মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর, ২০১০

দৃক : তৃতীয় সংখ্যা (১ম অংশ)

দৃক
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ
৩য় সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ২০১০
মাঘ-ফাল্গুন ১৪১৬


সম্পাদক
মাইনুল ইসলাম
হেলাল মোর্শেদ

সম্পাদনা সহযোগী
অজিত দাশ
খালেদ চৌধুরী

প্রচ্ছদ
জিলানী আলম

কৃতজ্ঞতা
বদরুল হুদা জেনু, ডা.মোসলেহ উদ্দিন, ডা.উত্তম কুমার ঘোষ, সফিকুল ইসলাম শিকদার,
মেহেদী হাসান,ওমর ফারুক সায়মন,নাজমুল হাসান,মীর হোসেন মিশন, আব্দুল বাসেত আল ফয়সল, শামসুল ইসলাম বকুল, এনামুল হক তানভীর, মাসুদ পারভেজ জনি, কাজী কাউসার আহমেদ,কামরুল আরেফিন পলাশ, আবু আব্দুল্লাহ আসলাম

যোগাযোগ
মাতৃছায়া; ১৬৩, জংলি বিবি মসজিদ রোড; ছোটরা; কুমিল্লা।
অথবা,৪৮৫/ক; হযরতপাড়া (২য় মুরাদপুর); কুমিল্লা।
ফোনঃ ০১১৯১-৪৭৮৪৭১, ০১৭১৭-৫১৮৭১৯
ই-মেইলঃ drik_littlemag@yahoo.com
ওয়েবঃ www.driklittlemag.blogspot.com

মুদ্রণ
ইন্ডাস্ট্রীয়েল প্রেস, পুরাতন চৌধুরীপাড়া, কুমিল্লা।

প্রাপ্তিস্থান
ত্রিবেণী, সমবায় পৌরবিপনী(২য় তলা), কান্দিরপাড়, কুমিল্লা॥ লিপিকা,ভিক্টোরিয়া কলেজ রোড,কুমিল্লা
লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণ/লোক, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
নন্দন/বাতিঘর, চেরাগী পাহাড় মোড়, চট্টগ্রাম।

মূল্য ৪০ টাকা।

____________________________________________________________

সম্পাদকীয়


“বর্ণমালাগুলো নানাভাবে বিন্যস্ত এখানে। উপলব্ধি এখানে ভাষার আশ্রয় খুঁজেছে।

উপনিবেশিকতার ক্ষত এখানে মিলিয়ে যায়নি। পুঁজিবাদের বিরাট হা গিলে নিচ্ছে সবকিছু, কি বস্তুগত, কি অবস্তুগত কিছুতেই তার অরুচি নেই। বিশেষত তৃতীয় দুনিয়ায় এই অপতৎপরতা সর্বব্যাপি।

কেটেছেঁটে দিলেই বড় কাগজ ছোট কাগজ হয়ে যায়না। উল্টোক্রমেও তাই। ছোট কাগজের কণ্ঠ বিমুক্ত, উচ্চারণ সাহসী ধর্মত প্রতিষ্ঠান বিরোধী।

আমরা কালের পথিকমাত্র। কালের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারিনি বলেই- আপনাদের সামনে তৃতীয় বারের মতো নীত হয়েছি।

যাদের উৎসাহ ও আনুকূল্য দৃক এর তৃতীয় প্রকাশে আমাদের প্রাণিত করেছে প্রত্যেককে ধন্যবাদ।”

____________________________________________________________

সূচি

প্রবন্ধ
বাংলাদেশের ইন্দো-ইঙ্গ-মার্কিন এলিটদের পোদ্দারির সংস্কৃতি ও রাজনীতি/ফারুক ওয়াসিফ ॥ আমরা যে মার্ক্স পাঠ করি/জাভেদ হুসেন ॥ বাংলা গল্পের ভাষা/কাজী মোহাম্মদ আলমগীর ॥ বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রথম পার্থ’:মানবিক সৌকর্যে চিরকালীন দৃশ্যকাব্য/রুবাইয়াৎ আহমেদ ॥ আধুনিকতা উত্তরাধুনিকতা : অর্থহীন পরপদচর্চা/গোঁসাই পাহলভী ॥ গ্যাস ও আমাদের রাজনীতি/মাহবুব সবুজ

কবিতা
আরিফ হাসান ॥ নভেরা হোসেন ॥ আজহার ফরহাদ ॥ শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন ॥ তারিক মাহমুদ ॥ আশরাফ মাহমুদ ॥ কায়সার হেলাল ॥ অজিত দাশ ॥ অপর্ণা হাওলাদার ॥ খালেদ চৌধুরী ॥ বিজু সময় ॥ মাহমুদ কচি ॥ ফয়সল অভি ॥ শরীফ খিয়াম আহমেদ ॥ মাইনুল ইসলাম ॥ আতাহার সজীব ॥ তানজীম আল বায়েজীদ ॥ শিশির রাজন ॥ অথই নীড় ॥ অদ্বিতীয়া সিমু

গল্প
ঘাসপাড়ে বৃষ্টি নেমে কাদা/আশরাফ মাহমুদ ॥ ক্ষত আত্মার বিজ্ঞপ্তি/পিয়াস মজিদ ॥ একটি শর্করা উপাখ্যান/কায়সার হেলাল ॥ হুইসেল, ঝিকঝিক এবং অতঃপর/খালেদ চৌধুরী ॥

অনুবাদ গল্প
স্যান্ডি লেনে ভালবাসা/সেমবেনে আউজমেন (ভাষান্তর: জাকির তালুকদার)

ফিরে দেখা কবিতা
শামীম কবির ॥ সাবদার সিদ্দিকি ॥ সৈয়দ আহমাদ তারেক

মুক্ত গদ্য
একটি প্রাচীন ইস্তাহার/রণজিৎ দাশ ॥ সময়ে শিল্পীর প্রতিকৃতি ভাবনা/যামিনী কবিয়াল ॥

পুস্তক পর্যালোচনা
রক্তাভ মৃণালের গান/শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন


____________________________________________________________
প্রবন্ধ
____________________________________________________________


বাংলাদেশের ইন্দো-ইঙ্গ-মার্কিন এলিটদের পোদ্দারির সংস্কৃতি ও রাজনীতি
ফারুক ওয়াসিফ

বহু বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেসময়কার শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীকে সনাক্ত করেছিলেন অনেকটা এভাবে, যে টেবিলে খায়, চোঙ্গা পড়ে, কমোডে হাগে, কাগজে মোছে; সে-ই বাবু। অন্যত্র বলেছিলেন যে, যে পিতার কাছে হিন্দু, কেশব সেনের সামনে ব্রাহ্ম, ইয়ং বেঙ্গলের কাছে বিদ্রোহী, ভিখারির কাছে নাস্তিক, বামুনের সামনে ধর্মাচারি, স্ত্রীর কাছে বীর এবং সাহেবের সামনে নতজানু, সেই বাবু। সেই বাবুরাই আজকের যুগে মধ্যবিত্ত। এখন সে সমাজে মুসলিম, রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী, বিশ্বব্যাংকের কাছে উন্নয়নবাদী, এনজিওর কাছে সিভিল সোসাইটি, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কাছে মডারেট এবং বিশ্বায়নের নামে প্রভুপ্রেমে দেশবিরোধী।

ইংরেজ আমলে যে শ্রেণীটি নিজ দেশবাসীকে বিকিয়ে দেয়ার মাধ্যমে বিত্ত অর্জন করে, যারা বিদেশি শাসনের খুঁটি হয়ে কাজ করেছে, ইতিহাসের পাকেচক্রে সেই মধ্যবিত্ত বিদেশি পুঁজির দোসরগিরি করে আজকের বাংলাদেশে ছোটোলাটসাহেব এবং তার ভাইবেরাদর সেজে রাজত্ব করছে। এরা শহরগুলোকে গ্রামের বিপরীতে সাম্রাজ্যের চেকপোস্টের মতো করে বসিয়ে রেখেছে। এরা এই করদ রাজ্যের বাধ্য জমিদার। ইংরেজ যে ভূমির জমিদার সৃষ্টি করে রেখেছিল, নদী-বন-খাসজমি আর কৃষিজমির দখল বাবদ আজো তারাই নব্য-ভূস্বামী কোটিপতি শ্রেণী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। এরাই নয়া উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির বাহন এনজিওগুলো তৈরি করেছে। এরাই কৃষি, বাজার, খনিজ আর এমনকি রাষ্ট্রটাকে ভাড়া খাটিয়ে এক পা বাইরে আর এক পা ভেতরে রেখে খাড়া আছে। রাষ্ট্র এদের কাছে মানুষ ও প্রকৃতিকে চোষণের চোঙের বেশি কিছু নয়। এদের এই জাতীয় বেঈমানের ভূমিকা সনাক্ত না করে আমাদের জাতীয় দুরবস্থার যথার্থ পরিমাপ সম্ভব নয়।

এতদিন যে মধ্যবিত্তকে আমরা দেখতাম, জাতীয় রাষ্ট্রের অবসানের তালে তালে সেই আদর্শবাদী খোলসে ঢাকা জাতীয় মধ্যবিত্তের দিন শেষ। এদের তথাকথিত আলোকিত অংশ যোগ দিয়েছে ইন্দো-ইউরো-মার্কিন দুর্বৃত্তদের শিবিরে। সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিকতা, লগ্নি পুঁজির অবাধ যাতায়াত, কর্পোরেট বিশ্বায়ন এবং গ্লোবাল মিডিয়ার কল্যাণে সে এখন আন্তর্জাতিকায়িত। এদের চালচলন ভিন্ন, এদের আচার-বিশ্বাস ভিন্ন। সাবেকি চোখে এদের প্রগতিশীল বলে ভুল হয়। দৃশ্যত, এরা নারী বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এরা প্রায় নাস্তিক, এরা অতি দেশীয়পনার সংকীর্ণতামুক্ত, এরা সমগ্র বিশ্বকেই পর্যটন ও স্থায়ী অভিবাসন-মারফৎ নিজের বিহারস্থল মনে করে। কোনো রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের প্রতি বিশ্বস্ততা না থাকা সিভিল সোসাইটি এরা। পুরুষ হিসেবে এরাই নারীর পণ্যায়ন ঘটায় এবং নারীর যৌনতাকে নিজের যৌনবাসনার উপযোগী করে, বিক্রিযোগ্য করে হাজির করে বা তা ভোগ করে। এরা ঈশ্বরের স্থানে কর্পোরেট পুঁজিকে বসায়, এরা দেশ-রাষ্ট্রের জায়গায় সাম্রাজ্যের নাগরিক হয়। এরা খাল কেটে কর্পোরেট বহুজাতিক কুমির আনে। জনগণের বাদপ্রতিবাদ মাত্রই এদের কাছে সন্ত্রাসী বা বিকৃঙ্খল কার্যকলাপ। জাতির সব স্বপ্ন, জনতার সব দাবি এদের চাহিদার কাছে অবৈধ।

এগুলো হলো এদের চরিত্র লক্ষণ। তবে গুণের দিক থেকে অনেক গুণধর এর বাইরেও আছেন দেশে ও বিদেশে। কেউ কেউ এই বিশ্বায়িত মধ্যবিত্তকে মোবাইল সিটিজেন বলেছেন। আবার অরুন্ধতী রায় ও আশীষ নন্দী এদেরকে ভোগতাড়িত ফ্যাসিস্ট মনোভাবান্ন বলতেও কসুর করেননি। এটাই তার রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ধারণ করে দেয়। এরা ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করছে, একদা যা তারা ইংরেজ শাসনের সুবিধাভোগী হিসাবে এবং কোলাবরেটরের ভূমিকা পালন করেছিল। হালে কেবল নাম আর পদবিগুলো বদলেছে। এদের কাঁধে ভর দিয়েই সারা হয় পুঁজির সন্ত্রাস, রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদ আর সাম্রাজ্যিক জুলুম। সংস্কৃতি ও মিডিয়া এদের বেডরুমের আয়নার মতো, তাতে এদের নিজেদের ছবি ছাড়া আর কিছু দেখবার উপায় নেই। বাহারি মিডিয়া আর রংদার লাইফস্টাইলে আসক্ত করে এরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তারুণ্যকে বশ করে।

‘সভ্যতা’ ও ‘গণতন্ত্রের’ ইন্দ্রজাল পাতা থাকে এদের চারপাশে। সেই ইন্দ্রজাল এদের আর আগ্রাসী পশ্চিমা শক্তিকে একই যুক্তিবাদ একই মানবিকতা একই মূল্যবোধ আর একই উন্নয়নের তরিকায় বেঁধে রাখে। পশ্চিমা পীরের ছুঁড়ে দেয়া পাগড়ি ধরেই নাশিক্ষিত মধ্যবিত্ত এখন যা, তা হয়ে ওঠে। হয়ে উঠে পশ্চিমা অধিপতির চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের চির মুরিদান। ব্যাপারটা কেবল বুশ-ব্লেয়ারের কারসাজি বা হান্টিংটনের উর্বর মস্তিষ্কের উস্কানি নয়। ইউরোপ যখন আলোকিত দর্শন, সাহিত্য আর মানবতাবাদের ঢেকিতে পার দিয়ে ক্ষমতামত্ত সভ্যতার কেন্দ্র হয়ে উঠছে, সেই ‘আলোকিত যুগ’ই কি এশিয়া, আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকায় বর্বরতম দখল আর লুণ্ঠনের উন্মাদ কাল নয়? সভ্যতা আর বর্বরতা কি নয় একই ঔরসে জন্ম নেয়া দুই ভাই- চাঁদের এপিঠ ওপিঠ? এই সভ্যতার নিরাকার যুক্তিবাদের তাবিজের মধ্যেই কি বর্ণবাদী শ্বেতশ্রেষ্ঠত্বের আঁটি পুরে দেয়া ছিল না? সেকারণে, এই আধিপত্যের প্র-যুক্তি যে আধুনিক মতাদর্শে গড়া তার বিরোধিতা না করে তৃতীয় দুনিয়ার সমাজ-অর্থনীতি ও প্রকৃতি ধর্ষণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায় না। দাঁড়ানো যায় না, খোদ কর্পোরেট পুঁজির জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়া ইউরোপ আমেরিকার নিপীড়িতের সঙ্গে সহমর্মিতার পাটাতনে।

আলজেরীয় বিপ্লবী ফ্রাঞ্জ ফ্যানোর রেচেড অফ দি আর্থ বইয়ের ভূমিকায় তাই সাঁত্রে স্বীকার করেন, ‘ইওরোপীয় এলিট একটি ঔপনিবেশিক এলিট তৈরির কাজ হাতে নিয়েছিল। সম্ভাবনাময় যুবকদের তারা বেছে নিত। গনগনে লাল লোহার ছেঁকায় দাগ মেরে দেয়ার মতো পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বুনিয়াদী নীতিমালা দিয়ে তাদের দেগে দেওয়া হতো। তাদের মুখগহ্বর ভরিয়ে দেয়া হতো গুরুগম্ভীর মহান আর ঝাঁঝালো শব্দাবলী দিয়ে। তা দাঁতে বাজতো। ঔপনিবেশিক দেশে কিছুকাল থাকার পর তাদের পাঠানো হতো নিজের দেশে। এই চলমান মিথ্যার প্রতিমূর্তিদের তরফে তখন তাদের দেশি ভাইদের বলার মতো কিছুই আর থাকতো না। তারা শুধু প্রতিধ্বনি করতো। প্যারিস, লন্ডন, আমস্টারডাম-এ আমরা উচারণ করতাম ‘পারথেনন ভ্রাতৃত্ব, আর আফ্রিকা অথবা এশিয়ার কোথাও তাদের কণ্ঠ খুলে যেতো, ‘ভ্রাতৃত্ত্ব তৃত্ত্ব তৃত্ত্ব’।’

আমাদের সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তি, রাজনীতি ও উন্নয়ন ‘তাদের’ জবানীতে বর্ণিত হয়। কারণ আমাদের কথা আমরা বলতে শিখিনি। এখন আর সভ্য হওয়ার জন্য ইওরোপে যেতে হয় না, ইউরোপ চলে আসে ঘরের কাছে। দোকান খোলে বাহারি সব উন্নয়ন, প্রগতি আর আধুনিকতার। এই উন্নয়ন মানুষ ও প্রকৃতিকে আরো বিপর্যস্ত করলেও, এদের প্রগতি মানে ইতিহাস ও সমষ্টিবিচ্ছিন্ন একমাত্রিক জীবন হলেও, এসবে ঈমান আনা উন্নয়ন ও প্রগতি নামক এই ধর্মে ফরজ। এ পণ্যের প্রচারকদের আমরা নাম দিয়েছি জাতীয় বুদ্ধিজীবী। অথচ কী পরিহাস! কোটি কোটি ‘আঁধারবাসী’ ‘পশ্চাদপদ’ জনগণের কাছে এদের কোনো প্রাসঙ্গিকতাই নাই। এ বুদ্ধিজীবীদের তারা পুঁছেও দেখে না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন বলেছিলেন, ‘এসব (গরিব) মানুষ প্রতিদিন যে পানি খায় তা দিয়ে ঐসব আলোকিত মানুষরা ছুঁচতেও রাজি হবেন না।’ তাহলেও আমাদের সাংস্কৃতিক মেরাজ বন্ধ হয় না, পশ্চিমা আরশের সংবাদের তৃষ্ণাও মেটে না আমাদের। আমাদের বাসনা চায় ইওরোপের লাওহে মাহফুজে রক্ষিত (গ্রেকো-রোমান) সভ্যতার আত্ম-উপভোগের শাঁস চেখে দেখার অভিযান চালাতে। এই-ই তাদের সেক্যুলার ধর্ম এবং এইই জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াবার দার্শনিক বর্ম। তাই আমাদের মতো উপনিবেশিত দেশের সামাজিক পাঁকে আটকে থেকে কল্পনার সুষমায় পাক খেতে থাকা প্রতিটি ‘আলোকিত’ ও ‘শিক্ষিত’ নাগরিকদের কি নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত নয়, যে সুরভিত মোমের পাখনায় আমাদের সাংস্কৃতিক উড়াল, তা কি জাতীয় অবস্থা তথা জনগণের অকহতব্য দুর্দশা থেকে দূরে সরবারই ছল? ছল, কেননা পাখনাটা মোমের আর বাস্তবতার তাপে তা গলে যেতে বাধ্য- ইকারুসের মতোই।

ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের প্রতিবাদস্পৃহা আধুনিকতার আংটায় লটকে থাকে শূন্যে। জনগণের ফরিয়াদকে যদি আমরা ধর্মের জিম্মায় রেখেই খুশি থাকি, তবে জনগণ ‘মৌলবাদের’ দলে গেলে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন? জনগণের দায়িত্ব কী চেতনায় আর কী কাজে আমরা নিচ্ছি? অন্যদিকে আরেক জিঘাংসার রস চোঁয়াতে দেখি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। আরবের প্রতিরোধ দেখিয়ে বঙ্গীয় প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম, তথা শরিয়াবাদীদের উত্থানকে মজলুমের উত্থান বলে চালাবার চেষ্টাও দেখি। দুটি প্রবণতাই একাত্তরে যে জনমানুষের উত্থান নিজস্ব জাতীয় গন্তব্য তৈরি বুঝি যে, একাত্তরে প্রত্যাঘাতের জমিন তৈরি চলছে। যে সংস্কৃতির জমিনে তাদের আগডুম-বাগডুম সেই জমিনে অনেককাল তাই কিছুই ফলে না। তারা জনগণকে ভয় পায়। এই ভয় থেকে জন্ম নেয় তাদের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা। প্রভুকেও তারা ভয় করে, কিন্তু তা রূপান্তরিত হয় ভক্তিমিশ্রিত আনুগত্যে। সেকারণে একই অঙ্গে মানবতাবাদী ছটফটানি এবং সাম্রাজ্যবাদের উন্নয়ন ও আধুনিকতার জোয়ার বইয়ে দেবার কাতরতা দেখি। আমাদের অবস্থা হয় না ঘরকা না ঘাটকা। আমাদের আত্মচৈতন্য অপরের ছাঁচে ঢালাই হবার কারণে তা এক নৈতিক সঙ্কটেরও কারণ হয়। আমাদের চৈতন্য আর সমাজ জীবনের মধ্যে এমন এক কাঁটাতারের বেড়া, যার আগম-নিগমে রক্তাক্ত হবার সম্ভাবনা। এ অবস্থা লজ্জাকর। মার্কস বলেছেন, লজ্জাও এক বিপ্লবী ব্যাপার। কারণ, সেখানে নিজেকে পাল্টাবার চেতনাগত তাগিদের বীজ থাকে।

আগে উপনিবেশিক শাসকশ্রেণীর আধিপত্য বজায় থাকতো বলপ্রয়োগের ক্ষমতায়, যাকে বলা হতো ডমিন্যান্স। শাসিতদের মধ্যে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ প্রোথিত করা তখনও সম্ভব হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ শাসিত হলেও সাংস্কৃতিকভাবে শাসনব্যবস্থা থেকে দূরত্ব রাখতো এবং তাকে ‘অপর’ বলে ভাবতো। কিন্তু শিক্ষার বিস্তার, মিডিয়াভিত্তিক সচেতনতা, এনজিওর প্রচারণা এবং সর্বোপরি কালচার ইন্ডাস্ট্রির কালচারাল বটিকা সেবনে (ফেয়ার এন্ড লাভলি থেকে শুরু করে মোবাইলের স্বাধীনতা আর ক্ষুদ্রঋণে মুক্তির যুক্তি) তার মধ্যে মতাদর্শিক আধিপত্য বিস্তার তথা প্রভুর মনের ছাপে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। ইতিহাসে এই প্রথম আমাদের মতো উপনিবেশিক দেশে আধিপত্য সাংস্কৃতিকভাবে নিজেকে গ্রহণীয় করার মতো ব্রেনওয়াশ করতে সক্ষম হয়েছে। ডমিন্যান্স এভাবে হেজিমনি তথা সম্মতি আদায়ে সক্ষম হয়েছে। এখন আমরাই চাই র‌্যাব, আমরাই চাই লুটেরা পুঁজির বিনিয়োগ, আমরাই চাই মার্কিন-ভারতের বন্ধুত্ব।

