নগন্য সংখ্যক কলেজ। তখন শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল উকিল মোক্তার অথবা ব্যারিস্টার হওয়া। এই প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও অনেক বিজ্ঞানী, কবি ও দার্শনিকের আবির্ভাব হয়। কিন্তু জনগনের মধ্যে তাদের প্রভাব বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন প্রায় সকল দেশ স্বাধীন হয় তখনও শিক্ষা ব্যবস্থা একই অবস্থায় থেকে যায়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষার উদ্দেশ্যই হচ্ছে সংকীর্ণ ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা। তাই আজ বিজ্ঞান শিক্ষার চরম লক্ষ্য হয়ে দাড়িয়েছে চিকিৎসক ও প্রকৌশলী হওয়া। যাদের লক্ষ্য বিদেশে পাড়ি জমানো। যাদের ভাগ্যে তা হয়নি, তারা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান সার্টিফিকেট নিয়ে চেষ্টা করেন আমলা অথবা রাজনীতিবিদ হতে। দুইটিই Brain Drain। একটি বিদেশে, অপরটি স্বদেশে। বর্তমান প্রচলিত শিক্ষা জনগন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিস্বার্থের সহায়ক। 

বর্তমান শিক্ষার উদ্দেশ্যঃ শিক্ষা সামাজিক বিবর্তনের হাতিয়ার। শুধুমাত্র সঠিক বিজ্ঞান শিক্ষাই পারে জনগোষ্ঠীর দারিদ্র দূর করে সমৃদ্ধশালী সমাজ গড়ে তুলতে। বর্তমান শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নীতি (ethics) সুস্পষ্ট নয়। বিজ্ঞান শিক্ষা অনেকটা ধর্মের বাণী মুখস্ত করার মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেখা যায়, পাঠ্য তালিকায় বৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারনার সমান্তরালে অবৈজ্ঞানিক ধ্যান ধারনাও পাঠ্যসূচীতে স্থান পেয়েছে। শিশুকাল থেকেই শিশুদেরকে মুক্ত চিন্তার অধিকারী না করে তার চিন্তাকে স্থবির করার উপাদান দেয়া হচ্ছে। ফলে বিজ্ঞান তার অন্তরে ও জীবনে কোন ছাপ ফেলতে পারছেনা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীও অতিসহজে তাবিজ ও পীর দরবেশের শরণাপন্ন হতে দ্বিধা করেনা। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থাঃ সকল শিক্ষার মতোই Science education begins at Home. সত্যিকার অর্থেই বিজ্ঞানের সকল মৌলিক নিদর্শন প্রতি ঘরে ঘরেই বর্তমান। কিন্তু তাদের সাথে শিক্ষার্থীর সংযোগ ঘটিয়ে দেয়ার মাধ্যম নেই। আমাদের মা অশিক্ষিত। শিক্ষিত এমন কি বিজ্ঞানে শিক্ষিত মায়ের মনেও বিজ্ঞানের প্রভাব নেই। রাষ্ট্রীয় রেডিও, টেলিভিশন অনুৎপাদনশীল যত প্রোগ্রাম করে তার নগণ্য অংশও মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষায় করেনা। আগের টোল, মক্তবের মতোই বর্তমান স্কুল গুলোর অবস্থা। স্কুল গুলোতে উপকরণের ও প্রচেষ্টার অভাবের জন্য হাতের আংগুলে দিয়েই টেস্টটিউবের কাজ দেখানো হয়। অধিকাংশ স্কুলেই উপযুক্ত বিজ্ঞান শিক্ষক নেই, অন্যদিকে হাজার হাজার উচ্চ শিক্ষিত যুবক বেকার অথবা Brain Drain এর শিকার। উন্নত বিশ্বে যেখানে প্রতি দশ লক্ষ লোকের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়, অনুন্নত দেশগুলোতে সেখানে গড়ে দুই কোটি লোকের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়। সে বিশ্ববিদ্যালয়ও আবার ক্ষমতার রাজনীতির হাতিয়ার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে জন সাধারণ বিশেষত শিল্প কারখানার সম্পর্ক নেই কর্মজীবি মানুষের সাথে বিজ্ঞান ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্ক স্থাপিত হলে একে অপরের পরিপূরক হতে পারে। উন্নত বিশ্বের শিক্ষা প্রসারের অন্যতম কারণ এটি। 

বিজ্ঞান শিক্ষা ও পত্র পত্রিকাঃ বিজ্ঞানকে জনগণের নিকটে পৌঁছে দেয়া এবং বিজ্ঞান মানসিকতা সৃষ্টির জন্য দরকার গবেষণা পুস্তক, বিজ্ঞান ম্যাগাজিন। বাস্তবে, বিজ্ঞান শিক্ষা পাঠপুস্তকের সীমায় আবদ্ধ। উন্নত বিশ্বে যেখানে অসংখ্য সমৃদ্ধ পত্র পত্রিকা নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, অনুন্নত বিশ্বে তা আসেনা। যদিও প্রকাশ্য ও চোরাই পথে কোটি কোটি টাকার বিদেশি সিগারেট, মদ ও নেশা জাতীয় বস্তু এবং অপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য এদেশে আসে কিন্তু বিজ্ঞান ম্যাগাজিন আনার ব্যাপারে কোন প্রচেষ্টা নেই। 

বিজ্ঞান ও মানসিকতাঃ অনুন্নত বিশ্বের তেল সমৃদ্ধ দেশগুলো বিজ্ঞানের ফসলকে ভোগ করছে কিন্তু তাদের মানসিকতা রয়ে গেছে মধ্যযুগীয় অবস্থাতেই। অপর দিকে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জীবন দর্শন ''লোকে বলে, বলেরে ঘর বাড়ি ভালানা আমার। কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যের মাঝার।" একদিকে অতিমাত্রায় ভোগ বিলাস অপরদিকে নিবেদিত বাউল মানসিকতা দুটোই বিজ্ঞান চর্চার অন্তরায়। বিজ্ঞান চর্চার পরিধি বাড়াতে হলে বিজ্ঞানকে জীবন দর্শন হিসাবে নিতে হবে। পরিশেষে আইনস্টাইনের উক্তিটি স্মরণ করা যায়...

"Science research can reduce superstitions by encouraging people to think & survey things in terms of cause & effect."

(গত সংখ্যায় আমরা প্রয়াত অধ্যাপক হরিধন দাস সম্পর্কে লিখে ছিলাম। মানুষ হিসেবে হরিধন দাসের মূল্যায়ণের মাপকাঠি আমাদের জানা নাই। এ মানুষটির প্রয়ানে আমরা হারিয়েছি অপরিমেয় কিছু। দীর্ঘকাল অগোচরে থেকে যাওয়া প্রবন্ধটি অধ্যাপক শেখর রঞ্জন সাহার সৌজন্যে পাওয়া। প্রবন্ধটি নব্বই দশকের শুরুতে কুমিল্লা মহিলা কলেজ মিলনায়তনে 'সংস্কৃতি পরিষদ' কর্তৃক আয়োজিত সেমিনারে পাঠ করা হয়।)

________________________________________________

প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলার প্রকৃতি: তৎপরতা, অপতৎপরতা 
গোঁসাই পাহলভী 
(পূর্ব প্রকাশিতের পর) 

চার. 'একটা কিছু বুঝতে চাই' আর 'একটা কিছু বোঝাতে চাই' এই সহজ সমীকরণ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলায় নাম লিখিয়ে শিল্পী হওয়াটা মনে হয় তামাটে। অনেক ভঙ্গি এর পেছনে তৎপর। তৎপর হয়ে আছে শেকড়চ্যুত ভাসমান শিক্ষার অনেক বিকৃত বাসনার। 

পাঁচ. যুগ বিভাজন যে দ্বার উন্মেচন করে তার কতটুকু ভারতীয় জনগণ পার হোতে পেরেছে? ঘটনাটা জাদুবিদ্যার মতো। হাতের কাছে যাদের (পূর্বে তৈরী) পেলেন তাদের সামনে একটি দরজা বানিয়ে বলা হলো এটা সেই বস্তু যার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করলে তোমরা নতুন জগতে প্রবেশ করতে পারো। ভারতীয় শিক্ষিত জনগণের জন্য ওটা ছিল মোক্ষম প্রস্তাব। তাঁরা গ্রহণ করলো। প্রবেশ করে যে জগৎ তারা দেখতে পেল-সেখানে ভারতীয় শিক্ষিত সমাজের আত্মদর্শনের মাধ্যমটি কি দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিলো একটি প্রশ্ন। অপরদিকে যে দরজাটি দিয়ে তাদেরকে উপনিবেশিক জগতে ঢোকানো সম্ভব হয়েছিল, সেই দরজার অস্তিত্বটি কেমন ছিল, তার আকারে আয়তনে কেমন। আশ্চর্যের বিষয় কল্পিত দিগন্তের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেই বাস্তব ভিত্তিভূমির কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে থিয়েটারের জন্যে নির্মিত ডানাওয়ালা পোষাকের ওপর আশ্রয় গ্রহণে-না পারলো সেই কল্পিত দিগন্তে পৌঁছতে না রাখতে পারলো নিজেদের সামান্য ভূমিকে পায়ের সাথে জড়িয়ে রাখতে। সবকিছু বেহাত হয়ে যখন আবার ভারতীয়দের হাতে ফিরে এলা এতক্ষণে জৈবিক শাব্দিকতার ডেফিনেশনটি সাদাচামড়ার প্রভুরা নিজেদের পশ্চাতের ফ্রেমের আদলে তৈরী করেই নিয়ে এলো। সেখানে শিল্পকলা মানে কেবল শিল্পকলা নয়, শিল্পকলাকে দাঁড় করানো হলো এমন কতগুলো কলামের উপর যেগুলোর সাথে ভারতীয় শিল্পের প্রকৃতমাত্রার সম্পর্ক অত্যন্তক্ষীণ। শিল্পকলার সাথে জড়ানো হলো জাতীয়তাবাদ, পুনঃজাগরণ, শিল্পীর স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ইত্যাকার কতগুলো শব্দ কিম্বা শব্দসমষ্টি। শিল্পীর উপর আরোপিত হলো বহিজগতের বাস্তবতা। শিল্পীর দায়দায়িত্বের সীমানা পশ্চাতের সীমানার আদলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হলো। 'এই পশ্চাতের আদল' (পাঠক লক্ষ্য করুন আমি পাশ্চাত্য শব্দটি ব্যবহার না করে সচেতনভাবেই পশ্চাতে ব্যবহার করেছি কারণ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক শৃংখল থেকে শৈল্পিক শৃংখলে শিল্পীদের ফিরে আসতে তথা মুক্ত হতে কত শতাব্দী লেগে ছিল? এবং আজকের পাশ্চাত্য শিল্পীদের স্বাধীন বৃত্তি হিসাবে জীবন যাপনের পেছনে তাদের যে (অর্থ) নৈতিক কাঠামোটি রয়েছে, একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে ইতালির প্রাক র‌্যনেশাঁস যুগের রাষ্ট্রীয় অর্থের নির্মাণের পেছনে যোগানদাতা হিসাবে কাজ করেছিলো নৈতিক সংঘর্ষের চূড়ান্ত বিজয়। যে কারণেই পৃথিবীর তাবৎ প্রান্তীয় (periphery) রাষ্ট্রগুলোর কাছে 'বিজয়'টিকে মডেল হিসাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হলো। যাই হোক এ বিষয়ে বিস্তারিত পরবর্তী প্রসঙ্গে উপস্থাপিত হবে।) এবং শিল্পীর দায়দায়িত্বের স্বরূপটি কেমন? 

প্রাক র‌্যনেশাঁস যুগে শৈল্পিক বিষয় আশয় শিল্পী এবং সামগ্রিকভাবে ইতালীয় জনপদকে এমন কোন বিশেষণযুক্ত সময়কে অতিক্রম করে পেছনে যেতে হয়নি যাতে তার ভবিষ্যটাই খাদে পড়ে যায়। ইতালির র‌্যনেশাঁস বলা হয় মধ্যযুগের পরে একটি নতুন চমক দিশা। ওখানকার বুদ্ধিজীবীরা চাইলেন ঐদিশায় আলোকিত হবেন দিশেহারা নয়। তাই হলো। যাঁর (যীশুর) জন্মের পরবর্তী ঠিক এক হাজার বছর ধরা হলো মধ্যযুগ বলে-র‌্যনেশাঁস কিন্তু তাকে বাদ দিয়ে নয়; তাঁকে নতুনভাবে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে শুরু হলো। সেই স্মরণের পদাতিক বাহিনী নিশ্চয় শিল্পীরা নয়, ক্রুসেডের মহানায়কেরা যার স্মরণ সংযোগ যার ফসল এনে গোলায় তুলে দিল। আমাদের মনে রাখতে হবে যদিও যীশু খ্রীষ্টের জন্মের পরবর্তী এক হাজার বছরের ইতিহাস হচ্ছে মধ্যযুগ নামে খ্যাত। সেই মধ্যযুগ অতিক্রম করে আসা মানে কিন্তু খ্রীস্টধর্ম, খ্রীস্টকে অতিক্রম করে যাওয়া বুঝায় না। যদি বোঝাত তাহলে র‌্যানেশাঁসের পরবর্তী ৭০০ বছর যীশুকেন্দ্রিকভাবকে পাশ্চাত্য সরাসরি কীভাবে বহন করলো? অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে বহন করলো একারণে যে, খ্রীস্টমতবাদকে আশ্রয় করে খ্রীস্টপরবর্তী যারা ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি হিসাবে চার্চের প্রতিষ্ঠা করে আকড়ে থাকলো, চার্চ থেকে ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়ে যীশুকে স্থানান্তরিত করা হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এর ফলে যা ঘটলো বিকাশ এবং সৃজনশীলতার পক্ষ ব্যক্তির ফতোয়া হয়ে দাঁড়ালো, যীশুর বক্তব্য। এটা কেবলমাত্র খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে ঘটলো তাই নয়; ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্যও অনেকখানি প্রযোজ্য। 

অতএব যীশুর চরিত্র কী এটা চিত্রনই হচ্ছে প্রথম কাজ। প্রাক র‌্যনেশাঁস অর্থাৎ ঈসায়ী ১২শ-১৩শ শতক সময় থেকৈ প্রায় ৬শ, ৭শ বছর প্রধান শিল্পীদের কাজকর্মের হদিস করলে দেখা যাবে তৎকালীন শৈল্পিক মানসিকতা ও অর্থনেতিক চাহিদার কাছে বিষয়বস্তু হিসাবে যীশুখ্রীস্টের গুরুত্ব ছিল কতখানি। চার্চ নির্মাণ ও চার্চ অলংকরণে যীশুর মুখকেন্দ্রিক ছবিগুলি যথেষ্ট ব্যবহারিক ছিল। 

