বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০১০

দৃক : প্রথম সংখ্যা (সম্পূর্ণ)



দৃক
সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক ছোট কাগজ
১ম সংখ্যা, অক্টোবর ২০০৭
ভাদ্র-১৪১৪


সম্পাদক
মাইনুল ইসলাম


সহ-সম্পাদক
হেলাল মোর্শেদ
সৌরভ বড়ুয়া


প্রচ্ছদ
জিলানী আলম


কৃতজ্ঞতা 
সাইফুল ইসলাম
মো.খায়রুল আনাম
মো.আব্দুর রহিম


অন্তরালের মুখ 
তৌফিকুজ্জামান, মো.সালাহউদ্দিন , জহিরশান্ত, আক্তার হোসেন, মিন্টু, কৌশিক, তানভীর, রিয়াজ, ফরহাদ, জয়, পিন্টু, মেহেদী, ভুট্টু, রিফাত, জাবেদ, রোমন, কৃষ্ণ।


যোগাযোগ 
‘মাতৃছায়া’; ১৬৩ জংলি বিবি মসজিদ রোড; ছোটরা; কুমিল্লা।
ফোনঃ ০১৭১৬-৫৬৭৯০৮, ০১৭১৭-৫১৮৭১৯, ০১৭১৮-৬৩৮২৯৯
E-mail : drik_littlemag@yahoo.com


প্রাপ্তিস্থান
লিপিকা/স্বরলিপি, ভিক্টোরিয়া কলেজ রোড, কান্দিরপাড়, কুমিল্লা।
মেঘবার্তা, ১০২, আজিজ সুপার মার্কেট (নীচতলা), শাহবাগ, ঢাকা।



১৫ টাকা।


____________________________________________


সূচি


গল্প
আরিফ হাসান। কায়সার মুহম্মদ হেলাল। ফরহাদ হোসেন মাসুম।


প্রবন্ধ
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর। গোঁসাই পাহ্‌লভী। পিয়াস মজিদ।


মুক্তগদ্য
দিবাকর মজুমদার। আবির নোমান।


কবিতা
অশোক আশরাফ। তৌহিদুল ইসলাম। রাসেল শাহরিয়ার। আরিফ ওবায়দুল্লাহ।
জহির  শান্ত। আতাহার সজীব। কায়সার মুহম্মদ হেলাল। সৌরভ বড়ুয়া।
মাইনুল ইসলাম। সৈয়দ আহমাদ তারেক। বিজন দাস। আহাম্মেদ কবীর।
গাজী মোহাম্মদ ইউনুস। বাবুল ইসলাম।


পাঠ প্রতিক্রিয়া
মোশারফ হোসেন।


পুনর্পাঠ
সৈয়দ মুজতবা আলী।


প্রণতি
হরিধন দাস-কে


_____________________________________________


সম্পাদকীয়


চারপাশে যা কিছু ঘটছে তার সচেতন পর্যবেক্ষণ সময়ের দাবি। ভাবলেশহীন নিস্পৃহ জীবন অন্যের অবৈধ কাজকে অবাধ সমর্থন যোগায় মাত্র। অসংখ্য মানুষের অস্থির ছোটাছুটি ক্রমশ যান্ত্রিকতায় রূপ নিচ্ছে। মানুষের পরিচয় খর্ব হচ্ছে নিয়ত। গোলকায়নের গালভরা বাখওয়াজি আমাদের স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তা ও মানবিকতাকে ঢেলে সাজাচ্ছে অমানবিক ছাচেঁ। গড়ে উঠছে নতুন সংস্কৃতি। মানুষ বিজ্ঞাপিত হচ্ছে পণ্যে।


বহমান সমাজের রূপ বদলে যাওয়ার পূর্বে থমকে দাঁড়ায় মুহুর্তের জন্য। দন্ডমুন্ডের কর্তার গায়ে চাপে ধূর্ততার নতুন চোগা-চোপকান। ভরসার আলোয়ানে ঢাকা থাকে চিরায়ত চোখ রাঙ্গানি। সময়কে অস্বীকার করে আমরা এগুতে পারবো না। অন্ধকূপ প্রচারণা ল্যাংড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কিছু সময়ের জন্য মাত্র। সময়ের মানদন্ড প্রত্যেকের জন্য স্বাধীন বলেই আমরা প্রয়াস পেয়েছি এই যূথবদ্ধ পথ চলায়। এ সময়ের তরুণ নবীন ভাবুকদের সৃজনশীল প্লাটফরম তৈরিতে দায়বদ্ধ দৃক। নিজস্ব সতন্ত্র ভাবনাগুলোকে অগ্রসর স্থানে পৌছে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকবে অকৃপন। ভোগবাদী সংস্কৃতির উল্টো প্রবাহে প্রগতিশীল চেতনার বিকাশ ও মানবিকতার নতুন বিনির্মাণের অগ্রসর বাহিনী আলো জ্বালুক তিমির হন্তারক হয়ে। এ প্রজন্মের সম্ভাবনাকে পরিচর্যার বিষয়টি সমাজ সচেতন বলে দাবিদার অংশকে এড়িয়ে চলা হবে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর নামান্তর।


আপনাদের অব্যাহত সহযোগিতা আমাদের আগামীর কণ্ঠস্বরে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এ পত্রিকা প্রকাশে যারা নানাভাবে উৎসাহ ও সহযোগিতা করেছে সকলকে ধন্যবাদ।

_____________________________________________
গল্প
_____________________________________________

মেঘ
আরিফ হাসান

একটি সকাল কি করে অপরিচিত হয়ে যায়? তার ঢং দেখে বলে দেয়া যায়? কিভাবে সে গড়াবে যদি সে শীতের আকাশ হয়। আর না হয় তার মতিগতি ঠিক ঠাহর করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। 

এই সকাল তার রূপ নিয়ে আসে ধীরে ধীরে। খুলবে কি খুলবে না এমন দু-টানায় প’ড়ে যায়। অথচ তার ভাবনা এমন কিছু জটিল ছিল না। শ্যাওলা ছিল না তার গায়। ছিল মেঘ। তবু তো সে মেঘ বিগত কয়েকদিন ধরে মাথার উপর দিয়ে কেবল উড়ে যেতে দেখেছি। তবে? তবে রোদ উঠবে নিশ্চিত। তারপর? তারপর কৌতূহলী মানুষগুলো তন্দ্রার ভেতর থেকে জেগে যে যার পোশাক পরে নেবে। পোশাকে পুরুষের মনে হয় কিছু যায় আসে না। আসে কি? এমনটা ভাবাই পুরুষের কাজ। আর তাই পুরুষ দেখে থাকে এই দিন যা কিনা শেষমেশ রোদেলা হয়ে গড়াবে, তার আলো পড়ে নীল জর্জেট শাড়ির ভেতর ফর্সা চর্বি সমেত পেট কতটা কিরণ ছড়ায়। কতোটা ভাঁজে প্রমাণ সাইজ ছুঁইছুঁই শরীরে নিতম্বের উথাল পাথাল একই রকম রয়েছে কি না? নাকি আরো আনত হয়েছে? কৈশোর থেকে তার ব্রীড়া আরো কেলাসিত হয়ে জড়তা কেটেছে কি না। নাকি কুঞ্চিত হয়েছে।

অথচ এরপর ঘুরে দ্বিধা জড়িত হাসি বিনিময় হলে পর রোদ বরাবর খাড়া হয়ে যায়। যদ্যপি এই হাসি তার মলিনতা হারাবে ততদিনে পৃথিবী আরো উর্বর হলে পৃথিবীর রমণীরা আরো বেশি ঈপ্সিত হয়ে উঠবে। এসব ভাববার সময় এখন; বয়েস চড়তে থাকলে ধীরে ধীরে কৌমার্যতা হারাতে হারাতে বোধগুলো বেহায়া হয়ে আসে।

বয়:সন্ধির প্রথম প্রথম এমনটা হতো। নিজের শরীর দেখতেও সংকোচ হতো। শারীরকে নিজের থেকে আলাদা কিছু মনে হতো। মনে হতো শরীরই যেন পৃথিবীতে পাপ ডেকে নিয়ে এসেছে। আদতে হয়তো সে ঠিক নাও হতে পারে। শিওর হওয়া গেলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেত! তারপর দখিনা হাওয়া বইতে বইতে বয়েসও বাড়তে থাকে। আবছা আধো অন্ধকারে ফুলেল কিছু প্রেম বলে মনে হতে থাকে, অথবা ভালোবাসা, এ ব্যাপারে দ্বিধা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে ভালোবাসা বলাই ভালো। পৃথিবীর প্রমথ প্রথম রমণীয় অনুভূতিগুলো হয়তো-বা ভালোবাসাই হয়ে থাকে। তার পরেরগুলো প্রেম? এ ব্যাপারে শিওর হওয়া মনস্তত্ববিদের কাজ। তবে প্রেম শব্দটির ভেতর কেমন যেন কর্কশতা লেগে থাকে। লেগে থাকে লালা মতোন তেল চিটচিটে কিছু একটা। 

এরপর হয়তো বা অনুভূতিগুলোর ভাঙচুর হতে থাকে। পদার্থগুলোর ভেতর থেকে অণুগুলো যেভাবে দীর্ণ হয়ে যায়। রিকশায় করে মেয়েগুলো যেতে যেতে কেমন উদাস হয়ে যায় ভাবতেই অবাক লাগে। আবার কেউ কেউ চোখ মটকে কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। আর এই তো রিকশা থেকে ধপ করে নামবার সময় বুক দোলে ওঠে। সে কেমন আব্রুহীন অহংবোধ নিয়ে হেঁটে যায়। এসবের রহস্যের সমাধান আজো হয় নি। এ বিজ্ঞান কি সাধু পুরুষের জানার বিষয়? 

এই যে এখন মেয়েটি একটি ছেলে সহ হাঁটতে হাঁটতে নোট ফটোস্ট্যাট করতে যাচ্ছে সে কি কখনো বলতে পারবে, যাকে সে বন্ধু ভাবে সে তাকে একবারও কামনা করে নি? অথবা হয়তো বা সে জেনেই বিষয়গুলো ইগ্‌নোর করছে। 

শালা! সিগারেটের মজা কি এর চেয়ে বেশি! ক্রমশ জ্বলে জ্বলে ছাইয়ে পরিণত হয়ে শেষমেশ থেকে যায় পাছা। সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার ভেতর ছুঁড়ে ফেলার এক ধরনের তৃপ্তি বোধ হয়। বোধ করি সিগারেট টানার এই এক আনন্দ থেকে থাকে। 

শিপন ভাই এক গ্লাস পানি দেন-বলতে বলতে এক গ্লাস পানি হাতের কাছে এগিয়ে এলে, পানি গিলে ঠাস করে গ্লাসটি রেখে তারপর কমনরুমে গিয়ে ঠাস-ঠুস কতক্ষণ টেবিল টেনিস অথবা ক্যারাম বোর্ড খেলে তীব্র চনাগন্ধঅলা বাথরুমে জিপার খুলে জলবিয়োগের পর হঠাৎ করে মনে হয় কোন কাজ আর থাকে না। তারপরও কলেজ বিল্ডিংয়ে কলা ভবনের তিনতলা গিয়ে ঘুরে এসে তারপর বিজ্ঞান ভবন সংলগ্ন বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালে পর আশপাশটা ভালো করে অবজার্ভ করা যায়। বেশ ঠান্ডা আজ। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার ভর্তির পর মাঝামাঝি এই সময়টা কলেজ বেশ ঠান্ডা থাকে পুনরায় অনার্স ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত। সামনে ৪ নম্বর পাপিয়া বাসের আবুল ভাই বসে বসে হালের রিমিক্স করা গানগুলো বেশ মনযোগ সহযোগে শুনতে শুনতে মাথা দুলিয়ে ড্রাইভিং হুইলের মধ্যে তাল বাজাচ্ছেন মৃদু মৃদু। তার পাশে বসা আরো কিছু মুগ্ধ শ্রোতা বসে আছে আর বারবার অনুরোধ করছে চুমকি গানটা বাজান, জাক্কাস গান একটা’। অতপর আবুল ভাই চুমকি গানটা বাজান আর মুগ্ধ শ্রোতাদের দোলা-দুলি, পায়ে চাপড় মারা আরো বেড়ে যায়। সাড়ে এগারোটা নাগাদ বিবির বাজার বাসে ইতিউতি দূরবাসী ছাত্র/ছাত্রী এসে ডাইরি অথবা আলাওল কাব্য রেখে সিট বুক করে অদূরে সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেলে হেলান দিয়ে ছেলে-মেয়ে একজোট হয়ে এটা-সেটা আলাপ করতে থাকে। কখনও আচার ধর্ম-ফ্রেন্ডশিপ-গিফট-বার্থ ডে-ফাস্ট ফুড-রাজনীতি-পর্দা পুশিদা-ইত্যাকার বিষয় নিয়ে আলাপ করতে থাকে আর ছেলেটা জনৈকার ফিটিং লেটেস্ট বোরখার চাপে ভেসে ওঠা স্তনের নিপল দেখতে দেখতে ঘেমে ওঠে আর থেমে থেমে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে থাকে। সামনে দিয়ে কয়েকটা কুকুর প্রচন্ড গরমে জিভ বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের পাশে ডোবাতে গিয়ে গা ভেজায়। ফার্স্ট গেইটের কোনায় চটপটিঅলার চটপটি চাখতে চাখতে চাট-চাট শব্দ তুলতে তুলতে মেয়েরা এবং ছেলেরা গাল-গল্প করতে করতে তাদের মুখে বৈশাখী হাওয়ার তোড়ে ধূলা বালি এসে আছড়ে পড়ে। দেখছস বাতাসে বালু আইয়া মুখের মধ্যে পড়ছে, চটপটিটাও ছিটকায়া জামার মধ্যে পড়ছে, ভাই একটু পানি দেনতো জামাটা পরিষ্কার করি। চাট্‌ চাট্‌ শব্দে আবার চটপটি খাওয়া চলে। 


বাস স্ট্যান্ডের ধারে বসে এতক্ষণ কফিল এই সব দেখছিল। হাতের চেটোয় মুখ ঘষে দেখল তাতে বালু আর তেল চিটচিট করছে। রুমালে হাতটা মুছে ৪ নম্বর বাসের শেষের সিটে গিয়ে ঝিম মেরে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ। চোখ খুললে চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসে। আবার সেই দিগ্বিদিক শূণ্য আশপাশের অনির্দিষ্ট ব্যস্ততা! বাসের আশেপাশে পিপঁড়ের মতো ভিড় বাড়তে থাকে। তারমানে কিছুক্ষণ পর বাস ছাড়বে। তবে কয়টা বাজে? হাত উল্টিয়ে কব্জির দিকে চোখে যেতেই ঘড়ির কাঁটা পোনে একটা নির্দেশ করে। তার মানে আরো পোনে দুই ঘন্টা বাকি।বাস ছাড়বে আড়াইটায়। আজকে কি তাহলে কোন সেমিনার নেই? সেমিনার মানে স্যার, আপা’রা প্রিন্সিপালের প্রশংসা করেন অত:পর প্রিন্সিপাল তার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। একজন জ্ঞানী টাইপের অধ্যাপক একটা প্রবন্ধ পড়েন। ক্লিক ক্লিক শব্দ হতে থাকে। তারপর খাওয়া-দাওয়া, বেঁচে যাওয়া বাকি খানা-খাদ্য ডিপার্টমেন্ট কেরানী-নেতা গোছের ছাত্র এবং স্যাররা ভাগাভাগি করে বাড়ি নিয়ে যান। ডিপার্টমেন্টের টাকার শ্রাদ্ধ- না মনে হয় নেই। সুন্দর-সন্ত্রাসমুক্ত-ক্যাম্পাস চাই বিকশিতজীবন, FM Method, NIIT, APTECH এ বিষয়ক কোন সেমিনারও কি নেই? -না নেই। আজকের দিনটা বড়ো আন্ধা। তো বাসের চারপাশে বেহায়া ছেলেমেয়ের ভিড় তো হবেই। বিজ্ঞান ভবনের পাশ দিয়ে যে  রাস্তাটা লেডিস হোস্টেলের দিক যায়, যে লেডিস হোস্টেলে সান্ধ্য আইন বহাল, সে লেডিস হোস্টেলের রাস্তা দিয়ে শর্ট কামিজ পরা দু’টো মেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বাতাসে তাদের কামিজ কোমর পর্যন্ত ওঠে যাওয়ায় ছেলে-পেলেদের হুল্লোড়ে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বাতাসই অত:পর মেয়েদের লজ্জা নামিয়ে দেয়। মেয়ে দু’টো তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এমন স্মার্ট দু’টো মেয়ের বিব্রত হওয়াতে কারো কিছু যায় আসে না। বরং কিছুক্ষণ টীকা-টিপ্পনি চলতে থাকে। তাদের রানের গল্প জুড়ে থাকে কিছুক্ষণ আশেপাশে কিংবা পাছার কিংবা বুকের। আবার অত্যুৎসাহী কেউ  বলতে থাকে ‘শালার বুকের ওড়নাটা উইড়া গেলে হেভি অইতো।’ খট করে বাসের পাদানিতে শব্দ হতে বাসের ভেতর আলোকিত হয়ে ওঠে। বহু পরিপাট করা মুখ। তারপর যেখানটায় পাছা পাতবে, পায়ের উপর পা দিয়ে অদ্ভুত মুদ্রায় সচকিত হয়ে বসে থাকবে সেখান থেকে আলাওল কাব্য সরিয়ে কোলের ওপর রেখে মেকি ভাবে বসে থাকে। মেয়েটি প্রতিদিন বিবির বাজার নেমে বিডিআর ফাঁড়ি পেরিয়ে গাঙের হেই পাড় চোখের দৃষ্টি যেখানে মিলিয়ে যায় সেখানে মিলিয়ে যায়। মেয়ের বাবা ইংরেজির শিক্ষক নন। ইংলিশ টিচার। হয়তো তার জন্য এখনি বিদেশ ফেরত আধা-শিক্ষিত পাত্র আসা শুরু করেছে। কিন্ত্তু মেয়ের আপ্রাণ চেষ্টা কিভাবে অন্তত শহরে বাড়ি আর এম.এ. পাশঅলা-মোটামুটি টাকাঅলা ছেলে পাওয়া যায়। এ প্রচেষ্টায় সে রীতিমতো চৌকষ। এ শুধু কি অনুমান? আবুল ভাইয়ের মাথা দোলানো বেড়ে যায়। গাঁজা খাওয়া ভাঙা গলায় রিমিক্স রোল ওঠে ‘ওরে নীল দরিয়া...’ কড়া সুরে বাজতে থাকে। যৌবনে শোনা আব্দুল জব্বারের গানের সাথে মিলাতে মিলাতে হয়তোবা তালটা আরো বেশি চড়ে যায়। ইনকিলাবের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একজন পর্যুদস্ত ইরাক এবং মার্কিন আগ্রাসন নিয়ে আলাপ করতে করতে শিশ্নের মতো খাড়া গাজর লবণ মাখিয়ে খেতে খেতে চুকা ঢেকুর তুলতে তুলতে বিবির বাজারগামী মেয়েটির দিকে তাকায়। পটিয়সী ভ্রুক্ষেপও করে না কারণ সে জানে ছেলেটা চকবাজারের পর নামে এবং চকবাজার শহরতলীর শেষ মাথায় সুতরাং তার বাড়ি সংরাইশের দিকেই হবে। সে ভাবতে থাকে আজাদ ভাইয়ের কথা যে কি না বি.এ. পাশ করে চাকরি হবে আর হলেই কবে আমার বিয়া করবা বলে ধানাই পানাই করে। 

