শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০১০

দৃক তৃতীয় সংখ্যা (২য় অংশ)

_________________________________________
কবিতা
_________________________________________
আরিফ হাসান


কোডিসিল

১.
অনেক জলের ভেতর এতোটা
দিনের পরো
আজো পাইনিতো কোনো
জল কুমারীর দেখা
শুধু শুধু জলের সামনে
অবিচল বসে থাকা
এতো গান; তবু মন ভালো থাকেনা তো
আয়নায় দাঁড়াই
নিজেকে বড় ক্লান্ত দেখায়
কোনো হা পিত্যেস নেই-
এমনিতেই তো এই একাকী বিষাদ যাপন
হ’তেছে তো হোতেই থাকে
এই ভবিতব্য’তো নিয়েছই মেনে
এই মেনে নিয়ে এই মেনে নিয়ে
আরো কতো কতো কতো দীর্ঘ পাথরকাল
ক’রে যাবো পার জানিনাতো!
তবু ঘুম আসে প্রতিবার রাত ফুরোবার অনেক
আগেই ঘুম ভাঙে; জেগে উঠি গভীর
গভীরতর অস্বস্তি নিয়ে।
অনেক স্বস্তি পেতে গিয়ে’ এইতো বিরহকাল
হোতেছে যাপন।
কতো শতো সম্পর্ক স্থাপনে প্রতিদিন
যায় যায়- সময় বলে কি আছে!
সে তো যায় যায়
বেলা ব’য়ে যায়
বেলা অবেলার ঘাটে
শ্মশানেও শব পোড়া ঘ্রাণ বাতাসে মিলিয়ে
যায়।
জন্ম জন্মান্তরের কতো ফের
তবু এই প্রাণ এই রাতে
জাগেনাতো!
অগণিত মৃত প্রাণ তবু জাগে?
কী যেন বলবার ছিল পরজনমে এই
কী কী কথা যেন তারা ব’লে যাবে।
আমিও মৃত প্রাণ যদি পাই ফিরে এই রাতে!
হৃত প্রাণ! জেগে থাকি ॥

২.
অনেক কাল অনেক অনেক কাল
ঘুমাইনি তবুও জেগে!
কোনো শীতল হাত যদি
এই কপাল ছোঁয়
ছোয় যদি এই রূপার সোনার কাঠি!
জীয়ন কাঠি; -
তারপর ঘুমাই অনেক অনন্তকাল- শীতের সকাল
ঘুমের কাঠি সোনার রূপার জাদুর কাঠি
একটা ঘুমের জন্য দিয়ে দিতে পারি
অনেক রোদেলা দুপুর অথবা যে কোনো
প্রেমময় বিকেলে
অনেক যত্ন কোরে রাখা পুরোনো প্রেমের
স্মৃতি;- সাধন সিদ্ধি সব ॥

৩.
এত আগুন তবু শীত নিবারণ হচ্ছেনা। এই নোতুন বছরে
তোমাকেই ভালোবাসি অনেক নক্ষত্রকাল হোতে। তুমি
আমি কেউই বুঝিনি আমরা। পরবাস বড় অন্ধ পরবাস।
এইতো যাযাবর চাই যদি স্থবিরতা এইতো এসে যায়।
মিথ্যা যাপনে নয় জীবনেও যে বড় সত্য হোয়ে আছে।
এই নক্ষত্র নীল অনাদি আকাশে আমরা সকলে তাকে
ভালোবাসি প্রাণাধিক। এই ছাঁইয়ের মতো শীতল থেকে
গিয়েও পুনরায় জ্বলে উঠতে পারি। তবু এই পোড়োজমি
কেন জানি ভালোলাগে। পড়ে রই বিস্তীর্ণ পোড়ে
রই অনেক কুয়াশা ভেজা দেহে। আর সূর্যকে ডাকি
হে আদিম তুমি আসো আমাকে দহন করো।
আরো কিছু দেহ পোড়া হোক। আমাকে এভাবে
ফেলে এতোটা পোড়াও! কতোটা পোড়াও! যতটা
পোড়ো নিজে তার থেকে আরো জ্বালা জেনেছি
শীতল পরশ ভালোলাগে এই জেনে!

৪.
হে! তুমি শুনতে পাচ্ছো কি! তোমাকে অতিক্রম কোরতে চাই।
যতোটা আঁড়াল কোরেছি ততোটা দ্যাখোনি বোলেই এই
এত দূরে ব’সে আছ! আমাকে স্মরণ করো। যতটা দূরে
গেছি ততোটাই ভালো থাকো। তাই এই দূরে এই নক্ষত্রের
মতো হোয়ে থাকা ভালো।