এ কারণে ছিল, ক্রুসেড পূর্ববর্তী সময়ে য়ুরোপ এবং আরো কয়েকটি মহাদেশের দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সাথে ঝাপটে ছিল ভক্তি, অর্থ, নৈতিক বাধ্যবাধ্যকতা। বুর্জোয়া সমাজের সৃষ্টিতে ভক্তি, অর্থ ও নৈতিকতা, ক্ষমতায়ন থেকে ধর্মকে আলাদা করে (দৃশ্যত) রাখা হলো। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় চৈতন্য ছিল প্রভু যীশু দাঁড়িয়ে থাকলে পদ ও অর্থের সামঞ্জস্য ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। সে বুর্জোয়াদের কাছে সম্ভব ছিল না। সম্ভব হলো না ক্রুসেডের মহা মহা আত্মত্যাগের ফলে। কারণ ক্রুসেড হোল সেই চাকাসম্বলিত গাড়ী যে গাড়ীতে সওয়ারী হয়ে যীশুকে আসতে হয়েছে ভেনিসে আর এসেছিল প্রাচ্যের পথে পাওয়া প্রত্নসম্পদ। যে সম্পদ নিরাপদে এসেছিল যীশুর কারণে-সেই সম্পদ নিজের জন্যে যীশুকে আর নিরাপদ না ভেবে মন্দিরে ক্লান্ত যীশুকে বসিয়ে দেয়া হলো। কারণ বরাহ দুর্গভাঙার প্রস্তুতিতে যীশু সর্বদা অহিংস, শান্তিবাদী হবে এটা ওদের জানা ছিল। বরাহ দুর্গ কী? ১০ হাত বিশিষ্ট স্বয়ম্বর শাসন ব্যবস্থার দুর্গা। যিনি দূর্গ স্থাপন করেন প্রথমত 'আপন' অস্তিত্বের বিপরীতে 'পর' অস্তিত্বের প্রশ্নে। আপন অস্তিত্ব অশুভ জনগণ ও শাসকশ্রেণীর ভেতর থেকে যীশুখ্রীস্ট হচ্ছে মধ্যবর্তী সাঁকো যিনি সম্বন্ধ স্থাপন করেন আপনসত্তা হিসাবে। যার স্থান হচ্ছে চার্চ বা খ্রীষ্টীয় পার্লামেন্ট। আর হ্যাঁ এই পার্লামেন্ট জনগণ কর্তৃক নির্বাচত নয়; শাসকগণ কর্তৃত্বে নির্ধারিত। রোমান সাম্রাজ্যের পতন পরবর্তী এক হাজার বছর চার্চকেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার মর্মমূলে পচন ধরতে থাকে। যার অবস্থান হচ্ছে দুর্গাভ্যন্তরে। কিন্তু ১৩শ ও ১৪শ শতকে চার্চের এই একক ক্ষমতার অবনতি শুরু হয়। শাসকবর্গের সাথে অব্যাহত বিরোধ, ধর্মীয়, ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদিতা এবং সর্বোপরি চার্চের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি একে বিশেষভাবে দুর্বল করে ফেলে। যদি চার্চের সংস্কারের জন্য নানা মহল থেকে দাবি উঠতে থাকে। এমনকি চার্চের সৃহৃদগণও এই দাবি উত্থাপন করেন। চার্চের সংগঠন ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম এবং যাজকবর্গের ক্রমাবনয়নশীল নৈতিকতা দর্শনে জনসাধারণ ভীষণভাবে বিক্ষুব্ধ হন। এমন পরিস্থিতিতে দুর্গভাঙার হালে পানি চাইলে বরাহদূর্গ পাশে অবস্থিত বুর্জোয়া (ব্যবসায়ী) শ্রেণী দুর্গভাঙার অবস্থিত পুজি শ্রেণীটি সেই জলের তাপমাত্রা পরিবর্তন করে চার্চের বিপরীতে কাজে লাগিয়েছিলো। 

এত সম্ভব কেবলমাত্র অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধিজনিত কারণেই ঘটেনি ধর্মীয় নব্য ইন্টারপ্রিটেশন জুগিয়েছিলো ব্যাপক ইন্ধন। ১২শ, ১৩শ শতকের সংস্কারপন্থি, Albigens ও Waldens গণ ও ১৪ ও ১৫শ শতকের Lollard ও Hussites গণ রেখেছিলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। 

খ্রীস্টযাজক মার্টিন লুথার যার ১৬শ শতকের সংস্কার মতবাদ ব্রহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপক গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। পূর্ববর্তী সংস্কারপন্থীদের সাথে পরবর্তী মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬), জন ক্যালভিন (১৫০৯-৬৪), ফিলিপি মেলাংথন (৪৯৭-১৫৬০) প্রভৃতিরা এই আন্দোলনের শ্রেষ্টতম প্রবক্তা ও নেতা। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে যাজক অধ্যাপক মার্টিন লুথার উইটেনবার্গ গীর্জার দ্বারশীর্ষে তাঁর সুবিখ্যাত ৯৫ তত্ত্ব (95 Theses) টাঙ্গিয়ে দেবার মাধ্যমে ধর্ম সংস্কারের জেহাদ ঘোষণা করেন। বিশেষ করে অর্থের বিনিময়ে পোপ কর্তৃক পাপ মোচনের অঙ্গীকারকে লুথার তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। পোপ তাঁকে ধর্মচ্যুত করেন (excommunication), তাঁর জীবনের উপরও হুমকি আসে। এতদসত্ত্বেও তিনি তার আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। শীঘ্রই সমগ্র উত্তর ইউরোপে তাঁর মতবাদ ও প্রভাব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।

বরাহ দূর্গপাশে অবস্থিত ব্যবসায়ী শ্রেণী ভেতরের পুঁজিশ্রেণী ও নৈতিক ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছ থেকে নৈতিক সাহায্য পাবার দরুন দূর্গের দেয়াল বর্ধিতকরণ অর্থাৎ বুর্জেয়াশ্রেণী প্রথমে দূর্গের অংশ হওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করে। বরাহ দূর্গপাশে অবস্থিত ব্যবসায়ী শ্রেণী ভেতরের পুজিশ্রেণী ও নৈতিক ধর্মতাত্ত্বিকদের কাছ থেকে নৈতিক সাহায্য পাবার দরুণ দুর্গের দেয়াল বর্ধিতকরণ অর্থাৎ বুর্জোয়াশ্রেণী প্রথমে দূর্গের অংশ হওয়ার প্রস্তাব উথ্থাপন করে। সংস্কারপন্থিদের চাপে পরবর্তীতে যা প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে বণিকশ্রেণীর প্রভাব পাকাপোক্ত হয়ে গেল। যদিও বণিকশ্রেণীর অর্থাৎ অর্থনৈতিক একক স্ফুরণকেই অনেকের মতো (যান্ত্রিক) মার্কসবাদীরা যে সিদ্ধান্ত টানেন তাকে র‌্যনেশাঁস গবেষক 'অমলেশ ত্রিপাঠী' ভ্রান্ত ধারণা চালুর কর্মকর্মা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাণিজ্যিক বিপ্লব; বুর্জোয়া শ্রেণীর অভ্যুদ্বয়, ধনতন্ত্রের সূচনা ইত্যাদি - এসব (যান্ত্রিক) মার্কসবাদী সিদ্ধান্ত সত্য কিনা পরীক্ষা করা দরকার। 

অমলেশ ত্রিপাঠীর আরো সিদ্ধান্ত: ইউরোপর মধ্যযুগের অর্থনৈতিক ইতিহাসে নতুন যুগ শুরু করেন ডপসক (Dopsch), লাতুস (Latouche), আঁরো পিরেন (Henri Pirenne)। পিরেনের মতে ভূমধ্যসাগরে ইসলামের অভিযান ও আধিপত্য বিস্তার নগর ভিত্তিক ক্লাসিক সভ্যতার অবসান ঘটায়। কিন্তু বরার্ট লোপেজ (Lopez), তাঁর Mohammed and charlemagne a Revision এবং কেমব্রিজ ইকনমিক হিস্টরি অব ইউরোপ-এর দ্বিতীয় খন্ডে পিরেন মতবাদের খন্ডন করেছেন। পিরেন বলেছিলেন, পশ্চিম ইউরোপ থেকে স্বর্ণমুদ্রা, প্রাচ্য রেশমী ও রঙিন বস্ত্র এবং প্যাপিরাসের অন্তর্ধান-অবক্ষয়ের চিহ্ন। লোপেজ দেখালেন, এগুলি কোনদিনই উঠে যায়নি। এখন আমরা মোটামুটি বলতে পারি- ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ- পঞ্চম শতকে বাণিজ্যের অবনতি ষষ্ট ও সপ্তম শতাকের প্রথমে উন্নতি এবং নবম শতক পর্যন্ত পুনরাবনতি ঘটেছিল। দশম শতকের শেষ থেকে বাণিজ্যের গতি উর্ধমুখী হল এবং ইউরোপ মুদ্রানির্ভর অর্থনীতি (money economy)-র স্তরে উন্নীত হল। ক্যারোলিঞ্জিয় সাম্রাজ্যের বিভাজন (৮৪৩), উত্তরে ইউরোপ ক্রমবর্ধমান ভাইকিং আক্রমণ এবং গ্রীক ইহুদি, মুসলিম মধ্যস্থরা পিছিয়ে পড়ায় ইতালির বণিকদের সুদিন ফিরে আসে। ভেনিস, জেনোয়া, নেপলস, পিসা ছিল তার অগ্রদূত। উত্তর ইউরোপ প্রসঙ্গে অধ্যাপক পোসটান এ ধরনের বাণিজ্যিক তথা নাগরিক পুনর্জীবনের কারণরূপে জনসংখ্যাবৃদ্ধিকে গুরুত্ব দিয়েছেন (M. Postan, the cambridge Economic History of Europe, Vol II, Chapter IV, R.S. Lopez, I bid, Chapter V.K.F. Hellenier, Ibid, Vol IV, Chapter I) দক্ষিণ ইউরোপের ক্ষেত্রে লোপজও জনসংখ্যাবৃদ্ধিকে prime mover আখ্যা দিয়েছেন। তবে নগরায়ন শুধু কৃষি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষক বিক্রেতাদের লাভ ও সামন্ত প্রভুদের বর্ধিত আয়ের জন্য সম্ভব হয়নি-হয়েছিল নতুন এক বণিকশ্রেণীর অভ্যুদ্বয়। পোস্টান লিখেছেন, 'trade was becoming to an ever increasing degree the affir of the whletime merchants and artisans trading in a professional way' 

ধনতন্ত্র, ক্রুসেড এবং ধর্মীয় অবস্থা পরিবর্তন করে সবচেয়ে বেশি আলোকিত করে তুলেছিল বুর্জোয়া শ্রেণীকে। যদিও 'সসমবাট' প্রথম খাঁটি বুর্জোয়াদের সন্ধান পান চতুর্দশ শতকের শেষে ফ্লোরেন্স। ব্রোদেল তাঁর বিখ্যাত Civilization and Capitalism 15th-18th century গ্রন্থের প্রথম খন্ডে ধনতন্ত্রের সঙ্গে এর নামযুক্ত করেছেন। Thirteenth Century and a fortior fourteenth century Florence was a capitalist city, waht ever meaning attaches to the word.

লোপেজের মতে, দ্বাদশ শতক ছিল 'বাণিজ্যিক বিপ্লব' -এর স্বর্ণযুগ এবং তার নেতৃত্ব দিয়েছিল ইতালি। Italy was to the medieval economics process what England was to the modern. মিলান, ভেনিস, নেপলস ও ফ্লোরেন্সে জনসংখ্যাবৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রতি শহরের চারদিকে দ্বিতীয় প্রাচীর নির্মাণে এবং শহরতলি ও সন্নিহিত জনপদের ওপর শহরের আধিপত্যে। জনসংখ্যার সঙ্গে বাড়ে স্থানীয় ও আঞ্চলিক চাহিদা, বিস্তৃত হয় বাজার। ক্রুসেডস তাকে ব্যাপকতর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে রূপ দেয়। বাণিজ্যে বেশি লাভ হওয়ায় অধিকাংশ নাগরিক সেই বৃত্তি নেয়-এমনকি অভিজাত্যের মতই সম্মানিত ছিল কাঞ্চনকৌলিন্য। দেখতে পাচ্ছি ক্রুসেডস তাহলে ছিল এক বড় আকারের হোতা। যার মধ্যে দিয়ে নির্মিত ঘটেছিল তৎকালীন ফ্লোরেন্সেসহ আরো কতিপয় বাণিজ্যিক নগরীর অর্থ (নৈতিক), সামাজিক, ধর্ম ও রাজনৈতিক আচরণের একটা কমন প্লাটফর্ম। যার প্রভাব কেবলমাত্র ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষেই নয় পৃথিবীর নানা অঞ্চলে যার ব্যবহারিক চরিত্র আজও কার্যকর।

(চলবে) 

জোড়াতালির ক্রমানুসারে : 
৪. ইতালীর র‌্যনেশাঁস বাঙালীর সংস্কৃতি, অমলেশ ত্রিপাঠী, দ্বিতীয় পরিবর্ধন সংস্করণ জুলাই ১৯৯৬। 
অন্যান্য : Hans Baronm, The Crisis of the Early Italian Renaissance (revised edn. Princeton, 1966); Maurice Dobb, Studies in the Development of Capitalism (London,1946); সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষ, ড.আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী ইশরাত শামীম, মুহম্মদ হাবিবুর রহমান, মোহাম্মদ ইমদাদুল হক সম্পাদিত। অনন্যা ৩৮/২ বাংলা বাজার ঢাকা, প্রথম অনন্যা সংস্করণ নভেম্বের ২০০১।

________________________________________________

তেভাগা আন্দোলন ও অন্যান্য 
মো. মোজাম্মেল হক 

"নিজের জমি হারাই আমি পরের ক্ষেতে কাম খাটি 
মরলে পরে জানি আমার কবরেরও নাই মাটি" 

নির্মলেন্দু গুণ-এর এ কবিতায় বাংলার কৃষকদের হাহাকার যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি এখনও কৃষি আর এ কৃষির প্রাণ কৃষক। অথচ মোট দেশজ উৎপাদনের সিংহভাগের যোগানদাতা কৃষকদের অবহেলা করেই আমরা উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে আসছি। যে কৃষক সবার মুখে অন্ন যোগায় তার নিজের অন্নের সুব্যবস্থা সব সময় হয় না। কৃষকের কষ্টের ফল, ঘাম ঝরানো শ্রমের ফসল চলে যায় জোতদারের গোলায়। ভূমিহীন প্রান্তিক চাষীদের অবস্থা তাই দিন দিন জীর্ণ হতে জীর্ণতর হয়ে চলেছে। কৃষি তথা সার্বিকভাবে গ্রাম উন্নয়নে যে দেশের মডেল (কুমিল্লা মডেল বা দ্বিস্তর বিশিষ্ট সমবায় সমতি মডেল) বিশ্বব্যপী সমাদৃত সে দেশের কৃষকদের উন্নয়নের জন্য আই.এম.এফ - বিশ্বব্যাংকের পরামর্শের প্রয়োজন নেই প্রয়োজন সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সদিচ্ছার। 