বাসের ভেতর প্রতিদিন একটা মেয়ে যার কোমর কি না কম করে হলেও ষাট হবে বসে বসে ডায়েট কোক খায় আর পাশে বসা খোঁচা খোঁচা দাড়িঅলা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে শেখা তার আধা খেঁচড়া শুদ্ধ বাঙলায় ‌আচ্ছা! আপনারা ‌এত সিগারেট খান কেন? আমার মতো ডায়েট কোক খাইতে পারেন না? ছেলেটা তার প্রস্তাব লুফে নিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ফেঁসে গিয়ে বেচারী তাকে ডায়েট কোক দেয়। রোগাপটকা ছেলেটা ডায়েট কোক গিলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মোটামেয়েটার সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে। বাসের ভেতর ধীরে ধীরে ভিড় বাড়তে থাকে। কেউ দরজার পাশে রেলিঙে ব’সে বাইরে কারো সাথে কথা বলছে। কেউ আবার আড় চোখে আশেপাশে মেয়েদের স্কিন টাইট সালোয়ারে ভেসে ওঠা উরু সহ পাছার কিয়দংশ কিংবা ওড়না স’রে যাওয়াতে ভেসে ওঠা বুক দেখে আবার বিচ্ছিন্ন আড্ডায় যোগ দেয়। কফিল ঘামিয়ে ওঠে। তার ভ্রু কুঞ্চিত। তার পাশে এসে বসে বোঁচা নাক। ঝাপসা চেহারার অস্পষ্ট দৃষ্টি; অল্প কেউ সিট নম্বরেরদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চুপ ব’সে থাকে। 

বাসে সম্ভবত সবাই ঘামিয়ে ওঠেছে। ঘামের একটা মিলিত বোটকা গন্ধ মিলে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। তবে সবাই মনে হয় এ গন্ধে অভ্যস্ত তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না অথবা গা সওয়া হয়ে গ্যাছে। 

গায়ে রোদ পড়লে জানলা টেনে দিলে কাঁচের ভেতর বাইরেরটা কেমন অস্পষ্ট হয়ে যায়। পুরো কাঁচের ভেতর বাইরের রূপ পাল্টে যায়। কেমন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে জানলার ওপাশ। 

এঞ্জিন কঁকিয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে বাস কলেজ গেটপার হয়ে রেলগেট রেল গেট পার হয়ে পুলিশ লাইন, পুলিশ লাইন পার হয়ে মোগলটুলী, রাজগঞ্জ মোড় করতে করতে চকবাজার, চকবাজার থেকে তেলিকোনা করতে করতে বিবিরবাজার গিয়ে থামে। তারপর ঘুরে আবার সে চ’লে শাসনগাছা তার রোজকার নিয়মিত ট্রিপ মারার জন্য। শিল্পকলার সামনে এলে গোল চাকতির মতো ট্রাফিক আইল্যান্ডে বাসটি যখন স্লো হয় বাস থেকে নেমে গেলে আরেকটা নিঃসঙ্গতার বল গড়াতে গড়াতে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সন্তর্পণে তারপর রাস্তা পার হলে ঘরে ফিরে না গিয়ে পৌর পার্কে একবার ঢু মারতে ইচ্ছে হয়। সেখানে গিয়ে এ সময় পার্কটিকে একটু একা পাওয়া যায়। বিশাল দিঘি সামনে রেখে ভাঙা বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে বসে থাকলে নিজেকে বেশ উদাস উদাস মনে হয় তার সাথে সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে ধোঁয়া উড়িয়ে দিলে তো মনে হয় জীবনটাকেই উড়িয়ে দেয়া হল। তারপর হঠাৎ পা মেলতে গিয়ে পায়ের পেশীতে টান পড়লে ধীরে পা আলগা করতে গিয়ে অবশ হয়ে এলে পুরো শরীরটাই নেতিয়ে পড়ে। তার সাথে মুচড়ে মুচড়ে হঠাৎ যেন পুরো দিনটাই নেতিয়ে পড়ে। তারপর ল্যাংচে ল্যাংচে যেন সন্ধ্যের দিকে যায় দিন এবং কফিল। সন্ধ্যে মানে বাড়ি।

_____________________________________________

বিকলাঙ্গ গদ্য
কায়সার মুহম্মদ হেলাল

প্রথমা: ঐতিহাসিক প্রয়োজন
রাস্তার পাশে দাঁড়ানো কিংবা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো আমার দৈনিক কাজ। কোন একদিন হয়তো ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আমি দাঁড়িয়েছিলাম পূবালী চত্বরে। হয়তো সারাদিনই, ঘড়ি নাই বলে সময় জানি না, দালির চিত্রের মতো খাঁ খাঁ রোদ্দুরে সময় গলে চুঁইয়ে পড়ে প্রাকৃতিক ঘড়ি থেকে। 

প্রয়োজনের রসদ সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত নাগরিক ঝোলা ক্রমশ পূর্ণ হতে থাকার সেই সময়টুকুতে একজন বিকলাঙ্গ আমার দৃষ্টি কেড়ে নেয় তার প্রতি। ধার করে তার বাঁচতে  বিবেকে বাঁধে বলে হয়তো অনায়াসে হাত পাতে নাগরিক দ্বারে। অথচ নগর ইট-পাথরের স্তূপিকৃত জঞ্জাল তার মানবিক দৃষ্টি কখনোই হানে না, দেয় না কোন ন্যূনতম সেবা তার প্রতি। আর পয়সা খেকো দানবাধিকার কমিশন ব্যস্ত ভিক্ষার পয়সার ভাগ বন্টনে। হঠাৎ কিংবা বাস্তবিক টানাপোড়েনের শিকার ঐ বিকলাঙ্গটি চাপা পড়ে যায় একটি দামি গাড়ির তলায়। কাক যখন আহত কিংবা নিহত হয় তখন অন্য কাক বন্ধুরা জটলা পাকায় ঐ কাককে ঘিরে। ঠিক তেমনি বিকলাঙ্গটি চাপা পড়ার পরপরই হাজার খানেক বিকলাঙ্গের ভিড় জমে যায়। আহত বিকলাঙ্গের জটিলতা যখন জটলায় পরিণত তখন কেউ কেউ রাস্তা পার হতে উন্মুখ হয়। তখনই আমার দাঁড়িয়ে থাকার ঐতিহাসিক প্রয়োজনের জাগতিক প্রয়োজনীয়তাও শুরু হতে থাকে।  

বিকলাঙ্গরা রাস্তা পার হয় আর দামি গাড়ি তাদের চাপা দিয়ে মারে-একটা, দুইটা, তিনটা এভাবে অনেক। কেউ কেউ তৎক্ষনাৎ মরে যাচ্ছে কিংবা ফুটপাতে উঠেই মরে যাচ্ছে, কেউ কেউ আবার বেঁচেও যাচ্ছে। এরকম পরিস্থিতি আমাকে একটুও আবাক করে না দিয়ে বরং স্বাভাবিক রাখে, কেন জানি না। বিকলাঙ্গরা যে সহজেই পার পেয়ে যায় ঠিক তেমন নয়, মৃত্যুর আগে বা পরে তাদের কিছু গালিও শুনতে হয়েছিল, যেমন “শালারার ঠ্যাং নাই, হাতও নাই, পথে নামছে বাল ছিড়ব্যার লাইগ্যা” ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথম বিকলাঙ্গ পুনরায় দৃষ্টি কাড়ে আমার। আমি দেখি সে মরেনি,তার অদ্ভুত চলন আমার নিউরনে তখনও সপ্রতিভ। তার দুই হাত অনায়াসে টেনে আনছিল তার বিকল পা  দুটোকে যেন পৃথিবীর যত যন্ত্রনার বোঝা বইতে গিয়ে জয়ী হবার গোপন প্রয়াস অথবা এই গুরুদায়িত্বটি গছিয়ে দিতে চায় কারো কাছে। 

আশেপাশে কোন যান চোখে পড়ে কিনা খুঁজতে থাকলে হঠাৎই ঐ গাড়ি চালককে দেখতে পাই আমি। বিকলাঙ্গটিকে তার গাড়ি করে কোন চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাবার আকুতি করলে অপরাধ স্বরূপ তাচ্ছিল্যের হাসিটিও গিলেছি সাড়ম্বরে, মনে হল যেন স্বয়ং ঈশ্বর পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য বিকলাঙ্গ সংক্রান্ত ছায়াছবি প্রদর্শিত হচ্ছে অথবা তিনি ভুল-ত্রুটি শোধরাচ্ছেন। আমি বিকলাঙ্গটিকে মাটি থেকে তুলে তার একটি হাত কাঁধে তুলে নিলাম। আমার এরকম কাজ দেখা মাত্র কতগুলো মুখ হা হা করে উঠে। আমি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে এগিয়ে যাই। তাকে নিয়ে ফুটপাতে যাওয়ার পথে তার বিকল মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসে গম্ভীর স্বর-“মানুষ বড় জটিল”। আর এ কথার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ, বাতাস, নদী-নালা, সাগর ইত্যাকার প্রকৃতি কেঁপে উঠে। আমি এতক্ষণ নির্ভয়ে থাকায় পর একটু একটু ভয় পেতে শুরু করলাম, তাকিয়েছিলাম তৈলাক্ত কালো চশমার ফ্রেমের পেছনের গর্তে। প্রকৃতি স্থির হওয়ার পর আমার মাথা খুঁজে পেলাম তার বুকের একপাশে, আরেক পাশে আমার ডান হাত। ইচ্ছে হচ্ছিল চিৎকার করে বলি আমাকে ছেড়ে দে, অথচ একি মায়াজালে জড়িয়ে গেলাম জানি না। কিছুক্ষণ পরই তার ভবলীলা সাঙ্গ হয় আর আমার দেহের কিছু অংশে তার মুখ নি:সৃত লালা লেগে থাকে।


দ্বিতীয়া: ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তার স্ফুরন
এভাবে জীবন চলতে থাকলে দেখা যায় পর্যায়ক্রমে মানুষের বিকলাঙ্গ হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে শুরু করে যতদূর কল্পনা করা যায় তার সব কেমন যেন বিকলাঙ্গতাকে বয়ে বেড়াচ্ছে অসীম শ্রদ্ধায়। আর ঐ রাস্তাটিতে শুধু মৃত বিকলাঙ্গের গন্ধ। বিকলাঙ্গের ঘরে জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ, বিকলাঙ্গ নারী গর্ভে নেয় বিকলাঙ্গ সন্তান। বিকলাঙ্গেরা অফিসে যায়, ব্যবসা করে, বাজারে যায়, কোটি টাকা কামায়। কেউ কেউ কর দেয়, ঋণ নেয় আবার করখেলাপী কি ঋণখেলাপীও হয় নিয়মিত। ভূঁইফুঁড়ে বিকলাঙ্গ সমাজের উৎপত্তি হয়, সাফাই গায় ক্ষুদ্র ঋণের,ঘটা করে নোবেল পায় বিকলাঙ্গ অর্থনীতিবিদ। বিকলাঙ্গ নীতিতে কালো টাকা সাদা হয় অনায়াসে। প্লট,ফ্ল্যাট,গাড়ি,নারী গুলোও বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে সুখ খোঁজে বিকলাঙ্গ মদে। বিকলাঙ্গ ধর্মের জন্ম হয় প্রতিনিয়ত একটি দু’টি করে। বিকলাঙ্গ মসজিদে ইমামতি করে বিকলাঙ্গ ইমাম কিংবা মন্দিরে বিকলাঙ্গ ঠাকুর। বিকলাঙ্গ জাতের ধান পাটে আসে সবুজ বিপ্লব, বিপ্লবে ছেয়ে যায় বিকলাঙ্গ জমিন। জমিন সার চাইলে তখন বিশ্ববিকলাঙ্গ ব্যাংক ভর্তুকি দেয় দারিদ্র বিমোচন কার্যক্রমে। বিকলাঙ্গ সভ্যতা চিবোয় বিকলাঙ্গ বার্গার, স্যান্ডউইচ, দেখে হরদম উদ্দাম বিকলাঙ্গ নৃত্য।

ইত্যাদি বিকলাঙ্গতার ফসল হিসেবে কোন এক বঙ্গদেশে কিছু বিকলাঙ্গ বারবীয় সত্ত্বা একদিন হয়তোবা প্রতিদিন রাজপথে গলা ছেড়ে গায় বিকলাঙ্গ ভৈরবী-

“মন্ত্রী বিকল,
টাকা বিকল,
   বিকল রাষ্ট্রপতির চাঁদি।
   বিকল রাজ্যে
   বিকল রাস্তায়
   পোড়ে ভগ্ন নটির গদি।”

যখন প্রেমিক-প্রেমিকারা পছন্দে প্রাধান্য দেয় বিকলাঙ্গতার ভিত্তিকে তখন কোন   এক বিকলাঙ্গ বেদে গ্রাম্য মেঠোপথে সুর তোলে।
“দাঁতের বিকলাঙ্গ পোকা সারাই,
ভালা মানুষ বিকলাঙ্গ বানাই”।

অথবা হর হামেশাই শোনা যায় পরস্পর পরস্পরকে বলছে “লাঙ্গের ঘরের লাঙ্গ”। বিকলাঙ্গ কথাশিল্পীর বন্দি হন বিকলাঙ্গ কথামালার গদ্যে, উপন্যাসে। বিকলাঙ্গ কবির খাতা ভরে উঠে বিকলাঙ্গ কাব্যে। বিকলাঙ্গ মিছিলে শুরু হয় বিকলাঙ্গ স্লোগান-
“ বিকলাঙ্গরা মিল্য
দেশটা খাইল গিল্যা”...। ইত্যাদি। 

অথচ তাদের বোধশক্তি এতটা নিচু ছিল যদিও তারা মনে করত উঁচু, নিজেদের অজান্তে কতটা মসৃন ভাবে অন্যদেরকে বিকলাঙ্গ বলত তা,বোঝতে কিংবা ধরতে পারতনা।

এভাবে মানুষের বিকলাঙ্গতা কোথা থেকে শুরু হল তার হদিস খুঁজতে বিকলাঙ্গ ইনস্টিউট এ বিস্তর গবেষণার পর কোন এক বিকলাঙ্গ বিজ্ঞানী আবিষ্কার করলেন, “আসলে এ সকল কিছু শুরু হয়েছিল এক প্রকার বিকলাঙ্গলালা থেকে যা তৃষ্ণা মেটানো থেকে শুরু করে সর্ব কাজে ব্যবহৃত হতো” 

হতে পারে এসবের কিছুই ঘটেনি কোনদিন অথবা ঘটে, যদিও বিশ্বাস করতনা কেউ, তবে বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয় তখনই যখন নগরের সকল পতিতালয়ে বিকলাঙ্গ পতিতার সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তাদের কাছে বিকলাঙ্গ কনডম, পিল পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে আর তাদের বিকলাঙ্গ খদ্দেরদের সংখ্যা বাড়তে থাকে আশঙ্কাজনক হারে!