ট্রানজিশনের সময় শ্রেণীর গাঠনিক সীমানা আর সাংস্কৃতিক সীমানা যে আবছা হয়ে যায় এবং তা যে পরস্পর লেপ্টে থাকে, তা খেয়াল করা জরুরি। এটা উপনিবেশিক দেশে আরো বেশি করে সত্য। রাষ্ট্র ও অর্থনীতি যখন উপনিবেশিক গড়নে চলে, তখন তার ভেতরকার সকল সম্পর্কই আসলে উপেনেবিশিক উচ্চ-নীচ বিভাজনের সম্পর্ক। জাতির সঙ্গে শ্রেণীর বিচ্ছিন্নতা এবং শ্রেণীর সঙ্গে গোষ্ঠীর দূরত্বের সম্পর্ক মোটা দাগে সমান সমান নাগরিক সম্পর্ক না, বরং আধিপত্য বনাম বশ্যতার সম্পর্ক। মধ্যবিত্ত এই সম্পর্কের পূজারি রূপ পুনরুৎপাদক। কিন্তু একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আত্মক্ষম দেশের মধ্যবিত্তকে এরকম পরজীবীতা করতে হয় না। আমাদের মধ্যবিত্তের বিকাশ ও প্রতিপত্তি মানেই জনগণের বিকাশ আর প্রতিপত্তি নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যে সবক্ষেত্রেই এমনটা না করেও মধ্যবিত্ত নিজেকে সুখে রাখতে পারে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, উপনিবেশিক দেশে এরকমটা ঘটেনি এবং এ কারণেই মধ্যবিত্ত দিনবদলের বিরুদ্ধে, বিপ্লবের বিরুদ্ধে। এটা সে ঢাকে খোদ দিনবদল ও বিপ্লবের স্লোগান চুরি করার মাধ্যমে। আমরা বোধহয় সেই দলে পড়ি। ফলে আমাদের শ্রেণীবিশ্লেষণ আসলে আত্মবিশ্লেষণ। এবং তার মাধ্যমে যদি আমরা আমাদের চেতনার উপনিবেশায়ন ঘটাতে না পারি, তাহলে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে আমাদের দেখা যাবে গণশত্রুদের কাতারে।

এই মুক্ত হবার প্রক্রিয়াকে আমি বলতে চাই ডিকলোনাইজেশন। ফ্রাঞ্জ ফ্যানো এটা বলেছিলেন, মার্কস যাকে ডিক্লাসমেন্ট বলেছেন আমাদের এখানে তা ডিকলোনাইজেশনের ধাপে আছে। আমি মনে করি, মাওলানা ভাসানী, সুলতান, আহমদ ছফা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যার যার ক্ষেত্রে এরকম ডিকলোনাইজড হওয়ার সংগ্রামই চালিয়েছিলেন। লালনের তা করার প্রয়োজন ছিলনা, কারণ রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁকে কালোনাইজেশনের খপ্পরে পড়তে হয়নি। কলোনির ঘাঁটি তখনো নদীয়ায় হানা দেয়নি, কৃষক সংস্কৃতিকে তখনও তা পরাভূত করেনি। লালন সেই কৃষক সমাজের শেষ দার্শনিক প্রতিনিধি। তাঁর সমস্যা অন্য, তিনি আধুনিক বস্তুবিশ্ব এবং তার রাজনীতিকে চৈতন্যের সংকট দিয়ে বুঝেছিলেন, অর্থনীতি-রাজনীতি দিয়ে বোঝেননি। কিন্তু যতটা বুঝেছেন, তাও আমাদের পথ দেখায়।

কলোনাইজেশন যদি মানি, তাহলে এ থেকে মুক্ত হতে ডিকলোনাইজেশনও মানতে হয়। ডিকলোনাইজেশনকে এভাবেও বলা যায়, যে শিক্ষা-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে আমাদের স্ক্রুর মতো পেঁচিয়ে ঢোকানো হয়েছে সিস্টেমের তক্তায়, তাকে আবার উল্টো প্যাঁচে খুলে এনে অন্য জায়াগায় প্রোথিত করা। সেটা হলো দেশের ইতিহাস ভাষা-সংস্কৃতি ও অর্থনীতি এবং জনস্বার্থের পাটাতনে দাঁড়ানো বৈশ্বিক মানবতার সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। আমরা যতটা বৈশ্বিক হতে চাই ততটাই দেশের হূদয়ে প্রবেশ করতে যে চাই না। একে পরজীবীতা ও হীনম্মণ্যতা ছাড়া আর কি বলা যায়? আমরা মধ্যবিত্তরা আধুনিকতার নামে, বিপ্লবের নামে, প্রগতির নামে আর এখন উন্নয়নের নামে যতবারই জনগণকে মুক্ত করার নামে যতবারই ডাক দিয়েছি, ততবারই ভুলে গেছি আমাদের নিজেদেরই মুক্ত করা হয়েছে কিনা চৈতন্যের মধ্যে, স্বার্থবোধের মধ্যে। মার্কস বলেছিলেন, যে মুক্তি অপরকে মুক্তি দেবে, সে নিজেই মুক্ত কিনা তা আগে দেখা দরকার। আমরা যদি জনগণকে মুক্ত করতে চাই-ই (যদিও কেউ কাউকে মুক্ত করে না, মুক্তির সহযাত্রী হয় মাত্র) তাহলে তার আগে আমাদেরকেই পরাধীন-চেতনার দাসত্ব আর গণবিরোধী প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে হবে। সেই কাজে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও স্বার্থের ভিতে নতুনভাবে আগঠন তথা জাতিগঠন করতে হবে। কিন্তু একদল লোক ইদানিং দেখা যায়, যারা জনগণের সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মের উচ্চবর্গীয় ভাষ্য ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পান না। যেন ধর্ম ছাড়া জনগণের সংস্কৃতিতে আর কিছু নাই। ঠিক যেভাবে প্রাচ্যবাদীরা কুসংস্কার ছাড়া ন্যাটিভ সংস্কৃতিতে আর কিছু দেখতে পায় না। আবার ধর্মীয় বোধ থাকা মানেই জনগণ মৌলবাদী ইত্যাদি কুসংস্কার জনগণের সঙ্গে তাদের সেতুবন্ধন হতে বাঁধা দেয়। এই দুই ঘোর মোচন করার সাংস্কৃতিক রাজনীতির মাধ্যমেই নতুন জমানার চিন্তা ও মুক্তির রাজনীতি দাঁড়াতে পারে। ফকির লালন সাঁই তাই আমাদের জানান,

শব্দের ঘরে নৈঃশব্দ করে,
সদাই তারা আছে জুইড়ে
দিয়ে জীবের নজরে ঘোর টাটি,
ও মিছে ঘোর টাটি- পরের হাতে কলকাঠি।

আপন ঘরে পরের সংসার,
আমি দেখলাম না রে তার বাড়িঘর।
আমি বেহুশ মুটে, তার মোট বাহি,
ও তার মোট বাহি
পরের হাতে কলকাঠি॥

(সূত্র: মুক্তাঙ্গন/নির্মাণ)

____________________________________________________________

আমরা যে মার্ক্স পাঠ করি
জাভেদ হুসেন

এই লেখাতে কয়েক অংশে মার্ক্স পাঠ, মানে বাস্তব সমাজকে বদলের খাতিরে বুঝতে চাওয়ায় মার্ক্সের দ্বারস্থ হওয়ার কয়েকটি প্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা প্রস্তাব করা হল। এর মধ্য আছে মার্ক্সকে একটি অখন্ড প্রবহমান ধারাবাহিকতায় পাঠ প্রসঙ্গ, তাঁর আর্লি রাইটিংস এর কথা। আছে আজকে আমরা যাকে “মার্ক্সবাদ” বলে চিনি (“জানি” বলা গেলনা, কারন জানা মানেই বোঝা, আর বোঝা মানে কোন কিছুর ভাল-মন্দ, ঘাটতি আর সেসবের কারন অনুসন্ধান) তার গড়ে ওঠার ইতিহাসের প্রারম্ভিকা, যার মোদ্দা কথা হল ‘মার্ক্স’ আর ‘মার্ক্সবাদ’ এর মাঝে প্রামাণিক ফারাক আছে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়েছে ঈশ্বরের মত ‘ইতিহাসের নিয়মের’ হাতে পুতুলের মত মানুষকে বিচারের জায়গায় মার্ক্সের সজীব, প্রাণশীল মানুষের কথা। লেখা হয়েছে কাঠামো নির্ভর ফর্মাল লজিক না মেনে। ফর্মাল লজিক সব সময় তার প্রকল হতে দ্বন্দ্ব দূর করে সুসংহত করতে গিয়ে বিষয়টাকেই মেরে ফেলে। দরকার কোন নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোন পর্যালোচনার বিষয়কে ছাপিয়ে যাওয়া। যা প্রাণশীল তাতে দ্বন্দ্ব থাকবেই, দরকার তা কোন কারণে, কেমন করে পয়দা হল তার পর্যালোচনা। এই পর্যালোচনার উদ্দেশ্য দ্বন্দ্ব দূর করা নয়, নিরসনও নয়, বরং যে বাস্তব পরিস্থিতি বা শর্তাবলি হতে দ্বন্দ্ব জন্মায় তাকে বাস্তবে বোঝা, সেই বাস্তবে সক্রিয় হওয়া।
                                        
১.
কার্ল মার্ক্সকে নিয়ে যারা চর্চা করেছেন তাদের কাছে আর্লি মার্ক্স (Early Marx) আর লেটার মার্ক্স (Later Marx) শব্দবন্ধগুলো পরিচিত ঠেকবে। সোজা কথায় ১৮৪৫ সালে মার্ক্স আর এঙ্গেলস মিলে “জর্মন ভাবাদর্শ” লেখার  আগে মার্ক্স যা লিখেছেন তাকে অপরিণত মার্ক্সের লেখা বলে পাশে ঠেলে দেয়ার একটা ইতিহাস আছে। যদিও আজকে মার্ক্সকে পাঠ করতে গেলে এই ভাগ করে ফেলার ব্যাপারে প্রশ্ন না তুলে, না ভেবে এগোনোর কোন উপায় নেই।

মার্ক্সের আর্লি রাইটিংস এর মাঝে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো তাঁর জীবদ্দশাতে ছেপে বের হয়নি। ১৮৪৩-এ লেখা “হেগেলের রাষ্ট্রতত্ত্বের পর্যালোচনা” ছাপা হয় ১৯২৭ আর ১৮৪৪-এর “ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট” ১৯৩২ সালে। মার্ক্সের এই সময়কার দার্শনিক রচনাগুলো নতুন করে আবিষ্কার হতে হতে বিশ্ব জুড়ে মার্ক্স এর চিন্তা প্রয়োগের শক্তিশালী কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। অবশ্য ১৯০২ সালে ফ্রাঞ্জ মেহরি মার্ক্সের কিছু প্রাথমিক লেখা ছেপে বের করেন যদিও গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো তখনও আবিষ্কারই হয়নি। ততদিনে প্রথম প্রজন্মের মার্ক্সবাদী প্লেখানভ, বার্নেস্টাইন, কাউটস্কি, লাব্রিওলা  তাদের ভাবনার আদল সম্পন্ন করে ফেলেছেন। ১৮৪৩ থেকে ১৮৪৫ পর্যন্ত সময়ে যে কঠিন আর জটিল প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে মার্ক্স তাঁর চিন্তাকে রূপ দিচ্ছিলেন, যে সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়ার সুযোগ ছাড়াই দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল গড়ে ওঠে।

মার্ক্সের গড়ে ওঠার এই গুরুত্বপূর্ণ কাল সম্পর্কে ১৯০০ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত জানার উৎস ছিল ১৮৫৯ সালের “রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনায় সন্নিবেশ” রচনার ভূমিকায় গোটা কয়েক বাক্য মাত্র। মার্ক্সীয় তাত্ত্বিকদের একটা গোটা প্রজন্ম মার্ক্সের এই রচনাগুলো সম্পর্কে কিছু জানবার সুযোগ পাননি। হেগেলের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর মার্ক্স কোন “বাস্তব আর দার্শনিক” কারণে দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি তাকে বিদায় জানিয়ে বাস্তব আর দর্শনের নতুন মানে দাঁড় করালেন, কেন নতুন দর্শন গ্রন্থ না লিখে তিনি বর্তমানের পুঁজিতান্ত্রিক সমাজকে পর্যালোচনায় মন দিলেন? জগত সম্পর্কে কী ভাবছেন, সাধারণ দার্শনিক ধারণাগুলো সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কী-এসব নিয়ে একটা আলাদা লেখা না লিখে কেন মার্ক্স পুঁজিতন্ত্রের সামাজিক অর্থনৈতিক গঠন নিয়ে বাকী জীবন কাটিয়ে দিলেন?

মার্ক্সের জীবনের বিশাল অংশটাই একটা লেখার পেছনে ব্যয় হয়েছে যা তিনি কখনোই শেষ করে যেতে পারেন নি। সেই লেখার নাম “ক্যাপিটাল”। এই “ক্যাপিটাল” যে প্রথাগত অর্থনৈতিক কোন লেখা নয় তাও প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লেগেছে। লেনিন এই ব্যাপারটা ধরতে পেরে বলেছিলেন - হেগেলের লজিক সম্পূর্ণ পাঠ ও অনুধাবন ছাড়া মার্ক্সের ক্যাপিটাল, বিশেষ করে এর প্রথম অধ্যায় বুঝতে পারা একেবারেই অসম্ভব। ফলে, অর্ধ শতাব্দি পরে মার্ক্সবাদীদের কেউই মার্ক্সকে বুঝতে পারেনি (ফিলোজফিক্যাল নোটবুক)। ক্যাপিটেলের প্রথম খন্ডের ইংরেজি অনুবাদের শিরোনাম দেয়া হয়েছিল The Process of Capitalism, মানে “পুজিতান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া”। মার্ক্স মূল জর্মন বলেছেন Der Producktionprocess des Capital, মানে The Production Process of Capital- পুঁজির উৎপাদন প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় নামটাতে মনে হয় মার্ক্স “পুজিতন্ত্রের” শর্তে মাল-সামান উৎপাদনের পদ্ধতি বর্ণনা করছেন যার সাথে মার্ক্স কথিত উৎপাদকদের পণ্যের সাথে সাথে নিরন্তর সামাজিক সম্পর্ক জাল বুনে চলার কোন সম্পর্ক নেই। মার্ক্স তার বিপুল রচনাবলীর কোথাও “পুঁজিবাদ” শব্দটি ব্যবহার করেননি। আসলে তার আলোচনার বিষয়টাই ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন, যাকে এভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে- যে উপায়ে পুঁজি সামাজিক সম্পর্ক উৎপাদন করবার সাথে সাথে নিজেকেই পূনরুৎপাদিত করে সেই প্রক্রিয়ার উন্মোচন।

২.
শুরুর দিকে হেগেলের পর্যালোচনা থেকে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের অসমাপ্ত পর্যালোচনা পর্যন্ত মার্ক্সের দর্শনের লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তি। এই কাজ শুরু করেছিলেন বুর্জোয়া সমাজের প্রবর্তকেরাই। এনলাইটেনমেন্ট হতে মানবতাবাদ হয়ে মার্ক্স কথিত “ভাববাদ” ধাপে ধাপে পা বাড়িয়েছে মানব মুক্তির দর্শনে, এই মুক্তিকে দিয়েছে ঐতিহাসিক দায়িত্বের চেহারা। উপনিবেশের মানুষকেও তারা “মুক্তিই” দিতে চেয়েছে পবিত্র কর্তব্যের খাতিরে, বলা হয়েছে এই কালা আদমিগুলো হল White men's burden। মার্ক্স এই ঐতিহ্য প্রসঙ্গে পুরো মাত্রায় সজাগ ছিলেন, এই প্রান্তে দাঁড়িয়ে তার ইতিহাসকে আত্মস্থ করেই মার্ক্সের যাত্রা শুরু হয়। বুর্জোয়াদের মানব মুক্তির আন্দোলন কেন রাজনৈতিক বিজয় পাওয়ার পরই থেমে পড়লো তার পর্যালোচনা করতে গিয়েই মার্ক্স বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও ইতিহাস দর্শনের চূড়ামনি হেগেলকে নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিলেন। বুর্জোয়া মুক্তি আন্দোলন যে রাজনৈতিক বিজয়েই তার কাজ শেষ বলে মানতে বাধ্য হয়-এই বাস্তবতার চুড়ান্ত প্রতিনিধি হচ্ছে হেগেলের দর্শন। হেগেলীয় দর্শন নতুন বুর্জোয়া অসাম্য আর নিপীড়ন দূর করতে বুর্জোয়াদের অক্ষমতার দলিল। এ রকম দর্শন যা অর্জিত হয়েছে তা দিয়ে সেই অর্জনের বলি সামাজিকভাবে বঞ্চিত নতুন শ্রেণীর সামনে ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে বলে অজুহাত খাড়া করে, কারণ এই নতুন শ্রেণীর কাছে বিগত বুর্জোয়া মানব মুক্তির আন্দোলন কোন শ্রেণীগত তাৎপর্য বহন করেনা। ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আম-জনতার দৃষ্টিভঙ্গি যাঁচাই করলে।

বুর্জোয়া সমাজের ভেতরের অসঙ্গতিগুলো হেগেলের আগে পরে আর কোন বুর্জোয়া দার্শনিক চিহ্নিত করেননি, স্বীকৃতিও দেননি। বুর্জোয়া সমাজের গতরখাটা মানুষরা যে কী দূর্গতিতে তাদের কাজের কাছে আটকা পড়ে কয়েদি হয়ে যায় তা দেখিয়ে তিনি নিজেই বলেছেন যে - “সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বুর্জোয়া সমাজ সীমাহীন দারিদ্র আর বঞ্চনারও জন্মদাতা”। তিনি অর্থনৈতিক ভিতের মাঝেই এই দ্বন্দ্ব বিরাজমান বুঝতে পেরেও স্বীকার করেছেন যে রাজনৈতিক রাষ্ট্র এই সমস্যা কমাতে পারবে, কিন্তু কখনোই বিলোপ করতে পারবেনা। সেই তিনিই আবার ঘোষণা করছেন যে, বুর্জোয়া রাষ্ট্র হচ্ছে মানব নৈতিকতার চূড়ান্ত অর্জন, কারণ এখানে ব্যক্তি ও সমগ্রের ইচ্ছা জীবন্ত ঐক্য তৈরী করে, আর ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বাধীনতাই আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত। হেগেলের দর্শনের পর্যালোচনা করতে গিয়ে মার্ক্স পরিষ্কার করে দেখালেন যে, যাকে সবাই হেগেলের চিন্তার সীমাবদ্ধতা বলছে তা আসলে খোদ বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার মাঝে মানুষের মুক্তি অর্জনের সীমাবদ্ধতা। এই সমাজ সর্বদা রাজনৈতিক, বৌদ্ধিক লড়াইয়ের কালে রাজনৈতিক, সাংবিধানিক মুক্তির দিকেই এগোয়, সে বুঝাতে পারে না যে, প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের উৎপাদনের জন্যই উৎপাদন, তথা খোদ মুনাফার জন্য উৎপাদন থেকে মুক্তি বাস্তব মুক্তির প্রশ্নের সমার্থক। ফলে যে পদ্ধতিতে ধন-দৌলত উৎপাদিত হয় তাতেই যে সামাজিকভাবে নিপীড়িত নতুন এক শ্রেণী উৎপাদনের দাস হয়ে পড়েছে সেই সমস্যা কাটানো তার পক্ষে অসম্ভব হয়। কারণ এই শর্ত বিলোপ মানে শ্রেণী হিসেবে তার নিজেকে বিলোপ করা। ফলে সে বার বার রাজনৈতিক বা নাগরিক স্বাধীনতাতেই এই সমাধান খুঁজে ফেরে।

হেগেল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বুর্জোয়া দর্শন, রাজনীতি, রাজনৈতিক মুক্তি আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাঝে সংযোগ ঘটাতে পারেনি, ফলে মালয়েশিয়া যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটায় তখন তাকে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে রাজনৈতিক অধিকারে ছাড় দিতে হয়। সমস্ত মানুষের মুক্তির পথে শিল্প উৎপাদন পদ্ধতি, তার বন্টন, তার উদ্দেশ্য অবিচ্ছেদ্য বাঁধা হয়ে সামনে আসে। নয়তো অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে বাকি সব কিছুর বিকল্প হিসেবে সাফাই গাওয়া হয়।

মার্ক্স কিন্তু এসবের বিপরীতে খোঁজ নিলেন বুর্জোয়াদের মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতির, কেন এই প্রতিশ্রুতি দেয়া হল, কেনই বা বিজয়ী হয়েও বুর্জোয়ারা এই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারলোনা! আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র সে কাজে ব্যর্থ হয়ে যে সাফাই গাওয়া শুরু করেছিল, মার্ক্স তার বিপরীতে দেখতে পেয়েছিলেন যে, “সমগ্র আর ব্যক্তির অভিপ্রায়ের ঐক্য” সম্ভব কেবল যখন পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার ফলে পয়দা হওয়া সামজিক বিরোধ ও শ্রেণীবদ্ধ বিলোপ করা যাবে। তার মানে এই সমগ্রের মুক্তি এখন পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী বিদ্রোহের সাথে সম্পৃক্ত। এই বিপ্লবের লক্ষ্য হবে বুর্জোয়া রাজনৈতিক মুক্তি ছাপিয়ে মানুষের মানব সমাজের পৃথিবী। এই প্রয়োজনের বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করতেই মার্ক্স ১৮৪৪ এর ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক্যাল ম্যানুসক্রিপ্ট হতে তাঁর “পুঁজি” পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে গেছেন, পর্যালোচনা করে গেছেন পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতি, তার মাঝে মানুষের সম্পর্ক জালের গতি প্রকৃতি, যে কারণে সম্পর্কগুলো ঐ রকমই হয় তার কারণ এবং তার মাঝের লজিক। তাঁর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল যে বুর্জোয়া সমাজের রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র কোন স্থির বা প্রকৃতি-নিয়তি তাড়িত ঘটনা নয়, সজ্ঞানে বা অচেতনে তা সমাজ অভ্যাসের ফলেই উৎপাদিত হয়, ফলে তাকে সচেতনভাবে বদলে ফেলা সম্ভব।