বাংলার কৃষকরা নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বিভিন্ন সময় সংগ্রাম করেছে। এ সব আন্দোলনের মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৪৯-৫০ সালের ঐতিহাসিক তেভাগা ও টংক আন্দোলন। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এ আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চলে নানকার প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনও বেগবান ছিল। 
উত্তরাঞ্চলের সাহসী মানুষের উত্তরসূরীরা তাদের রক্তে বহন করেছে সংগ্রামের বীজ। তাইতো আমরা দেখি ইলা মিত্রের নাচোলের অদূরে কানসাটে সম্প্রতি বিদ্যুতের জন্য আন্দোলন, দিনাজপুরের কয়লা খনি এলাকায় এশিয়া এনার্জির বিরূদ্ধে আন্দোলন। 

তেভাগা অর্থ তিনভাগ করা। সামন্তবাদী শোষকদের প্রচলিত প্রথা অনুসারে জমিতে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক বর্গাচাষী পেত এবং বাকী অর্ধেক জমির মালিক বিনা আয়াসে ভোগ করত। এই আধিবর্গা প্রথার স্থলে তেভাগা প্রথা চালুর দাবি করা হয় যাতে জমির মালিক ও বর্গা চাষীর ভিতর উৎপাদিত ফসলের আধাআধি ভাগের বদলে ফসলকে তিন ভাগ করে বর্গাচাষী পাবে দুই ভাগ আর জমির মালিক পাবে একভাগ। জমিতে বর্গাচাষীর স্বত্ব স্বীকার করতে হবে। মাঠের ফসল কেটে বার্গাচাষীরা নিজ গোলাতে ধান তুলবে। জমির মালিক সেখানে এসে নিজ হিস্যা বুঝে নিবে। 

টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা। অর্থাৎ ফসল যাই হোকনা কেন টংক চাষী জমির মালিককে কড়ার অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমান ধান দিতেই হতো। টংক প্রথার স্থলে দাবি করা হয় যে, ধান কড়ারী খাজনার পরির্বতে টংক চাষীরা প্রচলিত হারে টাকার খাজনা দিবে এবং জমিতে টংক চাষীর স্বত্ব স্বীকার করতে হবে। 
নানকার প্রথা মতে জমিদাররা সামান্য কিছু জমি ও বসতবাটি বিনামূল্যে নানকার কৃষকদের দিত তার বিনিময়ে নানকার কৃষকদের জমিদারদের জমিতে বেগার খাটতে হতো। রংপুর অঞ্চলে এ ধরনের কৃষকদের "ভাতুয়া" বলা হতো। অর্থাৎ ভাতের বিনিময়ে দাস। জমিদারদের বাড়ির যাবতীয় কাজ এমনকি রান্নাবান্নার কাজও নানকার কৃষক পুরুষ ও নারীদের দিয়ে করানো হত। সামান্য ত্রুটির জন্য তাদের উপর চলত দৈহিক নির্যাতন তদুপরি দুশ্চরিত্র জমিদাররা নানকার কৃষকদের ঘরের সুন্দরী যুবতী-বধূ ও কন্যাদের নিজেদের ভোগের পণ্য বলে মনে করত। নানকার কৃষকদের অবস্থা ছিল প্রকৃতপক্ষে মধ্যযুগের দাসদের মত। এভাবে বাংলার কৃষকগণ যুগযুগ ধরে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগি সামন্তবাদী জমিদার, জোতদার এবং মহাজনদের নির্মম শোষন ও জুলুমে নিপীড়িত ছিল। সামান্তবাদী শোষনে আধিবর্গা প্রথা পূর্ববঙ্গের সব জেলাতেই চালু ছিল, এর মধ্যে রংপুর ও দিনাজপুরে এই প্রথা তীব্র আকারে বিরাজমান ছিল। এছাড়া ময়মনসিংহ জেলায় প্রচলিত ছিল বর্বর টংক প্রথা। 

এ সব শোষন ও নিপীড়নের অবসানকল্পে কৃষকদের আন্দোলন পড়ে তোলার লক্ষে ১৯৩৬ সালে সর্বভারতীয় কৃষক সভার শাখারূপে 'বঙ্গীয় প্রদেশিক কৃষক সভা' গঠিত হয়েছিল। তখন থেকেই বাংলায় প্রগতিশীল ও সংগঠিত কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে কুমিল্লায় সারা ভারত কৃষক সভার একটি সম্মেলন হয়েছিল। এ সময়ে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরও কৃষক সমিতির কার্যকম চলছিল, বাংলার মেহনতি কৃষক স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ দিনের পর দিন ক্ষুধার জ্বালায় ধুঁকে ধুঁকে এবং ৪৩ সালের মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ ভাই বোনের অনাহারে মৃত্যু থেকে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিল যে, পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঁচতে হলে ঘরে খাদ্য ধরে রাখতে হবে। অথচ আধিবর্গা ও টংক প্রথার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত ফসল চলে যেত জোতদারের গোলায়। এই পটভূমিতে বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির নেতৃত্ব আধিবর্গা ও টংক প্রথার শোষনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে বাংলার কৃষকদের নিকট আহ্বান জানান। "কৃষকের হিস্যা আধি নয় তেভাগা, টংক প্রথার উচ্ছেদ চাই, জমিদারীর উচ্ছেদ চাই, জান দিব তবু ধান দিব না" ইত্যাদি স্লোগান তখন চাষীদের অন্তরের কথা হয়ে ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। 

১৯৪৬-৪৭ সনের ধান কাটার মৌসুমে জলপাইগুড়ি, মালদহ, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, পাবনা, মৈমনসিংহ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, মেদেনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, নদীয়া ইত্যাদির বর্গাচাষীর তেভাগার দাবিতে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এ আন্দোলন সবচেয়ে ব্যপক ও তীব্র আকার ধারন করেছিল দিনাজপুর জেলায় ও তারপর রংপুরে। এ সব আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কৃষক সমিতি নেতৃবর্গ সুশীল সেন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ, বিভূতি গুহ, অবনী বাগচী, দীনেশ লাহিড়ী, মোকসেদ আলী, নূরজালাল, বিষ্ণু চ্যটার্জি প্রমুখ। 

টংক প্রথার বিরুদ্ধে মৈমনসিংহ জেলার লক্ষাধিক উপজাতি (হাজং) টংকচাষী সুতীব্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। টংক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন কমরেড মনি সিংহ, রবি নিয়োগী, আলতাব আলী প্রমুখ নেতৃবর্গ ঐতিহাসিক এই তেভাগা ও টংক আন্দোলন বাংলার কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। 
সামান্তবাদী শোষকদের স্বার্থের রক্ষক তৎকালীন সরকার তেভাগা ও টংক আন্দোলন নির্মূলের লক্ষ্যে দমন পীড়ন চালনা করে। মৈমনসিংহের হাজং কৃষক রমনী রাশমনির নেতৃত্বে একদল হাজং কৃষক ঐ সময় ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশের হাত থেকে এক হাজং যুবতী কৃষক বধূকে রক্ষা করেছিল, কিন্তু রাশমনি ও সুরেন্দ নামে অপর একজন হাজং যুবক পুলিশের গুলিতে মারা যায়। সরকারের দমন নীতির ফলে আন্দোলন ক্রমশ স্তিমিত হয়ে গেলেও তা কৃষকদের বুকে ছাই চাপা আগুন হয়ে জ্বলতে থাকে। টংক প্রথার বিলোপ তেভাগা এবং নানকার প্রথা অবসানের জন্য ১৯৪৯ সনের প্রারম্ভ হতে আবার কৃষকদের আন্দোলন শুর হয়েছিল। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় কৃষক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-যুবকগণ। তাদের কন্ঠ ধ্বনিত হয় "লাখো ইনসান ভূখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়" ইত্যাদি। 

১৯৪৭ সালের টংক আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৪৯ সালের আন্দোলনের শুরুতেই গারো পাহাড়ের কয়েকটি অঞ্চলে কমিউনিষ্ট পার্টি ক্যাম্প স্থাপন করে এবং স্বেচ্ছা সেবকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া সরকারের দমন নীতি প্রতিরোধ করার জন্য অন্যান্য ব্যবস্থাও যথাসম্ভব করা হয়েছিল। কৃষকরা বহুস্থানে রাস্তা কেটে জমিদারদের গরুর গাড়ি আটকে দিয়েছিল এবং জমিদারদের টংক ধান আদায় বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল। দিনাজপুর, রংপুর, যশোর ও খুলনা ইত্যাদির যে সব অঞ্চলে ১৯৪৭ সনে তেভাগার আন্দোলন হয়েছিল ১৯৪৯ সালেও মোটামুটি সে সব অঞ্চলে আবার তেভাগা আন্দোলন শুরু হয় তবে ১৯৪৯ সনে তেভাগার আন্দোলন তীব্র হয়েছিল রাজশাহীর নাচোলে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন রমেন মিত্র, ইলা মিত্র ও সাঁত্ততাল কৃষক নেতা মাতলা সর্দার। রমেন মিত্র ছিলেন স্থানীয় বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। তিনি তাঁদের পরিবারের সকল জমিতে "তেভাগা কায়েম হল" বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন। তাতে অন্যান্য জোতদারের উপর একটা প্রভাব পড়ে, তদুপরি তেভাগা আন্দোলনে সাঁত্ততাল কৃষকদের ব্যাপক জমায়েত দেখে নাচোল, নবাবগঞ্জের জোতদাররা তেভগার দাবি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে পুলিশ ও রাইফেলস সদস্যরা ব্যাপক দমন নীতি চালালে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইলা মিত্র ধরা পড়েন। সিলেটের বিয়ানীবাজার ও বড়লেখা থানায় নানকার প্রথায় বিরুদ্ধে ১৯২০ দশক থেকে বারবার আন্দোলন হয়েছিল আন্দোলনের মূল দাবি ছিল দুটি: ক. নানকার প্রথার সস্পূর্ণ বিলোপ এবং খ. নানকারদের জমিও বাড়ির উপর নানকার কৃষকদের স্বত্ত্বের স্বীকৃতি। 

১৯৪৭ সালের শুরুতেই ঐ অঞ্চলের নানকার কৃষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে সকল জমিদারের কাজ বন্ধ করে দেয়। নানকারদের ন্যায্য দাবির প্রতি ঐ অঞ্চলের অন্যান্য কৃষকেরা এবং খাজনাই প্রজারাও সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানায় এবং সকল জমিদারদের খাজনা বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনে যোগদান করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই আন্দোলন আরো বেগবান হয় এবং জমিদার শ্রেণীর স্বার্থরক্ষক মুসলিম লীগ সরকারের দমননীতিও আরো বেড়ে যায়। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা, টংক প্রথা বা ধানুয়া খাজনা প্রথা এবং নানকার প্রথা অবসান কল্পে আইন প্রণীত হয়। কিন্তু আধিবর্গা প্রথা পুরোপুরি বজায় রাখা হয়। 

তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন এবং নানকার প্রথা বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার কৃষকদের রাজনৈতিক শ্রেনীচেতনা ও সংগ্রামী মনোবলের পরিচয় পাওয়া যায়। নানা দমন নির্যাতনের মধ্য দিয়ে তারা আপাত বিজয় অর্জন করলেও চূড়ান্ত বিজয় আজো অর্জিত হয়নি। আজও বাংলার মাটিতে আধিবর্গা প্রথা বিদ্যমান। 

(তথ্যসূত্র: সংগ্রামের তিনদশক, খোকা রায়) 

_________________________________________________

সেন্সিটাইজিং দ্যা সেন্সিবিলিটি 
ফরহাদ হোসেন মাসুম 

প্লিজ! খটোমটো নাম শুনে ঘাবড়ে যাবেন না। সত্যি বলছি তেমন কঠিন কিছু লিখবো না। সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পঁচা-ভাতের মতো গ্যাঁজাতে থাকি। ওখান থেকে ফিরে তিনটা টিউশনিতে সামান্য দক্ষিণার আশায় কিছুক্ষণ নমো নমো করি, টেম্পুর পা-দানিতে ক্লান্ত শরীরের ভর রেখে বাসায় ফিরে জট লেগে যাওয়া এ মস্তিষ্ক থেকে জটিল কিছু বের হবেনা, নিশ্চিন্ত থাকুন। 

আমার শিক্ষাদান কর্মসূচি শুরু হয় যার সাথে সে তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। পড়াশোনায় বেশ চৌকস, পাশাপাশি মায়ের খবরদারি তাকে শিক্ষার্জনে মনোযোগী ব্রতী বালক করে তুলেছে। কিন্তু মনোমুগ্ধকর স্থানীয় মানের অংক আজ কিছুতেই তার মনযোগ ধরে রাখতে পারছেনা। আমি অনেকভাবে চেষ্টা করলাম, লাভ হলোনা, স্থানীয় মানের জন্য আজ কিছুতেই তার মনে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। 

বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলা আমি একেবারেই পছন্দ করিনা। তবু একটা শেষ চেষ্টা হিসেবে, তার পেটে ছোট্ট করে কলমের একটি গুঁতো দিয়ে আবার শুরু করলাম। ৬৫৩২-এ ৫এর স্থানীয় মান যে ৫শত, এই তথ্যটা পাঁচশতবারের মতো জানাতে গিয়ে দেখলাম সে হাসি চেপে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। আমার দেয়া গুঁতো-ই যে এই হাসির কারণ, তা বুঝতে বাকি থাকলোনা। জিজ্ঞেস করলাম, 'তোমার এত কাতুকুতু?' 