_____________________________________________

দ্বন্দ্ব
ফরহাদ হোসেন মাসুম

খুব দ্রুত শ্বাস ওঠা নামা করছে, ঘন ঘন বুক ফুলে ফুলে উঠছে। যে কোন মুহূর্তে থেমে যাবে জীবনস্পন্দন। রোগীর বিছানার আশেপাশে অনেকেই অপেক্ষা করছে। কারো চোখে আশা, কারো চোখে হতাশা। অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বয়স্ক লোকেরা বুঝতে পারছেন, বড়ো রকমের কোন আশ্চর্য ছাড়া এ রোগী বাঁচবে না।

ঈশ্বর, শেফা আর মৃত্যু দু’জনকেই আদেশ দিলেন, ঘটনাস্থলে পৌঁছতে। যদি শেফা আগে পৌঁছে তবে রোগী বাঁচবে। যদি মৃত্যুদূত পৌঁছে যায়, মরণ অবধারিত।

আদেশ পাওয়া মাত্র তারা নিজ নিজ সর্বোচ্চ গতিতে ছুটতে আরম্ভ করলো। দুই দূত, দুই বিপরীত ধরনের ঘটনার বাহক। তাদের গতিবেগ একেকদিন একেক রকম থাকে। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই রোগমুক্তি পৌঁছে যায় দ্রুতবেগে ; আবার কখনো অবধারিত মৃত্যুর কারণ হয়ে সেকেন্ডেরও স্বল্প সময়ে গমন করে মৃত্যুদূত।

আজ গতি বেশি মৃত্যুদূতের,সে খানিকটা এগিয়ে রইলো। রোগমুক্তি বুঝল কী ঘটতে যাচ্ছে।সে শান্তস্বরে মৃত্যুকে সম্বোধন করল,
মৃত্যু ?
কি হলো ?
কিছু কথা ছিলো ।
বলে ফেলো সময় নেই।
বলব ?
তাড়াতাড়ি করে। ইতস্তত করছো কেন? সরাসরি বলো।
তুমি নির্দয়।
ঈশ্বরের ইচ্ছা।
তুমি কঠিন হৃদয়।
নরম হওয়া আমার স্বভাব নয়।
তুমি ভয়ঙ্কর।
হুঁ, আমার রূপ অতি ভয়ানক।
তুমি মানুষকে কাঁদাতে ভালোবাস।
আমি মানুষকে মুক্তি দিতে ভালোবাসি। জীবন শৃঙ্খল থেকে মুক্তি!
কাঁদাই তো আমিও, তবে সে পরম আনন্দের কান্না। তুমি মুক্তি দাও, তবে না চাইলেও।
নামের মুক্তি সবার অদৃষ্টের বিধান। তোমার বা আমার কিছুই করার নেই।
তোমার কিছু করার নেই, আমার আছে।
পারলে করো।
শোনো মৃত্যু, আমি একটু ক্লান্ত।
কিন্তু আমি এখানো বেজায় সবল, আমার গতি এখনো অটুট।
এ ও কি সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা?
সবই তার ইচ্ছা। ঐ লোকের মৃত্যুও বটে। তাই আজ আমি এগিয়ে।
ঠিক আছে, হার মানছি। তুমিই যেও। তবে যাওয়ার আগে একটু থামো। কয়েকটা কথা শুনে যাও।
আমাকে ঠেকাবার জন্য ছলনা করছো? তা হবার নয়। তার চেয়ে এসো, কে তার কাছে আগে পৌঁছতে পারি, সেই চেষ্টা করি। আমি জানি তুমি ক্লান্ত নও।
কিন্তু, আজ যে তোমার গতি আমার চেয়ে বেশি।
লোকটির মরণ নিশ্চিত।
তবুও একবার ভেবে দেখো, ঐ লোকের মৃত্যুতে কেউ পিতৃহারা হবে। কেউ ভ্রাতৃহারা হবে। কেউ অভিভাবক হারাবে, কেউ...
যখন অন্তিমদশা উপস্থিত, তখন এতকিছু ভেবে লাভ কি?
কখনো তুমি এসব ভেবে দেখোনি, তাই বলছি।
আজো ভাববো না। তাই আমার নাম মৃত্যু।
ব্যাপার তা নয়।
তবে? 
তোমার মগজ ক্ষুদ্র, তাই তুমি ভাবতে পারো না।
ব্যাঙ্গের হাসি হেসে মৃত্যু বললো, ‘তাহলে আজ তুমিই বুঝিয়ে দাও?’
তার আগে কষ্ট কী, তা তোমাকে বুঝতে হবে।
কষ্ট?
হ্যাঁ, কষ্ট, মুক্তি নয়, কষ্ট। তুমি মানুষকে কষ্ট দিতে ভালোবাস। একজনের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তুমি অনেকজনকে কষ্ট দাও, কাঁদাও। সবাই কষ্ট পায় তোমার জন্যে। তুমি নিজে কখনো কষ্ট পেয়েছো?
আমার মৃত্যু যখন হবে, তখন বোধহয় কষ্ট পাবো।
নিজের মৃত্যুর চেয়ে বেশি কষ্ট তুমি তখন পাবে, যখন তোমার প্রিয় কেউ মারা যাবে। যাকে তুমি ভালোবাস। তাকে যখন তুমি বধ করবে, তখন তুমি বুঝবে কষ্ট কী?
কিন্ত্তু ভালোবাসা নামক কোন ব্যাপার তো আমার মধ্যে নেই।
তাই তো বলছি। যখন তুমি কষ্ট জানো না, ভালোবাসা বোঝো না, তখন অন্য কাউকে কষ্ট দেয়ার অধিকার তোমার নেই।
কিন্ত্তু মানুষ মাত্রই মৃত্যুর দিকে ধাবমান। মৃত্যু সবার জন্য অবধারিত। সে তুলনায় তোমার কথাগুলো কি ঈশ্বরবিরুদ্ধ হয়ে গেল না?
সে কথা তুমি ঈশ্বরকেই জিজ্ঞেস করো।
তার আগে এই কাজটা শেষ করে নিই।
তুমি কি লোকটাকে মারবেই?
তোমার গতি অকস্মাৎ বেশি না হয়ে গেলে সেটাই লোকটার নিয়তি।
তুমি যা করো, তার সম্পর্কে তোমার নিজেরই কোন ধারণা নেই। তুমি জানো, মৃত্যুর চেহারা কত কদাকার। কিন্তু মৃত্যু কত সম্ভাবনা নিভিয়ে দেয়, সেই হিসাব তুমি রাখ না। তুমি স্মরণ রাখ, কত হাজার প্রকার মৃত্যু তুমি দিতে পারো। কিন্ত্তু তোমার উপস্থিতি কত ঘৃণ্য, কত নিগৃহীত, তা তুমি জানো না।
উত্তর যোগালো না মৃত্যুদূতের মুখে। শেফা আবার বললো, 
হয়তোবা, যাকে এখন তুমি মারতে যাচ্ছো তার ওপরে তার পুরো পরিবার  নির্ভর করে আছে। সে মারা গেলে তাদের কী হবে?
তাদের খাদ্য ঈশ্বর যোগান দেবেন। 
হয়তোবা অসৎ উপায়ে তাদেরকে জীবন ধারণ করতে হবে। সেজন্যে তুমি এবং ঈশ্বর দায়ী থাকবে।
তোমার আজ হয়েছে কী? ঈশ্বর প্রেরিত দূত হয়ে তুমি তার বিরুদ্ধেই তর্ক করছো?
ব্যাপারটা তা নয়। আমি তোমাকে তোমার ভুল সম্বন্ধে সচেতন করে দিচ্ছি। 
সন্দেহের দোলাচলে মৃত্যুদূতের মন। ‘সে রকম হলে ঈশ্বর নিজেই আমাকে সচেতন করতে পারতেন।’
এখন সে সময় এসেছে। আরেকটা ভুল করার আগেই তুমি জেনে নাও, এটা প্রকৃতই ভুল কিনা।
এবার থমকে দাঁড়ালো মৃত্যু, চোখে সংশয়। কি বলবে, ভেবে পাচ্ছে না। তার কাছে এসে শেফা থামলো। বললো,
এখনো সময় আছে। যাও, জেনে এসো।
একটু ইতস্তত করে মৃত্যু বললো ‘আর সে সুযোগে তুমি যদি...’
না, না, আমিও তোমার সাথে যাবো, চলো।
চলো।

সবই প্রত্যক্ষ করছিলেন ঈশ্বর। এতক্ষণে মৃত্যু তার আসনের উপকন্ঠে এসে দাঁড়ালো। বললো ‘আদেশ দিন ঈশ্বর।’ মৃত্যুদূতকে আদেশ না দিয়ে শেফাকে বললেন ঈশ্বর, ‘তোমার অভিসন্ধি আমার নিকট নিঃসংশয়। মৃত্যুদূতের বুদ্ধিমত্তার ধার প্রত্যক্ষ করে তোমার সাজানো ছক অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। তবে তুমি শুনে রাখো - মৃত্যু, তার রূপ যত প্রকট, যত দানবীয়, যত ধ্বংসাত্মকই হোক না কেন সবার ভাগ্যেই তা অবশ্যম্ভাবী। কারণ, দেহে অমর মানুষ পৃথিবীর জন্য হুমকি। দেহে অমর না হয়ে শ্রেষ্ঠত্বে অমর হবার সুযোগ আমি মনুষ্যজাতিকে দিয়েছি।’ এবার দুজনকেই আদেশ দিলেন তিনি ‘অতএব তোমারা পুনরায় গমন করো। যে আগে পৌঁছবে, সে-ই জয়ী।’

আবার রওয়ানা হলো দুই দূত, দুই বিপরীত ধরনের ঘটনার বাহক। আড়ালে ঈশ্বর যে সামান্য প্রসারিত করলেন তার ঠোঁট নিঃশব্দে, তা দূতদের চোখে পড়লো না। তবে এবার মৃত্যুদূতের চেয়ে রোগমুক্তি অনেকটা এগিয়ে রইল।

____________________________________________
প্রবন্ধ
_____________________________________________


বৈকুন্ঠে যাব
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর

কোন প্রকার দর্শন মাথায় নিয়ে একজন গল্পকার গল্প লিখতে বসেন কি না-এ প্রশ্ন অনেকের মত আমারও। কোন গল্প যদি দর্শন ধারন করে, শুধু একটি নয় একাধিক দর্শন ও যদি গল্পে থাকে তাহলে গল্পকারকে দর্শনমুখিনতার জন্য কতটুকু দায়ী করা যাবে? দর্শন উপস্থিতির কারণে যদি গল্পের চেয়ে দর্শনই বড় হয়ে দেখা দেয় তাহলে সেই গল্পের মৃত্যু অনিবার্য। একই কথা আঙ্গিক বা শৈলীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। শৈলী বা আঙ্গিক যদি গল্পকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠে, শৈলী অভিনব হলেও,পাঠক গল্পকারকে অভিনবত্বের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেই এর দায়ভার গল্পকারকে বহন করতে হয়। ইচ্ছাপূরণের গল্প-কষ্টকল্পিত গল্প, কোন গল্পরই বিপক্ষে মতামত দেয়া সহজ নয়, যদি গল্পটি সার্থক গল্প হয়ে উঠে। গল্প সবসময় বাস্তব ভিত্তিক হতে হবে। এটা স্বথ:সিদ্ধ নয়। বাস্তবতার রয়েছে কত রকমফের। কল্পনার ভিত্তিভূমিও বাস্তবতা। কল্পনা সৃষ্টিশীলতার বড় অংশ। আজকের জটিলতা আগামীদিনে সহজ সরল রূপে দেখা দিতে পারে, অতীতেও তাই হয়েছে। প্রাগ্রসর পাঠক তা বোঝতে পারে। পাঠকের জন্য সরলীকরণ, সেই পাঠকের কথা ভেবে ভাল গল্পও হয় না, মহৎ কবিতা হয় না। ‘বাংলা গল্প’ বাংলা সাহিত্যের কনিষ্ঠ সন্তান হয়েও এর গৌরবের ফর্দ বেশ দীর্ঘ। গল্প লিখতে বসে একজন গল্পকারকে কি কি বিষয় মনে রেখে গল্প লিখতে হবে? বরংচ বলা যায় কোন বিষয় বাদ দিয়ে যাবে গল্পকার। কথা সাহিত্যকে বলা হচ্ছে জ্ঞানের অভিধান। বয়স ধরে রাখার স্টেমসেলের ব্যবহার থেকে শুরু করে মাথার উঁকুনের খবর পর্যন্ত রাখতে হয় গল্পকারকে। বিজ্ঞানের যত যুক্তি-ব্যাখ্যা আছে তা মেনেও বলা যায় অব্যাখ্যাত অনেক বিষয় গল্পে স্থান করে নিচ্ছে অবলীলায়। জাহেরি জগত পার হয়ে বাতেনি জগত কত হাঁটুভাঙ্গা যুক্তির মোড়কে ঢুকে পড়ছে গল্পে। পাঠক নিচ্ছে। হরদম নিচ্ছে। ছোট কোন ঘটনা, অল্প সংখ্যক পাত্র পাত্রী-আর তীব্র একটা গতিশীল দ্বন্দ্ব ও সমাধানের নাম গল্প-না গল্প বর্তমানে সেই জায়গাকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রাচীন সংজ্ঞার শরীর ক্ষত বিক্ষত করে অস্বীকার করে এগিয়ে চলছে ছোট গল্প।

পশ্চিম থেকে আসছে বলে নতুন কোন শৈলীর ব্যাপারে মুখ ফিরিয়ে থাকার অবসর কোথায়? একই সঙ্গে শিল্পের অন্য কয়েকটি মাধ্যম:  নাটক, গান, চিত্রশিল্প মোটেই বসে নেই। তবে বিপদের কথাও আছে। সুবিধা অসুবিধা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠঃ মূলকথা আত্মস্থ করা। পরিবেশনে যেনো এ মাটি ও মানুষের সংলগ্নতা থাকে। গল্প পড়ার পর পাঠক যেনো বলে না বসেনঃ  বুঝলাম ঢংটি বাইরের কিন্তু মাটি ও মানুষকে কেন চিনতে পারছি না। গল্পকার তার অভিজ্ঞতার বাইরে যেতে পারেন না। বিষয়ের সম্ভাব্যতা স্পর্শহীনতাও লেখকের ভূগোল থেকেই উঠে আসে। বলা হয় গল্পের বাস্তবতার ভেতর শৈলী লুকিয়ে থাকে বা অবস্থান করে। আবার নিবিড়ভাবে আত্মস্থ শৈলীর উপরও বাস্তবতাকে স্থাপন করা যায়। শুধু লেখককে সাবধান থাকতে হয় তা যেন চর্বিত চর্বন না হয়। আত্তীকরণ করা হয়। সংকট আরো আছেঃ আমরা একই সঙ্গে দৈশিক ও বৈশ্বিক। এতে সুবিধা অসুবিধা দু’ই-ই।

ল্যাটিন আমরিকা, আফ্রিকার গল্পের স্বকীয়তা বা তাদের ব্যবহৃত ফর্ম তাদের বাস্তবতা থেকে সৃষ্ট বলে তারা যে পশ্চিম থেকে কিছু নেয়নি এমন নয়। আমাদের প্রাচীন গল্প আমাদের কাছে ফিরে এসেছিল দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে। আরব্য রজনী পড়ে আমরা বুঝলাম দীর্ঘ ভ্রমণে গল্প পাল্টে যায়। এই গল্প যেখানে গিয়েছে সেখানে বিয়ে করেছে সংসার পাতি করেছে। আবার বেনিয়ার জাতের মত অন্য ঘাটে গেছে। পঞ্চতন্ত্র হিতোপদেশ জাতকের গল্প-এসব গল্পে প্রাণীরা কথা বলে। রবীন্দ্রনাথও লিখলেন ঘাটের কথা রাজপথের আত্মকাহিনী।

বাংলা ছোট গল্পের রাজকীয় তোরণের সর্বোচ্চ স্থানটি বা রাজমুকুটের সবচেয়ে সুন্দর পালকটির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তারপরও গল্প রবীন্দ্রনাথ থেমে নেই।

গল্পকার কি নেবেনা তার লেখায়? সংস্কার কুসংস্কার, টুটেম ট্যাবু, যাদু (জাদু), বাস্তব, অধিবাস্তব, ধর্ম-বিজ্ঞান, রাজনীতি, শরীর-অশরীর কোনটাকে গল্পকার বাদ দিতে পারে না।

অন্য প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শরীর প্রসঙ্গে দু’চার কথা বলতে ইচ্ছে এ অধমের। দু’টি শরীর পরস্পর না জাগলে একে অন্যের ভেতর প্রবিষ্ট হওয়াই অন্যায়। অন্য অর্থে তাই ধর্ষণ। শরীর পাওয়ার মূলভিত্তি যদি হয় ভালোবাসা তাহলে বলতে হয় এখানে ভালোবাসার অভাব আছে। অনেক পাঠক-সমালোচক আছেন যারা গল্পে শরীর উন্মোচনকে অনুমোদনই করেন না। তাদের নিজেদের শরীর আছে কি না প্রশ্নজাগে। আরেক শ্রেণীর পাঠক সমালোচক আছেন যারা আড়াল পছন্দ করেন। কেউ বলেন শিল্পীত আড়াল। অথচ এদের প্রায় সকলেই বিশ্বর নান্দনিক সকল নগ্ন ভাস্কর্য দেখে বিস্ময়-বিমূঢ় দৃষ্টিতে। তবে তাদের একটি প্রশ্ন করার অধিকার স্পষ্টত থেকে যায়: গল্পে প্রয়োজনহীনভাবে শরীরের ব্যবহার করা কি ঠিক। গল্পকারের অন্য সব ব্যর্থতার সাথে এ ব্যর্থতাকে সমালোচনা করার অধিকার তাদের আছে। উল্টো কথা হলো একটি গল্প শুরুই হতে পারে শারীরিক সম্পর্কের বর্ণনা দিয়ে। তারপর এগিয়ে যেতে পারে সন্দেহের বিস্তারে। কেন হলো? হওয়ার পর কি হলো? ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে কোন আপ্ত বাক্যই গল্পকারের জন্য প্রযোজ্য নয়। প্রযোজ্য শুধু এর প্রেক্ষিতটুকু সঠিক করে তোলা।

কখনো কখনো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে বড় বেশি আড়াল করেছেন। তিনি খুব বেশি সাবধানী ছিলেন। আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার গল্পে সেই শূন্যতাটুকু ভরাট করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন এবং তাই করেছেন। সার্থক হয়েছেন।