৩.
ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংম্যানস এসোসিয়েশন (প্রথম ইন্টারন্যাশনাল) মিলিয়ে যাওয়ার সাত বছর আর কার্ল মার্ক্সের মৃত্যুর ছয় বছর পর ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল গড়ে ওঠে। এর মধ্যে জর্মন সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির মত বেশ কিছু গণসংগঠনও গড়ে ওঠে। এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর ১৯১৪ পর্যন্ত এই জর্মন পার্টির নেতারাই ইন্টারন্যাশনালের মূল নেতৃত্বে আসে। পার্টির তাত্ত্বিক নেতা কার্ল কাউটস্কি (১৮৫৪-১৯৩৮) আসেন এর পুরোভাগে। তাঁর কাছে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন ছিল ইতিহাসের অমোঘ নিয়মের বাস্তবায়ন, তা যেন প্রাকৃতিক নিয়মের মতই কিছু, মানুষ তার হাতে ব্যবহৃত কলকব্জার মত। কাউটস্কি এর মাঝেই মার্ক্সের ‘ক্যাপিটেল’ কে একটা অর্থনৈতিক তত্ত্ব হিসেবে হাজির করে ফেলেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদনের ফলে ঘটা টেকনোলজিক্যাল অগ্রগতি আর সংখ্যায় বাড়তে থাকা সর্বহারাকে একত্রিত করবার মন্ত্র পাওয়া যাবে এই তত্ত্বে। আর সেই বিদ্যায় শিক্ষিত সমাজান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা শ্রমিকদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র শিক্ষা দেবে। তাঁর কাছে সমাজতন্ত্র মানে শিল্প রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে আসা, আর রাষ্ট্র বিকশিত সংসদীয় রূপের কিছু একটা।

এর মাঝে জর্মন সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টি আরো শক্তিশালী হল। বার্নেস্টাইন (১৮৫০-১৯৩২)এর মত লন্ডন প্রবাসি নেতারা কাউটস্কি’র মার্ক্সবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে লাগলেন। লন্ডনে তাঁর ফেবিয়ান সোশালিস্টদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। ১৮৯৭ সালে তিনি ঘোষণা করলেন যে কাউটস্কির সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ধারণা পুরোনো হয়ে গেছে। পুঁজিতন্ত্র শন্তিপূর্ণভাবে, ধীরে ক্রমান্বয়ে সমাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হবে। উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব এখন অপ্রয়োজনীয়, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে মার্ক্সীয় হেগেলকে বাদ দিয়ে কাপ্টের কাছে ফিরে আসতে হবে। কাপ্ট তখন একাডেমিক মহলে খুব ফ্যাশন দুরস্ত ব্যাপার ছিল। পরে তোপের মুখে বার্নেস্টাইন বললেন, মার্ক্স মনে হয় পুঁজিতন্ত্র বিকশিত হয়ে সমাজতন্ত্রের উত্তরণের কথা বলেছিলেন। তবে বার্নেস্টাইনের কথা আসলে তখনকার অনেক পার্লামেন্টপন্থী আর ট্রেড য়ুনিয়ন নেতাদের অনুচ্চারিত মনের কথা, যতক্ষণ প্রত্যক্ষ সফলতা আসছে তখন আন্দোলন নিয়ে তাত্ত্বিক কচকচিতে তাদের রুচি ছিলনা। রোজা লুক্সোমবার্গ ভাল জবাব দিয়েছিলেন এই বলে যে, বার্নেস্টাইনের এই সংশোধনের প্রস্তাব বুর্জোয়া সমাজে খাপ খেয়ে টিকে থাকার ফন্দি। অপর দিকে তখন জার শাসিত রাশিয়াতে বেআইনি শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধছে। সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত গেওর্গি প্লেখানভকে কেন্দ্র করে একদল মানুষ মার্ক্সপন্থা অনূসারে সমাজতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তুলছেন। প্লেখানভ যখন পার্টি কর্মসূচি খসড়া করতে গিয়ে মার্ক্সের “সর্বহারার একনায়কতন্ত্র” ধারণা সন্নিবেশ করলেন, তবে অধিকাংশ রুশ “মার্ক্সবাদী” তার যে অর্থ করলেন মার্ক্সের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। মার্ক্স ও এঙ্গেলস আদতে ধারণাটি ব্যবহার করেছিলেন ফরাসি বিপ্লবী অগুস্ত ব্লাঁক এর অনুসারীদের হতে নিজেদের পৃথক করতে। ব্লাঁক সারা জীবন কাটিয়েছেন বিপ্লবী একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে “ষড়যন্ত্র” বাস্তবায়নের চেষ্টায়। এই পরিকল্পনা যোগ্য, অভিজ্ঞ কিছু মানুষ বাস্তবায়ন করবে শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থে, শ্রমিকরা পরে কাজ সফল হলে জানতে পারবে যে তাদের জন্য বিপ্লব সম্পন্ন করা হয়েছে। এর বিপরীতে মার্ক্স ও এঙ্গেলস বললেন যে, সমগ্র সর্বহারা শ্রেণীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ হলেই কেবল কমিউনিজম বাস্তব হতে পারে। শোষকের পক্ষ হয়ে যে রাষ্ট্র শোষিতকে বঞ্চনা করে তা কোন শ্রমিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে নির্মূল করা সম্ভব নয়, সেটা হবে এমন এক প্রক্রিয়া যা প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকেই নিজকে জনসমপ্রদায়ের মাঝে মিলিয়ে দেয়া শুরু করবে। এই হল মার্ক্সের “সর্বহারার একনায়কতন্ত্র”।

দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ “মার্ক্সবাদী” মৌলিক ধারণা প্রবর্তন করে। সেটা হল “দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ”। মার্ক্স নিজে তাঁর এত বিশাল রচনাবলীয় কোথাও “দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ” পদবাচ্য ব্যবহার করেননি। এর প্রথম ব্যবহার করেন প্লেখানভ ১৮৯১ সালে কাউটস্কির New Zeit পত্রিকাতে প্রকাশিত প্রবন্ধে। তৎকালীন নারোদনিকপন্থীরা রুশ বিপ্লবের মূল ভিত্তি হিসেবে বিষয়ীর বিপ্লবী আকাঙ্খাকে সর্বাগ্র গণ্য বলে প্রচার করতো। প্লেখানভ একে স্বতঃস্ফূর্ত আম-জনতার হুল্লোর মনে করে তার বিপরীতে এমন এক ‘বস্তুবাদ’ প্রতিস্থাপন করলেন যার মাঝে মানুষের ইচ্ছা বা অভিপ্রায়ের কোন জায়গাই নেই। সমস্যাটা হল এই ধারণা আজ অবধি মার্ক্সের নামেই চালু আছে। দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের কালে নয়া কান্টবাদের আক্রমণ প্রতিহত করতেই মূলত “দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ” ধারণাটি আরো পোক্ত হয়। সে সময়ের পদার্থ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মাখের প্রভাব মার্ক্সীয় বলয়ে লক্ষণীয় ছিল। মাখ অষ্টাদশ শতাব্দীর ডেভিড হিউম এর মত মনে করতেন যে সংবেদনই জ্ঞানের মূল এখানে বস্তু কোন বিষয়গত ভূমিকা রাখেনা। লেনিনের ঘনিষ্ট সহযোগী বগদানোভ ছিলেন সবচে’ সোচ্চার মাখপন্থী, প্লেখানভ এবার এই দার্শনিক লড়াঁইয়ে নামলেন তিনি বস্তুকে কান্টের Thing is themselves এর সঙ্গে এক করে দেখলেন তবে কান্ট যে তাকে ‘অজ্ঞেয়’ বলে ঘোষণা করেছিলেন তা অস্বীকার করলেন। তার মানে আমাদের সংবেদন সরাসরি বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান দেয়? প্লেখানভ বললেন, না, সংবেদন যা দেয় তা কাঁচামালের মত, যেটাকেই পরে চিন্তা হিসেবে ডিকোড করে নিতে হয়। বস্তুর এই ব্যাখ্যার সমীহ করবার মত ইতিহাস থাকতে পারে, তবে তা মার্ক্স বা এঙ্গেলসের মত নয়। “বস্তুকে সংবেদনের মাধ্যমে পাওয়া যায়” এই মত অষ্টাদশ শতাব্দীর যান্ত্রিক বস্তুবাদীদের মত, প্লেখানভ তাদের সম্পর্কে বিশদ জানতেন। এ সাপেক্ষে তিনি হলবাখের উদ্ধৃতি দেন, যার মতে “আমাদের সংবেদনে কোন না কোন ভাবে যা ক্রিয়া করে তাই বস্তু”। কিন্তু এতে বুর্জোয়া চিন্তাবিদদের মত, যাদের কাছে মানুষ চিন্তাশীল অনুমাত্র, যারা বলতেন “কিডনির জন্য যা প্রশ্রাব, মস্তিস্কের জন্য তাই চিন্তা”। সংবেদন তাদের কাছে ব্যক্তিদের ওপর বাইরের জিনিসের রেখে যাওয়া শরীরী ছাপ। জ্ঞান এখানে ব্যক্তি নাগরিকদের পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়, যা নিঃসঙ্গ, একাকী, বাকি মানুষদের সাথে সংযোগহানী, ফলে সমাজ সাপেক্ষে গোলকধাঁধাঁর মত।

প্লেখানভ দেখাতে চেয়েছিলেন যে বার্নেস্টাইনের কান্টের কাছে প্রত্যাবর্তন বুর্জোয়া সমাজকে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ার অংশ মাত্র। সেই সাপেক্ষে প্লেখানভের প্রচেষ্টা এক স্রোতে মিশে যায়।

এই সাপেক্ষে লেনিনের প্রসঙ্গ আরো বড় আলোচনা দাবি করে। তবে একটা উদাহরণ দেয়া যাক। এই ডামাডোলের মাঝেই লেনিন লিখেছিলেন Materialism and Empirio Criticism। সেখানে তিনি “লুডভিগ ফয়েরবাখে” বলা এঙ্গেলসের যে মন্তব্যে জোর দিয়েছিলেন তা হল এই যে প্রতিটি যুগান্তকারী আবিষ্কার (এমন কী তা প্রকৃতি বিজ্ঞানে হলেও) এর সাথে বস্তুবাদকে তার রূপ পাল্টাতে হয়। পরিহাস হল দ্বিতীয় আন্ত-র্জাতিকে লেনিনের এই বইটাই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের অপরিবর্তনীয় বাইবেল হয়ে গেল। মোদ্দা কথায়, এই প্রক্রিয়াতে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনাল এবং তার পরে মার্ক্স সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা প্রশ্নাতীত বিশ্বাসের স্থান পেল, কে কী বিশ্বাস করে তা দিয়ে মানুষ মাপার এই হল শুরু।

৪.
তথাকথিত “পরিণত” মার্ক্সের যে বিশাল দর্শনিক প্রেক্ষাপট রয়েছে, তাঁর কাছে যে মানুষ সদা আত্মসৃষ্টিরত সত্তা, তাঁর যে “দ্বান্দ্বিক বা “ঐতিহাসিক বস্তুবাদ” নামের কোন দর্শন ছিলনা- এই রকম বহু প্রশ্ন উপস্থাপিত হল খোদ মার্ক্সের তরফ থেকেই, মোটামুটি ১৯২৭ থেকে ১৯৩২ এর মাঝে, মার্ক্সের লেখা “হেগেলের রাষ্ট্র তত্ত্বের পর্যালোচনা” ও “ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুসক্রিপ্ট” প্রকাশ হওয়ার মাধ্যমে। ততদিনে সোভিয়েত রাশিয়াতে, য়ুরোপীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলোতে “দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ” শক্ত হয়ে দানা বেঁধেছে, তাকে প্রশ্ন করা বিপদজনক - তা যত তাত্ত্বিক পর্যায়েই হোক না কেন।

মার্ক্সের দার্শনিক ও নৈতিক অবস্থান লেখা আছে যে “আর্লি রাইটিংস” এ, এই হচ্ছে তার পাঠ ও গ্রহণের প্রেক্ষাপট যা আজকে, অন্তত বাংলাদেশে, খুব বেশি পাল্টায়নি। মজার ব্যাপার, লেখাগুলো প্রকাশিত হওয়ায় সাথে সাথে “আর্লি রাইটিং” হয়ে গেল, মানে এগুলো অপরিণত, ছোকরা বয়সের মার্ক্সের লেখা, তখনো তার বুদ্ধি পেকে ওঠেনি। ১৯৫৭ সালে পূর্ব জর্মন মার্ক্সিজম লেনিনিজম ইনস্টিটিউট, রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সিদ্ধান্তে ইকোনমিক এন্ড ফিলোজফিক ম্যানুসক্রিপ্টকে মার্ক্স এঙ্গেলস রচনাবলীর বাইরে আলাদা খন্ড হিসেবে প্রকাশ করে।

এই লেখাগুলো কর্তাজনদের এত বিব্রত করবার কিছু সহজ কারণ ছিল। কারণ প্রচলিত “মার্ক্সবাদ” এর “দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ” ও “ঐতিহাসিক বস্তুবাদ” এর সাথে এই মার্ক্সের চূড়ান্ত অমিল, এখানে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার কোন উল্লেখ নেই, নেই মহাবিশ্বের সর্বত্র চালু মূল তিন নীতি’র (গুণ থেকে পরিমাণ আর পরিমাণ থেকে গুণে উত্তরণ (নেতির নেতিকরন আর বিপরীতে সমাপতন) কথা।

৫.
মার্ক্সের সমাজতন্ত্রের ধারণার জন্ম তাঁর মানব ধারণা হতে। সমাজতন্ত্র রাষ্ট্র, যন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের এমন কোনো সমাজ নয় যেখানে ব্যক্তি অধীন।  এমনকি যদি ব্যক্তি পুঁজিপতির  জায়গায় যদি রাষ্ট্র জনগনকে কাজের ব্যাবস্থা করে দেয় তাহলেও তা মার্ক্সের কাছে সমাজতন্ত্র নয় (এই প্রসঙ্গে দেখুন রুশ ইংরেজি সংস্করনের Capital প্রথম খণ্ডের পৃ.৬৮৯)। মার্ক্স খুব পরিষ্কারভাবে ১৮৪৪ এর খসড়াতে যেমন বলেছেন, “এমন কমিউনিজম মানব বিকাশের লক্ষ্য নয়।” তাহলে লক্ষ্যটা কি?

পুঁজির তৃতীয় খণ্ডের শেষে মার্ক্স অসাধারণ স্বচ্ছভাবে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য ব্যক্ত করেছেন :
“ বস্তুতপক্ষে স্বাধীনতার এলাকা সত্যি সত্যি শুরু হয় কেবল সেখানেই, যেখানে শ্রম, যা নির্ধারিত হয় প্রয়োজন ও সাংসারিক চিন্তা ভাবনার দ্বারা, তার বিরতি ঘটে; তাই স্বাধীনতার স্বাভাবিক অবস্থানই হচ্ছে সত্যিকারে বস্তুগত উপাদানের পরিধি ছাড়িয়ে। ঠিক যেমন অ-সভ্য মানুষকে তার অভাব মেটাবার জন্য জীবন পোষণ ও পুনরুৎপাদনের জন্য কুস্তি লড়তে হয় প্রকৃতির সঙ্গে, ঠিক তেমনি করতে হয় সভ্য মানুষকেও এবং তাকে তা করতে হয় সমস্ত সমাজ-ব্যবস্থায় এবং সম্ভাব্য সব রকমের উৎপাদন-পদ্ধতিতে। তার বিকাশের সঙ্গে দৈহিক প্রয়োজনের এই পরিধি তার বিবিধ অভাবের ফলে বিস্তার লাভ করে; কিন্তু একই সঙ্গে বৃদ্ধি লাভ করে উৎপাদনের শক্তিসমূহ যারা পূরণ করে এই সমস্ত অভাব। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা রূপ ধারণ করতে পারে কেবল সমাজীকৃত মানুষের দ্বারা, সংঘবদ্ধ উৎপাদনকারীদের দ্বারা, প্রকৃতির সঙ্গে তাদের লেনা-দেনাকে যুক্তিসিদ্ধভাবে পরিচালনা এবং প্রকৃতি কর্তৃক, তথা তার অন্ধ শক্তিসমূহ কর্তৃক শাসিত না হয়ে, তাকে তাদের সামূহিক নিয়ন্ত্রণাধীনে আনয়ন করা এবং ন্যূনতম কর্মশক্তি-ব্যয়ে এবং তাদের মানব-প্রকৃতির পক্ষে সর্বাধিক অনুকূল ও উপযুক্ত অবস্থাধীনে এই লক্ষ্য সাধন করার মাধ্যমে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তা তখনো থেকে যায় প্রয়োজন-পূরণের পরিধির মধ্যে। এই পরিধি ছাড়িয়েই শুরু হয় মানবিক শক্তির সেই বিকাশ, যা নিজেই নিজের উদ্দেশ্য, স্বাধীনতার সত্যিকারের জগৎ, কিন্তু যা কুসুমিত হতে পারে কেবল প্রয়োজন-পূরণের জগতের ভিত্তির উপরেই। ”

____________________________________________________________

বাংলা গল্পের ভাষা
কাজী মোহাম্মদ আলমগীর

গল্পে মানুষের কথা থাকে কিন্তু গল্পের ভাষা এবং মানুষের ভাষা এক নয়। কারণ মানুষ গল্পের মতো কথা বলে না। আবার গল্পের লেখকের নিজের একটা ভাষাশৈলী থাকা সত্বেও মানুষেরই ভাষা। প্রশ্ন দাঁড়ায় গল্প কি লেখকের ভাষা নাকি মানুষেরই ভাষা। লেখক যেহেতু মানুষ অতএব লেখকের ভাষা মানুষেরই ভাষা। মাঝখান থেকে শৈলী শব্দটি একটি রেখা বিভেদ তৈরি করে।

গল্পে লেখক মানুষের ভাষাকে তার নিজের মতো করে প্রকাশ করেন, ফলে এর একটা শৈলী দাঁড়ায়। শৈলী নির্মাণ করতে গিয়ে লেখকের কথা ও মানুষের মুখের কথার যে সংশ্লেষণ তৈরি হয় তাতে ভাষা কিছুটা পাল্টে যেতে বাধ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পে ঘাট কথা বললো; তাও মানুষেরই কথা। ঈশপের গল্পের প্রাণীরা কথা বললো-মানুষের স্বভাব চরিত্র ও প্রবণতা নিয়ে। ভারত উপমহাদেশের গল্প যখন আরব অঞ্চল ঘুরে ফিরে এলো তখন তার বিশাল সংসার। গল্পের দাদা, নাতি, পুতি- তাদের ছিরিছাঁদ মরুভূমির উত্তাপে পাল্টে গেলো, পাল্টে গেলো রুক্ষ মরুভূমির  গল্পরজনীর শারীরিক চেতনায়। ভাষাও পাল্টালো।

ভাষা কত সময় নিয়ে পাল্টায়? লেখক কি ইচ্ছে করলে গল্পের ভাষা পাল্টাতে পারেন? সাফ কথা পাল্টাতে পারেন না। তাহলে গল্পের শৈলীটা কি? এর ভেতর যে ভাষা পাল্টে দেবার প্রণোদনা রয়েছে তা কি অস্বীকার করা হবে? লেখক যখন সমাজ দেহ থেকে গল্প গ্রহণ করেন অথবা গল্প যখন তার মগজে প্রবেশ করে তখন তার একটা ভাষা শৈলীও প্রবেশ করে। কিন্তু লিখতে বসে গল্পটির সমাজভাষা লেখক সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারেন না। শুরু হয় যোজন বিয়োজন প্রতিস্থাপন। তখন ভাষা বদলে যায়। ব্যাকরণের বেঁধে দেয়া নিয়ম কানুন মেনেই গল্পের ভাষা বদলায়, কিন্তু সে নিয়ম কানুনও লেখক কখনো কখনো অমান্য করেন।