জবাবে সে কোনোমতে মাথা নাড়ালো, কিন্তু তার সতর্ক দৃষ্টি আটকে রইলো সেই কলমটার দিকে। শেষ পর্যন্ত সে আর হাসি চেপে রাখতে পারলোনা... কলমটা দেখতে দেখতে হো হো করে শরীর মুচড়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো। বুঝলাম... কলমটা দিয়ে কাতুকুতু দিলে কী বিপর্যয় ঘটতে পারে সেই সুদূর ভবিষ্যতের কথা আগাম কল্পনা করেই তার এ অবস্থা। তার হাসি আমার মাঝেও সংক্রমিত হলো। কিন্তু আমার ভবনার বিষয় হয়ে রইলো শিশুদের কল্পনাশক্তির তীক্ষ্ণতা। 

প্রখর কল্পনাশক্তি আছে বলেই ওরা ভূতের গল্প শুনে মজা পায়। সাধারণ মুহূর্তগুলোকে সাজিয়ে নেয় অসাধারণ মহিমায়, চোখে ভর করে থাকে রাজ্যের বিস্ময়, চকোলেট চেয়ে না পেলে হুমকি দেয় 'প্যান্ট খুলে দিবো কিন্তু'। 
সেকথা বাদ দিয়ে এবার চলুন ঢুকে পড়ি হাসপাতালের মর্গে, যেখানে আমরা ব্যবচ্ছেদ করবো আরেকটি কল্পনাপ্রবণ মনের কিন্তু এবারের ব্যক্তিটি প্রাপ্তবয়স্ক। ছেলেটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশ মুখে দাঁড়ি, সুঠাম দেহটি এখন মর্গের বিছানায় নিথর। এই লাশটির প্রতি ডাক্তারদের কোনো সহানুভূতি নেই, কারণ ছেলেটি মারা গেছে সুইসাইডাল মিশনে।

সেই কল্পনাপ্রবণ মনটির ময়নাতদন্ত করলে একজন সুযোগসন্ধানী প্রতারকের সাথে তার নিম্নরূপ কথোপকথন শোনা যাবে...। 

সুযোগসন্ধানী- সাফল্য তোমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তোমার একটি প্রাণের বিনিময়ে হাজার হাজার আত্মা রক্ষা পাবে। তুমিই হবে আগামী প্রজন্মের আদর্শ। 
কল্পনাপ্রবণ- কিন্তু আমার জীবন? 
সুযোগসন্ধানী- জিহাদের কাজে না লাগলে সেই জীবন অভিশপ্ত। 
কল্পনাপ্রবণ- আমার পরিবার? 
সুযোগসন্ধানী- তারা তোমায় নিয়ে গর্ববোধ করবে। 
কল্পনাপ্রবণ- আমার দেশ? 
সুযোগসন্ধানী- তোমারই রক্তে উর্বর হয়ে উঠবে। 
কল্পনাপ্রবণ- বাবা-মা চেয়েছিলো আমার পরমায়ু। 
সুযোগসন্ধানী- কিন্তু কওম দাবি করছে তোমার শৌর্যপূর্ণ আত্মাহুতি। 

অতএব, মুখে সুশোভিত দাঁড়ি বা বুকে বোমাসমেত ছেলেটি শহীদ হওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। 
ইতিহাস বলে, মানুষ একসময় বর্বর ছিলো, এখন নাকি সভ্য হয়েছে; কিন্তু ঝোপ বুঝে কোপ মারা শ্রেনীটি কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি। 

১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বেনিয়া ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী আর তাদের কিছু তাঁবেদার জমিদার, ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান আর রাজাকারগোষ্ঠী এরপর কিন্তু এই ভূ-খন্ডের সুযোগসন্ধানী শ্রেণীটিকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করা যায়নি। 

'৪৭ আর '৭১ এই দুটো সালে একবার হয়েছি পাকিস্তানি, আরেকবার হয়েছি বাংলাদেশি। যুদ্ধ করার জন্য বাইরের কোন শক্তি বাকি থাকলোনা। কিন্তু দেশটাকে এখনো চিবুনো হচ্ছে, এখন অস্ত্র ধরবো কার বিরুদ্ধে? 
সেই সুযোগসন্ধানী সমাজ যে বিলুপ্ত হবেনা তা কি আমরা '৭১-এ ভেবেছিলাম? তখন কি আর জানতাম, একসময় কারো বালিশ অথবা চালের ড্রামে পাওয়া যাবে টাকার বান্ডিল? নামে-বেনামে, দেশের ও বিদেশের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে কারো কাছ থেকে পাওয়া যাবে কয়েক'শ কোটি টাকা? তখন কি কেউ বুঝেছিলো, একসময় আড়তে চাল আর আটা পঁচে যাবে; আর তৈরি হবে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ? দেখতে দেখতে ৪ টাকার আলু হয়ে যাবে ২২ টাকা? ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে বাবা নিজ হাতে সন্তানকে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলে পড়বে? 

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ক্রলিং করতে থাকা সৈনিক যখন রঙিন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুনতে বুনতে গুলি ছুঁড়ছে, সে কি জানতো দেশে থাকবে একটি বিরোধী দল, যারা সবসময়ই মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলবে? আর প্রধানমন্ত্রীর ছেলে চিহ্নিত হবে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে? সে কি বুঝেছিলো ১০০ টাকার নোট নিয়ে মাছ কিনতে গেলে মাছওয়ালা পর্যন্ত হাসাহাসি করবে? নির্বাচনে পাশার ছক পাল্টে দেয়ার জন্য আবির্ভূত হবে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট জেএমবি? একজন মুক্তিযোদ্ধার কষ্টার্জিত স্বাধীনতার ইতিহাস বদলে যাবে প্রতি ৫ বছর পরপর? 

আপনারা সবাই বেশ ভালোভাবেই জানেন, তবুও ইতিহাসের ওপর ধর্মের প্রভাব নিয়ে কিছু কথা পুনরাবৃত্তি করছি। বিদেশি একটা ইংরেজি চ্যানেলে একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, ভারতের একটা বিরাট আকৃতির মসজিদের পিলারে কিছু ক্ষুদ্রাকৃতির দেবমূর্তি দেখা যাচ্ছে। আরো খুঁজতেই দেখা গেলো, মসজিদের দেয়ালে দেয়ালে দেব-দেবীর উপস্থিতি কম নয়। ইসলাম ধর্মে মূর্তিপূজা অসম্ভব, তবে কীভাবে ঘটলো এই দুর্ঘটনা? প্রতিবেদক ব্যখ্যা করলেন গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষ আক্রমনের পর লুট করা সম্পত্তি নিয়ে দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু লোকের মনে নিজের ভয় জিইয়ে রাখার জন্য কী করা যায়? বেছে নিলেন সবচে মারাত্মক অস্ত্র ধর্ম, মসজিদ স্থাপন করতে হবে, কিন্তু এত সময় কোথায়? তাই দ্রুততম পন্থা হিসেবে মন্দির থেকে মূর্তি হটাও, তাকেই সমজিদ বানিয়ে ফেলো। পিলার ভেঙে দিলে ভবনটাই ধসে পড়ে, তাই সেগুলো হটানো যায়নি। 

একটু কাছের ইতিহাস বলি। ১৯৪৭ এ জন্ম নিলো দুটি নতুন রাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তান, এই ভাগাভাগির ভিত্তি কি নতুন করে বলে দিতে হবে? 

'৭১-এর ঘটনা আরো লজ্জাজনক। হানাদার বাহিনীর কবলে পড়লে প্রথমেই বলতে হতো, 'স্যার, ম্যাঁয় মুসলমান হুঁ'। সন্দেহ নিরসনের জন্য খুলতে হতো লুঙ্গি, দেখাতে হতো কর্তিত চামড়া। 

১৯৭১, মাত্র চার দশক আগের ঘটনা। কারা সে সময় সুযোগসন্ধানী রাজাকারের ভূমিকা পালন করেছে, সেই ইতিহাসের জীবিত দলিল হয়ে এখনো অনেকেই বেঁচে আছেন। কোন শক্তির বলে সেই রাজাকারের দল সরকার গঠনে অংশ নিচ্ছে? ধর্মের আড়ালে লুকিয়ে কীভাবে তারাই হচ্ছে আমাদের ভাগ্য-নিয়ন্তা? দিকে দিকে আন্দোলন হয়েছে 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই'। বিচার হয়েছে? এই আন্দোলন কয়েক বছরের মধ্যে থিতিয়ে যাবে। কারণ, ঐ সময়ের দেশদ্রোহীরা কয়েক বছরের মধ্যে বুড়ো হয়েই মারা যাবে। শুধু প্রার্থনা করতে পারি, তাদের মৃত্যুটা যেন করুণ ও মর্মান্তিক হয়। 

অন্য প্রসঙ্গে আসি। দেশের জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) বা উৎপাদিত সকল দ্রব্য ব্যক্তি মালিকানাধীন না হয়ে সবার মাঝে বণ্টিত হবে, শ্রেণীহীন এই সমাজব্যবস্থার নাম সোশ্যালিজম। এ ধরনের সমাজ, অনেক শোষিত মানুষের কল্পনা। কিন্তু এই কল্পনাপ্রবণতাকে দমিয়ে রাখতে সুযোগসন্ধানীদের একটি ঢাল-ই যথেষ্ট প্রমাণিত হয়েছে... সোশ্যালিস্টদের কপালে লাগানো হয়েছে নাস্তিকতার তিলক আর গণসাম্যবাদের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে 'ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড'।

ধর্ম যথেষ্ট সংবেদনশীল একটা বিষয়। নিজের অগ্রযাত্রা অক্ষুণ্ন রাখতে বারবার কিছু সম্প্রদায় একে ব্যবহার করেছে। ধর্ম যেন এক উত্তেজিত ক্লোরিন পরমানু, যা সুপরিকল্পিত চেইন বিক্রিয়ার মাধ্যমে বিবেকের ওজোন স্তর ফুটো করে দিচ্ছে। 

আমাদের অনুভূতি নিয়ে এ কোন হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ হলো? 

সামাজিক লোকাচার আমাদের মুখে এঁটে দিচ্ছে মিষ্টতার কুলুপ। শিক্ষা ব্যবস্থা উৎসাহিত করছে মুখস্থবিদ্যার প্রবণতাকে। রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের স্বপ্নাতুর চোখে পট্টি বেঁধে খেলে চলেছে কানামাছি ভোঁ ভোঁ। অর্থনীতি স্বপ্ন দেখাচ্ছে স্বয়ংসম্পূর্ন বাংলাদেশের, পরক্ষণেই সে স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে মুদ্রাস্ফীতির ঠ্যালায়। সাহিত্যের নামে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আমাদেরকে মতিভ্রম শেখাচ্ছেন, আর মতি জাগানিয়া লেখকের পতন ঘটছে রক্তপাতের মধ্য দিয়ে। সবকিছু থেকে পালিয়ে নতুন কিছু করতে চাইলে আইনের ল...ম্বা হাত বলে ওঠে 'ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও বাছাধন '। 

সবার মিলিত উদ্যোগে আমরা হয়ে পড়েছি সেই পেঙ্গুইন, যার ডানা আছে কিন্তু ওড়বার ক্ষমতা নেই। সবাই আমাদের অনুভূতি নিয়ে খেললেও আমাদের কল্পনা প্রবণতা কিন্তু রয়ে গেছে। আর সেই কল্পনাপ্রবণতার সুযোগ নিতে মুখিয়ে আছে অনেকেই।তারা বুঝে ফেলেছে, আমাদের সেনসিবিলিটিকে সেনসিটাইজড করতে প্রয়োজন, কলমের ছোট্ট একটি গুঁতো।

_________________________________________________
কবিতা
_________________________________________________

সৌরভ বড়ুয়া
নির্জনতার বৃত্তে 

গায়ে রোদ্র মাখানো দুপুর গুলো ক্লান্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে। 
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। কালো মেঘের বীভৎস ছায়া পড়ে রহস্যের 
বেদীতে দাঁড়ানো অদৃশ্য কালো মূর্তির উপর। 
হিংস্র নিসঙ্গতার ভয়ে ঝলসানো মস্তকগুলো লুকিয়ে 
থাকে কল্প-বাস্তবতার প্রাসাদে। 

তীব্র আর্তনাদের সুর ক্রুশবিদ্ধ সময়ের কন্ঠক মুকুটে বিঁধে। 

রক্তাক্ত কাঁটাতারের গা বেয়ে নেমে আসে নির্জনতার 
স্রোত। চারিপার্শ্বে বিপর্যয়ের অনুরণন আর অসুস্থতার 
কালো ধোঁয়া পৃথিবীর সমস্ত পান্ডুলিপিকে ঢেকে ফেলে। 

বিশালতার বৃত্তে একাকীত্বের আশ্চর্য কান্না শুনি। 

দেখি অনৈসর্গিক পৃথিবীর আশ্চর্য দেবশিশুদের অনৌদার্য রূপ। 
আমি শূন্যতার অস্তিত্বে কামড় বসিয়ে দেব। 

এই সময়টা 
আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকি 
দেখি ছিন্ন মুহূর্তগুলো 
ক্লান্ত দুপুরের গা বেয়ে 
নেমে আসে 
ব্যালকনির অন্ধ প্রাচীরে। 

বিমূর্ত পথকে আশ্রয় করে 
দাঁড়িয়ে আছে একটি বিকলাঙ্গ বৃক্ষ। 
নোংরা জামা গায়ে 
অশরণ ক্ষুধার্ত পাতাগুলো 
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে 
ঐ বিবর্ণতার দিকে। 
দীর্ঘ ভ্রমনে শ্যাওলা পড়া নগ্ন পা গুলো 
এখন বেশ ক্লান্ত। 
পৃথিবীর সমস্ত মর্মযন্ত্রণা 
মূর্ত হয়ে ওঠে বিমূর্ত ক্যানভাসে। 
শোনো, সময়ের রন্ধ্রেরন্ধ্রে নির্জনতার তীব্র আর্তনাদ। 
পার্থিব চোখগুলো ঘুমিয়ে পড়ে 
কাল্পনিক নৈশব্দের আড়ালে। 

চারদিকে 
আতঙ্ক
শূন্যেতায় ডুবে যাচ্ছে নগরের নিস্তব্ধতা 
অচেনা অরন্যে কুষ্ঠরোগাক্রান্ত দানবের 
অসাড় পদচিহ্ন। 
শুধু কি অসাড়তা? 

হে গ্রেগর, অস্তিত্ববাদী মঞ্চে 
পৃথিবীর সমস্ত পতঙ্গের মুখ থেকে 
ঝড়ে পড়ে সভ্যতার অসুস্থ লালা। 


নীড় দত্ত মজুমদার 
বিসর্জন 

গোধুলির আবছা আলো সাড়া দিয়েছে 
আমার হৃদয়ের উঠোনের আঙ্গিনায় 
মনের সমস্ত যন্ত্রণা আজ বিসর্জন দেব 
নিরবে, সাজানো মঙ্গল ঘটে! 

নিশীথিনী হয়ে কাটাবো বিষণ্ন সময় 
ভালোবাসা তখন উড়ে যাবে ছাই হয়ে 
তবুও প্রসণ্ন হাসি হেসে ঠিকই 
কথা বলে যাব কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে। 

পৃথিবীর সব ফুল তখন আমার মতো 
সুখী হয়ে নিজেদের বিসর্জন ক্ষণে 
আমার কানে কানে স্বাগত জানাবে 
আমার বিসর্জনের জন্য! 


কায়সার হেলাল 

আগন্তুক 

একাধারে স্রোতের মত প্রতিটি ধাক্কা 
এই কন্ঠনালীতে, খাবলে খাবে এমন হুমকিতে 
যেন কাগজের জমিন 
যেন কালো গহ্বরের অসীম বিস্তৃতির 
অন্বেষায় অপ্রকৃতিস্থ ছায়াপথ 
জলের উন্মাদ ঢেঁকুর, জলোচ্ছ্বাস রূপি 
অক্ষরবিন্যাস এসে যায় কলমের ডগায় 
সাগরগাত্র লেহন শেষে অসুস্থ মীনরাশি 
ক্ষ্যাপাটে ভেবে আত্মগ্লানিরা ভারসাম্যহীন অনুসন্ধিৎসু 
শব্দপ্রতারণা সয়ে তবু সমুদ্রে যাই 
হয়তোবা কিছুটা সমাজ কিংবা পারিবারিক 
চাঁপড় পিঠ চুলকানোতে ব্যাস্ত 
ভাবি অথবা জানি 
শব্দ জগতে অনাকাঙ্খিত আগন্তুক 
বহির্জাগতিক কর্মযজ্ঞে বিপুলা অপারগ ! 