৫.
এইখানে হৃদয় জমেছে হিম হয়ে। ময়নার ডাক শুনে পিছে ফিরে চাই। রাত্রি। কুয়াশায় অনেক আলো জমে গেছে। হলুদ সাদা সোডিয়াম আলো। এখানে অরূপ দেখি। দেখি মধ্যিখানে ঘুম এসে গেছে। বাদুর তার ডানা মেলে উড়ে যায়। রাত আসে চলে যায়। ঘুম যায় কিছু কুয়াশায় ভেজা রাত্রির ট্রেন। নিজেকে পথিক ভেবে বুকের ভেতর জমা কিছু - চোখে ঘোর জড়তা গতি জড়তায় সামনে বিরাট সবুজ অন্ধকার বিরাট খিলানের পাশেও গুটি হয়ে ব’সে থাকি। ছাই নিভে গেলে দেখি এই দোয়েল চত্বরে ছেড়ে দিয়ে আসি এই ক্রান্তির মহড়া। সেখানেই ফেলে আসি এই বরবধূ খেলা। রঙধনু ধেনু আহা বেনু বাজে - শীতে হিমে কুয়াশায় ঠোঁটে জমে বরফের কুঁচি। চাঁদ জমে যায় আকাশে অস্থির লেখারা জানালার পাশে জমে যায়। আর এই ভরাট কুয়াশায় নিজেকে দেখিনা - দেখিনা নিজের হাত। এই মধুচন্দ্রিমা হবেনা তো - হবে না তো জানি। কুয়াশায় ত্রিশতম মৃত্যু আসিবার কালে ঢলে পড়ে গেছি। ব্যথা নিয়ে এই স্মৃতি জাগানিয়া ক্ষণে আহা ব্যবহৃত হয়ে চলে গেছি এই ঘরাণায়। গরু গাড়ি পদছাপ পথে - হিমেল কুয়াশায় ঘাসে অধিক আলোর কাছে গেলে এই মৃত্তিকা থেকে উঠে আসা কাচপোকা ঘাসফড়িঙেরা গুবড়ে গুমোট পাক খায়। বাতাস এসেছে হু হু এই গতি উদ্দাম অতিব্যুহ ভেদ করে এসে গেছে আরো দূরে চলে যাবার বার্তাবহ সময়েরা। আমি ব্যথা পাই এই ভোরে শুনশানে অধিক জমেছে শীতের হিমের ফল। ঝরে গেছে  বীজ হয়ে তারা ঝরে গেছে। এই ছবি তার ভেসে গেছে জলে - রোদ্রে ভেসে গেছে। আমি এই বারবার মৃত্যু হতেছে জেনেও মৃত্যুকে জেনে নিতে চাই আরো বহুবার। টিপয়ের কাছে কিছু জাল জমে আছে মৃত্যুকে ছোঁয়ে অন্ধকারে চলে গেলে  এই জীবন লাগেনা ভালো। এই দূরে গিয়ে মুক হয়ে পড়ে গেলে এই মৃত্যুর নেশা বড় পিশাচের মতো ঘুমমৃত্যু নিয়ে অনেক বলের মতো ছল নিয়ে বাঁচে আর মদিরায় এক বীর আর তার সেই ঘোড়া সেতো ডুবে গেছে। তবুও কি ভয় পাও পথ ঘোড়া ছায়া হয়ে ছুটে জ্বলিয়া জ্বলিয়া আহা চলে গেলে হেলে যায় রাত। জাননাতো জান এই ধ্বনিত স্বরগুলো নীরবে এই তন্দ্রা জুড়ে থাকে ময়লা জমা দেয়ালের বুকে। কিছু ফেঁসে যায় জ্বলে রোদ। রোদ্রে বুকে জমে থাকে শুধু কথা। আর ঘন্টা কলতান তুমি নীরবে ঘুমিয়েছ তুমি ধ্বসে গেছ এই দীর্ঘ বেতারে তারে জমেছ খেয়ালে জমেছ কথা ভরা রাতের তারায়। আর এই মৃত্যুরে জানে এই অনুহাতে ধরেছি ধরেছি মৃত্যুর হাত। অনুপাত হারে তুমি দূরে আরো দূরে চলে গেছ। ধানমন্ডি। এই জাহাজ বাড়িটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হারিয়ে যাচ্ছি গোপন খেলাগুলো প্রস্তুত হচ্ছে আরো গভীরে যাবার।

আর এই কাহাতক আর ঘুমনিদ্রা তন্দ্রা হতে আরো দূরে চলে যাই এই ফেলে রাখা বেঁধে রাখা এই কান্তিরা জানে এই বোঁধের পাখিরা ছিল চারাক্ষেতে। এখন আসেনা আর এই জলপাই পাখি আর নাই আর এই অনুপরমানুর খেলায় এই ভুলে গেছি এই সবকিছু অন্ধকার ইহাদেরও। ইহারও সঠিক কোন আলোকে ডুবে গেছি দ্রুত গতিলয়ে। এইতো ভোরের মন্দিরে ঘুম এসে গেছে বারবার মন্দিরে এই এসে গেলে গোলগাল একটি চেহারা অথবা সে হুলো সেতো পেঁচারা মতো এই ঘুম ঘুমমেরে জেগে থাকে... আরতো জানিনা, এবার এই দূরতম গ্রহকেন্দ্র থেকে আরো দূরে চলে গিয়ে আরো অতিক্রান্ত হয়ে রাত্রিকে আমি আরো দূরে গিয়ে খোঁজ করি। খুন হয়ে গেছি এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যথাক্ষত নিয়ে বেঁচে গেছি। তবু বহুবার বেঁচে যেতে আছি এই ছিল পিছনে অনেক মৃত্যুর কাহিনি। ওরা চলে গেছে এই ক্লান্তি খাই। জানি এই অবশেষে মৃত্যু জেনেও ব্যবধানে মৃত্যু আছে। এই বেনোজলে ছবি ছিল। নেইতো এই পরাজয় গেঁয়ো মফস্বলী পথ আর হারাইবার যা কিছু ছিল অন্তিম নক্ষত্রের কাছে। এই সোনালি অনুপাতে এই বিন্দু বিন্দু শব্দে সংখ্যায় এসেছে নেমে শীতের মতো করে ঘুরে ফিরে পার হয়ে গেছি। এইতো দ্রাঘিমাচ্যুত হয়ে যাই। এই অপেক্ষারত থাকি অনর্গল যে বাণী শুনি তা অমৃত নয় অমেয় জলের মতো তৃষ্ণা মরেনা এখানে। এখানে হরিৎদেশ ধূসর ছেঁয়েছে এখন - এখানে পড়েছে চাপা এক জোড়া মৃত শালিখের দেহ এই মৃত্যু দেখে এই বদলে গেছি এই হীন যান থেমে গেছে থেমে থেমে যায় এই  তাসখেলি তারা খসা রাতের নিচে নষ্ট দ্রাঘিমায়। এই কর্কশক্রান্তিতে এসে ॥ 