অমিয়ভূষণ সম্পর্কে বলা হলো,‘অমিয়ভূষণের বাক্য বিন্যাস অনেকাংশে ইংরেজি গদ্যরীতির অনুসারী। ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার, জটিল বাক্যকে ভেঙ্গে দেওয়া, বিদেশি শব্দ ব্যবহারের প্রাচুর্য, প্রায় অপ্রচলিত অদভুত নামকরণ চমকে দেয় পাঠককে। আবার ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে অমিয়ভূষণ তৈরি করেন একটি বিপরীত জগত। ...যাকে বলা যায় অ্যান্টি-ওয়ার্ল্ড বা বিপ্রতীপ পৃথিবী। সেই জগতে প্রকৃতি, মানুষ, ঘরবাড়ি আমাদের এই পৃথিবীর প্রতিবিম্ব বলে মনে হবে। তবে এমন কিছু ঘটনা সেখানে ঘটে, যা আমাদের এই চেনা পৃথিবীতে ঘটে না। অমিয়ভূষণ এই বিমূর্ত ছায়াময় বাস্তবতাকে এমনভাবে প্রতিফলিত করেন, যা আপাত বিচারে প্রবল বাস্তব বলে মনে হলেও সে বাস্তবতা আমাদের চেনা-শুনা জগতে খুঁজে পাওয়া যায় না।’ তাহলে চেনা জগত বলতে আমরা সীমাবদ্ধ যে জগতকে বুঝি সেই জগতে লেখক সীমাবদ্ধ থাকতে নারাজ। লেখক তাহলে কি প্রতিস্থাপন করেন? তার আগে জানা দরকার এই প্রচেষ্টা বা চেষ্টা-তদ্বিরের কেন প্রয়োজন ঘটলো? লেখক বা শিল্পী অনুকরণে তৃপ্ত নয়। বাস্তববাদের স্রেফ ফটোগ্রাফিতে তার মন ভরে না। আরো নতুন রাস্তা চাই, নতুন জানালা চাই, নতুন পথ চাই। তখনও তার সঙ্গী ভাষা। লেখক আজকের ভাষা গতকালের ভাষা, ভাবীকালের ভাষাকে অতিক্রম করে। অনাগত কোন ভাষা শৈলী নির্মানে সে ব্রতী হয়।  অতি ব্যবহারে বস্তু যেমন ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, পড়ে থাকলে লোহায় যেমন জং ধরে ভাষাও আটপৌরে হয়। এর থেকে মুক্ত হতে লেখক ছটফট করতে থাকে। সকল লেখক যে একাজটি সমাপ্ত করতে পারেন তেমন নয়। পুরাতন আটপৌরে ভাষা ব্যবহার করেও অনেকে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু যিনি পৃথক হয়ে যান তিনি ভাষাকে ঘষে মেজে শাণদার করেন। শাণদার ভাষা দিয়ে মানুষের ভেতর সার্জারি করেন সেলাই করেন, বাহিরে সৌন্দর্যও প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ভাষা এখানে অপারেশন থিয়েটারের অস্ত্রের মত। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দৃশ্যমান বস্তু দেহের অসঙ্গতি না হয় দেখা যায় কিন্তু মানব মস্তিষ্কের চিন্তা প্রবাহের সঙ্গতি বা অসঙ্গতির একমাত্র বাহন বা একমাত্র অস্ত্র ভাষা, সেক্ষেত্রে কি ঘটে? দেখা যাক সেক্ষেত্রে কি ঘটে- ‘কমলা লেবুর কোয়ার মতো খোলে গেলো জানালা, রোদ এসে মেঝের উপর পড়লো সরলরেখায়, কেউ যেন শাদা রুমালের মতো রোদ ছুঁড়ে মারলো মন্টুর মুখের উপর।’ আব্দুল মান্নান সৈয়দ তাঁর ‘চমৎকার অবচেতন’ গল্পে এই যে ভাষার ব্যবহার করেছেন তা কি কারণে করতে গেলেন? মনে হয় আমরা আমাদের বিগত সাহিত্যের ভাষায় ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম, মনে মনে অগ্রসর লেখক তা বুঝতে পেরেছিলেন। পরাবাস্তববাদী সিল মেরে অথবা পশ্চিম থেকে আমদানী বলে এবংবিদ যুক্তি তর্ক থেকে দূরে থেকে বলা যায়- এ ভাষায় বাস্তবকে অতিক্রম করার প্রয়াস থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবকে আরো বেশি বাস্তব করে তোলে। অবশ্য মান্নান সৈয়দ এ পথে বেশি দূর এগোলেন না।  মান্নান সৈয়দ ‘সত্যের মতো বদমাস’এ  আটকে থাকেন - সেখান থেকে আর এগুতে পারেন না।

আমরা না এগিয়ে কিছুটা পিছনের দিকে তাকাতে পারি। খুব বেশি পেছনে না। বিদ্যাসাগর পর্যন্ত। বিদ্যাসাগরের পরবর্তী রীতিই আমাদের পথ দেখিয়েছে। কোম্পানির লোকেরা ধর্ম প্রচারের জন্য বাংলাভাষার একটা হিজড়া রূপ দাঁড় করিয়েছিলেন। ইংরেজের মুখে বাংলা যেন খোঁজা বাংলা। শাসকরা এমনি হয়। ভারতদেহে যে আর্যরা একসময় ব্রাম্মণ্যের কৌলিন্যের ছড়ি ঘুরিয়েছিল- তারা বাংলা ভাষাকে সরাসরি ঘৃণাই করত। পালি-প্রাকৃত-বাংলার ভাষাদেহে কত চোখ রাঙানী রক্তপাত আর হেয় করার ইতিহাস রয়েছে তা আমাদের জানা আছে। আর্যরা বলতো- কুকুরের মতো শব্দ উচ্চারণকারীদের জিভ কেটে দাও। ৫২ থেকে ৭১ পর্যন্ত এ জিবকে আবার কেটে দেবার চেষ্টা চলেছিল। কাটা যায় নি।

তবে আমাদের জিবকে অনেকবার ভোতা করার চেষ্টা চলেছে। সে চেষ্টা এখনও তলে তলে সক্রিয়। বিষয়টি খোলে বলাই শ্রেয়। রাজাদের পতনের পর প্রজা শাসনের নামে এখানে যতবার রঙ বদলানো শাসকের আগমন ঘটেছে ততবার আমাদের সিংহভাগ মানুষ ঠকেছে। আমাদের নিজেদের দোষও কম না। আমাদের অকালপ্রয়াত গল্পকার শহীদুল জহির কি বলে শুনুন, ‘এই দেশের মানুষের ব্যপারে একটা বিষয় আপনি খেয়াল করবেন তারা রুটি-রুজির জন্য আন্দোলন করে না; বড়ো বড়ো বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী বিষয় নিয়ে আন্দোলন করে, ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে, জাতিগত সম্মানের জন্য আন্দোলন করেছে; কিন্তু মজুরির ব্যপারে,ভাত কাপড়ের ব্যাপারে, কাজের ব্যাপারে আন্দোলন দানা বাঁধে নাই।’

আমাদেরকে মুক্তবাজার বোঝানো হলো। চাউলের মূল্য বৃদ্ধিতে অতিষ্ঠ মানুষ। বাড়িতে, রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে, অফিসে, আড্ডায় ক্ষোভ বাড়লো- কিন্তু কোন আন্দোলন দানা বাঁধলো না।

‘আজ কাল পরশু’র (১৯৪৩) গল্প গ্রন্থ সম্পর্কে মানিক বলেন, গল্প গুলি সমস্তই প্রায় গত বছরের মধ্যে লেখা। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়। ভেতরে ভেতরে সমাজ কাঠামো ভেঙ্গে চুরমার। মানিক বন্দোপাধ্যায় যে পরশুর গল্প বলেছেন সে পরশুর গল্প এখনও বহাল তবিয়তে আছে। অভাবের ভাষা, অনাচারের ভাষা, অন্নকষ্টের ভাষা, পাপের ভাষা সামাজিক কাঠামোতে একই রকম আছে।

মানকুশিয়ার রামপদরা আগের মতোই আছে। রামপদের স্ত্রী অভাবের সংসার ছেড়ে শহরে চলে গিয়েছিল। শহরে চলে যাবার অন্য কারণও ছিল- ‘এক রাতে দুটো মদ্দ এলে, কামড়ে দিয়ে বাদাড়ে পালিয়ে বাঁচলাম এতটুকুর জন্য। দিশে মিশে ঠিক রইল না আর, গেলাম সদরে চলে।’

রামপদের বউ ফিরে এসেছে। কিন্তু সমাজ! মানিক  বলেন সমাজ মানে- ঘনশ্যাম দাস, কানাই বিশ্বাস, নিধু নন্দী, লোচন কুমার, বিদু ঘোষ, মধু নন্দী। তারা রামপদকে জিজ্ঞেস করে- ‘বউ এসেছে রামপদ?’ ‘আজ্ঞে!’ ‘ঘরে নিয়েছিস?’ ‘আজ্ঞে।’ ‘বার করে দে এ দন্ডে। যারা এনেছে তাদের সঙ্গে ফিরে যাক।’ ‘ভাত খাচ্ছে।’ টেকো নন্দী শুধোয়-‘তোর মতলব কী?’ ‘আজ্ঞে।’ ‘বউকে রাখবি ঘরে?’ ‘বিয়ে করা ইস্তিরি আজ্ঞে। ফেলি কি করে?’ রামপদের ‘স্ত্রী’ উচ্চারণে ‘ইস্তিরি’ হয়ে যায়। আঞ্চলিক ভাষার শক্তি সম্পর্কে মানিক সচেতন ছিলেন। হাসান আজিজুল হক আরো বেশি মাত্রায় আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেন। প্রমিত ভাষার পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার না করলে গল্পের চরিত্র উৎকেন্দ্রিক হয়ে যাবার সম্ভাবনাকে ভালো ভাবেই বুঝান হাসান আজিজুল হক। তার ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পের রাশেদ চরিত্রটির উপস্থিতি এবং তার মুখনিঃসৃত সংলাপ অনেকটা নাটকের বিবেকের মতো। অসুস্থ জমিরুদ্দি এবং তার সাথে হাসপাতালে আসা লোকজন রাশেদের মতো উত্তেজিত হতে পারে না। জমিরুদ্দিরা নিম্নবর্গের মানুষ। তারা রক্তকে বলে ‘অক্ত’, গ্রামকে বলে গেরাম, সম্পর্ককে বলে ‘সম্পক্ক’, মধ্য শব্দটি তাদের উচ্চারণে ‘মদ্য’। তাদের মুখের ভাষাকে বদলে দিলে এর বাস্তবতা বদলে যায়। হাসান প্রমাণ করেন- ভাষিক এ সংশ্লেষণ ব্যতিত আমাদের গল্পভাষার মেরুদণ্ডটি শক্তিশালী করা সম্ভব নয়।

গল্প রাজদরবার থেকে নেমে এলো সাধারণ মানুষের কাতারে। গল্পে স্থান পেলো সাধারণ মানুষের কথা। এই সাধারণ মানুষের কথাকেও লেখকরা একই রকমভাবে পরিবেশনে ক্লান্তিবোধ করলেন। কেন ক্লান্তিবোধ করলেন? এভাবে বলা যায়- ‘ভাই কতো দেবো?’ এই জিজ্ঞাসা মাছ বাজারে একরকম, স্বর্ণ দোকানে আরেক রকম, পোস্টমর্টেমে, খুনি নিয়োগে, সন্তানের জন্য একজোড়া জুতা কেনায় অন্যরকম।

গল্পভাষার অন্তর্গত উষ্ণতা একক কোন ব্যারোমিটারে পরখ করার উপায় নেই। গল্পের ভাষা বদলিয়েছে নানা কারণে। সামাজিক, রাজনীতিক, অর্থনৈতিক কারণের বাইরে দুমড়ানো মুচড়ানো বাস্তবতা ও পরাবাস্তবতার বিশাল স্রোত রয়েছে। রয়েছে রাষ্ট্রের সাথে জনগণের বৈরী সম্পর্ক (মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী ছাড়া)। রয়েছে বিশ্বায়নের মাল্টি-ডায়মেনশনাল গুঁতো। রয়েছে এনজিও ওয়ালাদের উন্নয়নের তথ্য জিকির-তথ্য জজবা। রয়েছে মুঠোফোনের মোটের ছিদ্রপথে মুদ্রা প্রবাহের সুদূর প্রসারী আত্মঘাতী উন্মাদনা। গল্পের ভাষা এসব থেকে মুক্ত নয়।

শহরের নসিমন ড্রাইভাররা, রিক্সাড্রাইভাররা চিৎকার করে বলে-‘সরেন ভাই, নার্গিস আইতাছে’। নার্গিস উন্নতবিশ্বের উপহার। মাঝে মাঝে গ্রামে শহরে প্রায় শুনা যায়-‘কিস্তি আইতাছে ঘুমাইবেন্না’। এ বিষয়ে ক্ষুদ্রঋণ আমাদের ঘুম নষ্ট করে দিয়েছে। আবার এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টকে নবেলও দেয়া হয়। কোন কোন অর্থনীতিবিদ এ আনন্দে কেঁদে ঝার ঝার।

ইতোমধ্যে আমাদের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ তলে তলে প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। যা বাজারি মূল্যের উর্ধ্বগতিজনিত যুক্তির (?) আড়ালে প্রতিদিন চাপা পড়েছে অথবা কৌশলে চাপা দেয়া হচ্ছে। চাপা দেয়া হচ্ছে এভাবে - ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে কেউ কি না খেয়ে আছে? কেউতো মরছে না?’ প্রতিদিন পথের পাশের ধূলা আচ্ছাদিত রুটি-পরোটা খেয়ে বাঙালি দিব্যি বেঁচে আছে। কিন্তু তার যে আয়ু কমে যাচ্ছে এ হিসেব কে করবে? তাও চাপা পড়বে কিছু উর্ধ্বমুখী গড় আয়ুর যুক্ত ফলাফলের কারণে। যারা তাদের অর্থের কারণে যতটা না স্বাস্থ্য সচেতন তার চেয়ে বেশি মাত্রায় চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণকারী। যাদের আয়ু কমে যাচ্ছে তাদের পকেটের স্বাস্থ্য তথৈবচ।
লক্ষ করুন কিভাবে আয়ু কমে যায়- ‘জরমের পর কটো বছর কাটতে না কাটতে মা মঁয়ে গেল, দাদীর কাছে ছেলাম, দাদী মঁয়ে গেল- তা বাদে বাপ মঁয়ে গেল, সবচেয়ে ছোট ভাইটো মঁয়ে গেল, মায়ের পেটের ছোটভাই মঁয়ে গেল, নাড়ি ছেড়া ধন। সে-ও মঁয়ে। তাইলে কি থাকলো আমার?

‘একটি র্নিজলা গল্প’ এগল্পে হাসান আজিজুল হক যে গল্পভাষা ব্যবহার করেছেন এর মধ্যে কি শুধুই আঞ্চলিকতা রয়েছে? চন্দ্রবিন্দুযুক্ত নাসিকা বাক্যের পরতে পরতে যে দুঃখ ক্লিষ্টতার ছাপ রয়েছে তা এ গল্পভাষা ছাড়া পরিস্ফুটন সম্ভব নয়। তবে এ ভাষা অনুবাদে প্রাণহীন হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এ ক্লিষ্টতা প্রকাশের পথ বা অন্য কোন উপায়ও নেই। ছোট গল্পের ভাষা সময়ের ভাষা, কোন সময়ের ভাষা? প্রেমেন্দ্র মিত্রের তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পটি কালবিচারে ভাবীকালের গল্প। যা এখনও ঘটে নি তবে ঘটবে এমন কালের গল্প। তা একান্ত ভাবেই ব্যাকরণের বেঁধে দেয়া নিয়ম। কিন্তু গল্পটি কি আদৌ ভাবীকালের গল্প? গল্পটির প্রতিটি ঘটনাই বহু আগেই ঘটে গেছে। ঘটে যাওয়া সেইসব ঘটনাকে ভাবীকালের স্রোতে ফেলেছেন লেখক। ফলে তা দাঁড়িয়েছে অতীত ঘটিত ভবিষতের ছকে। লেখকের এ প্রচেষ্টা এবং গল্পভাষা আঙ্গিকের সাথে আবিষ্কৃত গ্রথিত। এ ভাষায় কমপক্ষে আরো তিনটি গল্প লেখা হয়। সর্বশেষ শৈবাল মিত্রের ‘নো’ গল্পটি তেলেনাপোতা গল্পের মতো হওয়া সত্ত্বেও কোন কোন বিষয়ে তাকে ছাঁড়িয়ে।

কালের ব্যবহারেও এভাবে গল্পভাষাকে বদলে দেবার প্রচেষ্টা চলে আসছে। গল্পের ভাষা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে গল্পভাষার ক্রমবিবর্তন বা পরিবর্তনকে আমরা স্পষ্ট করতে চেষ্টা করি। কিন্তু একজন লেখক থেকে আরেকজন লেখকের যে কালিক দূরত্ব সেক্ষেত্রে ব্যকরণের নিয়ম বদলে দিয়ে নতুন কোন ভাষা তৈরি করার সম্পূর্ণ সুযোগ নেই। আংশিক সুযোগ হয়তো সবসময় থাকে।

কমল কুমারের ভাষা প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন- ‘কমল কুমারের মুখের ভাষার সঙ্গে তার মুখের ভাষার দুস্তর ব্যবধান আমাদের বিশেষভাবে বিস্মিত করেছিল। ... কমল কুমার চলতি ভাষায় বেশ কয়েকটি গল্প লেখার পর সাধু বাঙলা গ্রহণ করতে দ্বিধা করেন নি, সাধু ক্রিয়াপদ এবং অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করেছেন বহুল পরিমানে। ... তাঁর ভাষা ঠিক দুর্বোধ্যও নয়। অতি সরলও নয়; তাঁর যেকোন রচনাই দ্বিতীয় পাঠ দাবি করে।’

কমল কুমারের কয়েকটি গল্প মগজের মধ্যে কঠিনভাবে ছাঁপ মেরে যায়; মধু, মল্লিকা বাহার, খেলার দৃশ্যাবলী, প্রেম ইত্যাদি।

কমল কুমার তার গল্পের শুরুতে, অধিকাংশ গল্পের ক্ষেত্রে, ‘মধবায় নমঃ, তাঁর ব্রম্মাময়ী মাগো; জয় রাম কৃষ্ণ’- দিয়ে শুরু করেছেন। খেলার আরম্ভ, দ্বাদশ মৃত্তিকা, বাগান কেয়ারি, আর চোখে জল, বাগান পরিধি, বাগান দৈববাণী, অনিত্যের দায়ভাগ, খেলার দৃশ্যাবলী ইত্যাদি গল্পের শুরুতে বাক্যটির উপস্থিতি শুরুতে মনে হয় কোন ধর্মগ্রন্থ। মজার কথা হলো কমল কুমার এক লাইনের এ বাক্যটি দিয়ে নিজেকে পৃথকও করেছেন।

যতিচিহ্ন ব্যবহারে কমল কুমারের গতি সম্পর্কে বলতে হয়। কমল যেন থামতে চান না। পূর্ণ যতি ব্যবহারে যেন তার অনিহা রয়েছে। কঙ্কাল এলিজি গল্পের দ্বিতীয় প্যারাতে কমল মাত্র একটি পূর্ণযতি ব্যবহার করেছেন। আট লাইনের প্যারাটিতে অর্ধযতি (কমা, সেমিকোলন) ব্যবহার করেছেন ৭টি। ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরাম সম্বলিত একটি পূর্ণবিরাম তৈরির ক্ষেত্রে কমল বাক্যটিতে অনেক কিছু ঠেসে দেন। তাঁর গল্প দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার পড়ার দাবিটা এখান থেকেই উত্থিত।

যতিচিহ্নের প্রসঙ্গ  ধরে শহীদুল জহিরের প্রসঙ্গও চলে আসে। অকালপ্রয়াত এ গল্পকার ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পে একটিও পূর্ণযতি ব্যবহার করেন নি। কমা দিয়ে দিয়ে বাক্যকে বাক্যের সাথে জুড়ে দিয়েছেন।

এ ধরণের নিরীক্ষা আগেও অনেকে করেছেন। আরশিনগরের রূপকথার লেখক সুব্রত কুমার রায় তার ‘আট কুঠুরি নয় দরজা’ গল্পটিতে কোন প্রকার যতি চিহ্নই ব্যবহার করেন নি। মাঝে মাঝে ড্যাস এবং ডট চিহ্ন ব্যবহার করেছেন। সুব্রত কুমার রায়ের গল্পটি চেতনা প্রবাহের দৃশ্যাবলীতে ঠাসা। এ জাতীয় গল্পে ভাষা প্রবহমান এবং অবশ্যই খরস্রোতা প্রচুর বাঁক বহুল। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হকের ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’র কথা আসে। ‘ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে’- বইয়ের প্রথম গল্প। প্রথম লাইনটি দেখুন- ‘বৃষ্টি এবং অন্ধকার, একটি প্রবল, অন্যটি নিশ্ছিদ্র’- দুটি কমার পর একটি পূর্ণযতি।

সপ্তম এবং অষ্টম লাইনে লেখক বলেন- ‘একটি জনপদের উপর পবিত্রতা যখন পাখা বিস্তার করে উড়ে যায় তখন শহীদের রক্ত আকাশ ধারণ করে। এ বাক্য পাঠককে চমকে দেয়। রাজনীতিক হত্যাকান্ডে আমাদের অন্তর শিহরিত হয়ে উঠে। সৈয়দ শামসুল হকও ক্ষুদ্র যতিচিহ্ন ব্যবহারে অভ্যস্ত। তাঁর গল্পের টান যা পাঠকের জন্য অপেক্ষা; তাহলো কি যেন ঘটবে, একটু পরেই ঘটবে।

‘নিয়ামতকে নিয়ে’ দ্বিতীয় গল্পে- ‘তুমি যদি এতই জানতে, জানতে না বঙ্গবন্ধু খুন হবেন? তবে তুমি সেই কথাটি কেন আগে বলো নাই? কেন তুমি দেশবাসীকে বলো নাই? তবে আমরা জানতাম, আমরা সাবধান হতাম। তুমি তবে জানতে না নিয়ামত ভাই।’

সৈয়দ হকের গল্পের ভাষা জিজ্ঞাসার ভাষা, অপেক্ষার ভাষা, রাজনীতির ভাষা, ইতিহাসের ভাষা- না তাতেও কিছু বোঝা গেল না। তা এই হতে পারে; সৈয়দ হকের গল্প পড়লে পাঠক জিজ্ঞাসায় পতিত হন, অপেক্ষায় পতিত হন, রাজনীতির পাঠ পান, ইতিহাসে প্রবেশ করেন। তাতে ভাষার দিকটা কি হলো? মনে হয় সৈয়দ হকের ভাষা এসব সহজে ধারণ করতে পারে। তাহলে একটা বিষয় আবিষ্কৃত হলো লেখকের তৈরি ভাষারও একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। হয়তো আছে। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় - আক্তারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের ভাষা দিয়ে কি কথিত নিটোল প্রেমের গল্প লেখা যাবে। বলা যাবে- নিশ্চয় না। যেমন- হাসান তার গল্পে পারেন না স্যাটায়ার করতে।

শহীদুল জহিরের গল্প অনেক গল্পের মধ্যে পৃথক। কি কারণে শহীদুল পৃথক। শহীদুল বাক্য গঠন করেন এক ধরণের অনিশ্চয়তা দিয়ে। ‘যেন’ শব্দটি আগে ব্যবহার হতো; কিন্তু শহীদুল ‘হয়তো’ শব্দটি ব্যবহার করে শুধু অনিশ্চয়তাই তৈরি করেন না এক ধরনের প্যারাডক্স তৈরি করেন। সত্য মিথ্যার আপাত সংঘাত বা কুটচাল যাই বুঝানো হোক শহীদুল তা ব্যবহার করেন পরম দক্ষতার সাথে। শহীদুল পুরাতন ঢাকার ভাষাকে হুবহু ব্যবহার করেন না। কিছুটা নিজের মতো করে নেন। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা ব্যবহারেও তিনি সিদ্ধতা দেখিয়েছেন। রাজনীতি সচেতন এলেখকের গল্প ভাষাটি প্রতিটি গল্পেই প্রায় এক রকম।