পত্রাপেলের গতি 

বুক খোলা আকাশ আর ছেঁড়া জমিনের শাড়ি 
রূপবতী সুখের পেয়ালায় এক চিলতে ধোঁয়া শুধু 
আহা বারি ঝরা নোনা ঘাম পত্রালীর শাখা চুঁইয়ে 
পত্রিকার গরম পরোটায় শালীনতা বজায়ে বিলীন 

(কেননা বায়ুপূর্ণ পরিবেশে নীলিমা যখন ধু্রবনীল 
সূর্য যখন হেলে পড়ে মানবিক দেয়ালে 
অথবা রাত্রির ঘনাকার বাঙ্গুলো 
যখন চাঁদোয়া জোৎস্নায় 
পিকাসোর কিউবিক আকারে প্লাবিত 
সোডিয়াম বাতিতে সিগারেট ধোঁয়া সমেত 
কালো মানুষের চেহারা দেখে যখন গলিমুখ থেকে কুকুর 
মাথা বের করে দেয় তখন আপনি নিশ্চিত 
পত্রাপেলের পতন তার পারিপাশ্বর্িক মন্ডলের 
গতির সাথে অসামঞ্জস্যশীল এবং 
আপেলের 
           গতি 
                 পত্রের 
                         গতির 
                                ব্যাস্তানুপাতিক) 


আত্মসমাচার 

কন্ঠসুধা পিপাসু অলি আমি 
বেদ নাই, নাই বিধি 
পরিধিবিহীন বৃত্তের কেন্দ্র আমি 
সত্য-মিথ্যা, শুভ-অশুভ 
শয়তান-ভগবান মিলেমিশে কেলাসিত স্ফটিক। 
প্রাণে নন্দন ছোঁয়াই, ছোঁয়াই সোনার কাঠি 
মলিন দেহের তামাবর্ণা ঘাম, পৌরুষ গন্ধ 
ব্যগ্র, আকুল বিষণ্নতা আমত্ত ডুবে গেলাসে 
ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় স্বপ্নীল বিজ্ঞাপন 
থেকে যায় বিক্ষত কুশীলব; ফুসফুসে। 

নগর বিষ্ঠা পেরোনো যুবক আমি 
গায়ে মাখা আছে নিশুতি রাতের নিশাগন্ধ 
বৃষ্টি ঝরা নিশি পেরোনো যুবক আমি 
হৃদে তোমাদের কল্পিত সত্ত্বার অমানিশি সমাবেশ অন্ধ। 

জল পেরিয়ে ফুটপাত 
ভিজে চপচপে শার্ট -জিন্স-চটি, 
পুলিশ দাবড়ানো রাজপথে 
রজনীরাজপুত্র আমি জলোচোখ হাঁটি। 

প্রগাঢ় গলা ছেঁড়া জল, নিপতিত ঘোর 
নিমীলিত আঁখি নিস্পৃহ ভোর 
রূপসুধা পিপাসু অলি আমি 
নারীতে মুগ্ধ সত্ত্বার যন্ত্রণা খোলসযুক্ত শ্লোকগাঁথা গাই 
জনপদ থেকে অলি গলি ঘুপচি বস্তিতে। 
সফেদ কাগজের পাতায় উঠে আসে বর্ণিল কল্পনা। 

নাগরিক দ্বার খোলা রেখো 
সুধাসেবী পতঙ্গদের আনাগোনা বাড়ছে বেশ 
নক্ষত্রঝরা আহত প্রেমিক আমি 
ভিক্ষে মাঙ্গতে আসব 
কড়ি নয়, ভাত নয়, পুরনো কাপড় নয় 
শব্দপাঠ নেবো দেহের, একপাশে রেখে ক্লেশ। 


মাইনুল ইসলাম 

অরণ্য 

তোমার মসৃণ চরাচর কেবলি তৃষ্ণা জাগায় 
বিভোর পরিব্রাজক নেশায় চুর। 

দূর লাইট হাউসে দাঁড় কাকের মেলা 
অপসৃয়মান দিনের আলো ঠোঁট উল্টে 
বিকট হেসে ভেঙচে গেল। 

ঝর্ণার ঢাল ভাঙে পাহাড়ের এবড়ো পাথর 
নির্ঝর জল পতন 
তাড়িত স্মৃতিভ্রষ্টের নিষ্ফল রোমন্থন- 

শঙ্খচিল আর মেছো বাঘ নখর উঁচিয়ে ক্লান্ত 
পাহাড়ি যোনির প্রলুব্ধ আয়োজন 
নিঃশঙ্ক শিকার নাক ডুবিয়ে শুকছে গন্ধ 
মহুয়ার মতো কাছে টানে- 
ঋতুবতী অরণ্যে ধুম পড়ে গেছে 

অথচ হিমঘরে সটান শুয়ে নির্বোধ শিকারি। 


কুড়িয়ে নিয়েছি যা কিছু 

      অবশেষে হারিয়ে গেল 
           যা কিছু নিয়েছি কুড়িয়ে 
                পদব্রজে দীর্ঘ ভ্রমণে। 

জারুল-কৃষ্ণচূড়ার 
          গাঢ় লাল অথবা নীল 
                 প্রজাপতির মতো পাঁপড়ি। 

নির্বাক চেয়ে থাকা 
          রাত্রির গভীরতা বাড়ে 
              স্তব্ধতায় শিশিরের পতন 
                 চাদর চাপানো 
                    আটশাট শীতের রাত । 


অবিরাম কথার মাতাল আড্ডা 
           ঠোঁটে ফিল্টার সিগারেট 
                বন্ধুর মতো পাশে থাকে । 

সামনে লঘু পায়ে থামে 
           শহরের রাত্রি শেষের ঝরা ফুল 

শেষ রাতে অহর্নিশ ব্যস্ত চৌরাস্তায় 
            কুয়াশা উড়ানো চায়ে 
                অচেনা জীবনের কথকতা। 
ঘুম ভাঙ্গা শহরে 
          আপিসের বড়কর্তা অথবা যুবকের 
                দ্রুত চলা - দীর্ঘ রাত ফুরালে। 

বিগত যৌবন স্মৃতি 
           হিঁচড়ে টেনে নেয়, না ঘুমানো আরক্ত চোখে 
                প্রাক্তন প্রেমিকার ভুলতে চাওয়া পরিচিত পথে। 

অবশেষে হারিয়ে গেল 
            যা কিছু নিয়েছি কুড়িয়ে 
                পদব্রজে দীর্ঘ ভ্রমণে। 


দিনলিপি 

দিনলিপি সমাপ্ত 
নিথর পাতায় গাঙচিল মেলে না চোখ 
কালো হরফগুলো মৃতের সারির মতো 
বিদঘুটে অন্ধকার 
মর্গের স্তব্ধতা। 

কবিতার প্রগভলতা 
চরাচরে অবিমিশ্র অদ্ভুত সারথী। 

আলো আধারির 
প্রত্ন ছায়াতে 
উদ্গত অস্পৃশ্য বিধি। 

হৃপিন্ড বিক্ষত, স্খলিত আর্তনাদ 
সমর্পিত ভাগ্যাহতের দশদিক আকীর্ণ 
স্তব অথবা মৃতু্যর অভিসন্ধি। 


ভবঘুরের বিকেল দর্শন 

কিছু পথে ঝড়ে যায় 
দুরন্ত বিকেলের স্তব্ধতা 
দিনান্তে সূর্য ঘোমটা টানে 
চুরি যাওয়া তারুণ্য মুখ দেখবে বলে। 

পাড়ার দোকানি ছোট বাক্সের ভিতর 
ঝিমুয় গা এলিয়ে নিভু চোখে 
উদ্বিগ্ন বাড়ি খিল আঁটে 
ছুটে যাওয়া রাস্তার ঘুম ভাঙে 
শহুরে যানের হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়ায়। 
বাসা বাড়িতে ঢুকে যায় দু-একটি নির্জন পথ 
গাঢ় নীল যুবতীর ওড়নী ঝুলে গলায় 
উঠতি চাঁদের মতো আধখান স্তন। 

চলতি পথে শহরে ভবঘুরে এক 
হঠাৎ থেমে ঝেড়ে ফেলে 
জুতোয় আটকে পরা পাথুরে কণা। 

সব ঠিকঠাক হিসেব কাগজে টুকে রাখা 
দোকানীর টালি খাতার তালিকা দীর্ঘ হয় 
আরো কত্তো সব হিসেব না রেখেই। 

সময় চুইয়ে পড়ে 
যুগল স্তনের ভাঁজ কিম্বা যোনি চিরে 
রক্ষা কবচ নিয়ে ছুটে চলে শহর-রাস্তা 
মহুয়া গাছটির নাভিশ্বাস-বিহ্বলতা। 

নাতিদীর্ঘ বিকেল, পাড়ার ছোট গলি 
পথিকের পায়ে পায়ে 
ছুটে পিচগলা রোদ্দুর ঝলসানো পথে। 


জহির শান্ত

বিষণ্ন বিন্দু 

প্রচন্ড খরতাপে পোড়ে কৃষকের দেহ। 
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে 
অনর্তদহনে জ্বলে কেউ কেউ! 

বিষণ্নতার শেষ বিন্দু 
চিহ্ন আঁকে মানবিক আয়নায় 
রমণীর দীর্ঘশ্বাসে কাঁপে 
দুঃসময়ের বাতাস 

আহা! সুখ গেলো কোথায়? 


খালেদ চৌধুরী 

অভিনয় 

গভীর রাতে 
হাসনা হেনার সুবাস 
যখন বেড়াতে বের'ই 
অন্ধকার শব্দের সুর 
যখন নিভৃতে ডেকে উঠে। 
জল যখন জলকে ডেকে তুলে 
যখন শিশির 
গলায় মাফলার বেঁধে 
ঝরতে শুরু করে 
তখন আমি 
ভোরের মোয়াজ্জিন কে 
ফাঁকি দিয়ে 
জেগে উঠি। 
দু' চোখ বুঝে 
অভিনয় করি 
তোমায় স্বপ্নের। 
আর তুমি 
ভোরের আলোয় আমায় দেখে 
দু'হাতে লুকাও নিজেকে। 


সৈয়দ আহমাদ তারেক 
অদিতি ফাল্গুনী, কল্যানীয়া 

অন্য কাঁটা 

তুমি চুল খুলে মাথার কাঁটা রেখে দিলেই 
আমি সেটা নিয়ে এলাম। 
আমি কেন বুকের কাছে রেখে দিলাম। 

এমনও তো পারতো হতে 
অন্য কেউ নিয়ে যেতো, গোপন আলোয় 
বিলি হতো মাথার কাঁটা, 
অন্য কেউ ম্লান হতো। 

তুমি তখন হৃদয় খুলে উঠিয়ে আনো অন্য কাঁটা। 

গোলাপ কাঁটা? মাথার কাঁটা ফেলে দিয়ে 
আমি তখোন 
অন্য কাঁটা বুকে নিয়ে চলে এলাম


মাহমুদ কচি 
কবিতালাপ 

হঠাৎ অস্থির হয়ে গেল জোনাকির দল 
মুমূর্ষু ডানা মেলে চকিত উড়ে গেল 
থামলো বললো না 
জোনাকিরা দল বেঁধে মুমূর্ষু না বোধক 
ধ্বনি দিয়ে গেল 

এবার সমস্ত স্মৃতি উপচে পড়ে যেন 
আকাশ গুছিয়ে নিল নিজেকে 
চুপসে পড়ে জল চোখ ফুলে ওঠে 
উড়ে গেল জমানো স্মৃতি 
এরপর হেঁটে হেঁটে জোনাকিরা কিছুদূর এগিয়ে গেল। 


_________________________________________________
গল্প
_________________________________________________

খানিকটা পাতার ধোঁয়ায় 
কায়সার হেলাল 

প্রথমেই আমরা ধরে নিব একটি উল্লম্ব বাঁশ। এর তিনটি অংশের সাযুয্যের মধ্যে মূল বাঁশটাই গ্রাহ্য যার নিম্নভাগ ছুঁচোলু পেরেকে ঠাসা, উর্ধভাগ অসম্ভব পিচ্ছিল, মধ্যভাগ উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন। ...বাঁশটির অসাযুয্যতার মাঝে এসবই দৃষ্টি আকর্ষন করে। এবার অলোচ্য বিষয়ে অনুপ্রবেশ... 

আমাদের আলোচ্য বিষয় প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য দু'প্রকার নৃত্য যা একই সাথে দু'মুখো এবং শতমুখো। মধ্যভাগের অবজেক্ট হলেন আদতে দৃশ্যমান নৃত্যরত প্রকল্পভোগীরা যারা মধ্যপন্থি ভাবলেশহীন। এরা স্বার্থের প্রয়োজনে মধ্যভাগ ব্যাতিত অন্য উভয় প্রকার বৈশিষ্ট্যধারী বাঁশরীয় অবজেক্টকে অকুন্ঠচিত্তে স্ববিরোধপূর্ণ ও স্বার্থবিরোধী কথাও বলতে পারবেন। তাছাড়া স্বাভাবিকভাবে তারা ছুঁচোলু অংশকে বলবেন, "ওমক জায়গায় আমার দশবিঘা জমি আছে "। অথচ একই সাথে পিচ্ছিল অংশকে এরা বলবেন, - 'স্যার যেভাবে বেচেঁ থাকি তা মানুষ নয় পশুর মত বাঁচার শামিল!'