__________________

নভেরা হোসেন
রাতের সিম্ফনি

১.
দৃশ্যগলো বদলে যাচ্ছে
একটার পর একটা টয়োটা,
জি-করোলার মসৃণতা মিলিয়ে যেতেই
গাল থেকে ঝুলে পড়া মাংসপিন্ড
আধহাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে
চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নাও তুমি;
আঠারো শতকের নাগরিক ছাপ-
ফুটে ওঠে চিবুকের কোণে-

নির্মমতা নয় সকালের একরাশ অধৈর্য
তিরতির কাঁপতে থাকে ভলভোর হাতলে
তুমিও চোখ বুজে ট্রেনের স্লিপারে
দ্রুত পার হয়ে যাও শেষ রাতে।

২.
চারপাশে যেমন সব মানুষ কথা হচ্ছে
তুমিও তার সাথে সায় দিচ্ছো;
মাছের পেটিটা ছুরি দিয়ে দু’টুকরো করছ
তারই মাঝে সরসর শব্দে চলে যাচ্ছে
কালো একটা গুঁইসাপ।

__________________

আজহার ফরহাদ


ও পিতামহী, পরমজননী

হিরুকাকার স্টোর থেকে মহেশখালির একটি পান মুখে পুরে তার কথা
মনে হলো---যার কথা মনে হলে বুকে ঝর্ণার উৎসমুখ খুঁজে পাই না।

বিরতিহীন পাথর চাপা ফুল---ও বুক পুষ্পকাননের
যে শুভক্ষণ ফিরিয়ে দেবে হিমতিয়াষার সৌরভ
থেমে থেমে বৃষ্টির ছাট, ছুটে যাচ্ছে পান পরাগের ডিবি
তোমার আপন দুনিয়ার যা কিছু নিঃশেষ, সখা কাতর
বরজ ছেঁড়া পাতা শহরের দোকানঘরে বিড়ায় বিড়ায়
                           পড়ে থাকে সূর্যমুখী ঠোঁটের অপেক্ষায়।

ও মোমের আলোর বেলা, পড়ে যাওয়া শেষ দুপুর---আগমনী সন্ধ্যা
বৃন্তে বৃন্তে যেরকম ফোটে সুপারি ফুল---তীব্র ও কিরকম!
অবসান ঘটাবার আগে হেসে ওঠো, চাপা যৌবন থেকে
একেকটি ক্লান্ত উজ্জ্বলতা মাঝে মাঝে হাওয়ার ঝাপটে
মুছে দেয় দাগগুলি মুখের---মনে হয়
হাতমোজার ওপর দিয়ে একটা অন্ধকার, পাতাল-নিঃস্ব
                                 টেনে নিতে চায় তাকে।

এই সাজ, সিন্দুক চাপা ইতিহাস
উত্তাল সময়ের আছে কিছু গন্ধের নিষ্ঠুরতা---পরামানবিক।
৫.১২.২০০৯
গোধুলি, কলেজরোড, জয়দেবপুর।



তাজিয়া বিলাপ
একটা খোলা তরোয়াল ছিল ঝুল মেখে, দেখিনিতো
তারো আগে মুখ মুশুরীর ক্ষেতে ক্ষত হয়ে
তিনিতো এলেন-একটা সানাই বাজেনি বাজেনি কতকাল
গিয়ে দেখি খুলে সমূহ সম্ভাবনার দ্বার
আঁকা আলতার রেণু-লিলুয়া দুপুরে তার পায়ে।

নিহত ঘুঙুর পেলে হতো, একশিলা পাহাড়তো দূরে আছে টিলা
মরিচের বন ধরে টিয়া পারে না পারে না ছুটে যেতে
কথা কার কানে বেজে ঘরময় ঝুম মেরে থাকে
বাজিয়ে ছোটে না সেই একা কয়েকজনের থেকে একা ঘুঙুরের শব্দ মাখিয়ে।

এ কথাই বলে যাওয়া থাকে আর শেষমেষ কিছুতো বাকী না রেখে
বাতাসের বাস শুঁকে পাইনাতো ঠোঁটের লাগাম
চোখে দেখা মনে থাকেনাতো মনে থেকে ঘুমে থাকে চোখ
কিন্তু নাগাল পাই যার থেকে তার দূরে বসে থাকি।

একটা তরোয়াল খুলে থেকে ভুলে থাকে তাজিয়া বিলাপ
সমর-মাতাল যুগে নাচ নাচ রক্তপামর
একা থাকি কয়েকজনের থেকে একা-দোহাই তোমার।
২.৪.২০০৯
শান্তিনগর, ঢাকা।



শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন
রুমালে রক্তের দাগ
(আনিসুজ্জামান জুয়েল, সাইফুল ইসলাম রতন, ফয়সাল রহমান কিশোর, মঈনউদ্দিন পাঠান- একসাথে হেঁটেছি যাঁদের সাথে)

ও মেঘ, ওখানে কোন শত্রু নেই!
নিষাদের আড়াল আছে
খুব ভালো খরগোস শান্তির জল
ওখানে বৈদূর্য ঢালে।

ও গো তারা, ও কোমল পাতারা, 
ওখানে কোন শত্রু নেই!
বিষাদের ভনিতা আছে
খুব ভালো শুকরপুরিষ, 
পোতাশ্রিত-কফ, লালা- লাশ
ওখানে লেহন ঢালে।

ও বেবুশ্যে নিদ, দেয়াল, 
   ওখানে কোন শত্রু নেই!
মৃত্যুর রগড়ে ভীনজগতের মীড় 
বাজায় পিয়ানো বিষণ্ন অবশ;
লোবান জলের সুরা ফেলে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে

ও শঙ্খশাদা, ওখানে কোন শত্রু নেই!
যদিও যুদ্ধ রয়েছে
খুব ভালো, পদ্মধোয়া জল, ভেষজ আমলা,
স্তনঝরা, আগাম কুমারী দুধ
ওখানে দিগন্ত ঢালে।

ও মেঘ, ও তারা, ও কোমল পাতারা,
ও বেবুশ্যে নিদ, দেয়াল, ও শঙ্খশাদা
ও অন্য জগত মীড়,
পিয়ানো বাজানো বিষণ্ন অবশ, অপেক্ষা,
ও রক্ত কোরক দল

এখানে। গভীরে। আমার তিমিরে। আমার।
গভীরতা। আমার। বিষণ্ন গোপন। বিষ-বাঙ্কার...