শরীর বিষয়ক লেজটা লেজহীন শরীরে অনেক বড় হয়ে গেলো। লেজ খসে গেলেও মাথার বোঝা ভারি হতেই থাকে। নতুন নতুন বিষয়ের ঘাতে ভারি বোঝা আরো ভারি হয়। হৃদয় বৃত্তির চেয়ে মগজ (চিন্তা) বৃত্তি বেড়ে চলে। গল্পকার যেন আপন মনে জপতে থাকে : বোঝার উপর বোঝা, নামাবে কোন ওঝা। নিজের বোঝা নিজেকে নামাতে হয়। গল্পের (সাহিত্যের) বোঝা অন্যের সাহায্যে নামানো যায় না। ওঝা (গল্পকার) যদি সাপের বিষদাঁত 
আগেই তোলে ফেলে খেলা দেখাতে নামে তাহলে পাঠক বুঝতে বিলম্ব করবে না সমস্তটাই খেল। খেলা নয়। প্রতিটি  নতুন সৃষ্টিতে ওঝার (গল্পকারের) মৃত্যু হয়। আরেকটি সৃষ্টির ভেতর দিয়ে নব জন্ম হয়। এভাবে লেখকের জন্ম-মৃত্যু ঘটতে থাকে। সম্ভবতো এ জন্ম মৃত্যুর নাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মিশরীয় সেই প্রত্ন চিহ্নের মত। যে চিত্রে সাপটি নিজেকে লেজের দিক থেকে গিলতে শুরু করেছে। নিজেকে নিজে গিলে ফেললে নিজেই উল্টে যায়। আবার মৃত্যু, আবার জন্ম। তবে নিরীক্ষার সাফল্য সহজে পাওয়া যায় না। কালে কালে একেটা ঘূর্ণাবতে (সাহিত্য আন্দোলনে) পাঠকের রুচি ও মননে যে দাগ পড়ে সে দাগ মুছে নতুন দাগ লাগানো সহজ কথা নয়।স্তূপকৃত অতীত জঙ্গমতা  বিরোধী বিদ্রোহী পাওয়া কঠিন। নিরীক্ষার কানের কাছে মৃত্যু নিঃশ্বাস ফেলে।সম্মুখ ভাগের যোদ্ধারা প্রথম শহীদ হয়। তাদের গাজী হওয়া দূরহ। বলতে ইচ্ছে হয়-

‘নিরীক্ষা আর পরীক্ষা অবিরাম
করে চলেছে যে জন বা যারা
আমি অধমও আছি প্রস্তুত
বৈকুন্ঠে যাব বলে এক পায়ে খাড়া।’

_____________________________________________


প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলার প্রকৃতি : তৎপরতা, অপতৎপরতা
গোঁসাই পাহ্‌লভী

সন্দেহ নেই স্বাধীনতাপূর্ব আমাদের সংস্কৃতিচর্চা শাসক শ্রেণীর অর্বাচিত ক্রিয়াকলাপের  মধ্য দিয়ে বিশেষ উচ্চতা এবং সুনির্দিষ্ট গুণগত রূপ অর্জন করেছিল। আমারা দেখেছি, এইরূপ যতনা আমাদের সমাজ চেতনা-জাত, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আঘাতের প্রতিক্রিয়াজাত। সেটা ছিল সংশ্লিষ্ট শ্রেণী-বিশেষের স্বার্থ নির্ভর মানসিকতার চেতন অচেতন প্রতিফলন। ছিল শিক্ষিত শ্রেণীর আত্মবিস্তারের পদক্ষেপ। ছিল বিশেষ কয়েকটি শ্রেণীর অর্থনৈতিক স্বার্থ ও ক্ষমতালাভের পক্ষে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি চর্চা।... আসল সত্য হলো... তার শ্রেণী স্বার্থের প্রয়োজনেই বাঙালি সংস্কৃতির চর্চায় ও সংস্কৃতির বাঙালিপনায় উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল। আহমদ রফিক, বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৭, মুক্তাধারা, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ১৯৮৬।

এক. ‘সংস্কৃতি চর্চা’ কখোনও একই জায়গা থেকে একইভাবে একইরূপে প্রকাশিত হয় না। সংস্কৃতি এবং চর্চার মধ্যেও স্পষ্ট ফারাক রয়েছে। লোকসংস্কৃতি এবং নগর সংস্কৃতি বলে যে দু’টি ধারা আমরা সনাক্ত করি তার বিভক্তিকরণ পদ্ধতি উপনিবেশিক এবং ক্ষমতা ও প্রয়োজনভিত্তিক বিভাজিত অবস্থা। একালে ওসবের পরিবর্তন ঘটেছে। প্রশ্নটি হোল কার বিষয় কে চর্চা করে। ‘নগর সংস্কৃতি’র নামে যে বিভ্রান্ত পদটি আমরা পাই তার চাপেই সংস্কৃতির ধারণার বেহাল অবস্থা। -এর অর্থ হলো নগর মূলত কিসের চর্চা করে এবং কার  চর্চা করে? কোথা থেকে সে সংস্কৃতি চর্চার উপাদান পায়।

দুই. ‘লোক সংস্কৃতি’ বোলে যে আলাদা একটি সংস্কৃতির প্রস্তাব এ্যাতোকাল আমরা শুনেছি, আদতে তাকে কি সংস্কৃতির সংজ্ঞায় ফেলে হ্রাস করা হয় না। মূলত  জীবনের যে অঙ্গগুলোর সমন্বয়ে লোকমানস গঠিত হয় তার থেকে দু’য়েকটি অঙ্গ খসিয়ে যদি নাম দেয়া হয় সংস্কৃতি, তাহলে লোকজীবন হয়ে পড়ে বিকলাঙ্গ। একথার ভিত্তিতে আমরা যার নগর সংস্কৃতির পান্ডা তাঁরা যে গৃহে বসবাস করি সেখানকার নির্মাণ উপাদান আদতে লোকমৃত্তিকার রূপান্তরিত পর্যায় হোলেও মৃত্তিকা ও লোকসমষ্টি তাকে আর গ্রহণ করার পর্যায়ে থাকে না অর্থে গ্রহণ করার শর্ত নষ্ট হয়ে যায়।

‘লোকসংস্কৃতির’ পদটির আবিষ্কার মূলত নগর কর্তাব্যক্তিদের ‘সংস্কৃতি’ বিশেষ। পদটির মধ্যে রয়েছে লোক জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধরার চিহ্নায়ন প্রচেষ্টা এবং লোক মানসিকতার উপর এক ধরণের জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্মাণও বটে। মূলত নগরকর্তা সকল সবসময়ে যা দেখাতে চায় লোকজীবনের  ঘাত-প্রতিঘাত এবং তাদের বাসনার মূর্তাবস্থা হিসাবে নগরের উপস্থিতি এবং প্রান্তীয় জীবনাচারণ কেন্দ্রীয় ডিসকোর্সের সাহায্য ব্যতিতে বুঝে ওঠার তৎপরতা যেন আমরা আর করতে পারি না।

শাসকশ্রেণীর এই এক কর্ম। প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃত সকল বস্তুর ওপর ‘ধারণাসীমা’ আরোপ করে সকল বস্তুকেই একমুখী এবং এক কেন্দ্রীক করে গড়ে তোলে। সেদিক থেকে রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত সকল প্রান্তীয় প্রকাশ যেন কেন্দ্রমুখী। কেন্দ্রকে চিন্তা করেই যেন সেই সব বাসনার নির্মিতি ঘটে।
বাঙলাদেশের বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক সাংস্কৃতিক চর্চাও তাই উপনিবেশিকতাবাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি জগাখিচুড়িমূলক সংস্কৃতি। উত্তর উপনিবেশিক পর্ব বলে যে কালখন্ডের সংস্কৃতি অঙ্গনটিকে বর্তমানে আবিষ্কারের চেষ্টা চালোনা হচ্ছে উপাদানগতভাবে তার ভাষা ঔপনিবেশিকতাপর্ব থেকে পৃথক নয়। আমাদের শাসক সকল উপনিবেশিকনীতি ও শাসন পদ্ধতি থেকে পৃথক কোনও চরিত্র নিয়ে আমাদের সামনে হাজির নয় আজ। সংস্কৃতি চর্চার স্বরূপটিও যেন একই ফ্রেমে বাঁধা।

ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি মানে কী?
‘উপনিবেশকারীগণের চর্চা’
উপনিবেশকারীগণ কীসের চর্চা করে?
‘যা কিছু উপনিবেশ ঠিক করে দেয়, যথাযথ শৃংখল’
কারা উপনিবেশ ঠিক্‌ করে দেয়?
‘যারা উপনিবেশ স্থাপন করে এবং অন্যের জন্য তার অংশ ছেড়ে দেয়।’

এখন অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের জন্য তার যে অংশ ছেড়ে দেয় তাঁরা উপনিবেশ স্থাপন কালে; আদৗ খেয়াল রাখেনা, যে জায়গাটি তাঁদের অপরিজ্ঞাত এবং তার মানে, ‘অপরিজ্ঞাত স্থানে আবাসস্থল নির্মাণ করে সাময়িকভাবে কিংবা চিরস্থায়ীভাবে বসতি করা। এই অর্থে মানুষের নতুন বসত নির্মাণকেই উপনিবেশ বলা হয়েছে।” ‘উপনিবেশ’ যাহারা উড়ে এসে জুড়ে বসল তাহারাই নহেন, তাঁহারা শাসন করবার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন প্রকল্প নির্মাণ করেন, অই প্রকল্পে দেশি বিদেশি যাহারা বসেন, ডিম পাড়েন, বাচ্চা প্রসব করে বংশ বিস্তার করেন তাহারাও ‘উপনিবেশিক’। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি উপনিবেশবাদী এওরুপে এবং আরো অন্যান্য যাহারা তাহাদেরও তাহারা অর্থাৎ খোদ এই ভারতকান্দার অধিকাংশ মানুষও এই ‘উপনিবেশ’- এ বসবাসকারী।

এই উপনিবেশবাদ দীর্ঘায়ু করার প্রকল্পের কয়েকটির মধ্যে একটির নাম এশিয়াটিক সোসাইটি আরেকটির নাম কলিকাতা গর্ভমেন্ট আর্ট স্কুল। উভয় প্রকল্পের আওতায় যাহারা শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছিলেন, আমাদের বিচার উহাদের অধিকাংশই সর্বভারতীয় অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সমপ্রদায়।

কেন কলিকাতা গভর্মেন্ট আর্ট স্কুল গঠিত হয়েছিল? তারা কি এদেশে শিল্পচর্চার প্রসার ঘটানোর জন্যই এই যজ্ঞটির বীজ রোপন করেছিল, সম্ভবত নয়। ইতিহাস ঘাটিয়ে আমরা জানতে পারি ‘টমাস ব্যবিংটন মেকলে’ ১৮৩৫ এ যে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাবনা করেছিলেন তার অন্তর্নিহিত ভাবটি সেকালে প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন- ভারতীয় শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনে এমন একটি শ্রেণী সৃষ্টি করতে হবে, যারা রক্ত ও ত্বকের পরিচয় হবে ভারতীয় কিন্তু রুচি, মতাদর্শ, নীতিবোধ এবং প্রজ্ঞায় হবে ইংরেজ। কিন্তু ‘মেকলের শিক্ষা প্রস্তাবে কেতাবি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও, কারিগরি শিক্ষার স্থান ছিলো না। কিন্তু উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার খাতিরে জরিপ, যোগাযোগ ইত্যাদি টেকনিক্যাল সংস্থান নিম্নস্তরের কাজে প্রচুর লোকের প্রয়োজন হলে বাস্তব কারণে ইংল্যান্ড থেকে লোক আনা তখন সম্ভব ছিলো না। ফলে যে সব কাজে হোম থেকে লোক আনানো ছিল ব্যয়সাপেক্ষ এবং যে কাজগুলিতে প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রায় নেই, এই রকম কাজে এ দেশের জনসম্পদ ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল- (ফয়েজুল আজিম, বাংলাদেশের শিল্পকলার আদিপর্ব ও উপনিবেশিক প্রভাব পৃ. ৪৭) ‘এই বিশেষ প্রয়োজনের অংশ হিসেবে  ইংরেজরা সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল স্কুলের কাঠামোতে ভারতে আর্টস্কুল গড়ে তুলেছিলো।


কিন্তু এই স্কুলগুলিতে কারা শিক্ষা গ্রহণ করতো? দেখিয়েছি যাহারাই ‘ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার’ চাহিদা পূরণে আর্থিক প্রয়োজনের তাগিদে আগ্রহী ছিল। এওরোপ পক্ষ থেকে অবশ্য নির্বাচিত ছিল ‘ঐতিহ্যগত কৌলিক বৃত্তির কারিগররা’। অর্থাৎ ‘ঊনবিংশ শতকের প্রারম্ভে উত্তর-ভারতীয় শিল্পী বটতলার আঁকিয়ে আর কালিঘাটের পটুয়ারা’ এরাই যদিও চিত্রশিল্প এবং স্কুলের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন অতঃপর ‘আর্টস্কুল সরকারি অধিগ্রহণের পর’ হেনরি হোভার লক্‌ সাহেব অধ্যক্ষ হিসাবে যোগদানের সময়ও নিম্নবর্গ বৈ উচ্চবর্গ থেকে তেমন ছাত্র স্কুলে শিক্ষালাভ করতে আসিত না। কিন্তু এর কিছু কাল পরে পরিস্থিতি পাল্টে গেল। ‘বাংলা পত্রিকা সঞ্জীবনী’তে লেখা হোল “তিনি (লক্‌) যখন প্রথম স্কুলে পদার্পন করেন... তখন কামার, কুমার, ছুতোর প্রভৃতি শ্রমজীবী শ্রেণীর লোক ভিন্ন ভদ্রবংশীয় সন্তানগণ এখানে শিক্ষা লাভ করিতে বড় আসিত না। এখন এই বিদ্যালয়ে সদ্বংশীয় ও শিক্ষিত বালকগণের সংখ্যা দিন দিন বাড়িতেছে (শোভন সোম, ‘অনুষ্টুপ: শারদ সংখ্যা, ১৯৮৬; কলিকাতা পৃ. ৬৫)

অত:পর সদ্বংশীয় ও (পাশ্চাত্য ভাবধারায়) শিক্ষিত বালকগণের ‘কলিকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্ট- এ অনুপ্রবেশের কালপর্বে দুটি প্রবনতার জন্ম ঘটলো, ‘এক, শিল্পকলার শ্রেণীগত পালাবদল। অর্থাৎ নিম্নবর্গের হাত থেকে শিল্পকলার কর্তৃত্ব স্থানান্তরিত হলো উচ্চবর্ণের হাতে। এই পরিবর্তনের ছাপ শিল্পের বাহ্যিক চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, চাকুরী নির্ভর শিল্পী সমাজের জন্ম। কলকাতার নিম্নবর্গের আদি চিত্রকররা সম্পূর্ণ বৃত্তি নির্ভর শিল্পী ছিলেন। কিন্তু আর্ট স্কুল থেকে পাশ করা ছাত্রদের সামনে সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এই শিল্পীদের মাঝে সার্বক্ষণিক শিল্পচর্চার পরিবর্তে চাকরি নির্ভরতা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলো।’

যাই হোক আমরা দেখলাম ভারতবর্ষে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলার প্রতিষ্ঠানটি মূলত কেন গড়ে উঠেছিল এবং ওখানে নিম্নবর্গের থেকে শিল্পকলা কিভাবে বেহাত হয়ে উচ্চবর্গের হস্তগত হয়।

তিন. কিন্তু এক্ষনে আমাদের বিচার্য বিষয় হোল বাঙলাদেশ থেকে যে সমস্ত শিক্ষানবিশ কলিকাতায় শিল্প শিক্ষার ডিগ্রি লাভ করতে গেলেন তাদের বর্গটির নাম কি? জয়নুল আবেদীন থেকে যদি ‘বর্গে’র হিসাবটি শুরু করি তাহলে তালিকায় আসে নিম্ন মধ্যবিত্তের নাম। কিন্তু ‘নিম্ন  মধ্যবিত্ত’ অভিজ্ঞতার ‘কলিকাতা গর্ভমেন্ট আর্ট স্কুলে’র টালিখাতায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্তি করে, একইভাবে কলিকাতার স্থানীয় ‘নিম্নমধ্যবিত্ত’ বা নিম্নবর্গ কী একই অভিজ্ঞতা নিয়ে সেখানে নিজেদের নাম অন্তর্ভুক্তি করে। সম্ভবত নয়। উভয়ের অভিজ্ঞতার পরিমাণ এবং তাঁদের সাথে শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার সহিত নীতিগত দ্বন্দ্ব বা সমন্বয়ের চরিত্রের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ বলতে তখনও তাদের অভিজ্ঞতায় এমন কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলনা যাতে করে ‘সার্বিক সাংস্কৃতিক মুক্তি’ বলতে যা বুঝায়,  তার আগাম সম্ভাবনার দ্বার কলিকাতার উক্ত আর্ট স্কুলের ছাত্রদের হাত দিয়ে উন্মু্‌ক্ত হোতে পারে!                                                                  (চলবে)
                                                                             
জোড়াতালির ক্রমানুসারে
১. বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি-আহমদ রফিক, পৃষ্ঠা ৫৫-৫৭, মুক্তধারা, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ১৯৮৬
২. ভাষা পরিকল্পনা ও অন্যান্য প্রবন্ধ,  মনসুর মুসা, মুক্তধারা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি-১৯৮৪
৩. বাংলাদেশের শিল্পকলার আদিপর্ব ও উপনিবেশিক প্রভাব-ফয়জুল আজিম, বাংলা একাডেমী, সেপ্টেম্বর ২০০০