শহীদুলের গল্প বাস্তব ও পরাবাস্তবের মিশ্রণে তৈরি। মার্কেজের জাদুবাস্তবতাও তাকে টেনেছে। ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ বা ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পের বাস্তবতার ভিতর অধিবাস্তবতা বসে আছে। শহীদুল জহির একটার ভেতর আরেকটা ঢুকিয়ে দেন। কার ভেতর কে বলা দূরহ। বরং লতানো যমজ উদ্ভিদের মত পরস্পর বিনুনী সম্বলিত এবং প্রলম্বিত বলা যায়। ভাষার মতো একটি শক্তিশালী অস্তিত্বকে গল্পশৈলীর প্রয়োজনে উদ্ভিদের সাথে তুলনা করতে হলো। তাতেও সম্পূর্ণটা প্রকাশ পেল না। তা যেন একটি আড়ালকে আরেকটি আড়াল দিয়ে ঢেকে দেয়ার মত। অথচ আমরা এই ঢেকে দেয়াকে বলি প্রকাশ। একটি আড়ালকে আরেকটি আড়াল দিয়ে সত্যিই কি প্রকাশ করা যায়?  সম্ভবতো যায়। তা নাহলে দৃশ্যমান বস্তুজগতের এতটা চিহ্নায়নের প্রয়োজন ছিল না। হাইজিন একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মত ও স্বাস্থ্য দেবীর নাম। এজন্য প্রতিকায়ন ছাড়া ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। ‘সোনার তরী’ ও ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’এর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

বাস্তব অতি ব্যাবহারে ফিকে হয়ে এলে একে একটু বেঁকেচুড়ে প্রকাশ করতে হয়। যদি বলি বদলে দিতে হয়, বদলে দেনও অনেকে, তখন গল্পের আন্ত ভূগোল নিয়ে মাপজোক শুরু হওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা আমাদের ভূগোল থেকেই দেখাতে পারি একেকটা গল্প সময়ভাষা নিয়ে কিভাবে দন্ডায়মান। বাস্তব যখন পিছলে যায় তখন সম্ভবত এভাবে বলতে হয়- ‘আমি বলি মূর্খ, জীর্ণ ইটের স্তূপ তোমার অট্টালিকা, তোমার বাগিচা, পঁচা ডোবা তোমার পুকুর, মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ দম্পতি তোমার প্রতিবেশ। আর এই উলঙ্গ শিশুর মাতাপিতা তোমার আত্মীয়। আমি তোমাকে কিছুতেই সালংকরা কন্যা দেবো না।’ এ হলো জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘বিচার চাই হে সম্রাট’ গল্পের বাস্তবতা, গল্পের ভাষা। একটু আঁড়াল না করলে একটু বাঁকিয়ে না দিলে এর অর্থময়তা গভীর ব্যাখ্যার দাবিকে ছুঁতে পারত না। তবে ভাষা যদি সম্পূর্ণ অচিন হয়, অধিক মাত্রায় বিমূর্ত হয় যা ফর্মের কোমর ধরে এগোয়, তাহলে পাঠক গল্প বিমুখ হতে বাধ্য। ভাব ও বস্তুর সমন্বয়হীনতার কারণে শুধুমাত্র ফর্ম নির্ভর কথাবস্তু ক্ষণিক ঝিলিক সৃষ্টি করলেও দীর্ঘ স্মৃতিতে আয়ুষ্মান হয় না।

গল্পকারকে সচেতন হতে হয়। মা মেয়ের সংসার গল্পে হাসান আজিজুল হক চার শিয়ালকে কিছুক্ষণের মধ্যে মুক্ত করে দেন। শিয়াল চারটিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখলে গল্প অন্য কোন প্রান্তে পৌঁছে যেত। কিন্তু এ গল্পে অল্প সময়ে পাঠক বুঝতে পারে এগুলোও মানুষ। আবার একেই গল্পের শেষপ্রান্তে প্রতিকায়ন বা চিহ্নায়নের কারণে ভাষা- অধিক মাত্রায় বিমূর্ত-  ‘মেয়ে মা’কে ডেকে দেখাতে চায় এই ছবি, তখনই আসে প্রথম মৃতদেহটি। অনেক দূর দিয়ে চলে যায়, তারপর আর একটি, ... হাজারে হাজারে তারা আসে...। তারপর বাঁক থেকে আলাদা হয়ে যায় এক লাশ, একটু আসছি বলে, ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে পাঁক খেতে খেতে সে এগিয়ে আসছে মা মেয়ের কুঁড়ের চালের দিকে।’

মানুষের মুখের ভাষা এবং লেখকের নিজস্ব ভাষাশৈলী মিশেই গল্পভাষা তৈরি হয়।

শৈলীর সাথে বিভিন্ন ইজম, ফর্ম যুক্ত হয়। কিন্তু গল্পের সামগ্রিক অবস্থা থেকে কোনটাকে পৃথক ভাবে বিবেচনায় আনা যায় না। তবু আলোচনার অবকাশ থেকে যায়। ইজমের পূর্ব নির্ধারিত স্বতঃসিদ্ধ সমূহ হুবহু মানা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব না। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পক্ষে ‘ছোট প্রাণ ছোট কথার...হইয়াও হইলনা শেষ’- শর্তটি সর্বদা মানা সম্ভব হয় নি।

গল্পে বহু পরীক্ষা নীরিক্ষা হয়েছে। তাতে অনেকে সফলও হয়েছে ব্যার্থও হয়েছে। কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে কি এমন শর্ত প্রয়োগের কোন সুযোগ আছে? আসলে তা থাকেইবা কি করে? জনগোষ্ঠী বলতে যে ভূ-খন্ড যে আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, শাসন, শোষণ তোষণ পোষণ, দ্রোহ ক্রোধ প্রতিবাদ অর্থনীতি সমাজনীতি সংস্কৃতি জড়িয়ে থাকে তা লেখকের ভাষার অংশ হয়ে যায়। ভাষা গড়ে উঠার ইতিহাস, এর অন্তঃস্থ প্রণোদনা, বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন উৎস উৎসার নির্বাচন নির্ধারণ এবং ব্যবহার প্রকৃতপক্ষেই একটি জটিল প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে সহজে সম্মুখ ভাগে চলে আসে অঞ্চল বা অঞ্চলিক ভাষা। যদিও ভাষার আন্তর্জাতিক মনোপলি পূর্বেও ছিল এখনও আছে। এক্ষেত্রে ভাষা অস্ত্রের মতো ধারালো। আর এর ভেতরে রয়েছে রক্তক্ষরণের ইতিহাস। বাংলা ভাষা এর ব্যাতিক্রম নয়। পার্থক্য এ ভাষার জনগোষ্ঠী অন্য ভাষার উপর চড়াও হয় নি। বরংচ অন্য ভাষার লোকেরা শাসনের নামে দুঃশাসনের ইতিবৃত্তি ঘটিয়ে গেছে। আমাদের গল্পভাষা এবং বিষয় সেই সব ভাষা থেকেও অনেক কিছু গ্রহণ করেছে।

বলা হচ্ছিল আঞ্চলিক ভাষার কথাঃ আঞ্চলিক ভাষার শক্তি প্রমিত ভাষার চেয়েও অধিক। তবে শুধু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে গল্প বা উপন্যাস লেখার সমস্যা রয়েছে। তাই আমাদেরকে সাধু বা চলিত রীতির মাঝে আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু শুধু আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগে নাটক গল্প উপন্যাসও ব্যতিক্রমভাবে হচ্ছে। বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে খুব বেশি বড় না হওয়া সত্ত্বেও প্রমিত একটা বাংলার সাথে আমরা পরিচিত। আমাদের গল্প লেখকরা এ সুবিধাটুকু নিয়েছেন। গল্পের ভাষা প্রকৃতপক্ষে গল্পকারের ভাষা শৈলী। একেই অঞ্চলের মানুষের ভাষা প্রবণতা, শব্দ ব্যবহারের ঝোঁক বাক্য প্রয়োগে উচ্চারণগত মিল দু’জন লেখকের ভালোভাবে জানা থাকা সত্ত্বেও দু’জন গল্পকার দু’ভাবে উপস্থাপন করেন। পুরান ঢাকাকে নিয়ে আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস এবং শহীদুল জহির দু-রকম গল্প লিখেন। দু’জনের গল্পশৈলী দু’রকম। শৈলীগত কারণে দু’জনের গল্পভাষাও দু’রকম।

শব্দ বাক্য দিয়ে গল্পের ভাষা বা গল্পভাষার কূল খোঁজে পাওয়া যাবে না।

আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস নিম্নবর্গের মানুষের মুখের কথাকে বিশেষত উদোম কথাকে উদোমভাবে প্রকাশ করেছেন। তাদের কথায় তিনি পোষাক পরান নি। পোষাক বা শিল্পিত আড়ালের গুরু রবীন্দ্রনাথ মধ্যবিত্তের যে রুচিবোধ তৈরি করে দিয়েছেন ইলিয়াছ মাত্র ২৮টি গল্প দিয়ে সেই রুচিবোধের নেকাব ধরে টান মেরেছেন। ফলে রবীন্দ্রভাষায় অভ্যস্ত পাঠকের একটা বিশাল অংশ ইলিয়াসে ঢুকতে পারেন না।

গল্পের ভাষারূপ একটি প্রবণতার বিষয়, আবার বানানো বিষয়ও বটে। প্রবণতা বললে না হয় মান্য করা যায় কিন্তু বানানো বিষয় বললে নিজের বিশ্বাসের প্রতি অবিচার করা হয়। মানুষ প্রকৃতপক্ষে  কোন কিছু কি জন্ম দেয়? চালক বা মানুষেরা বলবে মানুষ অ্যাসেম্বলার মাত্র, সংযোজনকারী। শুক্রানু ডিম্বানু মিলে যে মানবভ্রুন হয়, সেই শুক্রানু বা ডিম্বানু মানুষ তৈরি করতে পারে না। তবে তা স্বতঃস্ফূর্ত উৎপাদিত হয়।

যদি বলা হয় প্রবণতা মানে অন্তঃস্থ কোন বিষয় আর বানানো মানে শ্রমযুক্ত মেধাহীন ঋণের সমষ্টি; তাহলে প্রবণতার পক্ষেই ওকালতি চলে যায়।

আর প্রবণতা অবশ্যই লেখকের নিজের ভাষাশৈলীর সাথে গভীরভাবে জড়িত একটি বিষয়।

____________________________________________________________

বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রথম পার্থ’
মানবিক সৌকর্যে চিরকালীন দৃশ্যকাব্য

রুবাইয়াৎ আহমেদ

মহাভারতের কর্ণ একটি ট্র্যাজিক চরিত্র। মহাবীর, দাতা, মহানুভব ইত্যাদি নানা অভিধায় চিত্রিত তাঁর চরিত্রের কাঠামো। পঞ্চপাণ্ডব মাতা কুন্তী কর্ণেরও মাতা। অথচ এই তথ্য সর্বসাধারণ্যে প্রকাশযোগ্য ছিল না। কেননা কর্ণের কোনও মানবীয় পিতা ছিলেন না। সূর্যরশ্মির শক্তিতে কুন্তীর গর্ভে আসেন কর্ণ। লোকলজ্জার ভয়ে কুন্তী তাঁকে ত্যাগ করেন নিভৃতে। সেই থেকে কর্ণ লালিত-পালিত হন অধিরথ ও রাধার আশ্রয়ে।

মহাভারতে বর্ণিত ঘটনানুসারে নানাবিধ কারণে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। একদিকে কৌরবরা রাজ্যের সূচাগ্র দেবে না পাণ্ডবদের অন্যদিকে পাণ্ডবরাও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এই দুই অংশের সমঝোতায় পৌঁছতে না পারার সুযোগে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই যুদ্ধ এতো দীর্য়ায়িত হয়তো হতো না কিংবা হয়তো যুদ্ধের প্রয়োজনই ফুরিয়ে যেত, একপক্ষ সন্ধিতেও রাজি হয়ে যেত যদি না একজন ব্যক্তি এই যুদ্ধে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতেন। তিনিই কর্ণ। মহাবীর, মহাবঞ্চিত কর্ণ।

কুরুক্ষেত্রের সেই মহাযুদ্ধের ঠিক আগের দিন দুপুর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত সময়বৃত্তে বাঁধা বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাট্য ‘প্রথম পার্থ’। অনিবার্য যুদ্ধকে ঠেকাতে কর্ণের কাছে মাতা কুন্তী, দ্রৌপদী ও কৃষ্ণের আগমণকে কেন্দ্র করে এই নাট্যের উপরিকাঠামো নির্মিত। স্থান-কাল-পাত্রের বিন্যাসও সংহত। গদ্যছন্দে রচিত এই কাব্যনাট্যে আমরা দুই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে পাই। তাঁদের অধিষ্ঠান কখনো যাত্রার বিবেকের মতো আবার কখনো ব্রেখটের এলিয়েনেশন তত্ত্বের আলোকে সচল কোনো চরিত্রের মতো। তাঁদের কথোপকথন দর্শক বা পাঠককে চরিত্রের সংলাপের ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকতে দেয় না। নতুন কোনও সম্ভাবনা অথবা ভাবনার দিকে ঠেলে দেয়।

এই কাব্যনাট্যের শুরুতে আমরা দেখতে পাই দুই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কথাচ্ছলে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন নাট্যের গতি-প্রকৃতি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কেন সংঘটিত হচ্ছে আর কী তার পরিণাম এসবই আভাসে-ইঙ্গিতে ব্যক্ত হচ্ছে তাঁদের কথোপকথনে। তাঁরাই জানিয়ে দিচ্ছেন এ নাট্য কর্ণকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে। ফলে পাঠক কিংবা দর্শক সূচনালগ্নেই এক ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কর্ণের জন্ম নিয়ে নানা সংশয় তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। কিন্তু এরই ফাঁকে প্রথম বৃদ্ধের মুখ দিয়ে রচয়িতা কয়েকটি শব্দে বলিয়ে নেন ভীষণ আধুনিক এক দর্শনের সারার্থ।

‘যাকে বলে প্রতিভা, তা সহজাত।’

অনতিকাল পর আসেন পঞ্চপাণ্ডব মাতা কুন্তী। আসেন কর্ণের সঙ্গে কথা বলতে। সব সন্তানের প্রতিই জন্মদাত্রীর ভালোবাসা থাকে। কিন্তু কারো কারো প্রতি প্রচ্ছন্ন পক্ষপাত এড়িয়ে যেতে পারেন না কোনো মা-ই। মহাভারতে আমরা দেখি, অর্জুনের প্রতি মাতা কুন্তীর প্রচ্ছন্ন পক্ষপাত বরাবরই ছিল। এই নাট্যেও তার আড়াল থাকেনি। কখনোই স্বীকৃতি না দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঠিক আগের দিন কুন্তী এসে দাঁড়ালেন কর্ণের সামনে, মাতৃত্বের অধিকার নিয়ে। বললেন,

এই আমি:
যার গর্ভ ছিলো তোমার প্রথম মর্ত্যলোক,
যার ভুক্ত অন্ন প্রথম পথ্য ছিলো তোমার,
যার প্রাণবায়ুতে তুমি প্রথম নিশ্বাস নিয়েছিলে-
শোনো আজ তার মুখ থেকে, বিদ্ধ ক’রে নাও হৃদয়ে:
তুমি কুন্তীপুত্র, তুমি সূর্যের সন্তান।

দ্বিধান্বিত সংশয়াচ্ছন্ন কর্ণ বিস্তারিত দর্শনে বুঝতে চাইলেন এই দাবির মর্মার্থ। ভাববাদিতা আর বৈজ্ঞানিক সত্যের আলোকে কর্ণ উত্তর দেন,

‘কে নয় সূর্যের সন্তান এই জগতে? যা-কিছু আছে সপ্রাণ,
তৃণ, বৃক্ষ, জন্তু, মানুষ-যারা পরস্পরকে আহার ক’রে
বংশপরম্পর বেঁচে থাকে, জন্ম-জন্মান্তরে ঘূর্ণিত হয়-
সূর্য তাদের সকলেরই পিতা, সকলেরই প্রতিপালক।
পশুর মলজাত যে-কীট, সেও তো সূর্যের সন্তান।’

কিন্তু পরক্ষণেই যখন বুঝতে পারেন, এটা কোনো ভাবার্থমূলক বয়ান নয়, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরই জন্মদাত্রী। তখন কর্ণের আধুনিকতার সীমানা পেরিয়ে যাওয়া উক্তি,

‘আমার মনে হয় মাতা একাই সন্তানের জন্ম দেন,
 আমার মনে হয় আমরা সকলেই কুমারীর সন্তান-
 পিতা শুধু উপলক্ষ- গোত্রচিহ্ন।’

মহাভারতে কুন্তী যে কারণে কর্ণের কাছে আসেন তা হচ্ছে, পঞ্চপাণ্ডবের প্রাণ রক্ষা। বসুর নাট্যে পাণ্ডবদের প্রাণ রক্ষার উদ্দেশ্যে না এসে কুন্তী এসেছেন চিরকালীন মাতৃত্বের অবয়ব নিয়ে। তবে পাণ্ডবদের স্বার্থরক্ষার আকাঙ্ক্ষা একেবারেই উহ্য থেকেছে এমন নয়। প্রচ্ছন্ন পক্ষপাত লক্ষ্য করা গেছে। যদিও কর্ণকে তাঁর আত্মপরিচয়ের সংকট কাটিয়ে রাজ্যের অংশীদারিত্ব ও পাণ্ডবর্গের অন্তর্ভুক্তির মর্যাদা সেই সাথে দ্রৌপদীর স্বামিত্ব লাভের প্রলোভন এ সবই প্রস্তাবিত হয়েছিল কুন্তীর পক্ষ থেকে, কিন্তু সেই প্রস্তাব কর্ণের মঙ্গলনিমিত্ত নয়, উদ্দেশ্য পাণ্ডবদের রক্ষা। ফলে এতোকাল পর আত্মপরিচয়ের সংকট থেকে উত্তরণের সুযোগ হাতের কাছে এলেও তাকে সম্মান জানাতে পারেননি কর্ণ। তাই তাঁর ছোঁড়া সংলাপে বঞ্চনার ক্ষত স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। কর্ণ বলেন,

‘তাহ'লে...এই আপনার অভীষ্ট? পাণ্ডবের শ্রীবৃদ্ধি?
অর্জুনের আয়ু?
সেইজন্যই এই পরিত্যক্ত পুত্রকে আজ
মাতৃস্নেহে অভিষিক্ত করলেন?’