বউ
বউ।
চিরোল পাতার পদ্মদিঘীজল। বুকশ্বাস উড়ে যাওয়া। পাখিদের আবার পালক ভাসা- বিসর্জন। নীড়ে ফিরে আসা, ঘুরে ঘুরে আ-চক্র মলিন দিন। ক্রমশ বিলীন চোখ। বউ। ভালোবাসা। আবেগ জানো না, যুক্তি মানো না। বউ! কেমনে শিখাই তোরে প্রণয়ছলাকলা!

বউ! বউ বউ! ডাক তার। ভোরের কাদায়। বেঁচে থাকা সুখে নীলিমা মাখায়। জল,কাদা, ঘুম। বউ। তুমি। প্রতিভাস। সালুনে নুনের চুম, অভাব-বাহাস। অভ্যাস; শুধু অভ্যাস। অভ্যাসের প্রয়োজন। 

ঠাণ্ডা পা, পায়ের ওমে। মিশে থাকা আরো শীত ঠাণ্ডা পা। স্পর্শ। লোম। কালো কালো ঘাসের বাহার। এইতো সেদিন ছাঁটা। মাদুলির কড়া। কেটে গেছে বিবসনা ত্বক। সর্পিল জ্বলুনি। জ্বলে গেলে তবে হোক থুতুর দাওয়াই।

পৌরাণিক সুতাশঙ্খসাপ। ফুঁসে ফুঁসে ওঠা। রোজ রোজ দেখা হওয়া। বিজলি-বিদ্যুত। মহাত্মা দালির গলনাভ ঘড়ি। প্রেমের পরের ব্যথা। দাঁড়িতে আটকানো জড়ি। ‘শরীলের মজা য্যান একলাই বোঝে নিজে! আহালো মরদ আমার!’- সূঁচ ফুঁটে ওঠা। 

সোনাবউ! 
পিদিম জ্বলা ব্যথা আঁধার। চোখবুজে দুর্দান্ত ঘুমে বুকে, দুধের পাহাড়ে ডোবামুখ  ভিজিয়ে ভিজিয়ে ভোরে জেগে ওঠা সোনার মাস্তুল। মুখোশে মেশানো, শিশিরজল জমে জমে থাকা। বউ তুমি সত্যিকথা। 

তারিক মাহমুদ
কবিতায় ভালোবাসার আড়াঁল খুঁজি

নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাই, তাই তো হাসি না। হাসলেই প্রকাশিত হয়ে যাব, তুমি বুঝে ফেলবে আমাকে আর তখন তোমার হাতের মুঠোয় চলে যাবে আমার সব। তাকালেই তোমার চোখে তুমি ভালোবাসার ব্লাকহোল মেলে দিবে আর আমি ডুবে যাব প্রেমের তীব্র অসুখে, তাই চোখ বন্ধ করে রাখি; অন্ধের ব্যাকরণ শিখি একান্ত নির্জণ অন্ধকারে। কথা বললেই শব্দেরা বিশ্বাসঘাতকতা করে তোমার সুন্দর চোখ-চুলের বর্নণায় মাতবে, তোমার ঠোট আর হাসির উপমা খুজবে চাদ থেকে জোসনায়, মেঘ থেকে মোনালিসায় তাই কথা বলি না; বোবার অভিনয় করি, শব্দ ভুলে নৈশব্দের জগতে স্বেচ্ছায় র্নিবাসিত হই বার বার। লিখতে চাই না তবুও লিখে ফেলি তোমাকে নিয়ে এলোমেলো শব্দ, নান্দনিকতাহীন ভুল-টুল ভরা উপমা আর এভাবেই না বলা কথাগুলো হয়ে ওঠে ছেলেমানুষী গদ্য কাবিতা; ভরসা একটাই- তুমি কবিতা পড়না।


আশরাফ মাহমুদ
শ্যাম্পলেন পার্কে

যেভাবে ঝুলে আছো, ঝুলে আছো উদিলা 
ঝাউয়ের বনে রোদ ঘেমে ছায়ার ওম; 
ওসে ভিতরে ধরে আছে নাজুক নির্ঝর- 
রাতুলপদ্মের পপলারে বাতাস কাটে ঘুম 
বিকালে এখানে এলে গোলপাতা জলের গামলা- 
প্রশান্ত কী ভূমধ্য গলে গেছে। টায়রা অধিকারে 
বেঞ্চে স্কার্টবিশেষ  এলোমেলো, অরণ্যে গমনের 
ট্র্যাক কী নিগূঢ়!
অরণ্য কি শহর কাটে, শহর কাটে পাহাড় 
আমি কি তাকে বানাই, সে বানিয়ে খালাস 
পরস্পর সংস্থান করি বুমেরাঙ।


কায়সার হেলাল
শীতকালীন কবিতাপোলব্ধি

১.
...ঘুমপনা তবু জাগিয়ে রাখে আলস্যের শীতে, স্বপ্নের বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটির
সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ক্লান্তি, অতঃপর অস্থিরতা, হাত চালানো আর মস্তক
খাটানার ধকল নিয়ে যায় নৈরাশ্যের বাড়ি, আমিই সে বাড়ির হর্তাকর্তা
অধিপতি বটে, তবু ঘুমপনা জাগিয়ে রাখে আমারে আলস্যের এ শীতে, খড়কুটো
আর পিতার ক্রোধানলের আসন্নতা জিইয়ে রাখে গৃহী এবং মুসাফির-স্বভাবী
স্বত্তার দ্বৈতাদ্বৈত টানাপোড়েন, এমত সংকটে মুই দিনাতিপাত করি আর
বেঁচে যাই কিংবা বেঁচে বেঁচে মরে যাই সকাল বিকাল রাত দুপুর ভোর
সন্ধ্যায়...