_____________________________________________
মুক্তগদ্য
_____________________________________________

রক্তিম মাধুরী
পিয়াস মজিদ

কবিতা ও জীবনকে যিনি ‘একই জিনিসের দু’রকম উৎসারণ’ ভাবতেন তাকে নিয়ে কোন সংশয় থাকতে পারেনা। অথচ নিঃসময়, নিঃসমাজ বলে তার ভিন্নতর মূর্তি গড়ার কী প্রাণান্ত প্রচেষ্টা অনেকের। ‘শুদ্ধতম’র শিরোপা দেবার জন্যে তাকে বিরাজনীতিক বলতে কারো কারো তিল পরিমাণ দ্বিধাও হয় না! জীবনানন্দ দাশের কথাই হচ্ছে। এর আগেও অনেক হয়েছে তার কথা। তবু যতই ফিরে ফিরে চাই, তাকে যেন দেখিতে না পাই। জন্মের শতবর্ষ চলে গেল। নতুন তথ্যে, নতুন ভাষ্যে তিনি যেন ধূসর থেকে আরো ধূসরতর হচ্ছেন। আকাশ জুড়ে শুধু কুয়াশা আর মেঘ। কিন্তু তাকে আবিষ্কারের সূত্রগুলো কি এতটাই জটিল? ‘ঝরা পালক’ এ বিপুলভাবে নিয়েছেন নজরুলকে। অল্প কিছু পরই তার নিজের পথ ঠিক হয়ে গেছে। চলে গেছেন একেবারে প্রত্ন-বাংলার গভীরে। ‘বাংলার মাটি-বাংলার জল’ তার কবিতায় অনুষঙ্গ হিসেবেই আসেনি শুধু বরং শ্যামলী স্বদেশের আশ্রয়ে পর্যটন করেছেন পৃথিবীর দূরতম মহাদেশ। গহন থেকে খুঁড়ে এনেছেন ভূতভবিষ্যবর্তমানের আলো ও তমস। প্রলাপ ও হাহাকারের সুর শুনেছেন। কিন্তু তাই বলে ফাঁপা আশাবাদের গান গাননি। চারদিকে বিশ্বযুদ্ধ-দাঙ্গা-ক্ষুধা-ভাঙ্গন-বিচ্ছিন্নতার বোধ। এ থেকে পরিত্রাণের জন্যে সমুদ্র সমান পিপাসা নিয়ে তখন বনলতা সেনের কাছে গেলে হয়তো শুশ্রুষা মেলে। তাই জীবনানন্দের প্রেমকেও এই পরিপ্রেক্ষিতের সাথে যুক্ত করে বিবেচনা করতে হবে। মন্ত্রপড়া মতবাদী হয়তো ছিলেন না দাশবাবু। কিন্ত্তু সৎশিল্পী যেহেতু ছিলেন তাই তারও পক্ষ ছিল। তবে তার আগে সবকিছু একটু পরখ করে নিতে চেয়েছেন। ইতিহাসের চোরাবালি ঘুরে, দর্শনের সার শুষে নিয়ে তার প্রবল কান্ডজ্ঞান খাটিয়ে একটা বোঝাপড়ায় পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন। আর এরপরই নিজের মধ্যে মত্ত হয়েছেন নিরন্তর কাটাকুটিতে। ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’ তাই কোন বিক্ষিপ্ত উচ্চারণ নয়; তার সমগ্রেরই একটি দিক মাত্র। বাইরেটা স্বচ্ছরূপে জানা ছিল বলেই মানুষের ভেতর নিয়ে তার অগ্রহ অশেষ। মানুষের অর্ন্তগূঢ়ে গিয়ে তিনি তুলে এনেছেন জীবনের গাঢ় সমাচার। তাই তার কবিতায় অর্ন্তগূড়ে রক্তপাত, ভাঙচুর এইসব একদিকে বিপন্ন অস্তিত্বের নির্জন স্বাক্ষর যেমন অন্যদিকে তেমনি বর্হিবাস্তব তার খন্ড খন্ড চিত্রও বটে। জীবনানন্দ নিয়ে কথা মানেই বিপন্ন জাহাজের নাবিকের গল্প বলা। ভাঙ্গছে, পুড়ছে, ভাসছে গোটা পরিপার্শ্ব। এর মধ্যে আমি একা তো নিরাপদ নই। আমিও ভয়াবহ রকম বিপন্ন। এ উপলব্ধির রসায়নই জীবনানন্দের কবিতা ও গদ্য। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির অদল-বদলে সকল টেক্সটেরই নাকি তাৎপর্য পাল্টিয়ে যায়। জীবনানন্দের লেখা পত্রও তবে এর ব্যতিক্রম কিছু না। আজ থেকে একশ বছর পর আমরা হয়তো আর এইভাবে জীবনানন্দ পড়বনা। তবু দেখার যেন থেকে যাবে কিছু। অন্যতর কিছু। অক্ষরের সীমিত বৃত্ত ভেঙে আজ কাল-আগামীর পাঠকের চোখে তুমুল অন্ধকার ঠিকরে ধরা দিতে পারে দুফোঁটা-এক ফোঁটা রক্তিম মাধুরী।

_____________________________________________

চোখের জলে ভিজে যায় সময়ের মুখোশ
দিবাকর মজুমদার

সে পথে অনেকেই গেছে; কাহিনীগুলোর বুকে তাদের ব্যর্থ কঙ্কাল,হাড়,হাতিয়ার সব জমা আছে; পথের দু’ধারে পাথরে রূপান্তরিত কারো কারো দেহ, কাহিনীর ব্যথাতুর হাড় তৈরি হয়েছে তাদেরই গুমড়ানো আত্মার আর্তনাদ ছেঁকে; তবু কাহিনীর লক্ষ্য হলো অন্য কোন মোক্ষ; এমন কোন আলোকপ্রাপ্ত নায়কের অনুগত যে কিনা ফিরেও এসেছিল তেমন পথে গিয়েও; এরকম নিষ্ঠুর কেন সময়ের মুখোশ? ব্যর্থতা জমে জমে যদি ভরাট না হয় অন্ধকার, তবে কোন নায়কের সাধ্য সেখানে পাথরের ঘুম ভাঙ্গায়, বিজয়ের ছটায় হাস্যোজ্জল করে কাহিনীর মুখ? সময় তবু মুখ খোলে না, কাজল রেখার শুকের মতো; কোনদিন মোক্ষম মুর্হুত আসবে কি? কিন্তু যে মঞ্চে নায়ক নেই,ইতিহাসের নাটক সেখানে অন্যরকম, গল্পের লক্ষ্য যখন ব্যর্থতার পাশ ঘেঁষে এগোয় আমি তেমনি একটি আকাঙ্ক্ষার কথা বলছি,- মহাজগতের নিঃসঙ্গ নিয়মগুলো যেন পরস্পরের মুখ দেখতে পেলো, চমকে ওঠলো ভীষণ, দুর্নিবার আকর্ষণের বেগে, সেই বিপন্ন পাথরের জন্য অপর কোন মানুষের প্রেম, করুনা নয়; নিজের বুকের রক্তে সে পাথরকে ফুটায়, তখনো বাকি ছিল তার পথ পরিক্রমা অথচ কাহিনীর বুকে জেগে থাকে অনন্ত কান্না সেই নিবেদনকে মহত্ত্ব দিতে। জয়ের থেকেও অধিক গভীর সেই প্রেরণা; আত্ম নিবেদনের ঐ তরল পরাক্রম সমস্ত ব্যর্থতা ও দুর্বলতাকে নির্মল করেছে... ঐ দেখো রাজকণ্যার সহচরী শুয়ে আছে সমুদ্র সৈকতে চিরকালের প্রেমিক মন সাগরের অনবরত ঢেউ হয়ে তার কাছে বহন করে নিচ্ছে নুন, তার বুকে আটকে থাকা জলকে আরো প্রগাঢ় করতে। 

____________________________________________

যাপনের এইসব খেরোখাতা
আবির নোমান

আষাঢ়ের তৃতীয় দিন মেঘ বন্ধ হল, মেঘ যা কয়দিন চললো, বান নামলো এদিক-ওদিক। দুই দুই সংখ্যায় আমার জম্ম,সংখ্যা দুইটার যোগ-চার আষাঢ়ে আকাশ ফর্সা হল।আজকের আকাশের সাথে তুলনা দেবার মতো কোন মেয়েলোক আমাদের পাড়ায় নাই, কিছু আগে যদিও ছিল সে কোথায় কার ঘরে পোলা-পাইনের পোয়াতি হয়েছে জানা নাই,মনে আমাদের আজকের ঝিরঝিরে বাতাসে চুল উড়ানো, উজ্জ্বল দিনের মত তরতাজা কোন মেয়ের স্বপ্ন হৃদয়ে নাই। না আমরা হতাশা ও নই,ফিল্মের লিপস্টিক-মেকাপের মুখগুলো আমাদের উজ্জীবিত রেখেছে। আকাশটা উদাসীন,ভালোই লাগে,গাছগুলো ঝিরঝির শব্দ তুলে ডানে-বায়ে হেললো-দুললো,মেঘ আজ চুপি-চুপি থাকলো,উনি একটু চেপে গেলে আষাঢ়টা আমাদের ভালোই যাবে;আশা রাখি। ৪ আষাঢ়,১৪১৪
                                                                                  

কেন আমি নিজের হতাশাগুলোকে দোষের ঘাঢ়ে চাপাতে চাই। নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় এ সকল কিছুর জন্য আমিই দায়ী। দোষকে কেন শব্দের নামে  নামাঙ্কিত করি, দায় এড়ানোর জন্য! তাই আমি ভীতু এবং কাপুরুষ।

আমার কর্মহীনতা আমাকে হতাশ করে । আমাকে নিষ্ক্রিয় এবং অলস দেখতে চাই না। পৃথিবীর কর্মস্রোতে আমার অবদান নেই। কেবলই আমার অস্তিত্বের অসারতা। ক্ষুদ্র গতিতে নির্ধারিত কাজগুলো কেন আমি করতে পারি না। আমি কি কর্মবিমুখ। এটা নিজের কাছে মানার মত কোন যুক্তি না। কর্মে আমার অলসতা, আমাকে শুইয়ে রাখে হতাশার কন্টকিত বিছানায়। অলসতা কেন! আমার কাজগুলো যদি কাজের মতো গুরুত্বপূর্ণই হয়! তবে কি কাজগুলো আসলে কাজ না! তাও না। কাজগুলোর প্রতি স্পৃহা থাকে না। স্পৃহা না থাকা অবশ্যই কাজগুলোকে সঠিকভাবে প্রমাণ না করতে পারা। বাস্তব সত্যটা বাস্তবিক পক্ষেই হতাশাজনক। এখানে এমন কিছুই নেই যা অদম্য ভালোবাসায় স্নাত হতে পারে অবিরত। সেটা আমার সাহিত্য হোক, আর যাবতীয় কর্মকান্ড যাতে আমার সুযোগ আছে। আমার  অর্ন্তজগতের ভিত্তিগুলো নিশ্চয়ই থাকতে হবে । সেখানে ব্যাপক শূন্যতা যা আমার সকল প্রকার কর্মস্পৃহাকে অর্থহীনতায় পর্যবসিত করে। প্রাচ্যের শূন্যই, তার একজনকে গিলে ফেলে। সে শূন্যতা থেকে নতুন কিছুতে নিজেকে চালনা করতে পারে না। হতাশাময় শূন্যতাই তাকে বিপুল গ্রাসে গলধঃকরণ করে। ২০ জুন ২০০৭
                  
আমি ব্যয়ে বিশ্বাস করি কিংবা আরো সঠিক লক্ষ্যে হানতে অপব্যয়ে বিশ্বাস করি। যথেষ্ট শক্তি অপব্যয় না হলে, অন্তঃসারতা আরো সমৃদ্ধ আরো শক্তিশালী হয় না। সম্ভবত অপব্যয়ের কোন গন্ডি থাকে না কিন্তু এটা অসীমও হতে পারে না, অতিরিক্ত ব্যয়ে গলে যাবে সকল শক্তির সার। জীবনের কি পরিমাণ অপব্যয়ের জন্য আমি অপেক্ষা করি;আমার শক্তির কেন্দ্রকে জ্বালিয়ে উঠাতে উপযুক্ত অপব্যয় কি শেষ হয় নি!

মধ্য আষাঢ় ঘন হচ্ছে, বালক বৈমানিকের মতো পাখিদের দুরন্ত ডানা মেলা মনোমুগ্ধকর। ওদের এমন চাঞ্চল্য আর বাতাসের উন্মাতাল প্রবাহ, মেঘেদের সত্যিকার সন্নাসী ব্রজ্যা দেখে আমি ভাবছিলাম এ আষাঢ় নয়, বসন্তরূপ নিয়েছে আমাদের দেশে। কৈশোরের শরীর পাওয়া ছিমছাম রোদ আমাকে রঙিন-ডানার ঈগলের মত উদ্বুদ্ধ করে ডানা মেলে দিতে নীল আকাশের সবুজ পৃথিবীতে। আমি আরো ম্রিয়মান, অপসৃত হয়ে যাচ্ছি পৃথিবীর দৃশ্যাবলী থেকে। চির বসন্তের কোলে ঘুমাচ্ছি, গালের হাড় আমার চোখ ঢেকে দিলো, ভ্রুজোড়া আরো সুগঠিত হয়ে বসলো আমার চোখের উপর। চোখ জোড়া নিমীলিত, মৃত লোকের মতো শীতল এবং স্থির। আমার উদ্যম এবং উৎসাহ নিঃশেষিত। বসন্তের দুবলা চকচকে রোদের শীর্ষে আমি দুলছি অনড় আলুলায়িত স্তম্ভে। ২৮ জুন ২০০৭
                                       _____________________________________________
কবিতা
_____________________________________________


অশোক আশরাফ
শাসন

সময়ের স্রোতস্বিনী আর
প্রশ্নের প্রণতি থেকে দূরে উবে যাওয়া কিছু ধোয়া
আজ বেশ শাসালো আমায়।
এ প্রেক্ষিতে মৃত্যু থেকে বিবিধ ব্যবধান ব্যতিরেকে
পৃথিবীর দিকে হা হয়ে আছি; রাঘব বোয়ালের মতো হা।
তলোয়ারের তলানি ক্ষয়ে, চাতালের তলে তলে মরচে পরা
প্রতিটি জনপদের পথের পরম্পরায় যুদ্ধ যায়।
অথচ একটা সূচালো ছুরির দিকে তাকিয়েও
জেগে থাকার দায় ঠেকলো এবার, ঘুমটা বরং নির্ধারিত
শপথের মুক্তি কেবল উক্তি ও উপলব্ধির সমন্বয়ে
বোকা বানালো আমায়। একরোখা রাখালিয়া।
পরিবর্তনের ওষ্ঠে এসে সময়ও আজ বেশ শাসালো
তারা’র পতনেও দ্যোতনা থাকে, ব্যগ্রতাও ধ্বনিময়।
এই আকুলতায় আমরা আমাদের দিকেই হা হয়ে আছি
রাঘোবের দিকে একরোখা ঘা হয়ে আছি।

কবিতা

একদিন সুবর্ণ ভালোলাগা থেকে জন্মেছিলাম বলেই
ডিমের খোলসের ভেতর
কুসুমের লাল মুছে দিতে চাইছি না আর।
চারদিকে দুলে-ঝুলে আরো ফুলে উঠা
শস্তা ভক্তি-ভঙ্গি নিয়মের বিজ্ঞাপন
জলধর যন্ত্রণার ভেতর থেকে গুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া হাওয়া আর
হালের বলদের দাম-দর বাড়লে আমার দামও বাড়তে থাকে
এবং আমি বেড়ে বেড়ে নগরায়তনের নিশানাকে ছাড়িয়ে গেলাম।
বিকাশ-প্রকাশের সীমায় পিচ্‌গলা রাস্তার আনাচে-কানাচে
অন্ধকারের অর্ন্তবাস খুলে আলোটা যে ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে গেলো
শুনতে পাওনি?
তবুতো আবার আমাদের সব খাট-পালং সরিয়ে নিচ্ছো
নামফলকের বাস্তুভিটা থেকে।



বুকে হাত রাখলে

বুকে হাত রাখলেই
পাঁজরের ভাঁজ টের পাই।
সেখানে বলিষ্ঠ হাতের চেয়েও
আরো ধারালো হাতিয়ার;
তাকে ঘিরে তাজা প্রাণের
ক্রমাগত ধ্বনিগুঞ্জন শুনে যাই।
আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রোদ

অন্য কোথাও 
প্রগাঢ় আত্মীয়তায় বাঁধে নিজেকে।
ভাবনার বিষয় কাটিয়ে
উঠোনে তবু কতো ধূলাবালি খেলা করে
বৃষ্টি নামে, ভেজা ডানা দু’টো
একটু জিরিয়ে নেয়, তারপর কিন্তু
পাখা ঝাপটায় না!
বুঝি বাড়ি ফেরার তাড়া নেই আর।
সেখানে পাথর চাপা, তার চেয়েও
গুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া বর্ণিল শ্লোক।
তার স্বপ্নীল আগমন কোথাও
ঝড় তুলেছিলো একদিন।

এখনো
বুকে হাত রাখলে পাঁজরের ভাঁজ টের পাই
জলে ভর দিয়ে
ডিগবাজি খেতে খেতে ঢিলটি অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে
জলের তলানিতেই আটকা পড়েছিলো।
ছোট ছোট ঢেউয়ের উপর আরো কিছু ঢিলের পথচলা,
সেখানেই তার ডানা ঝাপটানো সাঁতার
আমি সেই ধ্বনিগুঞ্জন শুনে যাই।



তৌহিদুল ইসলাম
অমৃতের সারস খুটে খায় কয়েকটি দানা

১.
যা খুশি গ্রহণ করো
তোমার পায়ের কাছে পড়ে আছে আমার কাটা নখ
                                            ও মস্তক।

২.
সকল বেদনাই বিচ্ছিন্নতার,     আর কোন বেদনা নাই
                                  আর কোন শ্বাসকষ্ট নাই

সকল সুখই প্রবিষ্টতার,         আর কোন সুখ নাই
                                  আর কোন শ্বাসকষ্ট নাই

তোমাকে বলি,   তোমাদেরকেই বলি
ছুরি হাতে যারা সর্বদাই প্রস্তুত-
কসাইখানায়
মিলনের অপার উৎসবে।

৩.
রক্তজবার মত তোমার নিকটে আসি
বলো কতদূর অই খোপা?   আর এই
আত্মবলিদান গ্রহণ করো
কেননা রক্তজবা চোখ আমারও রয়েছে তো।

৪.
যৌনতা,  তোমার কাছে বারবার নতজানু
পৌরুষ   চেতনার ভার অক্ষম বেদনার কাঁধে
                     তুলে দিয়ে বলি
                     প্রেম প্রেম প্রেম 
                            দাও
অনিশ্চিত ঈশ্বরী তবু তুমি যেদিকে তাকাও
সারি সারি উন্মাদ বিকলাঙ্গ শিশু
                    তীব্র চিৎকারে বলে
                       না   না   না
                            যাও

রাসেল শাহরিয়ার
একটা মৃত গাছ

একটা মৃত গাছ একটানা দাড়িয়েঁ
পাখি এসে বসল; চলে গেল;
সুতোসহ ঘুড়ির কঙ্কাল;
ডালপালা পাতাহীন, উদাসীন; নির্বাক; নির্বিকার।


গাছের পাশেই ধানক্ষেত। আল বাঁধা পথ;
কুলকুল পানির গান; ঝিরঝির হাওয়া।
দুলছে পাশের ধানক্ষেত।

গাছ কিন্তু সারাদিন ধরে স্থির।
স্থির স্থির ভোর;
স্থির দুপুর; সন্ধ্যা; রাত; বর্ষা; শরৎ;
রাত; দুপুর; বিকেল; ভোর...