আমাদের আলোচ্য বিষয় নিয়েই বলছি নৃত্যের কথা - যার দুমুখো উদাহরণ আপনারা দেখলেন। এবার আমাদের দৃষ্টি যাবে শতমুখো নৃত্যের দিকে। শতমুখী নৃত্যের জন্যে প্রয়োজনীয় শাড়ি যেমন রাষ্ট্র, মেকাপ যেমন আমলা, ঘুংঘুর যেমন এন.জি.ও, মঞ্চ যেমন কর্পোরেট বিশ্বায়িত ভূমি এবং পুরষ্কার হিসেবে বহুরূপী পণ্যশালার বহুজাতের পণ্যসহ অন্যান্য উপকরন লাগবে। উপস্থাপনায় অবশ্যই কাঁদা-মাটির ক্ষেত পেরোনো একজন মধ্যবয়স্ক যিনি মাইক্রোফোন নিয়ে ফসলের সজীব সাক্ষাৎকার নিতে অভ্যস্থ তাকে লাগবে। মঞ্চে মঞ্চায়মান নৃত্যের মুদ্রা বহুজাতে বিভক্ত বলে বাঁশের মধ্যাংশের দৃষ্টিসীমা অথবা কখনও কখনও বিবেক প্রশ্নের বাইরে অবস্থান করবে। নাঁচের মুদ্রা সংকট থাকতে হবে যেন প্রয়োজনে সারা বসুন্ধরা চষে বেড়ানো যায় এবং উক্ত সংকট মোচনের জন্যে নির্দেশিত পুরষ্কার যা অহর্নিশি নর্তক-নর্তকীদের তথা বিশেষে বাঁশের মধ্যাংশের অবজেক্টদেরকে খুঁজে বেড়াবে এবং প্রয়োজন বিশেষে বাঁশের উর্ধাংশ ও নিম্নাংশ অত্যন্ত সূচারুরুপে শাড়ি মেকাপসহ অন্যান্য প্রসাধন তাদের অঙ্গিভূত করবে। নর্তক নর্তকীদেরকে পরিচালনাক্রমে বিভিন্নস্তরে বিভিন্ন নির্দেশক যেমন কখনো শাড়ি, কখনো কখনো ঘুংঘুর সহ অনেক সুশীল নাগরিকেরা থাকতে পারবেন এবং আপনারা ক্রমেই বুঝতে পারছেন এদের অবস্থান বাঁশের উর্ধাংশে অর্থাৎ এরা বাঁশের উর্ধাংশের অবজেক্ট। 

নির্দেশনার জন্যে অবশ্যই থাকবে নীলস্ক্রীপ্ট, যার কৌশলী সমীকরনে নর্তক নর্তকীরা ক্রমাগত তাদের নিজেদের অজান্তে কিংবা আংশিক সজান্তে নেচে যাবেন। 

এসবের সবই মঞ্চের প্রয়োজনে মঞ্চ নিজেই সাজাবে এবং যে পুরষ্কারের ঘোষণা তারা দিয়েছিলেন কিংবা দিবেন তা হতে পারে শিশ্নাকার কোন ক্রেস্ট যার বোর পয়েন্ট টুটু থেকে সীমাহীন পর্যন্ত, হতে পারে নগদ টাকা অথবা হতে পারে স্বল্পসুদী ঋন সহ ইত্যাদি। মাঝে মাঝে মঞ্চের আড়ালে কিংবা কিঞ্চিৎ সমন্বয়ে নির্দেশিত কৌশল বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে অত্যন্ত সূচারুরূপে সম্পাদন করবেন যাদের ছাড়পত্রে- প্রথম স্বাক্ষর মঞ্চের, দ্বিতীয় স্বাক্ষর সুশীল নাগরিকদের তৃতীয় স্বাক্ষর হিসেবে শাড়ির নাম থাকবে অনুমোদনের প্রয়োজনে। 

আলোচনার শেষ প্রান্তে আমরা প্রায় এসে গেছি, শতমুখো নৃত্যের উদাহরণ আপনারা দেখলেন, হ্যাঁ এইযে আপনি, দয়া করে বিভ্রান্ত হবেন না এবং পাশের জনকে মনযোগী হবার সুযোগ দিন। অনুষ্ঠান সূচী দেখুন, "বহুজাতিক ইন্টারন্যাশনাল পর্যবেক্ষণ টিম" এর অর্থায়নে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে বিলাসবহুল ভোজনপর্ব অপেক্ষা করছে আপনার জন্য "বমিনোজ পিৎজা"- এর সৌজন্যে। 

হ্যাঁ যা বলছিলাম, উপসংহারে বলব, উপযুক্ত উদাহরণ ছাড়াও অন্যসকল উদাহরণরা সবাই বাঁশের মধ্যভাগের নর্তক-নর্তকী বা প্রকল্পভোগীদেরকে ক্রমান্বয়ে বিভ্রান্তির ঘোরে নিমজ্জিত রাখবে। যাকে বলা যেতে পারে অন্ধের হাতি দর্শন। যেমন অন্য একটি নৃত্যোদাহরণ, যা ইতোমধ্যে বেশ প্রশংসিত এবং প্রচারিত, মুক্ত বসনা নৃত্যের কথা বলছি, যার মুদ্রা হবে এমন- অর্থনৈতিক আবহে অন্তর্জাত সংগীত গলা টিপে মারবে প্রান্তীয় স্থপনা এবং মাইলফলক। বিভিন্ন কাগুজে এবং ব্রডকাস্টিং মিডিয়ায় আলোচিত নৃত্য সমূহ সগৌরবে চলছে, দেখার নিমন্ত্রণ, আর সামাজিক কিংবা অপারিবারিক এসব নৃত্যালোচনার পর আমরা উপযুক্ত অর্থলগ্নীকারী সংস্থার সহযোগিতায় অবশ্যই আয়োজন করব পারিবারিক নৃত্যালোচনা সভা এবং সবার নিকট কুইজ প্রশ্ন যা আপনাকে নর্তক বা নর্তকী করে তোলে প্রায়শই, অর্থাৎ আপনার সেল থেকে পাঠিয়েদিন এম.এল.এম নম্বরে- 

- মধ্যভাগের নর্তক নর্তকীদের আসল পরিচয় কি? 
- ছুঁচোলু পেরেকঠাসা অংশের এবং পিচ্ছিল অংশের অবজেক্ট কারা? 
- মূলত প্রশ্ন এই "বংশীটা আদতে কেগো বাজায়"? 

সবাইকে একটি দীর্ঘ কাবিতা সুড়ঙ্গ ঘোরে নিপতিত করে শেষ করছি "দ্বিতীয় সকাল" পত্রিকা আয়োজিত সন্দেহ বাতিকগ্রস্থদের নিয়ে প্রতিকার ও প্রতিরোধ মূলক আলোচনা সভা। 


'খানিকটা পাতার ধোঁয়ায়'

তিন. এগার. দুহাজার সাত 
রাত - ১১ , চারদিক কোলাহল 
বাইপাস সড়কের ম্লান আলো 
আছড়ে পড়ে চায়ের কাপে 
তুমুল কথোপকথন, বাকস্ফুরণ 
পথের বালুঝড়, জনারণ্য এপাশ ওপাশ 
বাস - সাঁই সাঁই ভোঁ... 
ট্রাক - হাইড্রোলিক হর্ণ, ঘোঁৎ ঘোঁৎ... 
কার্গো, ভারী যান আর 
অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ - সাইরেন... 

সাবধানে কাঁচি চালান মহাশয় 
গুড়ো করে অধিক, একপেটি তামাক মেশান 
আস্ত তিনটে চাই 
ফলস্ এনেছেন তো? 
চারতলা, গেট-লক্ড 
পাতাগুলো কাগজের পাঁকে ধোঁয়া হয়ে যায় 
ফুস ফুস অ্যাম্ফিটামিন... 
মগজের ঝিম 
একশ আশি, প্রতিমিনিট, হৃদকম্পন 
ধুক্-ধুক্, পুক্-পুক 
শিরা-উপশিরায় ক্রমাগত রক্ত সঞ্চালন 
বোধিজগতের বিমূর্ত দৃশ্যায়ন 
করোটির নলচেতে রক্তের ধার 
নৃত্যপর, টিপ টিপ, ব্যথায় কাতর 
ভীতির সঞ্চার, গায়েবী আত্তয়াজ 
খুক খুক পুনরায়ন 
শুকনো গলা জল চায়, মরু অভিযাত্রীর 
রিরি কাঁপন, দোল ঘোর, শরীর... 
আওয়াজ বিভ্রান্তি উৎসখুঁজে 
যেন মৃত্যু থেকে দুরে একহাত 
গড়গড় বাচালতা, এই-ই শেষবার... 
চিন্তা করুন বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী আপনি এক 
একা, সুস্থ শুভ্রতায় ভাসছেন, 
আহা! আবার উঠছেন কেন...জল... 
ইন্দ্রজালিকার রক্তাক্ত দহন, হৃৎপিন্ডের 
অনিশ্চিত আশু বিস্ফোরণ

খানিকটা পাতার ধোঁয়ায়... 
এবার লেবু নিন্ 
সাবধান মৃনাল, লাল রংয়ে রাঙ্গাবেন না ওটা 
মুখে ঢালুন, চোখে পড়ছে কেন... জল... 
আহ্, হাঁটুন, লেফ্ট-রাইট 
একশ, দুশ, তিনশ 
সাঁতার-ডুব-সাতার 
মগজের ঝিম 
তীক্ষ ফলা বেশ 
পুনরায় হিম, জল ঢালুন 
দশ মিনিটের আবার বিশ মিনিট... 
... জল-শাওয়ার-জল... 
বংশীর ধ্বনি 
কোলাহল চারদিক 
নৃত্যপর, ঢিপ-ঢিপ,ঝিঁ-ঝিঁ 
খানিকটা পাতার ধোঁয়ায়... 
অনুধ্যান ক্ষমিতায় অরুন্ধতি তিমির 
শুক্লপক্ষের অবচেতন ঘুম 
আয় ঘুম, যাই ঘুম, ঘু ...ম...বাড়ি... 
খানিকটা পাতার ধোঁয়ায় ... 

_________________________________________________

আদিম ও আদিমতা 
মোস্তফা সরওয়ার খান 

'ইউ ক্যান চেঞ্জ ট্রাইব, ট্রাইব ক্যান চেঞ্জ ইউ'- বাক্যটা শুনে মনে গেঁথে গিয়েছিল। সারাদিন ধরে কথাটা কতবার যে দু' ঠোঁটের বিড়বিড় উচ্চারণে উচ্চারিত হল তার হিসেব রইল না। এমন সে অনেকবার করেছে। কোন কবিতার পঙক্তি,গানের কলি, নাটকের সংলাপ অনেক অনেকবার...। মাঝে একবার আঁকতে বসে রাধা বিরহের পদগুলো দু' ঠোঁটের বাজনাতে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষ্ণের ওপর ত্যাক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছেল। রাধা কৃষ্ণের জীবদ্দশায় বৃন্দাবন আরো নিবিড় ছিল। কদম্ব শাখা থেকে ঝুলে থাকা রাধার শাড়ির প্রান্তে প্রান্তে মাখামাখি হয়ে যেতো কদম্ব ঘ্রাণ। 

অরণ্য তার নিবিড়তা মেলে ধরল। সংরক্ষিত বনের ভেতর শতফুট ওপর থেকে যে ঝরণা বয়ে নামছে সেই উৎসে পৌঁছাতে চড়াই-উৎরাই কম অতিক্রম করতে হবে না। বর্ষার সময় এ মাটি কোল্ড ক্রিমের মত হয়ে যায় তাই ওঠা দুঃসাধ্য। বর্ষা বিদায় নিয়েছে মাসখানেক আগে। সুতরাং শরতের নীল আকাশ ভেঙে নেমে আসা ময়ুর পাখার রঙা রোদ্দুরে শারদীয় আভা পাহাড় গাত্রে ফোটে কাশের শরীরে লাগে- 'তোর তো নদীর পাড়ে পলি নিয়ে পড়ে থাকার কথা'। কিন্তু নদী ও ঝরণার প্রভেদ হয়তো কাশ জানে না সে ফুলের সমাবেশ ঘটায় অকৃত্রিমভাবে। 

চোখে ফুল-পাখি রোদ্দুর কোনটাই নয়। এখন থাকবে এলিয়টীয় ভয়েস্টল্যান্ড। ক্যাকটাস থোকায় থোকায় চারধারে, বিবর্ণতা ভীষণ বিবর্ণতা যেখানে নিজের অস্তিত্বকে টেনে নামাতে হয়। অবলম্বনহীন জীবনে রোমান্টিসিজম! মানুষের মনের তিন অংশ ফেইথ, ফ্যানটাসি, আর ফ্যাগমেন্টেডনেস- বিশ্বাস,উদ্ভট কল্পনা আর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন চিন্তা। সবুজে বিশ্বাস নেই তাই নেই ধারাবাহিকতা। ছবিতে ফোটাবে সবুজ মাঝে কড়া লালরাঙা আকাশ, আকাশ থেকে যেন রক্তবৃষ্টি নামছে। সবকিছু লাল করে দিচ্ছে। কারো কপালে ফোটা, সিঁদূর এই লাল! উদ্ভট কল্পনা ! 

মেয়েটা ঝারির জলে নেয়ে ওঠে, পরিধেয়তে জলের উৎসব, বোঁচা নাক, তামাটে চামড়া বলে দিচ্ছে আধুনিকতা নয় ওর দরকার কুযেনি-সবুজ ঘাগড়া। সবুজ ঘাগড়া দুলিয়ে যদি সে ঝারির জলের অলঙ্কার কালো পাথর গুলোর উপর স্বচ্ছ পা ফেলে যেতো তাহলে ক্ষুদে মাছগুলোর মত সেও দেখে সুখ পেত। মেয়েটির নাম রিলসা (নামটি সে দিয়েছে)। সবুজ ঘাগড়ার ওপর রক্তবর্ণ আকাশ। ওর আধুনিক সাজ একে একে বিনষ্ট করে ওর বিশ্বাসকে আদিমতায় সমর্পণ করেই শেষ হবে চরিত্র নির্মাণ। রিলসা হাসলো। ওর হাসিটুকু চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল বনপাহাড়ের শেষ বিকেলের রোদ্দুরের মত। সে ভাবলো হয়তো রিলসার হাসিটুকু নিয়ে কেঁপে কেঁপে ডেকে গেল বার্ডস অব প্যারাডাইস। 

কত উঁচুতে ঐ ঝরণা শীর্ষ? পথে পড়ল কয়েকটা গোক্ষুরো সাপের খোলস। একটা বেজি সাপের খোলস মুখে ধরে লড়াই অভিনয় করে যাচ্ছে। বেশ সাবধানে হাতের লাঠিতে ভর করে উঠতে হচ্ছে। শব্দ শুনে ওটা পালালো। কোথায় যেন পড়েছিল সাপের মধ্যে আছে উৎপাদনশীলতা আর সৃষ্টি। কারো বিশ্বাসে সে শয়তান স্বর্গচু্যতির কারণ। সে সাবধানতা অবলম্বন করল। পথে হয়তো সাক্ষাৎ পাবে এমন সতর্কতা লাল আকাশের বুকে রয়েছে। আকাশের গায়ে বিষধর সাপের চিত্র এঁকে বেঁকে নদী কখনো বিশালতায় সমুদ্র। 

রিলসা এখন চা বাগানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ইট বিছানো সরুপথে গির্জাঘরে সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার জন্য পৌছেঁ গেছে। সেখানে কিছুক্ষণ পর উচ্চারিত হবে ধাতব ঢং ঢং শব্দ। একটা কালো কুকুরছানা ভুঁক ভুঁক শব্দ তুলে লোকজনকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। চায়ের আড্ডায় আজ সন্ধ্যার আলোচনার বিষয় 'আকাশের রঙ রক্তবর্ণ'। রিলসার মাথায় স্কার্ফ তাতে জলের দাগ। গির্জার শীর্ষে থাকা ক্রশটার প্রান্ত ছুঁয়ে পশ্চিমের শেষ রশ্মির কোন একটা সাপের শরীরের মত পিচ্ছিল বলেই ধরে রাখতে পারছে না রিলসার স্কার্ফকে তাই চুল তার এখনো ভেজা। সেও পারছেনা খুব সহজে শীর্ষে পৌঁছাতে এবং ঝরনার উৎস খুঁজতে। ক্লান্তি আর অভিজ্ঞতার অভাব টের পায় পদে পদে। 