২.
গন্ধটা অশ্রুর কিনা ধরতে পারিনি! দুঃখ-কষ্টের জৈবনিক বয়ানে জ্ঞানের
অনুপ্রবেশ কখনো কখনো আপনাকে বিপন্ন করে তুললেও, দিক-দিশা হারানো
আমার মতোন ভার সইতে না পারা গাধারা ডুঁকরে কেঁদে ফেলি! আঙ্গুলের
তড়িৎচালনায় কিছুটা সোঁদা জলের অস্তিত্ব চোখের কোনে গড়িয়ে নেমে পড়লে
নাকে এনে শুঁকে দেখি অশ্রুর কোন সুঘ্রাণ কিংবা দুর্গন্ধ নেই, যা আছে তা
ঠাহর করা যায়না, আবার, হয়তো যদি জাগতিক অভিজ্ঞতা সংশ্লিষ্ট কোন
গন্ধের লগে মিলে যায় অশ্রুজলের ঘ্রাণ, তবে হয়তো নাগরিক উচ্ছাস ক্রমে বর্ণ
হারাবে... বিপরীতও কি ঘটতে পারে?
কে জানে...!

অজিত দাশ
মূর্ত ভাবনা

ঘরমুখী জনতার ভীড়ে দাড়িয়ে একাকি
মনে হয় তুমি আছ চারপাশে, মনে হয় একটি মুখ প্রতিক্ষমান
যে দিকে আমার দৃষ্টি সর্বদা ধাবমান তোমাকে খুঁজে
মুহূর্তে শীতকাতর জলের মতো কেঁপে উঠি
তোমার শূন্যতার দিকে হাত বাড়িয়ে।
অনুভূতিকে চাঞ্চল্যের দিকে ঠেলে দেই
তাই ভেবে যেন নির্জনতা পরভূত হয়ে আমায় মুক্তি দেয়।
স্বস্তির বায়ুতে আর দশটা পাখির মতো
আমি ডানা ঝাপটে উড়তে চাই।

নিরক্ষর
কতদূর এগিয়ে গেলে
এইতো আমার সমাধি ফলকে তোমার পরিচয়
কে তুমি স্পর্শ কর মরণকালের দীর্ঘ সঞ্চয়
কি তোমার নাম?

এখন ভালোবাসার দীর্ঘ সময়ে মৃত্যু নেই,
নেই সময় কেন্দ্রিক ক্ষয়
তবেকি অজিত কল্পনা

নশ্বরে কত কি যায় আসে পুনশ্চ রবীন্দ্রসঙ্গীত
জীবনানন্দ, পুশকিন।
আমি কি তাদের কেহ নই?
তোমার জরায়ু ছিঁড়ে পুনর্বার আমায় জন্ম দাও
ভালোবাসব অনেক দুপুর, নীরবতা।
নিয়ত ফেলে যাই বস্তু ভাস্কর শিল্পের রূপ
তোমার নগ্নতার গভীর বিপন্নে ভোরের নৃত্যে
বিরতিহীন কবিতার পঙক্তি আমি
আমায় লক্ষ কর।

কতদূর এগিয়ে গেলে
এইতো আমার সমাধি ফলকে তোমার পরিচয়।

সম্পের্কের পতিতাবৃত্তি
যখন ফিরে চাইবে বিভক্তির ভঙ্গিতে
প্রত্যন্ত শীতের লাম্পট্য নির্ধারণে ব্যর্থ হবে
নূন্যতম প্রকাশ।
চৌরাস্তায় এই সময়ে তোমাকে বলি যন্ত্রণা
বিভ্রম পৌরুষের নাবালক বীর্যপানে যতদূর যায়
দেখি- উন্মুক্ত ব্যাধিকরণঃ সম্পের্কের পতিতাবৃত্তি।

ব্যাক্তিগত ডায়রি থেকে
দিন দিন পিছিয়ে পড়ি আমার জন্ম থেকে
চারপাশে নতুন ঘর, সোনালি ইতিহাস
সজ্ঞায়িত কতগুলো দালান।
ইটের ধ্বংসস্তুপে পুরনো প্রেম
আনাচে কানাচে প্রেমিক
সন্ধ্যার লিরিকে খুনের গল্প
অতঃপর বহুকাল
দিন দিন পিছিয়ে পড়ি আমার মৃত্যু থেকে।

মধ্যবিত্ত বেরিকেড
এই যে এতটুকু অশ্লীলতাকে বানালে অস্ত্র
ইতিহাসকে বোঝালে অসভ্য চর্চা
খুব জ্যান্ত-জ্বলন্ত কবচকে ঘিরে সন্দিহান
এক ছটাক পরমায়ু, সম্ভাব্যতার লাল কালো
বলের ফ্যাক্টরিয়েল যতটা মিথ্যে নয়
লিখলে না-
বিপ্লবে মধ্যবিত্ত জঙ্গির পাপ!
সীমাবদ্ধ গলনের বাইরে নপুংশক যন্ত্রণা।


অপর্ণা হাওলাদার 
আমি আমার লাশকে স্বীকৃতি দিতে এসেছিলাম 

আমি বহুক্ষণ আমাকে আর আমার লাশকে- 
এক খাটিয়ায় প্রথমে পাশাপাশি শুইয়ে,
আবার দিক বদলে আড়াআড়ি রেখে 
এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে মিলিয়ে দেখলাম।
 কোথাও কী তুলনীয়- 
এরা কোথাও কী পূরক বিম্ব?