একটা মৃত গাছ একটানা দাঁড়িয়ে
আমি যেতে যেতে দেখতে দেখতে; দেখছিলাম।


আরিফ ওবায়দুল্লাহ
বেহাল হালের চাকা

ভোর হতে হতে শহরের চিকাগুলো
নিমিষে মুছে গ্যালো।
তার জায়গা জুড়ে নিল এলোমেলো কতগুলো সৌখিন শব্দ।
জিপার খুলে হিসু করতে বসা লোকজন পড়ে নিচ্ছে শ্লোগান
হাসতে হাসতে
আজগর-রবি রিকসা চালাতো শুক্রাবাদে
বাবুরা গাড়ি হাঁকাবেন এই পথে তাই চলতে মানা
মানুষগুলোর বেহাল দশা
দস্যু দলের দোলযাত্রা।

যাত্রা দলের রানুদিদি দেবরের সাথে জেলে
লাল দালানে ভাত পেতনা ভাতারের ভাত খেলে।
হায়! ভাতের সঙ্গে তোমার আমার দ্যাখা হয় যে সঙ্গোপনে 
সঙ্গোপনে।
   নাচিয়ে আলো ধুলো হল
   ধুলো এলো চোখের কোণে।
  নাইলনের ঐ বাজার ব্যাগে
   আলু পটল পটল তোলে।
আমার---কিছু নাইরে মা।

বলব না মা এখন আমায় রাখিস রসে-বসে।
অনেক পাব, অনেক পেলাম চব্বিশ বছর চষে।


জহির শান্ত
কাম পিপাসার দিনে

অবেলায় কেঁদে ওঠো সোনার ঝংকারে
আষাঢ়ে পদ্মর মতো ভেসে
ভেসে থাকো মানসপটে,
আকাশে তখন পূর্ণিমা উড়ে;
বাতাসে ভালোবাসার দুর্গন্ধ!
বলো তো প্রেমকিশোরী, শেষ কবে
মেতেছিলাম মাতাল আড্ডায়?

চৈত্রের এক ঘোরলাগা দুপুরে, নাকি
পৌষের কুয়াশা ভেজা সকালে
যে উষ্ণ শিহরণ জেগেছিল
শরীর মাঝে; তা এখনো জ্বালায়।
আনমনে খুঁজে ফিরি সেই দুপুর-সকাল...

কাম-পিপাসার দিনে এমন ঘোরলাগা
দুপুরের সন্ধান পেলে মন্দ হতো না।।


আতাহার সজীব
নকশা

ওদেরই মতো করে
ওদের হাতে নকশা
তুলে দাও
ফুলের দোকান
ফলের দোকান
অহম কিছু নয়
ওরা বোঝে না
কিছু। বোঝে না
কোথায় ওদের
ক্ষয়।
ওদের চার্বাক
বাক্য শুনিয়োনা
ওদের পেটে
জমে আছে
অনেক অনেক
ক্ষয়।
ওরা সৎ
অথচ বিন্দু নয়
ওদের হাতে ওদেরই
নকশা তুলে দাও।


কায়সার মুহম্মদ হেলাল
তারে নারে দেনা পাধানি

কোন চাপ প্রয়োগ ছাড়াই দেখে ফেলি
তোমাদের চৌকো জানলা;
অনায়াসে লোহার গ্রিলে ঠেকানো চিবুক,
বুক,হাত,কখনো কখনো কেশাগ্র ছড়ানো কপোল
কোন চাপ প্রয়োগ ছাড়াই দেখে ফেলি।
যখন আমরা ত্রিচক্রযানে কিংবা ভাগিনার দোকানে

অথবা মোড়ের অশ্বত্থতলায়,
কোন চাপ প্রয়োগ ছাড়াই দেখে ফেলি
তোমাদের ছাদ,ছাদে টব, এলায়িত চেয়ার।
কাকনৃত্যের বেসাতি ছড়ানো টিভি এন্টেনায়,
যেখানে তোমাদের হাতের স্পর্শ অথবা মাথার একপাশ,
সেখানে ধরে গেছে জং অথবা যাবে।
কোন চাপ প্রয়োগ ছাড়া আমরা তাও দেখে ফেলি।

পিতা-মাতা সমেত অথবা শুধু পিতা কিংবা মাতা সমেত 
তোমাদের কব্জি যখন লেপ্টে যায়, দলে যায়, 
কারও কারও কামুক হবার মাত্রা ফ্রয়েডিয় শৃঙ্খল ভাঙতে চায়,
আমরা তাও দেখে ফেলি, চোখে কোন চাপ দেইনা বা পাইনা।

অসংখ্য অধিবিদ্যক ঘটনার সচেতন উপস্থিতি
জোড় চাপ প্রয়োগ করেও দেখতে বেগ পাইনা বলে
কখনো কখনো পত্রিকার লাল হেডলাইন-
“সকল বারান্দা, ছাদ,জানলা জুড়ে জরুরি অবস্থা জারি”!!!


বরাবর ভোগবাদী নেকাব

রেড লেবেল, হুইস্কি খাবো,
তাই টাকা চাই, অঢেল টাকা।
ভালবাসার মোহে অন্ধ আমি
ছিনিয়ে নেয়া সুখ ফিরিয়ে দিতে চাই
অপরাধী বলে তোমাদের...
মুহূর্ত ঘন্টায় শব্দাক্রান্ত
       চিত্তে লাগামহীন অনুরনন,
মগজের কোষে কোষে উল্লম্ফন,
আমাদের সমাজ বড্ড হ্যাংলা
                   বড্ড পাতলা,
অথবা বড্ড ভারি,
ভার বয়ে যাওয়ায় হাপিত্যেশ হয়তো হয় কখনো।

মিছিলে মিটিং নেই কিংবা মিটিংয়ে মিছিল
দেন-দরবার সালিশে শুধু জুতোপেটা হরকরা।
আদালত রায়ে নেই কিংবা রায়ে আদালত 
বিচারপতির এজলাসে বোতল-গ্লাসের টুংটাং।
আন্দোলনে জোশ নেই কিংবা জোশে আন্দোলন
জনতার আক্কেলে বিভ্রান্তির লেপন,
দ্বিতীয় প্রেমপিয়াসী শুধু তৃতীয় শক্তি,
কখনো জয়, কখনো পরাজয়, তবু-
ঠাঁয় শব্দখেলায় মাতি;
ধ্যানীর ধ্যানে ব্যাঘাতের মত
কোন প্রথমপিয়াসীর পুনরায় প্রেম দাবি
আর তাই বলি মুহূর্ত প্রতি-
“রেড লেবেল, হুইস্কি খাবো,
তাই টাকা চাই, অঢেল,অঢেল,অঢেল...”।।


সৌরভ বড়ুয়া
সময়ের বিন্দুতে লীন

পৃথিবীর নাট্যমঞ্চ থেকে,
আঁধারের পরিধিটা ক্রমশ কমে আসছে
হয়তো বিন্দুতে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবে।

অস্তিত্বশীল প্রবঞ্চনার কালো মূর্তিগুলো
টিকিয়ে রেখেছে প্রত্ন ঈশ্বরের ভগ্নস্তূপের অস্তিত্ব

মহাঅর্ঘের আয়োজন করেছিলো তারা
প্রতিক্রিয়াশীল কিছু শকুনের নিত্য আহ্বানে
হিংস্র  ডানা বসেছিলো
মৃতদের রক্তাক্ত দেহ প্রাচীরে

ভেঙ্গে যাবে আঁধারের প্রাচীর
মৃত শব্দের হাড়গোড়
আর প্রতিবাদহীন রোগগ্রস্থ কন্ঠের ধ্বনি।

সমাজের অস্তিত্বে মিশে থাকা ঘূর্ণায়মান অপব্যাখ্যা গুলো
সময়ের বিন্দুতে হবে লীন।


প্রাচীরের মৃত্যু

অঙ্কিত বৃত্তের প্রাচীরে শৃঙ্খলিত
অস্তিত্বশীল ছায়া মূর্তি
যার কাল ও সরনি আজও
মুক্তি পায়নি।

ভাষা অবরুদ্ধ তার
আর মৃত শব্দের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শূন্যতা
স্থবিরতা গলধ:করণ করেছে তার গতিকে,
মুক্তি হয়নি আজও সে বৃত্তের প্রাচীর থেকে।

মহাতরঙ্গ ভেঙ্গে দিয়েছিলো সে প্রাচীর
নব বিনিমার্ণের লক্ষ্যে
নব প্রাণের প্রস্রবনে...।


মাইনুল ইসলাম
কে আসে, কে চলে যায়

সারাদিন বিধ্বস্ত আমি
এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে 
এসে বসলাম শেষে
সেই কৃষ্ণচূড়াটির নিচে।
বোশেখের শেষ ক’টা দিন
ভাবনার বিভ্রান্তি বিবশ করে আমাকে
নতুন ভাবনা প্রতিস্থাপিত হয়
কেবল পুরাতন বরাবর
চেনা বেঞ্চি, চেনা পার্ক
রোজ আসি, রোজ ফিরি।

সবুজ ঘাসের উপর বসে
তরঙ্গায়িত সরোবরে পিছন ফিরে
যখন তাকাই সমুখে
কপালে দেয়া টিপটি আগে চোখে পড়ে
লাল টিপ কৃষ্ণচূড়ার নিচে।
আমাকে ক্ষণিকের জন্য ভাবিয়ে তোলে
আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে
আমাকে তরঙ্গায়িত করে, ফেনিল করে
আমাকে বিধ্বস্ত করে পুণর্বার।

এখন শেষ বিকেল
চারপাশে দিনের শেষ ছোটাছুটি
আমি এক পাশে রইলাম
কেউ লক্ষ্য করতে চায় না-কেউ করে না
একা কথা বলি। একা নিশ্চুপ
আবার তাকাই
সে চলে যাচ্ছে,
যে পথে আমি এসেছিলাম।


সৈয়দ আহমাদ তারেক
আগামীকালে, বেদনা বিষাদ

‘ছবি যদি কি ওগো নও তুমি...’

সে কি আয়নায় দেখা সাদা-কালো
মলিন ধূসর আলোকচিত্র?
পাথরের স্বপ্নে হৃদয়-কষ্ট তেইশ বসন্ত
পঁচিশের তারুণ্যে অস্থির সেলফোন:

প্লিজ ধরো না কেন?

অভিনেত্রীর কন্ঠ-আবেশ, আতিশয্য নিয়ে
আকুল আকুতির রিংটোন কেন যে আমিই রেখেছি!
‘ফুর্তি’র সুযোগে কথা বলা ছিলো বিনীত,
উদাসীনতা অধীনতা দুর্বিনীত-
নিয়মিত অনিয়মের বিশ্বাসঘাতকতা-
অভ্যন্তরীণ মননের নিস্পৃহতা
নৌকাডুবি ভরা বর্ষায়, তাই

আগামীকাল প্রেমের কথা, আজ বেদনা বিষাদ।


বিজন দাস
অনেক কিছুই হারিয়ে যায়

কিছু বুনো ফুল ফুটবে নগরীর বুলভার্ডে
যেমন ফোটে তারা অপুষ্টির আগ্রাসনে
বিধ্বস্ত প্রান্তিক গ্রাম-প্রান্তরে পরিচর্যাহীন
শ্বাপদসংকুল অরণ্যে বিশাল জারুল বীথির
অলস উঠোনে। মনে হয় নকশাদার চাদরের 
আদুরে জমিনে প্রাকৃতিক বর্ণ খেলার সমাহার 
যেন প্রাণ গঙ্গায় মেতেছে-শহরে সম্ভাব্য এই
নান্দনিকতা কবিরই কল্পনা; গ্রাম তো গ্রামই!

গ্রামেই আছে সুপুষ্ট ফসলের মাঠ অগ্রানে
শস্যের সৌরভ-নবান্নের উৎসবে ঘামসিক্ত 
কৃষকের পরিত্রাণ, শীতের কাঁথামোড়া নিদ্রাসুখ
অস্তাচলে পরিযায়ী পাখিদের গান।
শহরের কথা থাক গ্রাম থেকেই আজ
হারিয়ে গেছে সেই সব কোন কোন 
অলস বিকেলে স্মৃতিভারাক্রান্ত কবি কেবলি
খুঁজে ফেরে কৈশোরে দেখা গ্রামীণ মেলাটি
ঐখানে মুখরিত হলুদবর্ণ বালিকাটির 
মতো আরও অনেক কিছুর হারিয়ে যাওয়ার মর্মব্যথা।


আহাম্মেদ কবীর
উনিশ বছর পরে?

উনিশ বছর পরে, কেন আজ দেখা হয়ে গেলো? ... 
কেন আজ, আকাশের প্রান্ত ছেড়ে তুমি-আমি স্বপ্ন-জাগরণে
মিলনের এ-বাস্তব বিস্ময়ের মুখোমুখি স্মৃতির কালিকে?

কীভাবে কাটাতে দিন? ছিলে কোন জাদু-বাস্তবের অন্ত:পুরে 
সুখের বৈভবে রাঙা বিলাসিতা কিংবা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে?
বলনা গল্পের ছলে- সেসব দিনের কথা...

মনে পড়ে? ... জীবনের উনিশে-উনিশে আঁকা উত্তাল সৈকতে 
শিশ্নে- কৃষ্ণে ত্রিভুজের দন্ডাদেশ জলকেলি স্মৃতিমাখা কুয়াশা রোদ্দুরে 
কতশত অভিসারে কাটানো দিনের স্মৃতি
অন্ধকার হতে হতে ... গতরাতে দেখা হলো, কথা হলো 
স্মৃতিগুলো জড়ো হতে হতে বড় হলো তারপর ...
ঝড় এলো! তুমি চলে গেলে অন্ধকারে 
গাড়ির ধূয়ার  মতো, ক্রমে ক্রমে যেন নিঃশ্বাসে নিঃশেষ!

পৃথিবী এমন কেন? তুমি কেন রেশমের রঙে আঁকা 
কবিতায় আলপনা, শুধুই স্মৃতির ঘোর?...
এভাবে দেখাটা দেখা নয় উনিশ বছর পরে
পিছুটানে আঁচলেরা টানাটানির পদ্মে-পদ্মে তুমি তাই ফিরে যেতে চাও 
তবুও স্মৃতির জালে জড়াজড়ি  করা অধর-জড়ানো- জ্বর
উত্তাপের নতুনত্বে ভরা হঠাৎ দেখার এই অভিসারে 
তুমি-আমি হয়তোবা উনিশ বছর পরে?