চলছে দু'পায়ে ভীষণ ক্লান্তি- পৃথিবীর গভীরতর অসুখ টের পাওয়া যায়। যখন দীর্ঘ গর্ভযন্ত্রণা কাটিয়ে সন্ত্রস্ত শহরে আবিস্কৃত হয় সত্ত্বা। সে কী ছুটছে কেবলই মুক্তির জন্য। ক্ষতবিক্ষত করছে নিজেকে। পেছনের সময় পাংশুটে ও স্থবিরতাকে সে মাছির মত তাড়াচ্ছে। ক্ষুধার্ত বর্তমান অতীতের পুরোটা ভক্ষণ করার ক্ষমতা রাখে না। 

আধভাঙ্গা দেয়ালের ওপর সকালের মিষ্টি কুমড়োরঙ রোদ নিজের লতায় পাতায় আধিপত্য বিস্তার করতে ব্যস্ত। আধ পাকা ঘরের পলেস্তারাহীন মেঝে থেকে ধূসর গন্ধ ঘরের সবটুকু দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে। এরই মাঝ থেকে শেখ ফরিদ বেরিয়ে আসে জগৎ সংসারে কোথাও যদি মুক্তি আসে এই আশায়। কুয়োর পাড়ে শ্যাওলা আর নোংরার মাঝে কেঁচোর শরীরের উর্বরতা পেয়ে ছোটবোন আলেয়ার সন্ধ্যা মালতিও ফোটে। কিন্তু দিনে দু'একবার যা খাবার জোটে তাও শাকান্ন। বাবার প্রতি মায়ের আস্থাটা কুয়োর ভেতর থাকলেই বোঝা যায় স্বচ্ছ এবং টলটলে- আমাদের সুদিন আসবেই। 

একটু ভদ্র জীবনের খোঁজে গেঁয়ো শিল্পী শেখ আফজাল শেখ ফরিদদের নিয়ে শহরে আসেন। প্রথম প্রথম আশা ছিল শহরে তার বিরাট কিছু একটা হয়ে যাবে। এমন কিছুতো নয়ই ছিঁটে ফোটা বৃষ্টির মতও নয়। সুখ প্লাবনের কথা দুঃস্বপ্ন। রিক্সা অটোর পেছনে যতসব ছবি আঁকার মত কাজে জড়িয়ে নিজের জীবনের বিভীষিকা ঢাকতে পেনসিল কাটার দিয়ে একদিন শূন্যে উঠে গেলে। শূন্যে উঠে পূর্ণ হলেন কি-না জানা গেল না। জানা গেল এটুকুই, জীবন ধারণের জন্য শেখ ফরিদের বা কোন কিছুই অবশেষ রেখে যান নি। পিতার স্বপ্নপূরণের জন্য পাহাড়ী জনপদে আঁকিয়ে ফরিদ নিজেকে খুঁজতে চায় ফিরে পেতে চায় শীর্ষ-ঝরণার খোঁজে সে কেবলই একা ভীষণ একা। এ জীবনে যা কিছু প্রাপ্তি তাতে ম্লান হাসিতে শান্তনা খুঁজেতে গিয়ে খুব ছোট হয়ে যায় চারপাশ। গন্ডিবদ্ধ জীবনে এক একটা সকাল কাশফুল হয়না, খোলস ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসাও হয় না, পড়ে থাকতে হয় শুকনো বালির স্তরে স্তরে। লু হাওয়ায় উড়তে উড়তে থমকে দাঁড়িয়ে দেখে মায়ের মুখে ঘামের স্তরে স্তরে কোন স্বপ্ন উঁকি দেয়। মা নিজের কষ্টের ধাক্কা আগামীর স্বপ্নে উড়িয়ে দেন। মায়ের মুখ আকাঁউকি হয়ে যায় চাঁদ আর রাত মেশানো পাহাড়ী জনপদে। রাত গভীর হয়ে আসে। একটা তক্ষক ডেকে ওঠে। ঝরণার অবিশ্রান্ত শব্দের মধ্যে একটা পাখির কিরি কিরি অতল পায়। 

শীর্ষে পৌঁছে শেখ ফরিদ ক্ষুধিত পাষাণ বক্ষে চেপে মেহের আলির চিৎকার শোনে 'তফাৎ যাও তফাৎ যাও'- মেহের আলী তফাৎ গেলেও কেউতো পাষাণে প্রাণ খুঁজে পায়। পাষাণের বুকে নূপুর ধ্বনিতে যে ঝরণা নিজেকে চিনে নিয়ে নেচে গেয়ে নেমে যাচ্ছে তার সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক গড়ে নিয়ে সময় ছুঁড়ে দিচ্ছে নিজেকে। 

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাস্কর মুকম বিবানওয়ার জিম্বাবুয়ের রাস্তায় দুটো রুটি পাওয়ার ইচ্ছেয় ডিলমাইট রকের মধ্য থেকে প্রাণকে বের করে আনার চেষ্টা চালান ছেনি হাতুড়ির বিপ্লবে এবং চিৎকার করে সবাইকে জানান- 'ডিড আই নট লিবারেট দেম ফ্রম দ্য রক স্লিপ'। ক্ষুধা নামক চিরকালীন ব্যধিটি থেকে তার মুক্তি নেই কারণ বিশ্বাসের 'বেঙ্গা' মূর্তি সব রোগ নিরাময়ে কাজ করলেও শরীর থেকে ক্ষুধাকে মুক্তি দিতে অক্ষম। 

পাষাণের বুকে ঝরণা নামে, পাহাড়ের অশান্তি ধুয়ে যায়। হঠাৎ নূপুর ধ্বনির মত রিলসার দীপ্ত পদক্ষেপ চমকে নেমে আসে- জ্যোৎস্নার দ্রুত সঞ্চালনে রূপালি ফিতায় বাঁধা যেন ওর জীবন। গোপনে থাকা কিছু বাসনাকে লালন করে খুব বেশী চাওয়া পাওয়া হয়তো তার নেই। সেগুলো ঘন্টা ধ্বনির মতো মাঝে মাঝে বেজে ওঠে হৃদয়ের গোপন কন্দরে। চা বাগানে শ্রম ও ঘামের চিহ্নগুলো হয়তো শতাব্দী প্রাচীন চা গাছগুলোর গোড়ায় শিশির হয়ে জমে থাকে। মায়ের মুখেও শ্রমের ঘাম আর পাহাড়ের বুকের ঘামে জন্ম হয় ঝরণার। এই ঝরণার উৎসে পৌঁছে এক সময় আকাশ পাওয়ার বাসনায় কেউ যেন বিশাল শূন্যতাকে দু'হাতে ধরতে চায়। শূন্যতা আর নিঃসঙ্গতা এক সুতোয় বাঁধা। 

জোৎস্না চারধারকে নিঃশ্চুপ করিয়ে দেয় ঘুম পড়িয়ে দেয়। কিন্তু শেখ ফরিদের কোন ঘুম নেই। সে তার ক্যানভাসে কেবলই শূণ্যতা ও নিঃসঙ্গতাকে আবিষ্কার করে। পাহাড়ের ঘাম, শ্রমের ঘাম, মায়ের ঘাম সব মিশিয়ে আদিমতাকে মুক্তি দেবে। যে মুক্তির অপেক্ষায় পিতা শেখ আফজাল রঙতুলি হাতে তুলে নিয়েছিলেন। 

ছোট বেলায় শেখ ফরিদ খোলা ছাদে একটা বাদামি বেড়ালকে দেখতো একদম চুপচাপ বসে। হঠাৎ সেই বেড়ালটিকে মনে পড়ল। মনে পড়ল এটি যেন তারই নিঃসঙ্গতার চূড়ান্ত রূপ। অসীম শূন্যতা দূর করার জন্য ঝরণার শরীরে পা রেখে শরীর মনে প্রশান্তি ছড়িয়েও নিঃসঙ্গতাকে দূর করা কী যায়? শেখ ফরিদ অনুভব করে শরীর ও মনের মধ্যে কোন একটা আতঙ্ক কাঁটা দিয়ে ওঠে, গজিয়ে দিতে চায় আতঙ্কিত পাখা, পাখায় অসম্ভব সাদা পালকগুলো লাল হয়ে যাচ্ছে। 

যে শহর থেকে শেখ ফরিদ এসেছে সেখানে কঠিন জোয়াল কাঁধে নিয়ে দানব ষাঁড় বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আতঙ্ক মেশানো থমথমে ভাব। আতঙ্ক ভীষণ থকথকে কাঁদার মত; একবার কোথাও পতিত হলে তা থেকে মুক্তি মেলে না সহজে। এখানেও থকথকে কাঁদার মধ্যে আটকে মরে আছে কতক নিষ্পাপ পাখি। সে এদের সাদা পালক খুলে নেয় শরীর থেকে। এ পালক সে লেপ্টে রাখবে হৃদয়ে। পালকে মুড়ে হৃদয় সাঁজবে অপরূপ সাঁজে। 

ক্যানভাসের সবকিছু শেখ ফরিদের আবিষ্কৃত। ঝরণার শব্দ, রোদের কণায় আঁকা পাহাড়ী মেয়ে রিলসা, মায়ের স্বপ্ন বুদবুদ হয়ে জলের দাগ রেখে যায় জানালার কাঁচে। জীবনের জানালাগুলো উন্মুক্ত অবারিত। ছোট্ট করে একটা জানালা আঁকে স্বপ্নের ঘরের জন্য। আর ঐ যে চাঁদ সে উঠেছে দেয়াল ঘেঁষে যার রঙে আছে নিজের অনেক না বলা কথা। মানুষের জীবনের এতটুকু পরিসরে সব বলে বুঝিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ করা যায় না, তাই সব মানুষই কিছু অসম্পূর্ণতা নিয়ে বিদায় নেয়। একজন শিল্পীও মানুষ, তিনিও সারাজীবনে কতটা তুলে ধরতে পারেন ক্যানভাসে? 

দু'দিন পর ফিরে এসেছে। একটা ঘোরের মধ্যে শেখ ফরিদ এতগুলো ঘণ্টা পার করেছে। ঝরণার ছবি আঁকতে গিয়ে সে হারিয়ে গেছে এমন প্রচার তার বন্ধুদের। ওরা হন্যে হয়ে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত, আর সে সময় ওরা আবিষ্কার করল একটা জন্তুর মতন কেউ- শরীরের সবখানে চিতা বাঘের শরীরে থাকা গোলগোল চিহ্ন। মাথায় পাখির সাদা রঙ পালক, মুখে কালির লম্বা লম্বা আঁক, কিন্তু হাতের ক্যানভাসটি শেখ ফরিদের চিহ্ন প্রমাণ করলেও চোখের বন্যতার আগুন সবাইকে ভীত করে। ওরা এক সময় ওকে ধাক্কা দিয়ে কুন্ড'র মধ্যে ফেলে দেয় পাপ মোচনের জন্য। ওরা সভ্য, তাই পাপের হিসেব কষে, কিন্তু বন্যতায় সে হিসেব কোথায়? হয়তো পুনরায় শেখ ফরিদ বন্ধুদের চোখে সভ্য হয়েছে, কিন্তু মুছে গেছে কী তার বন্য স্বপ্নেরা? 

_________________________________________________
মুক্তগদ্য
_________________________________________________

উন্মার্জ এই গল্পটা 
পিয়াস মজিদ 

১. 
আজ এই নগ্ন-নির্জন রাতে শুনছি ঝিঁঝিঁর গান। আর বের করতে চাইছি নক্ষত্রক্ষত। শুশ্রুষা নয় বরং যেন প্রিয় সুন্দরের দূর্বলতা আবিষ্কার করেই আমার অপার আনন্দ। না আনন্দ না বিষাদ। এখন আসলে তীব্র ভাবে 'সাঝঁবাতির রূপকথা'র সে শিল্পী হতে ইচ্ছে জাগছে যে তার চিত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারত ঘাসের সাথে পৃথিবীর সাথে এমনকি পৃথিবীর বাইরের তারাদের সাথে। 

আচ্ছা আমার হলে, চায়ের দোকানে, ভাতের টেবিলে, বাসে, লাইব্রেরিতে এত খলমুখের, বিশুদ্ধ মুখোশের ভিড় কেন? না, একটু রুবী আপার সাথে দেখা হলে মানুষের প্রতি পুনরায় বিশ্বাসী হওয়া যেত। চূড়ান্ত শত্রুর প্রতি ঘৃণাও কেমন নমিত শান্তভাবে প্রকাশ করেন রুবী আপা। 

২.
হে দেরাজ, আশ্চর্য শহর, 
আমার সকল খাত লুকানো তোমাতে, 
তুমি খুলে যাও ধীরে আরও একবার, 
আজ আমি তোমার গভীরে প্রবেশ করতে চাই 
(শান্তনু চৌধুরী; সহজ সরল দোঁহা) 

হ্যাঁ প্রবেশ শুধু প্রবেশ। এছাড়া কিছু না। এই আছি, এই অন্ত। ভূতভবিষ্যবর্তমান। আলো ও তমস। প্রবেশেই অগি্ন, প্রবেশেই জলের প্রপাত। পাহাড় ও সমুদ্রের শুরু এখানে, এখানেই চূড়ান্ত নির্বাণ। আমি তো তোমাতেই প্রবিষ্ট হবই কিন্তু নারী তোমার প্রবেশ কোথায়? জানিনা ব্রিটি ফ্রাইডেন, মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট, রোকেয়া কিংবা তসলিমা এ বিষয়ে কী মত পোষণ করেন। যাক সব চুলোয়। চলো লিঙ্গ ভুলে আমি ও তুমি প্রবিষ্ট হই আশ্চর্য এক শহরে। 

৩. 
আজকাল এই গল্পের চরিত্রটা সব ভুলে যাচ্ছে। হতচ্ছাড়ার যাবতীয় স্মৃতি গুলিয়ে গেছে। অনেকের নামই সে আর সঠিক মনে করতে পারেনা। সামনে বহু পরিচিত কাউকে দেখল কিন্তু তাকে এই বিস্মৃতিহেতু সম্বোধন করতে পারল না। কারো সাথে এ জন্যে সম্পর্কও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যাক সব কিছুই তো নষ্টদের অধিকারে গেছে। না-তার কিন্তু মেলা পূর্বের ঘটনাও পরম্পরা অনুযায়ী মনে যাকত। আচ্ছা- বিট বংশীয় কোন কবির নাকি মাতৃগর্ভে থাকার স্মৃতিও অবিকল মনে ছিল। এও সম্ভব! সম্ভব নাই বা কেন? সব সম্ভব স্মৃতি, বিস্মৃতি সব। দূর হ স্মৃতি, দূর হ সত্তা, দূর হ ভবিষ্যত। সময়মুক্ত শূন্যতাই হোক সার। জয়ী হও আমার সব বিস্মৃতিপ্রবণ কোষ। 