শ্মশানে কাটিয়ে এসেছি যে বিগত জীবন 
ডোমজন্মের অভিজ্ঞতায় বুঁদ হয়ে থেকে হিমেল রক্তে; 
আর এই আরেক জীবন এখন 
খুলে খুলে পড়ে গেলো আমার মাংস থেকে
তবু দলিত সময়কে পাঁজরে পারিনা মিশিয়ে নিতে 
সেই সব উচারণ যাদের হওয়ার কথা ছিলো 
অস্ত্রের শিরদাঁড়ায় প্রবল ক্ষত্রিয়জন-
 আমার ঠোঁট থেকে এদিক-ওদিক উড়ে যায় তারা, 
সন্ত্রস্ত চড়ুই যেন- 
লুকিয়ে থাকে ভাঙা ভেন্টিলেটরে; 
কিন্তু পরীক্ষা করে দেখেছিলাম 
আমার আলজিভ ছোট নয় খানিকটাও- 

সেখানে একা খুন হতে চাওয়া আমার আহত ঊরু 
আর আমি;দেয়াল খামচে থাকি বোবা কব্জিতে, 
আঘ্রাণে বুঝি,দেয়ালের ওপাশেই গা ঘেঁষে- 
আছে সত্য শস্যসূর্যের বীজ অম্লান মানুষ। 
কেবল এপাশে নেই- এপক্ষে নেই
আমাদের বুক থেকে চুরি গেছে যা 
দেয়াল ভাঙার মতো স্বচ্ছ জারন; 
তাই তুল্য পারদে বিষাদ-লোক; 

এখনও নয়। 
মৃত্যুকে স্পর্ধিত ইশারায় দেখে;জীবন 
এখনও নয় ততোটা মুখর।


খালেদ চৌধুরী
গোলাপি টিস্যু

শিশির ধরা খেয়ে
কারাগারের আঁধারে
পরিমান মত ভেজালের সাথে
বহুজাতিক কম্পানির দানাদার পুঁজি।
মিষ্টি বিষয়ক স্বাদের হাহাকার
জিহ্বার অসংখ্য ছিদ্রে
শিশুর মত কাঁদছে।
তাওহিদাকে জিজ্ঞেস করি
মানুষ গরীব হতে চায় না কেন?
রিমোট টিপলে চ্যানেলের মত
নির্দিষ্ট মানুষগুলো পাল্টে যায়।
সবকিছু পাল্টানোর জন্য
ঘড়ির কাটাই কি দায়ী!
রোদন জমা করে উপহার পাঠাই
বাক্স ভর্তি গোলাপি টিস্যু।


বিজু সময়
বৃষ্টি কথা 

একদিন,অন্যদিন,সব দিন, 
আজ সারা দিন বৃষ্টি ঝরে। 
বৃষ্টি মাঝে লুকিয়ে ফেলি 
যাকে মানুষ বলি। 
হারিয়ে যাবার পথ খুজি 
হারাই ধুলো বালি 
বাঁকা চাঁদ পথ দেখায় 
চেনায় বাড়ি। 
চিনতে পারি জমে 
থাকা মাটির উপর 
তেতলা বাড়ির বারান্দায় আমি। 

মাহমুদ কচি
নবান্ন তোমার গাছপালা গুলো
একদিন অপরাহ্ণে
শিমুল পলাশের
সঙ্গে ছিলাম
ততদূর দৃষ্টির দিগন্তরেখা
তারপর সামনের পথ
দুচোখ মেলে দেখলাম
ডালপালা পাখির ডানা
খুঁজতে খুঁজতে অপরাহ্ণের চিঠি
ঠিকানাগুলো কালির সবুজ
আমি তোমার সুন্দর চোখে
চোখ রাখলাম
শেষ পর্যন্ত দাঁড়ালাম
পথ ছেড়ে
দেখলাম নবান্ন তোমার গাছপালা
আর যেন সে এক
বিকেলের সুদীর্ঘ চিঠি!



ফয়সল অভি
পলাতক সমুদ্র 

বাড়ন্ত যৌবনবতীর কোলে পাড়ার লোকের কৌণিক ছোবল 
দৃষ্টির বিকলাঙ্গ ধারায় ভেংচি কাটে স্বতন্ত্র নির্বাক সংবিধান 
তবুও শিরায় উপশিরায় গিরগিটির প্রবাহ পাহারা এড়িয়ে 
সমুদ্র অতলে একদৃশ্যে দিয়েছি মনযোগ;
দূষিত আর্তনাদ মিশে মোহনার শব্দ সাঁতার শীতল কাব্যে 
ক্রমবর্ধমান যুগের লকলকে আশাবাদ, 
কানে বাজে সমান্তরাল স্রোত পরিচিত সেই ছন্দ 
আহত বাঘিনীর ঢেউ থেকে আচড়ে অন্তহীন নিস্তেজ হুঙ্কার; 
অঘোর ঘুমে জাগা সূর্যটা সন্ধানী জলের গায়ে উত্তাল নাচে 
কখনও সন্দেহ উকি দেবতার চোখটা রূপালি হলে 
সামগ্র অঞ্চল জীবন্ত এক আয়নায় উপলদ্ধি যেন 
আজকাল প্রতিফলনও কালাজ্বরে আক্রান্ত 
বয়ে আসা রক্তবাহীর পুষ্টিহীনতা ও দখলে। 
নিঃশ্বাস জব্দ করে স্বনির্ভর পালে আজন্ম বাতাস 
কই!! কোথাও তো জানা রাজ্যের উদ্বৃত চিহ্নই নেই, 
দলিলের সেই পৃষ্টার খোঁজে এখন কি ঐতিহ্যে যাবো? 
তবে অপরিকল্পিত কয়েকটা রেখা পাশাপাশি বিধ্বস্ত পুড়ে পুড়ে 
গুপ্ত কালের ছলাকলায় পরিণত জমাট আজ শুধুই সাক্ষী, 
দৃশ্যত প্রকৃতির সন্তানগুলো সমকাল কাটা ঘরে 
অবশেষে বেওয়ারিশ হয়ে দাফন সভ্যতার লোভ কবরে, 
পরবর্তী মঙ্গলবার সকাল- 
হলুদ নীল সাদা কাগজে থৈ থৈ জ্বলন্ত শিরোনাম; 
“জন্মান্ধ কনভেশন দানবে বন্ধ্যা হয়ে পলাতক আমাদের জল-খণ্ড”