মাতা কুন্তী তবু দমে যাননি। সন্তানের প্রতি মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এমন কী কাহিনির অংশ হয়ে ওঠা দুই ব্রাহ্মণ বৃদ্ধের একজন যখন দেবতাদের অভিপ্রায় কুন্তীর আকাঙ্ক্ষার অনুরূপ এই বলে মতামত ব্যক্ত করেন, যখন তারা বলেন, যেহেতু পঞ্চপাণ্ডব কুন্তীর সন্তান আর কর্ণ নিজেও তাই। ফলে পঞ্চপাণ্ডব আর কর্ণ পরস্পরের ভাই। এই যুক্তি শোনার পর কর্ণ আরও প্রাগ্রসর চিন্তার স্ফূরণ ঘটান তাঁর বক্তব্যে, যা সর্বজনীন হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সহসাই।

‘আমি শাস্ত্র মানি না : আমার ধর্মের নাম মনুষ্যত্ব।
 যদি পাণ্ডবেরা আমার ভ্রাতা হন, তবে কৌরবেরাও তা-ই।
 যদি মনু হন আদিপিতা, আমার ভাই তবে সর্বমানব।’

মহাবীর কর্ণের চরিত্রের সবচেয়ে বলিষ্ঠ দিক, আত্মসংকল্পে অটল অবিচল। শত প্রলোভনেও যা হতে বিচ্যুত হন না এমনই কঠোর। ফলে তাঁর চরিত্রের আভিজাত্য স্বতন্ত্র হয়ে প্রকাশিত হয়। কারো সঙ্গে মেলে না প্রায়। নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে চান যা কিছু, দান কিংবা পরম্পরাগত হয়ে কোনো কিছুর অধিকার দাবি করেন না, তা সে হোক শাস্ত্র সিদ্ধ অথবা ধর্ম সমর্থিত। কর্ণ স্বয়ংবরসভায় লক্ষ্যভেদের মাধ্যমে অর্জন করতে চেয়েছিলেন দ্রৌপদীকে। কিন্তু সূতপুত্র অপবাদে তাকে বঞ্চিত করা হয়। যখন মাতা কুন্তী সেই পরমারাধ্য দ্রৌপদীকেও ভ্রাতাসূত্রে কর্ণেরও পত্নী বলে ঘোষণা দেন, যখন বলেন এটা ধর্মসিদ্ধ তখন কর্ণের চরিত্রের বলিষ্ঠতার অনন্য দিক উন্মোচিত হয়। তিনি বলেন,

‘ধর্মত’! ‘ধর্মত’! আর শুনতে চাই না ‘ধর্মত’।
আমি চেয়েছিলাম জয় করতে দ্রৌপদীকে- নিজের জন্য-
একান্তভাবে-
কিন্তু পারিনি- আমার শক্তির অভাবে নয়, আপনার ধর্ম
সুপ্ত ছিলো ব’লে।
আর আজ আমাকে ষষ্ঠাংশে তার পতি হ’তে বলছেন?
-না!
আমার কাম্য নয় কোনো নারী- কোনো রাজত্ব-
যা বিনা চেষ্টায় জন্মসূত্রে প্রাপণীয়,
আমার গ্রাহ্য নয় অনর্জিত কোনো উত্তরাধিকার।

এ নাট্যে প্রক্ষিপ্ত সংলাপে শুধুমাত্র ব্যক্তির বিভিন্ন দিকই উন্মোচিত হয় নি, চিরকালীন কথকতার সমাবেশও ঘটেছে নানা অংশে। তবে তা আরোপিত পন্থায় নয়, স্বতঃস্ফূর্ত বিন্যাসে। কুন্তীর কথায় এ ধরনেরই একটি দর্শনের আভাস জেগে ওঠে। তিনি বলেন,

‘যুদ্ধ ভালো নয়, যুদ্ধ ভালো : দুটোই সমান সত্য,
স্থান, কাল, পাত্র অনুসারে।
অহিংসা উত্তম ধর্ম, যদি সকলেই তা মেনে চলে- নচেৎ নয়।’

এই অংশের কিছুদূর পর আবার কর্ণের কাছ থেকে শুনি আরও এক সর্বজনীন কথা। রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকে রঘুপতি এ জগতকে মহাহত্যাশালা হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর কর্ণ এ পৃথিবীর সব কর্মের প্রচেষ্টাকে যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। দুটোই প্রকৃতির বিধান। অলংঘণীয়। কর্ণ বলেন,

‘যাকে বলে উদ্যম, চেষ্টা, পৌরুষ - যুদ্ধ তারই নামান্তর,
 যুদ্ধহীন কোনো কর্ম নেই জগতে।’

বুদ্ধদেব বসুর এ কাব্যনাট্যের একটি প্রধান দিক হচ্ছে, উপস্থাপিত ছয়টি চরিত্রই শেষ পর্যন্ত ইতিবাচকতায় ধাবিত আধুনিক। অদৃষ্টবাদী পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যদিয়েই তিনি বলিয়ে নিচ্ছেন অদৃষ্টবাদবিরোধী মুক্তমানবের বয়ান। কর্ণকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে এলে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সংশয় প্রকাশ করলে দ্রৌপদী ঘোষণা দেন,

‘কিন্তু আমি অদৃষ্টবাদী নই। আমি আস্থা রাখি চেষ্টায়।’

মানুষ যখন মানুষ তখন সে ভালো-মন্দ নিয়েই। মানুষ হিসাবে মানুষের সীমাবদ্ধতা অনেক। ফলে নানা দোষ-ত্রুটি তাকে ঘিরে থাকবেই। তবে কী আমরা আদর্শ মানুষ খুঁজে পাবো না। আমাদের এই জগতে কাউকে দাঁড় করিয়ে বলতে পারবো না, এই হচ্ছে আদর্শ মানুষ। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে বিশুদ্ধ ভালো কিংবা আদর্শ মানবের কোনও অস্তিত্ব নেই জগতে। তুলনামূলক ইতিবাচকতার অধিকারীকেই আমাদের স্বাগত জানাতে হয়। যেমন, প্রথম বৃদ্ধ বলেন,

‘আমরা তাঁকেই শ্রদ্ধেয় বলি, যাঁর স্খলন স্বল্প, সদ্‌গুণ প্রচুর।’

নির্বাচন এলেই আমরা দেখতে পাই দলীয় মনোনয়নের বিপরীতে একদল বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেছেন। ভোটাভুটির কালে রাজনৈতিক দল এমনিতেই একটু কোণঠাসা থাকে। তার ভাবমূর্তি, নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল, কাকে ছেড়ে কাকে দেবে মনোনয়ন, প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা ইত্যাদি নানা বিষয় তাকে বিবেচনা করতে হয়। অর্থাৎ দল তখন এক অর্থে বেকায়দায় থাকে। ঠিক তার সুযোগ নিয়ে, নিজদলীয় প্রার্থীকে হারাতে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যান নির্বাচনে। এ অনেকটা নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গের মতো বিষয়। আমাদের সামনে রয়েছে আরেক পুরাণ রাবণের ভাই বিভীষণের বিদ্রোহ, রবীন্দ্রনাথের বিসর্জনেও পাই রাজা গোবিন্দমাণিক্যের ভাই বিদ্রোহ করেছেন আর রাজা ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ এড়ানোর লক্ষ্যে রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বিদ্রোহ চিরকালীন। কিন্তু এইসব বিদ্রোহের বিপরীতে কর্ণ উদাহরণ হয়েই থেকে গেছেন। কোনও প্রলোভন, পরাজয়ের আগামবার্তা জেনে যাওয়ার পরও তাঁর সিদ্ধান্তে তিনি অটল। দ্বিতীয় বৃদ্ধের কথায় এ ধরনের একটি চিত্রই উঠে আসে।

‘যারা সংকটকালে বিদ্রোহ করে, তারা কি ভালো?
হয়তো রাবণভ্রাতা বিভীষণের উত্তরে
ইতিহাসে কর্ণ থাকবেন দৃষ্টান্ত।’

পাছে লোকে কিছু বলে, এই সংকোচে আমরা অনেক সময় অনেক ইতিবাচক কর্মকাণ্ড থেকেও পিছিয়ে আসি। ক্ষুদ্রার্থে কিংবা বৃহদার্থে যাই হোক না কেন, উদ্দেশ্য যদি হয় ভালো তবে আমাদের সংকোচ, লোকলজ্জা এইসব তো পাশেই ঠেলে দেয়া উচিত। দ্বিতীয় বৃদ্ধ বলেন,

‘যদি আপনার অভীষ্ট এই রাষ্ট্রের কল্যাণ,
যদি দ্বন্দ্বের সমাধান আপনার উদ্দেশ্য,
তা’হলে জানবেন লোকাচার তুচ্ছ, সংকোচ অনর্থক।’

বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল যন্ত্রসভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের যুগে মানুষ মূলত একা। কীভাবে! মানুষ চিরকাল স্বাধীন হতে চেয়েছে গোষ্ঠীর স্বার্থে, বৃহতের প্রয়োজনে। কখনো পেয়েছে, কখনো পায়নি। প্রকৃত স্বাধীন মানুষের পাশে কেউ থাকে না, থাকা সম্ভব নয়। বন্ধনযুক্ত কোনও স্বাধীনতা নাই। বন্ধনহীনতার মধ্যেই প্রকৃত স্বাধীনতা। নিয়ত অগণিত বন্ধনের চাপে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার স্বাভাবিকতা, প্রত্যেক মানুষের মন যুগিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ জটিল হয়ে ওঠে, হাঁপিয়ে যায়। ফলে ব্যক্তির জীবনে স্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না, সে হয়ে ওঠে সবার মন যোগানোর উপচার মাত্র। অস্তিত্বকে যে প্রকৃতঅর্থে উপলব্ধি করতে পেরেছে সেই তার নিজস্ব জগতে একা এবং একামাত্র হয়ে গেছে। কর্ণের প্রাগ্রসর চিন্তাশানিত সংলাপ,

‘ আমি স্বাধীন, আমি নিঃসঙ্গ।’

আত্মপরিচয়ের যে সংকট কর্ণকে তাড়িয়ে ফিরেছে সব সময়, যে পরিচয়হীনতার কারণে বরাবরই উহ্য থেকেছে তাঁর অর্জন, পরজায় হবে জেনেও কর্ণ যথাযোগ্য সংশপ্তকের মতোই দৃপ্ত উচ্চারণে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করেন।

‘এই যুদ্ধ
আমার বহুকালের প্রতীক্ষিত, প্রত্যাশিত।
সে অর্থ দেবে আমাকে, আমার অস্তিত্বকে।
আর বিনিময়ে
নেবে আমার চরম চেষ্টা, অন্তিম উদ্যম,
আমার সব অব্যবহৃত আবেগ।
আমি স্বাগত জানাই
রক্তবর্ণ, ক্ষমাহীন, মুক্তিদাতা এই দেবতাকে।’

পুরাণের প্রকৃত মর্যাদা হয়তো এখানেই যে, কখনোই তার পুরনো হয় না। চিরকাল নতুন নতুন রূপে, নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে নিজেকে নবায়ন করে হাজির হয় নিজে, নতুবা অন্যকারো করতলগত হয়ে। আমরা আমাদের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে খুব সহজেই তো উপলব্ধি করে ফেলি, কী আমাদের তাড়ায়, ভালোবাসা কিংবা প্রাপ্তি আমাদের কতটুকু জুড়ে থাকে! তারচেয়ে কী ঢের বেশি দখল করে থাকে না অপ্রাপ্তি অথবা বঞ্চনা অথবা অপমানের ক্ষতগুলো। ক্ষণে ক্ষণেই আমাদের তাড়িয়ে ফেরে না, নিজের ভেতরে চিরকাল চিনচিনে ব্যাথার ক্ষরণ ঝড়ে না। কর্ণ তার পৌরাণিক অবয়বে যেন আমাদের কথাই বলে ফেলেন, তাতে অস্পষ্ট থাকে না তাঁর ব্যক্তিজীবনেরও নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর বঞ্চনার চিহ্ন।
‘পরাজয় আমার চিরকালে সঙ্গী, আর পরাজয়ের স্বাদ তীব্র।
পাণ্ডবেরা বনবাসেও জয়ী : কুন্তী তাঁদের মাতা।
পাণ্ডবেরা নিঃস্ব হ’য়েও জয়ী : পাঞ্চালী তাঁদের সাম্রাজ্য।
        কিন্তু জয়ীরা তাঁদের প্রাক্তন জয় ভুলে যান, বা লজ্জিত হন
  তার তুচ্ছতা ভেবে, কালক্রমে। পরাজয় কেউ ভোলে না।’

যুদ্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে, মানবতার বিপর্যয়। যুদ্ধের সবচেয়ে ঘৃণিত দিক হচ্ছে মানুষ হত্যা। অথচ আমরা যদি মানুষের অগ্রযাত্রার ইতিহাসের দিকে তাকাই তবে দেখবো তার বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে যুদ্ধ আর হত্যার কথকতা। আমাদের কাছে সেই সবচেয়ে বড় বীর যার ঝুলিতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্তিত মুণ্ডু! একই প্রজাতি থেকে যদি মানবের উৎপত্তি তবে পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মধ্যেই তো আত্মীয়তার সম্পর্ক। অথচ আমরা স্থূলস্বার্থ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাই সংঘর্ষে, যুদ্ধে। বিপর্যস্ত করি আমাদের মানবতাকে। এ নাট্যে কৃষ্ণের মুখ থেকে নিঃসৃত হয় এমন এক চিরন্তন সংলাপ।

‘সব যুদ্ধই অন্যায়।
সব হত্যাই ভ্রাতৃহত্যা।’

পৃথিবীতে অনেক যুদ্ধ হয়েছে, হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে নিশ্চিত। আমরা নিশ্চয়ই জানি, যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কেউ জয়ী হয় না। প্রত্যেকেই পরাজিত হয়। প্রতিপক্ষের কাছ থেকে হয়তো সাময়িক জয় অর্জিত হয়, কিন্তু নিজের কাছে কী ভীষণভাবে লজ্জিত আর পরাজিত হয় মানুষ। কেননা যুদ্ধে মানবতা লাঞ্ছিত হয়। কেননা যুদ্ধে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধেই অস্ত্র ধারণ করে পরস্পরকে হত্যার নিমিত্তে। সেখানে প্রেম উধাও, ঘৃণা প্রবল, প্রতিপক্ষের রক্তে স্নান ভীষণ প্রার্থিত। ফলে সভ্য ও সভ্যতার দাবিদার হিসাবে আমাদের পরিচয় লুপ্ত হয়। মহাবল কর্ণ যখন জানতে পারলেন এই যুদ্ধে তিনি পরাজিত হবেন, তবে অর্জুনের হাতে নয়, অর্জুনরূপী কৃষ্ণের হাতেই তাঁর মৃত্যু হবে, তখন কর্ণ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। কেননা মৃত্যুই তাঁকে এনে দেবে তার পরিচয়, যার জন্যে এতোকাল প্রতীক্ষা। এই পরাজয়কে ধন্য মানেন কর্ণ। কিন্তু কৃষ্ণ সেখানে কিছুটা বিমর্ষ। তিনি বলেন,

‘এ-যুদ্ধে সকলেই পরাজিত হবে, কর্ণ-
জয়ী, বিজিত, হত, উদ্বৃত্ত- সকলেই।’

প্রতিটি যুদ্ধেই মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় আর পরাজিত করে নিজেকেই। মূলত মহাভারতের কয়েকটি চরিত্রের মাধ্যমে বুদ্ধদেব বসুর প্রাগ্রসর চিন্তা, যুদ্ধবিরোধী চেতনা এই নাট্যে প্রবলরূপে মূর্ত হয়েছে। তিনি আশ্রয় করেছেন মানুষের চিরকালীনতা আর আত্মসম্মানবোধকে। আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিলে মানুষ থাকে না, খোলস থাকে। চিরকালীনতা তো মহত্বে, আত্মসম্মানে। স্থূল কিংবা নতজানু অথবা লোভী মানুষের পক্ষে চিরন্তনের পাখায় ভর দিয়ে কাল থেকে কালান্তরে মানুষের হৃদয়ে কী স্থান করে নেয়া সম্ভব? ইতিহাস বলে, সম্ভব নয়। বুদ্ধদেব বসু ‘প্রথম পার্থ’ নাট্যে এই বিষয়ের প্রতিই তীব্র অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চিরকালীন অবয়ব তুলে এনেছেন তাঁর অমিত সবল লেখনীর মাধ্যমে।

____________________________________________________________

আধুনিকতা উত্তরাধুনিকতা : অর্থহীন পরপদচর্চা
গোঁসাই পাহলভী

এক. ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্য ও চিন্তার পালাবদলটাকে তৎকালীন বুদ্ধিজীবীরা বলেছিলেন বঙ্গীয় রেনেসাঁস। ইতালীয় রেনেসাঁসের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে বঙ্গে কোনও রেনেসাঁসই হয়নি। ইতালীয় রেনেসাঁস কেবল মাত্র সাহিত্য ও কয়েকজন ব্যক্তির চিন্তা ভাবনার ডাক নাম নয়। ইতালীয় রেনেসাঁস পরিবর্তন ঘটিয়ে ছিল সর্বক্ষেত্রে। বাঙালির রেনেসাঁস হয়েছিল কেবল সাহিত্য ও কয়েকজন ব্যক্তির চিন্তা ভাবনায়।

সাহিত্য ব্যক্তিগত চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রেও কি তারা মৌলিক ছিলেন?
ডিরোজিও কিংবা মাইকেল মধুসূদন কি আমাদের নতুন কোনও দর্শন দিয়ে যেতে পেরেছেন? নাকি পাশ্চাত্যানুকরনকেই আমরা অভিনবত্ব বলে মেনে নেব!

রেনেসাঁস শব্দটির অর্থ পুনর্জাগরণ। ইতালির ক্ষেত্রে এই পুনর্জাগরণ যদিও প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার অনুপ্রেরণায় গঠিত। কিন্ত কখনই অনুকরন হয়নি ইতালীয় রেনেসাঁস সংগঠিত হওয়ার আরো অনেক কারণের মধ্যে ক্রুসেড অন্যতম। ক্রুসেডের ফলেই প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে ওঠে। এবং ফেরিওয়ালা শ্রেণির মাধ্যমে প্রাচ্যের প্রত্নসম্পদের সাথে জ্ঞান বিজ্ঞানও ফ্লোরেন্সের রাস্তায় বিক্রয় যোগ্য জিনিষ হয়ে ওঠে। এভাবেই ইতালীয় পন্ডিতদের হাতে  গিয়ে পড়ে আর্যভট্টের গ্রন্থ, গিয়ে পড়ে কৌটলিয়াম অর্থশাস্রম। ইতালীয় রেনেসাঁস সেই বিবেচনায় কেবল মাত্র প্রাচীন গ্রিক সভ্যতারই পুনর্জাগরণ নয় - একই সাথে মিশরীয়, মেসোপটেমীয়,ভারতীয় এবং পারস্য সভ্যতারও পুনর্জাগরণ। কিন্ত ভারতবর্যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমরা কি দেখি?

বৃটিশ কলোনি ভারতের তৎকালীন পুনর্জাগরনের পুরোহিতরা যে সভ্যতার জাগরণ ঘটিয়েছেন তা বেদ শাসিত চতুবর্ণ ব্যবস্থার। ব্রাহ্মণ্য শাসিত ভারত। যে শাসন ব্যবস্থায় সাহিত্য দর্শন এবং ললিতকলার বিপরীতে বৌদ্ধ ও মুসলমানদের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে। অনিবার্যভাবেই এই দুই সভ্যতার জ্ঞান বিজ্ঞান আবিষ্কার ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিপুলভাবে উপেক্ষেত হলো। অতএব দর্শন এবং সাহিত্যেরে ক্ষেত্রে এই রেনেসাঁস হয়ে পড়লো সাম্প্রদায়িক। অপরদিকে এক প্রকার ধর্মীয় পনর্জাগরণ। অসামপ্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোনও প্রকার কাজ হয়নি তা কিন্তু নয়। রাখাল দাশ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীরা তো ছিলেনই। কিন্ত বৃটিশদের এশিয়াটিক সোসাইটিতে শেষ পর্যন্ত তাদের জায়গা হয়নি। চিত্র কলায়ও তাই। ই বি হ্যাভেলদের প্ররোচনায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যা করেছেন তাও পূর্বোক্ত বিবেচনার অধীন।

দুই. ইতালীয় রেনেসাঁসের সময়কাল থেকেই পাশ্চাত্যে আধুনিকতার যুগ। এই আধুনিকতার অধীন বারোক, রোকোকো, রিয়েলিজম, রোমান্টিসিজম, ইম্প্রেশনিজম, এমনকি কিউবিজম, দাদাবাদও। অথচ আশ্চর্য কতিপয় গবেষক রবীন্দ্রনাথকে রোমান্টিক বলে আধুনিকতাবাদের বাইরে রেখে দিলেন। একই বিবেচনা হয়েছে নজরুলের ক্ষেত্রেও।
ধরে নিলাম নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ আদৌ আধুনিক নন। তাহলে আধুনিক কারা? ত্রিশের পাঁচজন কবিকে প্রথম আধুনিক কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হোল ! তাহলে প্রশ্ন জাগে আধুনিকতার সংজ্ঞা কি? রবীন্দ্রনাথ কেন আধুনিক নন? বলা হয়ে থাকে রবীন্দ্র সাহিত্যে কিংবা নজরুলে ধর্ম আছে। আছে সাম্প্রদায়িকতার উপাদান। তার মানে হোতে পারে আধুনিকতায় সাম্প্রদায়িকতা নেই। নেই ধর্মের স্বীকৃতি। ইতালীয় জর্মন ও ইংল্যান্ডের আধুনিকতার অর্থ কি তাই। অই সকল দেশগুলোর তৎকালীন সাহিত্য কি ধর্ম ও সম্প্রদায়গত বিবেচনার উর্ধ্বে উঠতে পেরেছিল?

রবীন্দ্রনাথকে কি বোদলেয়ারের সাহিত্য দ্বারা বিবেচনা করা সম্ভব? ইতালীয় রেনেসাঁস থেকে বোদলেয়ার পর্যন্ত আসতে পাশ্চাত্য যতটুকু সময় নিয়েছে ভারতবর্য কি ততটুকু সময় পেয়েছে? সমান্তরাল বিবেচনাটা এ কারণেই অযথার্থ। যদি অসাম্প্রদায়িক সাহিত্যের মাধ্যমে অধুনিকতার সূত্রপাত আমরা ধরে নেই তাহলে ষোল শতকে সন্ত কবীরকেও আধুনিক বলতে হয়। বলতে হয় ফকির লালন সাঁইকেও। কিন্তু যুগভেদ অনুযায়ী তাঁরা দুজনেই আধুনিক নন। মধ্যযুগীয়। প্রকৃত বিবেচনায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গীয় রেনেসাঁস ও বিংশ শতাব্দীর আধুনিকতাবাদের সংজ্ঞাটা এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে যেন তৎকালীন ভারতবর্ষকে বৌদ্ধ ও মুসলিম যুগ থেকে পুরোপুরি বিস্মৃত করা যায়। এবং এতে সফলও হয়েছিল বৃটিশ শাসকশ্রেণি।

তিন. ধরে নিলাম ত্রিশের পাঁচজন কবি আধুনিকতার সংজ্ঞায় মেলানো সাহিত্য সৃজন করেছেন। আদৌ সে বিবেচনা কি প্রকৃত? আধুনিকতার সংজ্ঞাটার কথা যদি আমাদের মনেই থাকে তাহলে বলবো যে নয়। প্রকৃত নয়। বরং অপ্রকৃত। পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে যেদিকে অপ্রকৃত হয়; প্রাচ্যের দৃষ্টিতে তাঁরা ভারতবর্ষেরই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। হতে পারে এটা তাঁদের অগোচরেই ঘটেছে। যেমন হিন্দুধর্মের অন্যতম স্তম্ভের মধ্যে একটি মতবাদ হচ্ছে জন্মান্তরবাদ। হিন্দুদের এই বিজ্ঞানে আস্থাও অত্যাধিক। ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও একই কথা। তাহলে জীবনানন্দ দাশ কি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। ছিলেন জন্মান্তরবাদে? তা না হলে কিভাবে লিখতে পারেন তিনি : ‘হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে।’ এ বাক্যটি কি জন্মান্তরবাদের নজির হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়নি। না কি জীবনান্দ এ বাক্যটি দ্বারা অন্য কিছু বুঝিয়েছেন?

ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁস থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক কিংবা তারও কিছুটা পর্যন্ত সময়কালের উপর নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর অনেকগুলো বিবেচনা আছে। কয়েকটি উদ্ধৃতি আমরা পরপর তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, কিন্তু আজ এই রিনেসেন জোয়ারে ভাটা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। আপনাদের কেহ এই জিনিসটা অনুভব করিয়াছেন কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হয়, ১৯১০-১১সন হইতে ১৯১৮-১৯ সন পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনে একটি মোড় ফিরিবার কাল। যে প্রথম উদ্যম ও উৎসাহ একশত বছর ধরিয়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারার সংমিশ্রনে একটা নতুন সাহিত্য, চিত্রকলা দার্শনিক চিন্তা ও ধর্ম সাধনা গড়িয়া তুলিয়া ছিল তাহা যেন এই কয় বৎসরের মধ্যে অবসাদের স্পষ্ট লক্ষণ প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করিল। প্রকৃত প্রস্তাবে এই যুগের পর বর্তমান ভারতে সত্যকার কোন সৃষ্টি হইয়াছে কিনা সে বিষয় সন্দেহ আছে। গণিত, রসায়ন বা পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণা করিয়া যাহারা এ যুগে খ্যাতি অর্জন করিতেছেন তাঁহাদের কথা এখানে ধরিতেছিনা, কারণ তাঁহাদের এই সকল কার্যকলাপ এতটা বিশিষ্ট ও বিচ্ছিন্ন যে সমগ্র জাতীয় জীবনের সহিত উহাদের সম্পর্ক কি, এমনকি সম্পর্ক আছে কি নাই, এখনও তাহা বুঝিবার সময় হয় নাই। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে দেখিতেছি, এই যুগের পর আমাদের অসামান্য ব্যক্তিরা নিজেদের অনুকরণ করিতেছেন ও সামান্য ব্যক্তিরা অপরের অনুকরণ করিতেছে। এই বিচারহীন অনুচিকীর্ষা আজ এতদূর গড়াইয়াছে যে আমাদের সংস্কৃতি সৃষ্টির চেষ্টা আমাদের জীবনের সত্যকার প্রবাহ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সম্পূর্ণ কৃত্রিম ও বাহ্যিক একটা ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। [বর্তমান ভারতের সংস্কৃতি, নীরদ চৌধুরীর বাংলা প্রবন্ধ, সম্পাদনা; ফয়জুল লতিফ চৌধুরী, সময় প্রকাশ, মার্চ ২০০০]। একই প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন, ঠিক এই অনুচিকীর্ষা আমাদের সাহিত্য, রাষ্ট্রীয় চিন্তা ও সমাজ সংস্কারের চেষ্টার মধ্যেও পূর্ণভাবে বর্তমান, তবে শিল্পকলার ক্ষেত্রে যে স্থলে অতীতমুখী, এই সকল ক্ষেত্রে উহা পশ্চিমমুখী। আজ কয়েক বৎসর ধরিয়া বাংলাদেশে যে সাহিত্য সৃষ্টি হইতেছে উহাকে বাংলা ভাষাভাষীর জন্য বর্তমান যুগের ইউরোপীয় সাহিত্যের ভাষান্তকরণ ভিন্ন আর কি বলতে পারি? [পূর্বোক্ত ]

অন্য একটি প্রবন্ধে নিরদ চন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি জাতির এই কীর্তি সম্বন্ধে আমাদের এত বেশি শ্রদ্ধা যে যিনি আমাদের এই পথের প্রথম পথ প্রদর্শক তাহাকে আমরা যুগগুরু বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকি। কিন্তু নিরপেক্ষ বিচারে উহার মূল্য কতটুকু? উহাতে কৃতিত্বই কি খুব বেশী? নিজস্ব জাতীয় গৌরব নাই বলিয়া বাঙালি বরাবরই পরমুখাপেক্ষী ও পরধর্মী। মুসলমান আমলের আগে বাঙালি জাতি বলিয়া যে বিশিষ্ট একটা জাতি ছিল তাহার বেশি প্রমাণ আমরা পাই না। যদি থাকিত তবে হয়তো দেখিতাম তখনও বাঙালি উত্তরাপথের মুখ চাহিয়া আছে, সংস্কৃত অথবা প্রাকৃতে কথা কহিতেছে, আর্য্য আচার-ব্যবহারের অনুকরণ করিতেছে। [ বাঙালিত্বের স্বরূপ, পূর্বোক্ত ]

তিনি আরো লিখেছেন, যে অনুকরণশীলতা বাঙালি মনের একটা সনাতন ধর্ম, আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীর কীর্তি তাহার একটা নূতন প্রয়োগ মাত্র। কে পরিশেষে প্রভু হইয়া দাঁড়াইবে তাহা বুঝিবার সহজাত চাতুর্যের প্রমাণ উহার মধ্য আছে, কিন্তু সংস্কৃতি সৃষ্টির কোন পরিচয় নাই [পূর্বোক্ত ]।

এই অনুকরণ প্রিয়তার কারণ কি? পূর্বেই বলেছি, ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁস ছিল প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার পুনঃঅনুকরণ। ভাষাগত এবং চরিত্রগত সাযুয্যে। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ চলি−শ এমনকি আজও পর্যন্ত এই ধারাটা ভারতীয় এবং অঞ্চলভিত্তিক সৃজন প্রক্রিয়ার সাথে পাশ্চাত্য সৃষ্টি জগতের সমন্বয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর আঞ্চলিক চরিত্রটি ছিল অধর্তব্যের মধ্যে। সুতরাং ইউরোপীয় বর্তমান সভ্যতার সামনের আঘাত ঠেকানো বা আঘাত হজম করার ঢাল হিসেবে উচ্চবিত্ত বাঙালি বুদ্ধিজীবী এনে দাঁড় করিয়ে ছিল প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা।  বর্তমানের সাথে প্রাচীনতার সমন্বয় প্রচেষ্টা।

ফলটা কি দাঁড়ালো? নিরদচন্দ্র চৌধুরী তার অপর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন সে কথা। তিনি লিখেছেন, অন্তত একথাটি অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, মুসলমান যুগই হিন্দু জনসমষ্টির মধ্যে অগণিত লৌকিক ধর্ম, লৌকিক আচার, লৌকিক সাহিত্য ও লৌকিক সংগীত ইত্যাদির সৃষ্টিকাল। ইহার ফলে আমরা যে গ্রাম্য সংস্কৃতির প্রবর্তন করিয়াছিলাম, তাহাই বৃটিশ যুগের প্রাক্কালে আমাদের একমাত্র সম্বল ছিল। ইহাই আমাদের প্রকৃত পৈতৃক সম্পত্তি, ইহারই সহিত ইউরোপীয় প্রভাবক্রিয়া করিতে আরম্ভ করে। কিন্তু পরবর্তী যুগে গবেষণা করিয়া সম্পূর্ণ নতুন একটা জিনিষকে আমরা ইউরোপীয় সংঘাতের সম্মুখে স্থাপিত করি। উহা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা। আমাদের পক্ষে সে যুগে এইভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের শরনাপন্ন হইবার বিশেষ একটি কারণ ছিল। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও উহাকে একটা বাহ্যিক ও কৃত্রিম ব্যাপার ভিন্ন অন্য কিছুই বলিবার উপায় নাই। এই কথা বলিতেছি এই জন্য যে, এই পুরাতন সংস্কৃতি আমাদের লৌকিক সংস্কৃতির পূর্বপুরুষ হইলেও সমপর্যায়ের সংস্কৃতি নয় বলিয়া এ দুইয়ের মধ্যে কোন নিবিড় একাত্নতা ছিল না সুতরাং ইউরোপীয় সভ্যতার অপেক্ষা উহা আমাদের অনেক বেশি নিকট-গেয়াতি হওয়া সত্ত্বেও উহার অনুকরণও আমাদের পক্ষে অনুকরণ ভিন্ন আর কিছুই হইয়া দাঁড়য় নাই [ বর্তমান ভারতের সংস্কৃতি, পূর্বোক্ত ]।

এই যে প্রাচীন ভারতবর্ষকে এনে বর্তমান ইউরোপের মুখোমুখি দাঁড় করানো হলো তার ফলাফল কি হলো? সমন্বয়ের চরিত্রইবা কি কিরূপ অসম ছিল? নিরদচন্দ্র চৌধুরী বলেছেন, আমরা ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়িয়া সমন্বয়ের ধারণার উপর আমাদের সংস্কৃতিকে প্রতিসিত করিয়াছি, কিন্তু ভাবিয়া দেখি নাই প্রকৃত সমন্বয় একমাত্র তাহাদের মধ্যেই সম্ভব যাহাদের শক্তি ও প্রকৃতির সাম্য আছে। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে যে সহজ গ্রাম্য সংস্কৃতিকে পাইয়াছিলাম, তাহার তুলনায় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় সভ্যতার শক্তি ও পরিনতি এত বেশি যে এ দুইয়ের মধ্যে সার্থক মিলনের কোন প্রশ্নই উঠিতে পারে না। আমার মনে হয়, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এই দুই পক্ষের শক্তির তারতম্যের কথা উপলব্ধি করিয়া একটা অবশ্যম্ভাবী পরাজয়ের আশঙ্কা আমাদের নবযুগপ্রবর্তকদের মনে সজ্ঞানে না হইলেও অন্তত অজ্ঞাতসারে জাগিয়া ছিল; এবং সে জন্যেই তাহারা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ছিলেন। ইহাতে আমরা কিছু কালের জন্যে যে আত্মরক্ষা করিতে পারিয়াছি সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। হয়তো এইরূপ না করিলে স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইবার পর দক্ষিণ আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের যে দশা ঘটিয়াছিল আমাদেরও সেই দশা ঘটিত। কিন্তু তাই বলিয়া এ কথাটাও বিসৃত হইলে চলিবেনা যে উহার ফল চিরস্থায়ী হইবার সম্ভাবনা কোন দিনই ছিল না। কেন ছিল না তাহার কারণ নির্দেশ করিতে গেলে প্রথমেই বলিতে হয়, যে প্রচীন ভারতীয় সংস্কৃতিকে আমরা আপনার বলিয়া আশ্রয় করিয়াছি তাহাও আমাদের লৌকিক সংস্কৃতির পক্ষে অত্যন্ত বেশি শক্তিশালী ও পরিনত এবং উহাও শক্তি ও পরিণতির দিক হইতে ইউরোপীয় সভ্যতার সমধর্মী। এই লক্ষণের জন্য শুধু ইউরোপীয় প্রভাবকে ঠেকাইয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে প্রাচীন ভারতীয় ও অন্য দিকে ইউরোপীয়, এই দুইটি ধারাকে অবলম্বণ করিয়া আছি, কিন্তু দুইটি ধারাই আমাদের পক্ষে সহজপাচ্য নয় বলিয়া দুইয়ের অনুসরণই আমাদের বেলায় সৃষ্টির প্রেরণা না হইয়া নিষ্ফল অনুকরণ ও অবসাদের হেতু হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইউরোপ ও প্রাচীন ভারতবর্ষ, প্রাচীন ভারতবর্ষ ও ইউরোপ- এ দুইয়ের মধ্যে আমাদের এই ব্যর্থ আবর্তন শুধু যে আমাদের সংস্কৃতি সৃষ্টির চেষ্টাকেই ব্যর্থ করিতেছে তাহাই নয়, ভারতবর্ষে শিক্ষিত সমাজ ও সাধারণ জনসমষ্টির মধ্যে একটা প্রাচীরও গড়িয়া তুলিতেছে । [প্রাগুক্ত]

প্রকৃত আধুনিকতা কি হতে পারতো!

বাংলা সাহিত্যে বিশেষকরে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকে যে সমস্ত কবিদের নামের উপর আধুনিকতার তকমা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের সাহিত্যের ভাষা, বোধ এবং দর্শন সম্পর্কে নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন, আজ কয়েক বৎসর ধরিয়া বাংলাদেশে যে সাহিত্য সৃষ্টি হইতেছে উহাকে বাংলা ভাষাভাষীর জন্যে বর্তমান যুগের ইউরোপীয় সাহিত্যের ভাষান্তকরণ ভিন্ন আর কি বলিতে পারি? কেন তিনি তৎকালীন সাহিত্য সম্পর্কে এ ধরনের সিদ্ধান্ত টানলেন? কারণ কিছুদিন পূর্বে ওয়ালার পেটারের রিনেসেঁন শীর্ষক বিখ্যাত পুস্তক কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ পরীক্ষার পাঠ্য ছিল। তখন হঠাৎ বাংলা উপন্যাস বেয়াত্রিচে, মিকেল এঞ্জেলো, পলিজিয়ানো, পিকো দেলা মিরান্দোলার আবির্ভাব হইয়াছিল। আবার এক সময়ে ঐ স্কুলেও সোফোক্লেস পাঠ্য হইলো; তখন আবার বাঙালির সাহিত্যচর্চায় জিউস, হেরা, আর্টেমিস, ডানাই দেখা দিলেন। এই নিয়মের অনুসরণ করিয়াই অলডুস হাঙাসি, জে.বি প্রিস্টলী বা টি.এস ইলিয়ট হইবার যশোলোভী নব্য বাঙালি সাহিত্য স্রষ্টারা তাঁহাদের পুস্তকে এমন সব বিষয় ও ভাবের অবতরণ করিতেছেন যাহার সহিত সাধারণ বাঙালি পুরুষ ও নারী দূরে থাকুক তাঁহাদের নিজেদের ও সত্যকার কোন যোগ নাই। এই অনুকরণ স্পৃহাই তাঁহাদের লেখনির একমাত্র প্রেরণা, নহিলে তাঁহাদের ভাব ও ভাষা এ দুয়ের কোনটিকেই বাংলাদেশের স্বাভাবিক সাহিত্য বলিয়া গণ্য করিবার কোন হেতু নাই [বর্তমান ভারতের সংস্কৃতি,পূর্বোক্ত,পৃষ্ঠা-৯৫]।

তার মানে বাঙালি লেখকেরা বিদেশি যে সাহিত্যই পড়ুক না কেন তার প্রভাব অতিক্রম করিতে পারেন না। যার ফলে বিংশ শতাব্দী থেকেই বর্তমান কাল পর্যন্ত যে সমস্ত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তার অধিকাংশের পাত্র-পাত্রীর নাম, পোশাক-আশাকে এখানকার একটা রঙ থাকলেও মূলত পাশ্চাত্য থেকে যায় মেরুদন্ড আকারে। আর যে ক্ষেত্রে একান্তভাবে ভিন্ন প্রকৃতির স্বতন্ত্র সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হতে পেরেছে নিরদচন্দ্র চৌধুরীর ভাষায় একমাত্র দূরত্ব ও অপরিচয়ের ফলে। বৃটিশ সৃষ্ট মধ্যবিত্ত কেরানি মার্কা সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে কথাটা সর্বাংশে সত্যি হলেও সবার ক্ষেত্রে নয়। দূরত্ব ও অপরিচয় থাকাকালীন সময়ে জর্মন ফ্রান্স কিংবা ভারতের সাহিত্যে যেমন স্বাতন্ত্রীকতা ছিল তেমনি একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তারেও দেশগুলো সাহিত্যে-চলনে-বলনে চিন্তায় স্বাতন্ত্রীকতা আছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এই স্বাতন্ত্রীকতা আমরা বৃটিশদের সৃষ্ট মধ্যসত্ত্বভোগী সাহিত্যিকদের ভেতর আমরা পাবো না। পেতে হলে উক্ত গন্ডির বাইরে আমাদের চোখ বুলাতে হবে।

সেই বাহিরটা কি? নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কথার ভেতর সেই বাহির আছে। অথচ সেই বাহিরই হলো ভারতবর্ষের আত্নধন ভেতর। ইংরেজি জ্ঞানে দীক্ষিত গবেষকদের কাছে উল্টে গেছে খানিকটা। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কথা এই, অন্তত একথাটা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, মুসলমান যুগই হিন্দু জনসমষ্টির মধ্যে অগণিত লৌকিক ধর্ম, লৌকিক আচার, লৌকিক সাহিত্য ও লৌকিক সংগীত ইত্যাদির সৃষ্টি কাল। ইহার ফলে আমরা যে গ্রাম্য সংস্কৃতির প্রবর্তন করিয়াছিলাম, তাহাই বৃটিশ যুগের প্রাক্কালে আমাদের একমাত্র সম্বল ছিল। নীরদচন্দ্র কথিত এই গ্রাম্য সংস্কৃতির দিকে একটু নজর দিতে চাই।

এই গ্রাম্য সংস্কৃতি বলতে কি এবং কাদেরকে বুঝানো হয়েছে? স্পষ্টতই বলাহাড়ি, কর্তাভজা, খুশি বিশ্বাস, আউল চাঁদ, সাহেব ধনী, সহজিয়া, আউল-বাউল, ফকিরি পন্থাকেই। এমনকি শাক্তপদাবলীকেও গ্রাম্য সংস্কৃতির আওতায় ঢুকিয়ে ফেলা হয়। অথচ এই গ্রাম্য সংস্কৃতির চরিত্রের দিকে তাকালে আশ্চর্য হতে হয়। শাসকশ্রেণী প্রবর্তিত ধর্মগুলোর বিপক্ষে লড়তে গিয়েই ব্যক্তি বা সমষ্টি বিশেষের হাত ধরে আরেকটি পালা সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে উক্ত সম্প্রদায়গুলো। যে সংস্কৃতির সাথে জীবন-যাপনের যাবতীয় কার্যাবলী প্রত্যক্ষভাবেই সম্পৃক্ত। কোন কৃত্রিম আয়োজন সেখানে পাওয়া যাবে না। অধিকাংশ সম্প্রদায়গুলোর দার্শনিক প্রত্যয়ের দিকে তাকালে পাওয়া যাবে বৈদিক সভ্যতা, ব্রাহ্মণ্য অধিকারভুক্ত বৌদ্ধ দর্শন এবং ইসলামের অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্মাচারের বিপরীতে যা যাপনের থেকে উঠে আসা নয় সেই সমস্ত আচরনের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাখ্যান করে। যেমন কাব্য তেমনি দর্শনে। ক্ষেত্র বিশেষে কখনও বিভক্ত হয়ে পড়েনা সৃজনের পেক্ষাপট। অথচ বিভক্ত হয়ে থাকলো কেন্দ্র শাসিত ব্যবস্থা থেকে।

লৌকিক সংস্কৃতি বা নীরদচন্দ্র চৌধুরী কথিত গ্রাম্য সংস্কৃতি কখনই ভারতীয় সংস্কৃতির মূল ধারায় আসতে পারেনি। সম্ভবত চায়ওনি। কারণ মূলধারার নগর সংস্কৃতির সাথেই লৌকিক সংস্কৃতির লড়াইটা হয়ে আসছে সমান্তরাল। নগর সংস্কৃতির ভিত্তির সাথেও লৌকিক সংস্কৃতির পার্থক্য ব্যাপক। লৌকিক সংস্কৃতির অস্তিত্ব মানুষের যাবতীয় ধর্মের গভীরে। সহজে যাকে নাড়ানো অসম্ভাব। একটিকে আঘাত করলে চর্তুদিক থেকে সে আঘাত অনিবার্যভাবেই মোকাবেলা করে বাকী সমস্ত ধর্মগুলোর সমন্বয়ে। সে কারনে নগর সংস্কৃতি শেষমেষ লোক সংস্কৃতির কাছ থেকে কিছু না কিছু নিয়েই নিজেকে পুষ্ট করে। এই অতি স্বল্পতম জীবনবোধের অস্তিত্বেই প্রজ্জ্বলিত ছিল আমাদের তথাকথিত নগর আধুনিকতা। এই আধুনিকতা নিজেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ধর্মের সাথে নিজের অপ্রত্যক্ষিক সম্পর্কে। অথচ এই অপ্রত্যক্ষিক সম্পর্কটিও অনিবার্য ছিল আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্বের সাহিত্যিকদের। সে শিক্ষায় ধর্মপাঠ হয়ে উঠেছিল একাডেমিক। আচরণহীন শুষ্ক। ঐ সময় শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মগ্রন্থগুলোর প্রকৃত পাঠোদ্ধারেও তেমনি চাবি শব্দের সৃষ্টি হয়নি। অথচ অপ্রত্যক্ষিক সম্পর্কের চর্চায় থেকেও বঙ্গীয় রেনেসাঁস পুরোহিতদের কাছে ধর্ম অনেকটাই বোধগম্যের ব্যপার ছিল। এই জ্ঞান একমাত্র হিন্দু ধর্মের নয়। ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে ধর্মের পাশাপাশি পাঠ থেকেই পেয়েছিলেন তাঁরা।
শাক্ত পদাবলীর কবিদের কি আমরা আধুনিক কবি হিসেবে মেনে নিতে পারবো? বিংশ শতকের ত্রিশ দশকীয় কবিদের প্রেক্ষাপটে? অন্তত তা হবার নয়। সম্ভব ছিল অনেকটাই। যদি বাংলাদেশের আধুনিক কবিরা! চর্যাপদ বৈষব বা শাক্ত পদাবলীকে তাঁদের দেহ মনগত পূর্বাবস্থা ধরে সার্বিক অস্তিত্ব ভাবনায় মনোনিবেশ করতেন। কিন্তু তা হয়নি। চর্যাপদ কিংবা বৈষব পদাবলী তখনকার মতো এখনও কেবল ইতিহাসের বিষয়। চর্চার নয়।

যখন শাক্তের কবিরা তাদের জীবনের উপরে চাপিয়ে দেয়া বৈদিক ঘোরের চরিত্রগুলোকে দৈহিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ দিয়ে মোকাবেলা করছে তখন উপনিবেশিক ভারতবর্ষের আধুনিকতার দেহ পরপ্রশাসকের শৃঙ্খলাবদ্ধ। কেহ বাঙলাকে পাশ্চাত্যের রঙে রূপসী করে তুলছেন। কেহ পুরাতনী জয়ে বৈদিক সভ্যতার কোলে ঘুমিয়ে পড়তে চাইছেন। লৌকিক জগত অই দুই ধারাকেই কালনিক ঠাওরেছে। অর্থাৎ অতীতে ফিরে যেতে হলে মধ্যবর্তী পথ মাড়াতে হবে আবার ভবিষ্যৎ ভবিতব্য। অতএব তাকে বর্ধিত করণে কি শোভা? এহ বাহ্য!