৪. 
সন্দীপনে আরেকটু ডুব দিতে হবে। বুঝে নেয়া যাবে আলোহারা জনমের তাৎপর্য। অসহ্য ঢাকা। বেলাল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে চলি্লশ-পঞ্চাশের কলকাতার ঢুকে গেলে মনটা তাজা হয়ে উঠত। কিন্তু পল্টন যাবার চেয়ে রোমান হলিডেতে যাই। দেখি আড্রে হেপর্বানকে সুচিত্রা সেন লাগে নাকি? না সুচিত্রা সেনই ফলো করত হেপবার্নকে। হেপবার্ন সচিত্রা। সুচিত্রা হেপবার্ন। সুচিত্রা সুচিত্রা। হেপবার্ন হেপবার্ন। 

৫. 
এমন উন্মার্জকথন। এখানেই শেষ হতে পারে গল্পটা। সন্ধ্যাতীরে যখন কিছু সিন্ধুকাকের আনাগোনা। আজ আবার সেই গর্দভ অধ্যাপকটার ক্লাস। মাথায় মজনু ভাইয়ের বিদেশ চলে যাবার খবরটা ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার। গাড়ল মাষ্টার আর প্রিয়জন মিলেমিশে এক কোলাজ তৈরি করে ফেলেছে যেন। বেলা হয়ে আসছে ওদিকে। সকালের সব পাষান ফুলের ডাক ফুরোবে এখন।



_________________________________________________
বই আলোচনা
_________________________________________________

স্মৃতিহীন অচিন আঁধারঃ এক আলোকিত উত্তরণ 
লায়লা ফেরদৌস ইতু 

বাংলা কবিতার ইতিহাসের পটভূমিকায় রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস, বাঙালী জাতির ইতিহাস। স্বাধীনতার পর থেকে তৎকালীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে স্বাধীন ধনতান্ত্রিক বিকাশের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। যুদ্ধ বিক্ষুব্ধতার পর নতুন দেশ নির্মাণের নিরিখে তখন শুরু হয়েছিল আপাত অর্থনৈতিক মানের ক্রমাবনতি, খাদ্যাভাব, শ্রমিক অসন্তোষ ইত্যাদি। অন্যদিকে ৭৫-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন বিশেষ করে আশির দশকে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল ঝঞ্চামুখর এবং ঘূর্ণাবর্তে চঞ্চল। অথচ এ সংকুল, বন্ধুর যাত্রাপথে বোধ ও মনীষার প্রাজ্ঞ জানালা রূপে এক মহাজাগতিক ব্যপ্তি নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছিলেন আশির দশকের কবিগণ তাদের কবিতা নিয়ে। দশক বিচারে আতাউর রহমান মিলাদ ও সেই আশির দশক ভুক্ত। যদিও তাঁর অনুভব ও উপলব্ধির অন্তহীন আবিষ্কার, উন্মুখ জীবন কাতরতা, কবিতার শরীরে ডানা হয়ে মহাকাশের আকাশে আজ পর্যন্ত উড়ছেই। তাঁর "স্মৃতিহীন অচিন আঁধার" কাব্যগ্রন্থটি সেই চলমান কাব্য প্রবাহে এক আলোকিত উত্তরণ। এ গ্রন্থের সব গুলো কবিতাই টানা গদ্যে লেখা, যার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে আমাদের অতি চেনা বিষয়, আমাদের স্বপ্নহীন নিদারুণ কঠিন জীবন যাপনের বিষয়। দৃষ্টি দিই গ্রন্থের প্রথম কবিতা "পৃথিবীর মর্গে প্রতিদিন " এ, "দু:সময়ের আঁধার গিলে খায় নিজের ছায়া। আমি হারাতে থাকি/শেষ সূর্যের মত মলিন ধূলোয়। আমি মিলিত হতে থাকি অদ্ভূত/বিন্দুতে। আমার উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম নির্বিকার। চারপাশে/শুকনো মৌসুম, বিরাট শূন্যতা। বিষন্নতার সর্দি কাশি আটকে থাকে/বুকে ..." 

এভাবে স্বতন্ত্র মানস ও কাব্য রীতিতে কবিতাকে ধাবিত করে শেষ পর্যায়ে এসে উত্তরণের আর্তি হয়ে ওঠে এভাবে- "আমি প্রতিদিন কাটা ছেঁড়া হই পৃথিবীর মর্গে, বিশ্বাসে হাত রেখে/ আমিও যেতে চাই স্বর্গে"। 

এছাড়া ও মিলাদের রাজনৈতিক সচেতনতা কবিতায় সঞ্চারিত হয়ে যে সমীক্ষাধর্মী কাব্য শরীর নির্মাণ করেছে তা উপলব্ধির জন্য আমরা দৃষ্টি দিতে পারি এ পংক্তি গুলোতে :-"মনোহারী দোকানের নানা রঙ শেলফে রাজনীতি আটকে গেলে/চায়ের কাপে দোলে চাঁদ... মধ্যবিত্ত বায়োস্কোপ/ ধরা পড়ে আগামীর স্বপ্নহীন অনাবাদি বালুচর। জীবনের পূর্ণাঙ্গ পাঠ/শেষে যাত্রার খল নায়কের ভঙ্গিতে হাসির সশব্দ উচ্চারণে/রাজনীতির উলঙ্গ মঞ্চে দাঁড়িয়ে তখন কনডমের বেহায়া রাজা..." 

অথবা- "কাঁধের ক্ষতটা চাটতে চাটতে আমাদের পশুত্ব এবং দাসত্ব গাঢ়/হল। আমাদের নাবালক স্বপ্ন নিয়ে খেলা করলো শৌখিন শিকারী" (দাসত্ব ও পশুত্ব)। 

রাজনীতির চলমান নোংরামির প্রবহমান স্রোতে মানুষের অসহায়তাও কেমন পণ্য হয়ে ওঠে তার সুন্দর প্রতিচ্ছবি "ধর্ষিতা আলোচনা" কবিতাটি- "প্রতিপক্ষ ঘায়েলের মোক্ষম সুযোগ হাতে পেয়ে কারও ঠোঁটে লেগে থাকে শৃগালের হাসি। শোককে শক্তিতে পরিণত করার রাজনৈতিক/ অভিলাষে লাশকে পোষ্টারে তুলে ধরার চেষ্টা করে কেউ। মেয়েটির/স্বভাব চরিত্রের মলিন সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে মানবিকতার/চোখে মুখে ছুঁড়ে মারে থু থু ..." একই ভাবে- "স্বাধীনতা ফেরাবে জীবন, সাতরং রংধনু সাজাবে আকাশ, এরকম বিশ্বাসের তাবিজ বুকে ঘুমিয়েছি নকশি কাঁথার বেলায়/ ...অক্ষরহীন সড়কে ধর্মান্ধতার/মাইন পুঁতে পঙ্গু সমাজ" (বিরহবেলা)। 

তবে রাজনৈতিক প্রবাহে উত্তেজনা ও সামাজিক অনাচারে পীড়িত বোধ করলেও কবিতার ক্ষেত্রে এসবের দৃঢ় প্রকাশ তিনি এড়িয়েই চলেন। সুতরাং তাঁর কবি মানুষের দুর্গম আত্মস্থ পথের প্রতি অনুরাগ ও সভ্যতার সুস্থ বিবর্তনের প্রতি বিশ্বাস তাঁর কবিতাকে করে তুলেছে অন্তর্মুখীন ও অনুভূতি প্রধান। যেমন- 

১. "অভিনয় শেষে নায়িকার মতো খুলে নিই মুখের মুখোশ, পর/পুরুষের মলিন স্পর্শ... অসফল ভ্রমন শেষে/ফিরে আসি নির্জনতার নিজের ভেতর, বেড়ে উঠি ভবঘুরে লতায়/পাতায়। জীবনের নাগরিক যাপন শেষে নিজস্ব নিয়মে সেলাই করি/যোগ বিয়োগের কাঁথা " (জাল ও জঞ্জাল)। 

২. "আমরা ভাগ হতে থাকলাম দুর্বিনীত সময়ের স্রোতে। কেউ কেউ তীরের সন্ধান পেয়ে ঈশ্বর হয়ে গেল। যারা/পেলোনা তারা হলো ইঁদুর" (ঈশ্বর ও ইঁদুর)। 

পাশাপাশি বিজ্ঞান মনস্কতা, নিজস্ব তত্ত্ব দর্শন ও মননের উজ্জ্বলতা ও তাঁর কবিতার ঝিলিক দেয় এভাবে- "মাজারের মোমবাতির আলোয় বাড়েনা/চোখের জ্যোতি, মোম পুড়ে দগ্ধ দহনে। সভ্যতার আঙ্গুলে নাচে/সফটওয়্যার এর বোতাম। চন্দ্র ভ্রমণে যায় বিলাসী মানুষ" (ষড়ঋতু সময়)। 

আমাদের খুব চেনা সময়ের ভেতর কিছু অমীমাংসিত শূন্যতা থাকে। সেসব কে আমরা আলাদা ভাবে দেখার খুব একটা সুযোগ পাইনা। 

কিন্তু মিলাদ সেই শূন্যস্থান গুলোকে কেন্দ্র করেও কবিতা নির্মাণ করেন এবং আমাদেরও সেই শূন্যতার ঘোরে সম্মোহিত করে ফেলেন। যেমন- 

১. "স্মৃতি কর্তিত হয় ভরহীনতায়। দু'হাতে সাঁতার কাটে অচিন আঁধার/যুবক অভিমানে ভুলে যায় চেনা আল, ধূলো ভরা সমূহ পথ। মনু'র জলে জমা কৈশোরের স্রোত, বালিকার বুকে আঁকা শপথ" (স্মৃতিহীন অচিন আঁধার)। 

২. "চোখ বুঁজে প্রার্থনায় দীনতা এসেছে। বানে বন্যায় ভেসেছে সব/ পুঁথির অক্ষর গাঁথে বৈকালিক সন্ধ্যা, হতাশ শব্দরা বিলি কাটে/অবিন্যস্ত চুলে। চুল ও চুলোর তাত্তি্বক আড্ডায় মেতে থাকে ফকিরের দল/মন পুড়ে চিতার আগুনে" (গোধূলী বোধ)। 

৩. "ঘামে কামে ভিজে যায়/উষ্ণতার কাঁথা, রাতের বেড়া ভাঙ্গে বিড়াল স্বভাব। নষ্ট তিথিতে/খুলে ভ্রষ্ট দরজা। বাদুড় ভ্রমণে যায় চোখের শরম" (হাউসের মন)। 

আমাদের কোন হারানোই নি:শেষ ঋনাত্নক নয়। জীবনের হাওয়া প্রসারিত হয়ে সে শূন্যতাকে পূর্ণ করে, যা একদিন অপূরনীয় মনে হয়েছিল। হয়তো তার ক্ষতি পূরণ অন্যভাবে জীবনের কাছে মেলে, নয়তো প্রকৃতির শুশ্রষায় সেই হারানো নতুন আনন্দিত বোধে আশ্বস্ত হয়। আবার ঠিক এর বিপরীত বোধেও আমরা আশ্বস্ত হতে পারি। কিংবা নিসর্গ ও নিরন্তর শূন্যতার চিত্রকল্পে মনের কাছে উপস্থিত হয়। অর্থ্যাৎ জীবনের অভিজ্ঞতার বিনিময়ে কখনো সি্নগ্ধ প্রসন্নতার প্রসাদ, কখনোবা নিঃস্ব, নিরবলম্ব বেদনার সাথে পরিচয় ঘটে। সুতরাং মিলাদ ভাবেন- "ওড়নার সাঁকো বেয়ে এক পশলা ভেজা স্বপ্নে সারারাত হেঁটেছি এক আশ্চর্য জ্যোৎস্নার ভেতর" (কৈশোরের ভোর)। 

আর প্রশ্ন করেন- "বিদ্যালয়ে কি পাঠ করো বালক? প্রেমের ব্যকরণ? ভালোবাসার /সূচনা পাঠ? কিশোরীর ফ্রকের বোতামে আটকে রাখো ভবিষ্যতের/সোনালী স্বপন!" (কৈশোরের ভোর)। 

তবে মানুষের শূণ্যতার বোধকে কখনো মুছে ফেলা যায় না। সুতরাং কবি মানসের বৈশিষ্ট্য সেই শূণ্যতার অভাব বোধ নিয়ে সীমাহীন হাহাকার সৃষ্টি করা। আর এ হাহাকার ঘেরা স্মৃতি নিয়ে অসহায় বেদনায় মথিত হৃদয় নিয়ে মানুষ মহাকালের দিকে তাকালে দেখতে পাবে সৃষ্টি প্রক্রিয়ায়ও আছে অসঙ্গতি। আর এ অসঙ্গতি সন্ধান মিলাদকে চিনিয়ে দিতে সক্ষম। সুতরাং, কাব্যের গাঁথুনিতে বার বার ছক বাঁধা জীবনের প্রতি তিনি বিতৃষ্ণা দেখিয়েছেন, এ জীবন যে ছায়াবাজি তা নির্দ্বিধায় বলেছেন- 

১. "...ঋতুবতী কুয়াশায় অস্পষ্ট/হয় বাবার দেয়া বিধি নিষেধের কলম কিংবা কেয়া সাবানের ফেনায়/ভেসে যায় রাতভর জেগে থাকা চুমুর চিহ্ন। আমি এখন খুঁজিনা/আর মনুব্রীজে জেগে ওঠা জাফরানি ভোর কিংবা পুরনো দৈনিকের/পাতায় লেপ্টে থাকা সুখ-দুঃখের ক্ষত বিক্ষত অক্ষর। কাতর যাপন/শেষে নিথর মাটিতে দেখি মার্বেল চক্কর'(বিয়োগ)। 

২. "মায়াদির মায়া নেই, ছবি নেই কোন কল্পিত জীবন। চাঁদের চাদরে/ জমা বীর্যের দাগ, বোতলভরা জন্মহীন জন্মনিয়ন্ত্রণ" (মায়াবড়ির মায়াদি)। 

৩. "কবির কলম নেই, কবিতা বেকার। আধ ভাঙ্গা পথের শেষে পুরনো/বৃক্ষবাস, দোল খায় ধুলো ভরা কবির চুল। অঘোরে ঘুমায় কবি/পাশে তার জীবনের অলিখিত ভুল" (কবির কলম নেই,কবিতা বেকার)। 

এরকম বহুবিধ ভুলের বয়ানে গড়ে উঠুক মিলাদের কবিতার শরীর, উত্তর প্রজন্মকে তিনি উপহার দিন ঝলমলে কাব্য সুরের উন্মাদনা, এ প্রত্যাশা করছি। 

('স্মৃতিহীন অচিন আঁধার' এর দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন সুমন রহমান এবং ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ থেকে ২০০৫ বইমেলা বের হওয়া বইটির দাম ৫০ টাকা।) 

_________________________________________________
_________________________________________________