শিশির রাজন
অনিয়ম

উদ্বাস্তু শিবিরের পাশে ক্লীষ্ট শবের মুখ।
পৃথিবীর তাবৎ অনিয়ম এসে
গিলে খায় আলোকিত দ্বীপ,
লুটেরাদের ছোবলে আহত সভ্যতা
গোলকধাঁধাঁয় সাধের সংস্কৃতি।
অশরীরীয় আত্মায় ভর করে চলে
রুগ্ন সমাজ।
শরীফ খিয়াম আহমেদ
ঈশ্বরের লেজ আছে কিনা জানা হয়নি

আঁধার নিবাসী ফেরারী সত্ত্বার হাহাকারে
সম্বিত ফিরে পাওয়া অতৃপ্ত আত্মারা একদিন
মশাল মিছিল নিয়ে স্বর্গের দুয়ারে দাঁড়ালে
কপাট আটকে কি রেহাই পাবে তুমি...?
যদি তারা বিচার করতে চায়,
কাঠগড়ায় দেখতে চায় অদৃষ্টকে
এতদিন নরকে রাখার প্রতিবাদে
যদি খুন করতে চায় তোমায়
বা ফাঁসির দণ্ড দেয়, তবে
কিবা বলার রবে...?
এরপর যদি তারা স্বর্গটাকেই তোমার
শশ্মান বানাতে চায়
বানরকে নির্বাসিত করে তোমাকে,
মেনে নেবে...? নাকি নামবে শক্তিচর্চায়...?
লড়াইয়ে নামতে লজ্জা করবে নিশ্চয়ই
কিন্তু ওরা যে ততক্ষণে স্রষ্টার
ধোঁকা ধরে ফেলেছে
আত্মদন্দ্বের ভয়ে আবার
লেজ গুটিয়ে পালাবে না’তো?
অবশ্য ঈশ্বরের লেজ আছে কিনা জানা হয়নি...।

অথচ সে খরা আজও কাটেনি
কুয়াশার কম্বল জড়ানো নিশাচর পৌষে
মরু গুল্মের তলে লুকানো
রক্তাভ নদীর কিশোরী জলেরা
জলোচ্ছ্বাস হওয়ার বাসনা পুষে
সাঁতার কাটতে ডেকেছিল...।
সেই ডাকাতিয়া আহ্বানে
কেঁপে কেঁপেই ক্ষান্ত অতৃপ্ত ইচ্ছারা
সশব্দে ঢেকুর তুলে
ঘুমের আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে ভেবেছিল
উদ্বাস্তু-উপবাসীদের সাঁতার কাঁটতে মানা...।

প্রথাবিদ্ধ অনধিকারের জালে
শুধু মধ্যবিত্ত মাছেরাই ধরা পড়ে জেনে
সুদূর অতীতেই একদিন
শুরু হয়েছিল বন্দীত্বকে জানা,
অবশ্য বুঝিনি তখনও
ফাঁদের কোলে বসেই নিশ্চিন্তে ফাঁদ খুঁজেছিলাম...।

তবু যে কেন জলের হাতছানি অগ্রাহ্য না করে।
তাকিয়ে থাকা তৃষ্ণার্ত বালক
চেয়েছিল সাঁতরে বেড়াতে...
তা’ও সুইমিংপুলে নয়;
আশ্রয় চেয়েছিল অভিজাত নদীটায়...
হয়ত আশা ছিল মন ভরে ভিজবে আর
ডুব সাঁতারের তোড়ে ভাঙবে দু’কূল,
অথচ সে খরা আজও কাটেনি।


মাইনুল ইসলাম
খসড়া

এই শীতে এই হিমে পাখিরা ছেড়েছে নীড় অথবা উড়ে গেছে কোন দূরতম দেশে যেখানে বিচরণ ছিলনা তোমার। ছিল গভীর রাতের ক্রন্দন, মাটির কাছাকাছি শুয়ে মুহুর্তের বিভ্রান্তি আমাদের পথে, বিচ্যুতি মেনে নাকি মেনে নিতে হয় বলে; অনেক কালের ক্ষরণ আজো বুকে জমে আছে, যেখানেই গিয়েছি শুনেছি তোমার ডাক; নির্বাক থেকে থেকে আমাদের মগজে গেঁথে গেছে না শুনার ডাক অথচ আমরা নই কোন কালের মায়া; পৃথিবীর পথে পথে ছড়ানো রক্তবীজ থেকে উত্থিত আমাদের প্রাণ, বহুকাল দুলেছি বকুলের শাখে বহুদূর গিয়েছি হেঁটে তোমাদের পথে এই জন্মান্তরের হিসেব মেলাতে অথবা মেলেনি হিসাব; তবু পথের পারে তোমাদের আহ্বানে এসেছি আবার। জেনে নিও কালের আঁধারে নিজের চিবুক চিনে নিতে কখনো হয়নি ভুল ... এই পথে এই ঘুমে কোন মৃত্যুর দেশে নয়; মনে হয় জেগে আছি কখনোবা ঘুমে; তবু এই পথ এই নদী তোমাদের বসতি... থেমে থেমে নিরবে কাঁদা অতপর গিয়েছি আপন ভুবনে সাপের মতো দেহটাকে টেনে এই ঘুমে এই জাগরণে।