সেকারনেই শাক্তদের ভেতর কোন অংশেই অতীত পাওয়া যাবেনা। পাওয়া যাবে এক নিরেট নিপাট রক্তে মাংসে গড়া বর্তমান। সার্বিক বর্তমান এবং বর্তমান ভজা। অতীত ধ্যানে মগ্ন বঙ্কিম চন্দ্রের কথায়ও রয়েছে তার স্বীকৃতি। তিনি একবার লিখেছিলেন, একদিন বর্ষাকালে গঙ্গাতীরস্থ কোন ভবনে বসিয়াছিলাম। প্রদোষকাল প্রস্ফুটিত চন্দ্রোলোকে বিশাল বিস্তৃর্ণ ভাগীরথি লক্ষ বীচিবিক্ষেপশালিনী - মৃদু পবন হিল্লোলে তরঙ্গ-ভঙ্গ চঞ্চল চন্দ্রকরমালা লক্ষ তারকার মতো ফুটিতেছিল ও নিবিতেছিল। যে বারাণ্ডায় বসিয়া ছিলাম, তাহার নিচে দিয়া বর্ষার তীব্রগামী বারিরাশি মৃদু রব করিয়া ছুটিতেছিল। আকাশে নক্ষত্র, নদী বক্ষে নৌকায় আলো, তরঙ্গে চন্দ্র রশ্নি। কাব্যের রাজ্য উপস্থিত হইলো। মনে করিলাম কবিতা পড়িয়া মনের তৃপ্তি সাধন করি। ইংরাজী কবিতায় তাহা হইলো না। ইংরাজির সঙ্গে এই ভাগিরথীর ত কিছুই মিলে না। কালিদাস ভববুতিও অনেক দূর। মধুসূদন - হেমচন্দ্র - নবীন চন্দ্র - তাহাতেও তৃপ্তি হইলোনা। চুপ করিয়া রহিলাম। এমন সময়ে গঙ্গাবক্ষ হইতে সঙ্গীতধ্বনি শোনা গেল। জেলে জাল বাহিতে বাহিতে গাহিতেছে- ‘সাধো আছে মা মনে/ দূর্গা বলে প্রাণ ত্যজিব/ জাহ্নবী জীবনে।’ তখন প্রাণ জুড়াইলো - মনের সুর মিলিল - বাঙলা ভাষায় বাঙ্গালীর মনের আশা শুনিতে পাইলাম - এ জাহ্নবী জীবনে দূর্গা বলিয়া প্রাণ ত্যজিবারই বটে, তাহা বুঝিলাম। তখন সেই শোভাময়ী জাহ্নবী, সেই সৌন্দর্যময় জগৎ, সকলই আপনার বলিয়া বোধ হইলো - এতক্ষণ পরের বলিয়া বোধ হইতে ছিল [শাক্ত পদাবলী, একাদশ সংস্করণ, শ্রী অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, পৃ ফ-ব ]।

বঙ্কিম চন্দ্রের পরের বলিয়া বোধ কেবল মাত্র মধুসূদন কালিদাস থেকেই নয়, শাক্তের বোধও তার জন্যে পরের ছিল। কারণ শাক্ত পদাবলীতে যখন দূর্গা কালী কৃষ্ণ বা মহামায়ার নাম উচ্চারিত হয় তখন পাঠকের জন্য প্রয়োজন থাকে সচেতন হবার। এ কারণে যে নামগুলো যে সম্পর্ক থেকে আমাদের কাছে গেয়াত, শাক্তদের হাতে পূর্বেকার সম্পর্ক অনেকটাই উল্টে গেছে। কারণ নামগুলোকে মানবদেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গে রিপুর চরিত্রে সাঁজানো হয়েছে। বৃটিশ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় যার পাঠোদ্ধার অসম্ভব ছিল তখন। এছাড়াও শাক্ত বা কর্তাভজাদের কাছে (ফকিরি পন্থীদের কথাও বলা যায়) পদগুলো কখনই নাম মাত্রিক সাহিত্য চিন্তার নয়। কবিতা হবে এই আগ্রহ থেকে তাঁরা পদগুলো রচনা করেন নাই। অত্যন্ত সচেতন ভাবেই। সাহিত্য বলতে যা বুঝায় তাও কিন্তু এই ধারাগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়।

সহিত থেকেই সাহিত্য। বঙ্গীয় রেনেসাঁস থেকে ত্রিশীয় আধুনিকতা রচিত হয়েছে পরের সহিত। পরের সাথে থাকার আমলনামা। কিন্তু লৌকিক সংস্কৃতি তার দীর্ঘকালীন লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জেনেছে বেদই ভেদের স্রষ্টা। ভেদ থেকেই পরের ধারণা সৃষ্টি হয়। শাক্তদের প্রচেষ্টার মধ্যে কখনও অভেদ চিন্তা পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে আপনার আপনির সহিত থাকার প্রচেষ্টা। এছাড়াও রয়েছে পূর্ববর্তী ধারণা সমষ্ঠিকে প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে আপন করে তোলা।           (অসমাপ্ত)

____________________________________________________________

গ্যাস ও আমাদের রাজনীতি
মাহবুব সবুজ

সরকার সম্প্রতি দেশের তিনটি গ্যাস ব্লক দুটি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে- এটা পুরনো খবর। সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মিছিল সমাবেশ হয়েছে, পুলিশ কর্তৃক প্রতিবাদকারীদের উপর ধর-পাকড়, নির্যাতন নিপীড়ন হয়েছে-এটাও এত দিনে বাসি হয়ে গেছে। তবে উদ্বেগ এবং আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে শ্রদ্বেয় আনু মুহাম্মদ সহ অগনিত মানুষের উপর নগ্ন পুলিশি হামলার পরও দেশে তেমন বড়সড় কোন গণ-আন্দোলন গড়ে উঠেনি। তবে কি আমরা ঝিমিয়ে পড়েছি? বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি বলে বঙালির নামডাক আছে। তবে কি আমরা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছি? ভুলে যাচ্ছি আমাদের জাতীয় ইস্যু। কিন্তু কনোকো ফিলিপস, টাল্লো ওরাতো ভুলবেনা, ভুলবেনা আমাদের বুর্জোয়া শাসক-শোষক গোষ্ঠি। তারা ঠিকই আমাদের দেশ, দেশের স্বার্থ নিয়ে ব্যাবসা করবে। কারণ তাদের কোন দেশ নেই, দেশের প্রতি কমিটমেন্ট নেই। তাদের আছে কেবল তরলের প্রতি মোহ, তরলের প্রতি কমিটমেন্ট। সে তরল মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর “তেল”ও হতে পারে আবার অর্থনীতির তরল সম্পদ (নগদ নারায়ন) ও হতে পারে। এরা পরিস্থিতির পরিবর্তনে অতিথি পাখির মতোই ওড়ে বেড়াতে পারেন এদেশ-ওদেশ। কিন্তু আমাদের থাকতে হবে এখানেই, এদেশ এমাটিতেই। গরজটাও তাই আমাদেরই বেশি। এ গরজেরই ক্ষুদ্র অংশ এই লেখা। যদিও বর্তমান মহাজোট সরকার গভীর সমুদ্রের গ্যাস ক্ষেত্র ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর বীজ অনেক আগেই বপিত হয়েছিল। তথাকথিত সেনা সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সর্বপ্রথম এ পরিকল্পনা নেয়। মডেল পি.এস.সি-২০০৮ তাদের আমলে প্রণয়ণ করা। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কনোকো ফিলিপসকে গভীর সমুদ্রের আটটি ক্ষেত্র (১০,১১,১২,১৫,১৭,২০,২১ নং) এবং টাল্লো বাংলাদেশকে একটি (৫নং) ক্ষেত্রের জন্য যোগ্য ঘোষণা করে। কিন্তু প্রবল গণ-বিরোধীতার মুখে তার রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য সে সময় মহাজোট অথবা বি.এন.পি.-জামাত জোটের ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের আচরণ লক্ষণীয়। অবশেষে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা বর্তমান নির্বাচিত সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে ১০ এবং ১১ নং ব্লক দুটি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক কনোকো ফিলিপসকে, ৫নং ব্লকটি আইরিশ টাল্লো কে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তারস্বরে বলা হয়েছে, এবারের পি.এস.সি-তে দেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে। দেখা যাক মডেল পি.এস.সি-২০০৮ এ কি আছে।

মডেল পি.এস.সি-২০০৮ এর অনুচ্ছেদ অনুসারে কন্ট্রাক্টর কোম্পানি তাদের ব্যবহার্য সকল প্রকার যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক অন্যান্য দ্রব্য, জিপ, পিক-আপ ইত্যাদি শুল্কমুক্ত ভাবে আমদানি করতে পারবে। এসুযোগের অপব্যবহার করে আমাদের দরিদ্র দেশের কতকোটি টাকা শুল্ক বেহাত হবে তার কোন হদিস কি কেউ দিতে পারবে?

১৪.৩নং অনুচ্ছেদ অনুসারে বহুজাতিক কোম্পানি উত্তোলিত গ্যাসের সর্বোচ্চ ৫৫% পর্যন্ত গ্যাসকে বিনিয়োগ উসুল হিসেবে দেখাতে পারবে। ১৪.৪নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিনিয়োগ উসুলের খাতগুলো হচ্ছে-
১. অপারেটিং কস্ট
২. এক্সপেন্ডিচার বা খনি উন্নয়ন ব্যায়
৩. এক্সপ্লোরেশন ব্যয়।

দেখা যাচ্ছে চুক্তি সম্পাদিত হবার পর এদেশে তাদের ব্যয়কৃত প্রতিটি পাই পয়সা যোগাতে হবে আমাদেরই। এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য- ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে শেল-কেয়ার্ন ১৫ এবং ১৬ নং ব্লকের বিপরীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তাদের অফিস ব্যয়ের হিসাবকে বিনিয়োগ বলে উল্লেখ করেছিল। কনোকো ফিলিপস, টাল্লো একাজ করবেনা তার গ্যারান্টি কী?

১৫.৫.৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- পেট্রোবাংলার যদি গ্যাস পরিবহন ব্যবস্থা থাকে এবং প্রাপ্ত গ্যাস ব্যাবহারের ক্ষমতা থাকে তবে সে টোটাল মার্কেটেবল গ্যাসের সর্বোচ্চ ২০% গ্যাস প্রফিট গ্যাস হিসেবে রাখতে পারবে।
এ অনুচ্ছেদের প্রথম শর্তটি হচ্ছে- নিজের প্রফিট গ্যাস পেট্রোবাংলা তখনই পাবে যখন তার পরিবহন ক্ষমতা থাকবে। বিশেজ্ঞদের মতে প্রতি মাইল পাইপ লাইনের জন্য খরচ হবে এক থেকে দুই মিলিয়ন ডলার। স্থলভাগ থেকে গ্যাসক্ষেত্রগুলোর গড় দূরত্ব প্রায় দুইশ মাইল। তাহলে পাইপলাইন স্থাপনে ব্যয় হয় দুই শ থেকে চারশ মিলিয়ন ডলার। যেখানে ১৯৭৪ সালে আবিষ্কৃত নিকট সমুদ্রের কুতুবদিয়া গ্যাসক্ষেত্র এখনও পর্যন্ত পাইপ লাইন স্থাপনের অভাবে অনুত্তোলিত অবস্থায় পড়ে আছে সেখানে গভীর সমুদ্রে পাইপলাইন স্থাপনের গল্পটি অবাস্তব নয়কি?

দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে ব্যাবহার ক্ষমতা থাকতে হবে। এই মুহূর্তে আমরা প্রতিদিন ২৩৫ মিলিয়ন কিউবিক ফুটের বেশি গ্যাস তুলতে থাকি। তবে বাড়তি গ্যাস তাকে বিদেশি রপ্তানী করতে বাঁধা দেয়া যাবে কি?

১৫.৫ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, এক গঝঈঋ গ্যাস আই.ও.সির কাছ থেকে কিনতে হবে ৩০৫ টাকায়। অথচ সমপরিমান গ্যাস আমরা বাপেক্স-পেট্রোবাংলার কাছ থেকে পাচ্ছি মাত্র ২৫ টাকায়। তাহলে এদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে হবে ১২গুণেরও অধিক মূল্যে।

১৫.৫.৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি যদি এল.এন.জির মূল্য বাজারের অবস্থান, পরিবহন খরচ ইত্যাদির যৌক্তিক হিসাব দেখাতে পারে তাহলে পেট্রোবাংলা তাকে এল.এন.জি রপ্তানিতে বাঁধা দিতে পারবেনা।

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- ১৫.৭ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে হিসাবকৃত প্রতি গঝঈঋ গ্যাসের আন্তর্জাতিক বাজারদর ৬৭০ টাকা। কিন্তু আমরা কিনছি ৩০৫ টাকা দরে। প্রায় অর্ধেক দামে। এক্ষেত্রে কোম্পানি যদি বাজারদর, পরিবহন খরচ ইত্যাদি হিসেব দেখিয়ে গ্যাস বিদেশে রপ্তানি করে তাদের বাঁধা দেয়া যাবেনা। তারপরও কি বলা হবে পি.এস.সি তে দেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে?

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মেজর(অবঃ) মোক্তাদির আলী বলেছেন- ‘বিদেশি কোম্পানি কোন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করলে সর্বপ্রথম পেট্রোবাংলাকে জানাবে। পেট্রোবাংলা ঐ গ্যাস না কিনলে দেশের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করবে। এটা সম্ভব না হলে এল.এন.জি করে রপ্তানি করবে।’( দৈনিক যুগান্তর, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০০৯)

কিন্তু পি.এস.সি-তে ১৫.৫.৫ নং এবং ১৫.৭ নং অনুচ্ছেদের মিলিত যোগফল কী তা কি তিনি জানেন না? জানলে কার স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট তিনি? মডেল পি.এস.সি ২০০৮ এ দুর্ঘটনা সংক্রান্ত কোন অনুচ্ছেদ নেই কেন? বিদেশি কোম্পানি কি কোন দুর্ঘটনা ঘটায় না? জালালাবাদ-১, মাগুড়ছড়া, টেংরাটিলা, সাঙ্গু এতোসব দুর্ঘটনার একটিতেও আমরা এপর্যন্ত কোন ক্ষতিপূরণ পাইনি। কারণ পি.এস.সি সমূহে কোন দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ছিলনা। এবারও নেই। তবুও কি এতে দেশের স্বার্থ রক্ষা হয়েছে?

এবার আসা যাক- কাদের হাতে গ্যাস ব্লক তুলে দেয়া হচ্ছে- এ  প্রসঙ্গে। বহুজাতিক পুঁজিদার কোম্পানি এদেশে জনসেবার জন্য নয়, আসে ব্যবসা করতে। এদের মূলনীতি হচ্ছে- Evrything is fair in love,  war and business. এরা সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়। প্রথমে ধরা যাক বিডিংএ নামমাত্র ব্যয়ে বিশাল কাজ করে দেয়ার প্রলোভন দেখায়। তারপর সংশোধিত ব্যয় বাজেটের ফাঁদে ফেলে শোষণ করতে থাকে। চলতে থাকে প্রতারণা, মিথ্যাচার আর দুর্নীতি। কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় সংক্ষেপে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।

অক্সিডেন্টালঃ এরা ১৯৯৫ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে এদেশে আসে। চুক্তি অনুযায়ী গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মোট ব্যয়ের ৭৭.৫% বাংলাদেশ এবং ২২.৫% অক্সিডেন্টাল বহন করবে। চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, প্রথম দুবছরে ৭৫০ কি.মি. সিসিমিক জরিপ, ৩টি কূপ খনন, পরবর্তী পর্যায়ের জরিপসহ এককোটি ৮৮ লক্ষ ডলারে সমাপ্ত করা। কিন্তু ১৯৯৭ এর ডিসেম্বরে এরা একটি কূপও খনন না করেই মোট ৪টি সংশোধিত ব্যয় বাজেট জমা দেয়।

এছাড়াও যন্ত্রপাতির ওভাররেট দেখিয়েও এরা অনেক টাকা আত্মসাৎ করে। অবশেষে এদের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে ১৯৯৭ এর ১৪ জুন মাগুড়ছড়া গ্যাসফিল্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংস হয় এক বিশাল বনভূমি এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিস্মৃত এলাকার শস্য ও ফসল। ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বন্যপ্রাণীকূল এবং মৎস সম্পদ। (দৈনিক আজকের কাগজ, ২৯.০৪.১৯৯৮)। সর্বমোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞদের মতামত। কিন্তু অক্সিডেন্টাল ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটি পয়সাওতো দেয়নি, উল্টো বিভিন্ন প্রতিকারমূলক কাজের বিপরীতে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ ডলারের অতিরিক্ত ব্যয় বাজেট জমা দিয়ে যায়। সরকারও এক্ষেত্রে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে বিএনপি দিয়েছিল আশ্রয় আর আওয়ামী লীগ দিয়েছিল প্রশ্রয়। দেখা যাচ্ছে সব শেয়ালের এক রা।

শেল-কেয়ার্নঃ বিএনপি প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত হবার পর কেয়ার্নের সাথে ১৫ এবং ১৬ নং ব্লকের লিজ চুক্তি করে। কেয়ার্ন অবৈধভাবে শেল এর সাথে অংশীদার চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এরাও সংশোধিত ব্যয় বাজেটের মাধ্যমে ১০.৮১ মিলিয়ন ডলারকে বাড়িয়ে ২৬৪ মিলিয়ন ডলারে পরিণত করে। ৬ টি কূপ খনন করে ৪টি তে গ্যাস পায় শেল-কেয়ার্র্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে স্ট্যান্ডিং প্লাটফরম নির্মাণ, পাইপ লাইন স্থাপন, প্রক্রিয়াকরণ, টার্মিনাল নির্মাণ সহ সম্পূর্ণ প্রকল্প ব্যয় হতে পারে ৭০-৭৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ এরা শুধু একটি টার্মিনাল নির্মাণ বাবদ ব্যয় দেখিয়েছে ৭০ মিলিয়ন ডলার এবং একটি প্লাটফরম নির্মাণে ব্যয় দেখিয়েছে ৬৬ মিলিয়ন ডলার। ভাগ্যিস এরা সম্পূর্ণ প্রকল্প ব্যয় ২৬৪ মিলিয়ন ডলারের সাথে প্রতিটি ব্যয় আলাদা আলাদা দেখায়নি! তাহলে হয়তো তাদের ঋণ চিরদিন শোধ করতে হত।

নাইকোঃ নাইকো প্রসঙ্গ বহুল আলোচিত বিধায় বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে কেবল এটুকুই বলছি যে, ছাতক (টেংরাটিলা) গ্যাসফিল্ডে এরা খনন কাজ শুরু করার মাত্র দশ দিন পরেই এক প্রলয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটে। জ্বালানী মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়- নাইকোর অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে। কিন্তু নাইকো এবং তাদের এদেশীয় দোসর বিএনপি-জামাত জোট সরকারের নিকট এ রিপোর্ট পছন্দ না হওয়ায় পুনরায় বুয়েটের উপাচার্যের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিও একই ধরণের রিপোর্ট পেশ করার পর বুয়েটের অধ্যাপক কুখ্যাত দালাল ম তামিমের নেতৃত্বে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি রিপোর্ট করে মাত্র তিন বি.সি.এফ গ্যাস নষ্ট হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা অন্যরকম। তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বিবেচনায় ছাতক (পশ্চিম) গ্যাসফিল্ডের সমস্ত গ্যাস কাঠামো বিনষ্ট হয়েছিল। ধ্বংস হয়েছিল ১.৯ টিসিএফ মজুদ গ্যাস। এই গ্যাসের একক প্রতি মূল্য ২.৫ ডলার করে হলেও শুধু গ্যাস নষ্ট হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার। পরিবেশ প্রতিবেশ সহায় সম্পদ, জানমালসহ বিবেচনা করলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। নাইকো কী চল্লিশটি পয়সাও আমাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিয়েছে?

এসব মুনাফালোভী পুঁজিদারদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ। দোহাই দেয়া হচ্ছে আমাদের অদক্ষতার। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে? বাপেক্স-পেট্রোবাংলা কি সর্বাংশে অদক্ষ? তা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে- বাপেক্স-পেট্রোবাংলার অনশোরে দক্ষতা বর্তমানে কোন বিদেশি কোম্পানির চেয়ে কম নয়। এদেশে গ্যাস আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সাফল্যের হার বিদেশি কোম্পানির ৩:১ হলেও পেট্রোবাংলার সাফল্যের হার ২.২৫:১। এছাড়াও নাইকোর ফেনী-২ কূপ, টাল্লোকে বাঙ্গোরায় একটি কূপ খনন করে দিয়েছে বাপেক্স। টাল্লোর জন্য লালমাই এবং বাঙ্গোরায় well cellar survey করে দিয়েছে। এমনকি চাঁদপুরে control point পর্যন্ত স্থাপন করে দিয়েছে। তারপরও শুনতে হচ্ছে বাপেক্স-পেট্রোবাংলা অদক্ষ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পুঁজির অভাবের কথা।  অফশোর ড্রিলিং-এ কত টাকা ব্যয় হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী গড়ে এক বিলিয়ন ডলার বা সাত হাজার কোটি টাকা প্রতি গ্যাসক্ষেত্রের প্রকল্প ব্যয় হতে পারে। এক্ষেত্রে সময় লাগবে সাত বছর। অর্থাৎ গড়ে প্রতি বছরে এক হাজার কোটি টাকা। অথচ আমরা প্রতি বছর বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে উচ্চমূল্যে গ্যাস, বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য ভতুর্কি দেই ৪ হাজার কোটি টাকা। হা ধরণী! দ্বিধা হও। আমাদের নির্বাচিত সরকার কার স্বার্থ রক্ষা করছে?

মহাধুমধামে ঢাকঢোল পিটিয়ে এইযে জনগণের সম্পদ লুটপাট চলছে এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ এদের চরিত্রই এমন। লুটপাটতন্ত্রই এদের মূল দর্শন। আমাদের অচেতনতাই এদের বড় সহায়। ১৭৫৭ তে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ সিন্দাবাদের ভুতের মতো আমাদের ঘাঢ়ে চেপে বসেছিল। ২১৪ বছর যাবত নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেছি আমরাই। ধনিক বুর্জোয়া শ্রেণী, দালাল, মুৎসুদ্দিরা আরামেই ছিল। ১৯৭১ এ রাজাকাররা এদেশকে পাকিস্তান বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আমরা জেগে উঠে দেশ স্বাধীন করেছি। আজ আবার সময় হয়েছে দেশকে অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করার।