গাজী মোহাম্মদ ইউসনুস
নিয়মের গভীরে

প্রতিটা সৃষ্টির গভীরে কিছু না কিছু
নেতিবাচক শর্ত থাকে।
যেমন- সকল পাওয়ার গভীরে থাকে
না পাওয়ার অমোঘ নির্দেশ।
সব মেঘেই বৃষ্টি হয় না। সব নদীতে আসেনা জোয়ার।
রাগে, বিরাগে, মিলনে, বিরহে লুকিয়ে থাকে সূক্ষ্ম ভুল।

পাল্টায় অনেক কিছুই।
অনিবার্য নিয়মে ভাঙ্গে
অনিয়মের ঘর।
মানব জমিন পতিত হলে; এভাবেই বিমুখ থাকে
নিমার্ণের বোদ্ধা।


সেই আমরা

আমরা        যারা এই শহরে চুপিচুপি বড়ো হয়েছি
আমরা        যারা ইসকুল পালিয়ে ডুব সাঁতার শিখেছি দিঘির জলে
আমরা        যারা ঘুমের খোঁয়াড়ী ভেঙ্গে ছেড়া কাঁথার ফাঁক দিয়ে
    দেখেছি আলোর উৎসব।
আমরা        যারা বৈকালিক আড্ডায় টেবিল চাপড়িয়ে সময়কে
    করেছি দীর্ঘ।
আমরা        যারা নিজেদের মেধা আর মগজকে পানি করে
    নগরের গলিতে গলিতে রোপন করেছি শব্দের বাগান সেই
আমরাই      একদিন আঙ্গুলের ডগা থেকে ছুড়ে ফেলেছি
    মননের কলম।


বাবুল ইসলাম
নগরের একমাত্র নিঃশঙ্ক ভবঘুরে 

নিশ্চিত আমি, পাড় ভাঙ্গা বিষন্ন নদীর মতো কিছু-কিছু 
কষ্টবোধ কোথাও না কোথাও লুকিয়ে রেখেছো তুমি

ভেবো না-তোমার যাবতীয় দুঃখ বোধ কোন এক উৎসবের- 
রাতে কটুগন্ধি তরলে মিশ্রিত করে অন্যান্য সুখাদ্য: এই 
যেমন চৈত্রের হৃদয়চেরা মৃত্তিকার সমগোত্রীয় বর্ণিল সব
স্বপ্নভঙ্গের বেদনাশ্রিত খন্ডিত অংশ সমেত পাকস্থলীর 
অন্দরে পাঠিয়ে দেবো। পরিপাকতন্ত্র এহেন দুঃসহ পীড়নে 
এলোমেলো কিছুটাতো হবেই-হোক কি-ই বা যায় 
আসে তাতে? কে কার তোয়াক্কা করে? ধানী ডলোয়
ধু ধু রোদে একাকী দাড়িয়ে থাকা ধ্যানী বকের নিঃসঙ্গ 
শিকার বিভ্রান্তির মতো নির্ঘুম রাতের পথচলা-
অন্ধ সড়কে হোঁচট তো খাবেই। তবু উচ্ছাস-চঞ্চল
গানের উড়ু উড়ু সন্ধ্যায় ভুলেও তোমার পড়বে না মনে
নির্দোষ প্রমোদ শেষে সেই রাতটি জ্যোৎস্নায় কতটুকু
প্লাবিত হয়েছিল- হাস্নুহেনার আড়ালে অনঢ় দাঁড়িয়ে
আমি, মাতাল হাওয়ার অবরুদ্ধ বৃত্তে কতোটাই বা হয়ে
উঠেছিলাম বিষাদগ্রস্ত কিংবা দিকভ্রান্ত অথবা দুর্বিনীত?

সহচরী সমাবেশে মায়াবী সেই আলোড়িত সন্ধ্যায়
ছিলে তো তুমি নন্দিত ভ্রমররূপে। কেবল তীব্র প্রণয়ের
পাপে ক্রুশবদ্ধ যীশুই যেন ছিলাম আমি-রিক্ত,
আত্মধীকৃত আচরণে লিপ্ত নগরের একমাত্র নিঃশঙ্ক ভবঘুরে।

_____________________________________________
বই আলোচনা
_____________________________________________

'টেরির বীজ ও ইরার কষ' এর পাঠ প্রতিক্রিয়া 
মোশারফ হোসেন

ধাবমান সময়ের নিয়ত উল্লম্ফন, জীবনবোধের গভীর পরিস্ফূটন ঘটেছে ছোট গল্পকার কাজী মোহাম্মদ আলমগীরের গল্পগ্রন্থ ‘টেরির বীজ ও ইরার কষ’ এ। আধুনিক সাহিত্যের সমাজ সচেতনতা, ত্রিকালদর্শীর ভূমিকা, ক্ষয়-স্খলন-পচন, মানব চরিত্রের ক্ষিপ্ত-বিক্ষিপ্ত রকমফের ইত্যাদির সাথে জাদু-বাস্তবতার অশরীরী গতিশীল প্রয়োগ গল্পকে দিয়েছে নতুনমাত্রা। সমকালের ঔদ্ধত্য-বিকৃতি এর সাথে মানুষের উত্থান-পতন এবং সম্ভাবনার যথোপযুক্ত দ্বন্দ্বের প্রবাহকে বাঙময় ও প্রাণময় করে তুলেছেন তার প্রতিটি গল্পে। 

নাম গল্পে বিধৃত হয়েছে কীভাবে একটি পেশা রুগ্ন হতে হতে মুমূর্ষু অবস্থায় অনেক কষ্টে শেষ পর্যন্ত ধুন মিয়া পর্যন্ত আসতে পারে। বংশ পরম্পরায়  একটি পরিবার হুক্কা পেশার সাথে যুক্ত। হুক্কার গায়ে যে রঙ মাখা হয়, তা-ই এ শিল্পের সবচেয়ে বড় গোমর। এ গোমর প্রজন্মান্তরে অতি সাবধানে বাবার হাত থেকে ছেলের হাতে আসে। এ গোপন বিদ্যার বর্ণনায় পাঠক রহস্যের গন্ধ পাবে। এ রহস্য পাঠককে টেনে ধরে রাখে গল্পের শেষ পর্যন্ত। হুক্কার খোলে মাখাবার রঙ তৈরির পদ্ধতি বলা হয় একটি শোলকের মধ্য দিয়ে। এ শোলক আর সবাই জানলেও সবাই রঙ তৈরি করতে পারে না। যেন শুধু মন্ত্র জানলেই হয় না, প্রয়োজন যোগ তপস্যার। রঙ তৈরির উপাদান টেরির বীজ এবং ইরা কষি আসে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে। কিন্তু সময় প্রবাহে অতীতের জায়গা নেয় বর্তমান, বদলায় রূপ, বদলায় আয়োজন। হুক্কার খোলের জলের গুড়গুড়ি মানুষের প্রাণের কথা বললেও হুক্কা হেরে যায় তামাক শিল্পের নতুন সংযোজন বিড়ির কাছে। ত্রিপুরা থেকে আসা কুম্বুপাতার বিড়ি তৈরিতে থাকে না কোন রহস্য, প্রয়োজন নেই আন্তরিক দক্ষতার উৎকর্ষতা। কারখানায় তৈরি হতে থাকে- হারুন বিড়ি, রিয়াজ বিড়ি। ক্রমশ হুক্কার বদলে মানুষের হতে ওঠে আসে কুম্বুপাতার বিড়ি। গ্রাম-বাঙলার হুক্কা পরিনত হয় ফেলে আসা সংস্কৃতির প্রতীকে। মানুষের হাত থেকে চলে যায় ইতিহাসের পাতায়-স্মৃতির কুঠুরিতে। রঙ বানানোর কৌশল জানতে গল্পের নানা চরিত্রের দ্বন্দ্ব প্রশমিত হয় বিড়ি তৈরির হুজুগে কাজে যুক্ত হয়ে। একা হয়ে পড়ে ধুন মিয়া। বিড়ি শিল্পে প্রাণ সঞ্চারিত হয় হুক্কা শিল্পের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর মৃত্যু ধুন মিয়াকে তার জীবনের সাথে মিশে থাকা পেশা থেকে বিযুক্ত করে। 

বইয়ের দ্বিতীয় গল্প ‘অন্ধকারের বয়ান’। জীবনে নানা পেশায় পোড় খাওয়া এক লোক এখন অন্ধকার মাপজোখ করেন। কোথায় অন্ধকার বাড়ছে আর কোথায় কমছে এর নিখুঁত হিসেব জানেন এই লোক। অদ্ভুত এক হেয়ালির মধ্য দিয়ে গল্প এগুয়। এ মানুষটির একমাত্র মেয়েটিও প্রতিদিন দোতলার কর্নারে একঠায় দাঁড়িয়ে নির্জন নিস্তদ্ধ একটি বাড়ির নির্জনতা পরিমাপ করে। একটি রূপসীমেয়ে অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ায়ে থাকে, প্রতিবেশিরা উৎসুক হয়ে ওঠে। ভুবন খ্যাত লেখকদের গল্প শুনে শুনে বেড়ে ওঠা মেয়েটিকে তার পিতা তুলে দিতে চান একজন গল্পকারের হাতে। এই প্রত্যাশার বিপরীতে শহরের বেশ ক’জন ভালো গল্পকার ঐ লোকের বাসায় কোন এক সন্ধ্যায় মিলিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় সবাই মিলে একটি গল্প বলবে। প্রত্যেকেই কিছু অংশ বলে পরবর্তী জনকে ছেড়ে দেবে। এভাবে গল্পের মাঝেই আরো একটি  রোমাঞ্চকর গল্প শাখা-প্রশাখা মেলতে থাকে। একটি হত্যাকান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী পিতা-পুত্র পরবর্তীতে সবই অস্বীকার করে ভীরুতার নিকট আত্মসমর্পন করে। ‘যদি দুটি ভীরু মরে যেতো হয়তো কিছু বিশ্বাসের ক্ষতি হতো কিন্তু আমাদের ভীরুরা বেহুশ হয়ে পড়ে রইল আরো দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশায়’ এ বক্তব্যে আমাদের নৈমত্তিক আত্মসমর্পনই প্রকাশ পায়। গল্পে ফুটপাতে বসে টিয়া পাখি দিয়ে ভাগ্য গননা করেন জীবন বাবু। এ চরিত্রটির দৃঢ়তা আরো বেশি প্রত্যাশা করবে পাঠক। ‘অন্ধকারের বয়ান’ গল্পটি শেষ হয় সোনামূখী সুঁই সংক্রান্ত বিয়োগাত্মক ঘটনার মধ্য দিয়ে।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ও বহু চর্চিত সংযোজন ‘ক্ষুদ্রঋণ’। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র বিমোচনের উপায় হিসেবে ক্ষুদ্রঋণের উপযোগিতার কথার ফুলঝুরির বিপরীত চিত্র  আমরা দেখতে পাব ‘গরু রচনা’য়। রিক্সাচালক রুকন মিয়ার স্ত্রী মরিয়ম নোবেল পুরষ্কার পেতে যাচ্ছে এমন মালিকের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে গরু কিনে। সপ্তাহান্তে ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়। স্বচ্ছল ভবিষ্যৎ গড়ার আশায় দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকে এরা। একরাতে গরু ডাকলে মরিয়মের মনে  হয়- ‘তার স্বপ্ন পূরণের জন্য গরুটা ডাকছে। গরুর পর সে পাবে মোবাইল। টাকা আর টাকা...’। গরুর জন্য ঘাস, বিচালি, খড় আর কিস্তির টাকা যোগাড় করতে মরিয়ম- রুকন মিয়া উভয়ে হাপিয়ে ওঠে। গরু নিয়ে নানা উপদ্রপের প্রতিক্রিয়ায় মইজুদ্দি আর আ. করিমের শ্লেষ আর রস মেশানো বক্তব্যে ওঠে আসে অনেক অগোপন খেলো কথা- ‘এই মিয়া... দেখো না, বালের ব্যাংক মাইনষেরে কয়ডা ধরাইয়া দিয়া পাগল বানাইয়া ছাড়ছে।’অমানুষিক শ্রম আর কিস্তি পরিশোধের আপ্রাণ চেষ্টা- এত কিছুর পরও মরিয়ম বিবির স্বপ্ন পূরণের পোয়াতি গাভীটা একটা মৃত বাছুর প্রসব করে। দিশেহারা মরিয়ম গাভীর দুধ দোহনের উপায় হিসেবে মৃত বাছুরের চামড়া দিয়ে এম্বা বানিয়ে নেয়। মরিয়মের এ প্রচেষ্টায় ঋণদাতা কর্মকর্তারা মুখে প্রশংসার খৈ ফুটায়। কিন্তু নিয়মিত কিস্তির টাকা আদায়ে সামান্যতম ছাড় দেয় না। মরিয়মের সংসারে নেমে আসে অশান্তির করাল ছায়া। আমরা দেখতে পাই, একটি শ্রেণীর বেঁচে থাকার আবহমান দৃশ্য। একদিন কিস্তি আদায়কারীকে মরিয়ম বলে ওঠে-‘আমি আর কিস্তিটিস্তি দিতে পারমু না। আপনাদের আসল টাকা ফেরত দিতে পারলে বাঁচি।’ এ দৃশ্য আমাদের অচেনা নয়। বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত মানুষের অর্থনৈতিক হাহাকারকে পুঁজি করে ঋণদান ব্যবসা জমিয়ে তুলে কতক ভূঁইফোড় সংস্থা। এ গল্প আমাদের উপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকল, বর্গীদের লুন্ঠন, নীল চাষীদের ওপর দাদন ব্যবসার নামে অন্তহীন নির্যাতনের কথা মনে করিয়া দেয়। এসব নয়া উপনিবেশবাদী শোষনের আধুনিক সংস্করণের বাহ্যরূপ প্রতিফলিত হয়েছে ‘গরু রচনা’য়।

এ বইয়ের আরো একটি চমৎকার মনস্তাত্বিক গল্প ‘দরজা বিষয়ক হেয়ালি উদ্ভাস’। গল্পটিকে আকারের বিবেচনায় বড়গল্প বলা যায়। এ গল্পে সানা নামের এক মেয়ের অপরাধ, এর বিচার এবং বিচারে ন্যায্যতা, রূঢ় বাস্তবতা, অসংখ্য অমানবিক গোজামিল মেনে নেয়ার মানসিক যন্ত্রণা থেকে জন্ম নেয়া হেয়ালির সাথে জাদু বাস্তবতার প্রতীতি লক্ষ্য করা যায়। লেখকের গল্প বলার ঢঙে আলাদা বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল  এ গল্পে। সানা তার জীবনের একটি দরজা পার হয়ে অন্য দরজায় ঢুকে গেছে। দ্বিতীয় দরজা থেকে প্রথমটায় কোন ভাবেই ফিরে আসা সমাজ অনুমোদন করে না। সাপ-কুমিরের চরিত্র নিয়ে কেঁচোর মতো মেরুদন্ডহীন তালেবর ব্যক্তিরা জুরিবোর্ডের হর্তাকর্তা। এরা ক্ষমতার ছড়ি ঘোরায় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নিজের কদর্য স্বার্থকে সমুন্নত রাখতে। জুরিবোর্ডের সদস্য হয়েও আব্দুল কাদের তথাকথিত সমাজ পতিত সানার প্রতি অন্যায় বিচার নিরবে মেনে নেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে অনিবার্য আপোষ শত দ্বিধা সত্ত্বেও মেনে নেয়া অথবা মেনে নিয়ে অপেক্ষাকৃত নিরুপদ্রপ থাকতে চায় আব্দুল কাদের। কিন্তু সে পারে না। তার অবচেতন মন অসংখ্য দরজা থেকে দরজায় প্রবেশ-বাহির করতে থাকে, একের পর এক আসতে থাকে নতুন অঙ্ক, নতুন দৃশ্য। সানার পিতা প্রভাবশালী হুক্কা মিয়া থেকে দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল। ঋণ পরিশোধে অক্ষমতার সুযোগ নেয় হুক্কা মিয়া। এ ঘটনার বলি হয় এই পরিবারের যুবতি মেয়ে সানা। সামাজিকভাবে নাজেহাল করার চেষ্টা করে আব্দুল কাদেরকে। প্রচন্ড অবসাদে আ. কাদেরর দিন কাটতে থাকে ঘোরের মধ্যে। সামাজিক বিশৃঙ্খলার সামঞ্জস্য খোঁজতে থাকে ক্ষ্যাপার মতো। যে অর্থনীতির সঙ্গে ভালোবাসা নেই তাতে আস্থা নেই তার। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে মানবিকতার জায়গা কোথায়? ভোগের আত্মমগ্ন উন্মত্ততা এখানে দন্তবিকশিত করে এক বিরাট হা করে আছে, প্রতিটি নান্দনিক সফেদ দাঁতে পণ্যের ডিজিটাল বিজ্ঞাপন। মানুষের অনুভূতি, স্বপ্ন, আকাঙ্খার বাণিজ্যিকীকরণ চলছে দেদারছে। চারদিকে বোধের এই সংহার আ. কাদেরকে বিচলিত করে, আর আ. কাদের বিচরণ করতে থাকে দরজা বিষয়ক হেয়ালির মাঝে। আমরা এগিয়ে যাই এই পৃথিবীর বিশাল বিশাল দরজার দিকে।  যত বড় হই, দরজাগুলো হয় ছোট। ক্রমে বন্ধ হয়ে যায় ঘুড়ি দরজা, লাটিম দরজা, চরকি দরজা আরো কত! গল্পে লিবিডিও চেতনার জটিলতা প্রকাশ ঘটে। ক্ষমতাবানদের ক্রোধের অগ্নিদৃষ্টিতে মানুষ গলে যায়। জীবাশ্মের গলন রাস্তার বিটুমিন ইমালশনের অনুবন্ধন ভেঙ্গে দেয়, তৈরি হতে থাকে ক্ষমতাধরদের কবর। আ. কাদেরের দাদা ছিল ওস্তাদ ছুতার। তিনি তৈরি করতেন জমিদার সামান্তদের প্রাসাদের নানা দরজা। আর এক প্রজন্ম অন্তর দরজা বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়েছে একটু ভিন্নভাবে আ. কাদেরের ক্ষেত্রে।  এ যেন জোহান মেন্ডেলের বংশগতি বিদ্যার প্রতিকল্পিত রূপায়ন।

মাননীয় লাশ, ক্ষোভ, বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ- গল্প তিনটিতে ভিন্ন আঙ্গিকে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জটিল মিথস্ক্রিয়া প্রকাশ পেয়েছে। বিত্তের সাথে বোধের দ্বন্দ্ব রূপায়িত হয়েছে মানুষের জীবনের চিরায়ত জিজ্ঞাসায়।  জব্বর মিয়ার উড়াল পাখি এবং এক ভুবন চিলের গল্প, পতন ফেরতের নান্দী পাঠ, বস্ত্রশিল্পে নতুন প্রিন্ট: সীমান্ত বাটিক, শূণ্যতা থেকে জন্ম নেয়া অপ্রমানিত সূত্র, গম ও শহর সৃষ্টির ইতিহাস এ বইয়ের অন্যান্য গল্প।  

মোট তেরটি গল্পে লেখক তার সৌকর্য ফুটিয়ে তুলেছেন। কিছু গল্পের নামকরণে বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। প্রতিটি গল্পেই লেখকের শ্রেণী সচেতনতা লক্ষ্যনীয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবেগ আকাঙ্খা থেকে উৎসরিত গল্পগুলো। আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগে মানুষের মেলবন্ধন গভীরতর করে তুলেছেন বেশ কিছু গল্পে। আগামীতে লেখক তার স্বকীয়তার বিভা আরো ছড়িয়ে দিবেন নতুন সৃষ্টিতে, সেই পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা।

টেরির বীজ ও ইরার কষ; কাজী মোহাম্মদ আলমগীর; প্রচ্ছদ: জিলানী আলম; প্রকাশকাল : একুশে বইমেলা ২০০৭; প্রকাশক: দর্পন, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা; মূল্য : ১০০ টাকা।

_____________________________________________
পুর্নপাঠ
_____________________________________________

ভাষা
সৈয়দ মুজতবা আলী

হাট-বাজার,শাক-সবজি,১ দান-খয়রাত, দুখ-দরদ, ফাঁড়া-গর্দিশ, মান-ইজ্জত,  লজ্জা-শরম, ভাই-বেরাদর, দেশ-মুল্লুক, ধন-দৌলত, রাজা-বাদশা, ঝড়-তুফান, হাসি-খুশি, মায়া-মহব্বত, জন্তু-জানোয়ার, সীমা-সরহদ- ইত্যাদি ইত্যাদি।

এস্থলে লক্ষ্য করার প্রথম তত্ত্ব এই যে, প্রত্যেক সমাসের প্রথম শব্দটি খাঁটি দিশি ভারতীয় শব্দ; হাট, শাক, দান, দুখ, মান, লজ্জা, দেশ ইত্যাদি এবং দ্বিতীয় শব্দটি যাবনিক (আরবি, ফার্সি, তুর্কি, হিব্রু, গয়রহ্‌), যেমন বাজার, সবজি, খয়রাত, দর্দ ইত্যাদি। এবং দুটি শব্দই প্রায় সমার্থ-সূচক।

তাহলে প্রশ্ন, এ ‘কুকর্মের’ কি প্রয়োজন?

আমরা যখন সাধারণের কোনো অজানা ভাষা থেকে উদ্ধৃতি দিই, তখন বাঙলা অনুবাদটি দি তার পরে। অর্থাৎ যাকে বোঝাতে যাচ্ছি, তার ভাষা আসে পরে। 

তা হলে মনে করুন, মুসলমানের আগমনের কিছুকাল পরে কোনো হিন্দু (বা নবদীক্ষিত মুসলমানও হতে পারে কারণ হিন্দু ধর্মবর্জন করে মুসলমান হয়ে গেলে রাতারাতি তার আরবি ফার্সি রপ্ত হয়ে যায় না) গেল মুসলমান শাসনকর্তার কাছে বিচারের আশায়। বললে, ‘ধর্মাবতার’ হুজুর! "দেশ"- বলেই থমকে দাঁড়ালো। ভাবলে ‘হুজুর কি “দেশ” শব্দটা জানেন! হুজুর তো হাট-বাজারে ঘোরাঘুরি করে দিশি শব্দ শেখবার ফুর্সত পান না। (অথচ আমাদের হিন্দুটি পেটের দায়ে, কাজের তাড়ায় বিদেশাগত মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা করার ফলে কিছু কিছু যাবনিক শব্দ শিখে গিয়েছে) তাই ‘দেশ’ বলে থমকে গিয়ে বললে "মুল্লুক" - ওটা হুজুরের যাবনিক শব্দ। অতএব শেষ পর্যন্ত তার নিবেদন দাঁড়ালো, ‘দেশ-মুল্লুক ছারখার হয়ে গেল। রাজা-বাদশা (আবার রাজা বলে থমকে গিয়ে যাবনিক “বাদশা” বললে) আমাদের মত কাঙাল গরিবের (গরিব আরবি) দুখ-দরদ(দরদ,দর্দ ফার্সি) কে বুঝবে?আমাদের মান-ইজ্জত (ইজ্জত আরবি)ধনদৌলত(দৌলত যাবনিক)সব গেল। মেয়েছেলের লজ্জা-শরম (শর্ম যাবনিক)-ও আর বাঁচে না। রাস্তায় বেরোলেই দেখতে পাবেন,কারো মুখে হাসি-খুশি (খুশি ফার্সি) নেই। হুজুর অনুমতি দেন - ভাই-বেরাদর (বেরাদর ফার্সি) নিয়ে মগের মুল্লুকে চলে যাই।’
মনে করুন, কথার কথা কইছি, হুজুর সত্যকার হুজুর ছিলেন। হুঙ্কার দিয়ে প্রতিবিধান করলেন। 

আমাদের বঙ্গসন্তনাটি বাড়ি ফিরে গৃহিনীকে আনন্দে ডমমগ হয়ে বললে, ‘বুঝলে গিন্নী, হুজুর যা আমার খাতির-’ (বলেই থমকে দাঁড়ালো; হুজুরের দরবারের ‘খাতির’ কথাটি খুবই চালু, সেইটেই এতক্ষণ ধরে দরবারে সে শুনেছে, তাই দুম্‌ করে সেটা ব্যবহার করে দুশ্চিন্তায় পড়লো, গিন্নি তো যাবনিক শব্দটা বুঝবে না, গিন্নি তো হাট-বাজারে গিয়ে যবনের সঙ্গে মেলামেশা করে এসব শব্দ শেখে নি তাই সঙ্গে সঙ্গে বললে) 'যত্ন' যা খাতির করলেন কি বলবো। আবার দোকান (ফের মুশকিল -দোকান ফার্সি শব্দ তাই বললে “হাট” [হট্ট]) হাট খুলবে,- কোনো   চিন্তা করো না গিন্নি! নারায়ণ, নারায়ণ।’

এ যুগে আবার ফিরে আসবো। কিন্তু তার পরবর্তী যুগে দেখুন, ইংরেজ boss- কে বলছি, ‘স্যর! আমি আমি উকিল -(বলেই থমকে দাঁড়ালুম, উকিল যদ্যপি আসলে আরবি শব্দ, এদানিং ইটি খাঁটি বাঙলা, স্যর, কি বুঝবেন তাই হন্তদন্ত হয়ে বললুম) ব্যারিস্টার (উকিল-ব্যারিস্টার) লাগিয়েছিলুম। ঘটি (ঐ য্‌যা! স্যর বুঝবেন কি?) গেলাস (glass- এবার স্যর বুঝবেন!) ঘটি-গেলাস বন্ধক দিয়েছি - তেনার জন্য এরেক (ফের ইংরাজি ‘ব্রান্ডি’) ব্রান্ডি, বিড়ি-সিগারেট (দ্বিতীয়টা ইয়োরোপিয়) যা গেছে সে আর বলে কাজ নেই।’

এই সব বলে-কয়ে তো ছুটি নিয়ে দেশে গেলুম। প্রথমেই ঠাকুরমাকে পেন্নাম। বললুম, ‘ঠাকুমা’ পরে সব গুছিয়ে বলবো, এই বেলা শুনে নাও সংক্ষেপে। বড় মাসীর গুণধর ছোট ভাইটি নিয়েছেন ফ্ল্যাট (আবার সেই হাঙ্গামা - ঠাকুমা তো ‘ফ্ল্যাট’ বুঝবেন না, অতএব বললুম), ফ্ল্যাট-বাড়ি। আমাদের কাউকে না শুনিয়ে করেছেন বিয়ে।  কিন্তু ঠাকুমা, মেয়েটি কী সুন্দর। এক্কেবারে ডল (doll- সর্বনাশ, ঠাকুমা তো বুঝবে না, তা হলে ‘পুতুল’ বলি) পুতুলের মত। কিন্তু হলে কি হয়! গুরু আছেন, ধম্মো আছেন। ব্যাস! এল তেড়ে টাইফয়েড-জ্বর (টাইফয়েড তো জ্বরই বটে তবু ঠাকুমা যদি না বোঝেন, অতএব ‘জ্বর’-টা বলতে হল); তুমি ভাবছো আমরা কিছুই করিনি। ডাক্তার-(আবার সেই বিপদ, তাই বলতে হলে) বদ্যি (ডাক্তার-বদ্যি) নিয়ে এলুম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।’ 

তাই আবার নিবেদন করছি, যাকে বোঝাচ্ছি তার বোধ্য শব্দটি আসে পরে। 

এটা কিছু নূতন তত্ত্ব, আমাদের দেশের আজগুবি ব্যাপার নয়। ইংলন্ডেও নরমান বিজয়ের পর ইংরেজ যখন বিদেশি হুজুরের কাছে গিয়া ফরিয়াদ বা রিপোর্ট দিত, তখন বলতো, He is very meek and humble (meek খাঁটি ইংরিজি, কিন্তু humble বিজয়ী নরমানদের শব্দ), Sir, but it is odd and strange (odd ইংরিজি, strange নরমান) that although we thought it meet & proper (meet ইংরিজি, proper নরমান) that we should search every  nook and corner (nook ইংরেজি, corner নরমান), our sorrow and grief (sorrow ইংরেজি, grief নরমান) know no bound that we did not find him.’ 

তফাত শুধু এইটুকু যে ইংরেজ তখন দিশি ও বিদেশি শব্দের মাঝখানে and বসিয়েছে- meek and humble, odd and strange; আমরা বাঙালিরা  ‘and’ ‘এবং’ বসাই নি ; আমরা বলেছি, হাসি-খুশি, মান-ইজ্জত, দেশ-মুল্লুক।

পাঠক কিন্তু ভাববেন না,আমাদের সব সমাসই এ রকম।

জল-পানি, বাজার-উটকো, মাল-মশলা, ঘটি-বাটি, টোল-চতুষ্পাঠী, মক্তব-মাদ্রসা, ইস্কুল-কলেজ অন্য ধরনের সমাস॥ 

১২-৩-৬৬


(ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে আমাদের ভাষা কিভাবে বদলে গেল সৈয়দ মুজতবা আলীর এ লেখায় তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়-এই বিবেচনায় লেখাটি এখানে প্রকাশ করা হলো।)


_____________________________________________
স্মরণ
_____________________________________________

হরিধন দাসঃ একজন নির্মোহ প্রগতিবাদীর প্রতিকৃতি

'পাশ করা বিদ্যাকে শিক্ষা বলি না-' কথাটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অসম্পূর্ণতাকেই নির্দেশ করে। জ্ঞানের ভান্ডার যে ধনের ভান্ডার নয়- এ অনুধাবন আমাদের প্রতি মুহুর্তের। লাভালাভের হিসেবে পটু লোকেরা নিঃসন্দেহে চতুর। নিজেকে গড়তে চায় অপরকে ধ্বসিয়ে দিয়ে। প্রমথ বাবুর এ কথা তাই এখনও প্রাসঙ্গিক যদিও সময় সামনে গড়িয়েছে বৈ কি! এ সমাজ ধনীকে তোয়াজ করে চলে যথেষ্ট। যুক্তির তীক্ষ্মতার চেয়ে বক্তব্যের আড়ম্বর সর্বত্র। ধ্যানী-গুণীরা এখানে অবহেলিত থাকেন- সমাজের কথিত মূলধারায় মিশে যান না বলেই। অথচ প্রকৃত জ্ঞানীর তৃপ্তি অন্যের চাটুকারিতায় নয়, জ্ঞান আহরনে-অজনার সন্ধানে পরিব্যপ্ত হয়ে অধিকতর যোগ্য হয়ে ওঠায়। এ সমাজ অর্থে বিক্রীত বহু বিকৃত ব্যক্তির কৃতিত্বের স্বীকৃতির ভুয়া মানপত্র পাঠ করে। সমাজ সভ্যতার এ সংকটের মাঝেই একজন নিভৃতচারী মৃদুভাষী অধ্যাপক হরিধন দাস। ২০০৬ সালের ৪ জুলাই যিনি চলে গেলেন। আজ তাঁর মৃত্যুর পূর্ণ এক বছর গত হল। 

অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সদা উদ্দীপ্ত এবং আগা-গোড়া বিজ্ঞানমনস্ক ছিলেন পদার্থ বিজ্ঞানের এ অধ্যাপক। খুবই সাদাসিধে জীবন চর্চায় অভ্যস্ত ছিলেন। পদার্থ বিজ্ঞানে ছিল অসামান্য পান্ডিত্য। সাহিত্য, ইতিহাস,দর্শন-বিশেষ করে কপিল মুনির সাংখ্য দর্শন এবং গৌতম বুদ্ধের দর্শনে এর প্রভাব, বেদান্তীয় দর্শন, ধর্ম-এর রাজনৈতিক ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল যথেষ্ট স্পষ্ট ও দৃঢ়।

প্রগতিবাদী এ শিক্ষক সৈয়দপুর টেকনিক্যাল কলেজ থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে যোগ দেন ১৯৮১ সালে। এখানে তাঁর সাথে বিভিন্ন সময়ে  যোগযোগ ঘটে অধ্যাপক সুবীর কুমার চক্রবর্তী, শেখর রঞ্জন সাহা, শান্তনু কায়সার প্রমুখ শিক্ষকের সাথে। শান্তনু কায়সার এর উদ্যোগে সে সময় এখানকার অগ্রসর মানসিকতার শিক্ষকদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় নিয়ে নিয়মিত আলোচনার আয়োজন করত এ সংগঠন । অধ্যাপক হরিধন দাসের অংশগ্রহণ ছিল এখানে নিয়মিত।

১৯৯৫ সালে কাওসার চৌধুরী নির্মিত ‘‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’’ প্রামাণ্য চিত্রে একাত্তরে জগন্নাথ হল হত্যাকান্ড এবং নিজে আক্রান্ত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন হরিধন দাস। থাকতেন জগন্নাথ হলের নীচতলার ২৯ নম্বর কক্ষে। ‘‘রতন লাল চক্রবর্তী” সম্পাদিত জগন্নাথ হল হত্যাকান্ড বইয়ে বিস্তারিত উল্লেখ পাওয়া যায় হরিধন দাসের। বইটি আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য দলিল। প্রামাণ্য চিত্রে ২৯ বছর পর ছাত্রাবাসের একই কক্ষে তিনি ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারির নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ স্মৃতি পরিব্যক্ত করেন। সেই কক্ষে অবস্থান করা অপর দুজন ব্রাশ ফায়ার ও গ্রেনেড চার্জে ঘটনাস্থলেই মারা গেলেও হরিধন দাস ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। সংজ্ঞাহীন এবং আহত অবস্থায় তাঁকে ২৭ মার্চ সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। 

শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনে হরিধন দাস ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও আন্তরিক। ক্লাসে নিয়মিত পাঠদানে ছিলেন সদা সচেষ্ট। গ্রাফ ও ম্যাথমেটিক্যাল টার্মের উপর গুরুত্ব দিতেন সব সময়। আপেক্ষিকতাবাদ, কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স ইত্যাদি বিষয়ে ছিলেন গভীর প্রাজ্ঞ। ভিক্টোরিয়া কলেজের অনার্স ও মার্স্টাস ল্যাবের পাশাপাশি উচ্চ মাধ্যমিক ল্যাবের উন্নয়নে তিনি নিরলস খেটে গেছেন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি, ক্রয় ও মেরামত করে সমৃদ্ধ গবেষণাগারে রূপ দেন। প্রতিটি ব্যবহারিক পরীক্ষায় বরাদ্দকৃত অর্থের বেঁচে যাওয়া অংশ নিজেদের মধ্যে পারিতোষিক হিসেবে বন্টন না করে ল্যাবরেটরি সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করেন। ঐ সময়ে করা এক বিভাগীয় অডিটে দেখা যায় ডিপার্টমেন্টের সব হিসেব ঠিক থাকলেও যন্ত্রপাতির হিসেবে মিল নেই। যত যন্ত্রপাতি থাকার কথা রয়েছে তার চেয়ে অধিক। এ সময় তাঁকে সব সময় সহযোগিতা দিয়ে গেছেন একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক অর্জুন চন্দ্র শীল।

২০০১ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে চাঁদপুর সরকারি কলেজে বদলি হন। এ সময় থেকেই তাঁর ক্রমাগত স্বাস্থ্যহানি ঘটতে থাকে। কিছুকাল পর প্রফেসর পদে পদোন্নতি পেয়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে বিভাগীয় প্রধান হয়ে যোগ দেন। আমৃত্যু ঐ পদেই ছিলেন। 

আমাদের এখানে বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষক বহু অবিজ্ঞানকে প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা করে। সস্তা আপোষ করে ধর্ম ব্যবসায়ীদের সাথে। এ কলুষিত ধারার উজানে বিজ্ঞানের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট লালন করতে দেখেছি অধ্যাপক হারিধন দাসকে। একজন সৎ ও প্রতিভাবান ব্যক্তিকে আমরা তাঁর যোগ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি। এতে তাঁর আপন মহিমায় কিছুমাত্র ঘাটতি হবে না বরং আমরাই অধিকতর ম্লান হয়ে যাই। তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল আমাদের অকৃত্রিম প্রণতি।

#মাইনুল ইসলাম
_____________________________________________
_____________________________________________