আতাহার সজীব
চোরাবালি

যেন চোরাবালি
দিন আসে দিন যায়
রাত আসে রাত যায়
দিনরাত আসে যায়
পাশাপাশি
কোন কিছুই পূর্ণ হয় না
কোন কিছুই তৃপ্ত হয় না
সৃষ্টি হয় অভাব
সৃষ্টি হয় চাহিদা পাশাপাশি
প্রয়োজন অশেষ
পূর্ণ হয় যতটুকু চাহিদা
সৃষ্টি হয় অভাব
আরও বেশি
কিছু নয়
যেন চোরাবালি।

প্রেম
উদার এ আকাশ
উদার এ জগত
উদার মানুষ জন তার
এদিকে ভালোবেসে
দোয়া পড়া হয়
নাকের গোড়ায়
শ্বাস চলে আসে
যখন তার।

প্রেক্ষিত
মুসাফির জেনেও
আমাকেই বলা হয়
অথচ আমিতো
ঈদের চাঁদ নই
আমার থেকে
আনন্দ ছড়িয়ে
পড়বে কিভাবে
কিন্তু আমি ভরসা
পাই কথা দিবার।

খুনি
রাখালের মত
মনকে চড়িয়ে
বেড়ায় টাকা
অথচ ওজর ধরে মন
সামর্থের কাছে
হেরে যায়
অথচ থেমে
যায় না
এগুতে হয়
কিন্তু হেরে যায়
কারণ রাখালের মত
মনকে চড়িয়ে
বেড়ায় টাকা।

স্পর্ধা
আমি তো ছাই নই
যে আগুনকে ভালোবাসব
আমি তো মহান নই
যে দুঃখকে সেচে নিব,
আমি হলাম সেই
অবুঝ মানুষ
যে ধুলো হয়ে
সূর্যে পৌঁছাবার
ইচ্ছে পোষণ করে
বারবার ভুল করি
আমি সেই মানুষ
যে প্রতি মুহুর্তেই
গুনন করে চলি ॥


তানজীম আল বায়েজীদ
সমাধিগাথা
(শহীদুল জহিরকে মনে রেখে)

রোদ্দুরমাখা পাপে যে পেয়েছে নতুন জন্ম
নির্বাসনের অন্তহীন যাত্রায় দগ্ধ মাঠে মাঠে
চেনা অচেনা পথ উঠে গিয়ে বাগানে তার
বৈশাখি তৃণের  হ্রস্ব ছায়া, অনর্থক লাবণসাগর।

মৃদুগুচ্ছ শিষে, চাঁদ ঝিলমিল গঞ্জে-হাটে
বৃত্তাকারে ঘোরে যখন আলস্যের মৃতভাষা
একাদশীর অপয়া স্রোতে শ্বেত ধোঁয়াশায়
শব্দ করে শেষ মুক্তির ধুতুরা ছাওয়া নিদ্রা।

দিনের মধ্যযামে, নির্লিপ্ত প্রতারণার ভাপে
ঝেঁপে আসা বৃষ্টির সুঘ্রাণ আগুনপেয়ো জল হয়ে
সৃষ্টির প্রবল অধিবাসে উচ্ছিষ্টেও জাগায় আহ্বান,
বৃক্ষের মজ্জায় লকলকে তখন পুষ্পের স্বাদ।

ছাঁইচাপা বিভ্রমে অনাঘ্রাতা পুরুষের অমাঙ্গলিক বাঁশরি
অক্ষরেখায় টানে বুনোট বিবমিষা বৈধব্য
অকাল সংহারী মন্ত্রে শোকযাত্রা শেষে
বিকেলের ছায়ায় আঁকা থাকে নির্জন ঈগলের চোখ।


অথই নীড়
কেমন জানি বদলে গেছি

আমার গ্রামে জোছনা ফিরবে বলে মেঘের পাখি সেই খবর
দিয়ে যায় আমায়। কল্পনার নক্ষত্রগুলো ছড়াছড়ি করে বৃষ্টির।
প্রাচীন রূপকথার মত নানা মেঘের রং-এ তুমি ফুলের পাঁপড়ি
ফুটাও। শাশ্বত তুমি তো জাননা আমার অভিমানী আয়ু
কবেই নির্জনে আকাশের সাথে বিনিময় করেছে বৃষ্টির
লোভে। তাই মনকে আর ধরে রাখতে পারিনা মেঘবন্দী গ্যালারির
মধ্যে। ধূসর সমুদ্র আর ছায়া ছায়া পাহাড়ের মত ডানা ভরা
স্বপ্ন নিয়ে হারাই সমুদ্রচিলের কাছে। তা সত্ত্বেও ‘My soul
relation between you’। কেননা অহংকারী প্রেমকে নিয়ে আর
রোদে রোদে হাঁটতে ভালো লাগেনা। তাই নিঃসঙ্গ জোছনায়
হারিয়ে যাই না ফেরার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। আর কিছু এখন
আর টানে নারে বন্ধু!

অদ্বিতীয়া সিমু
জ্বালাময় সুখ

এখানে আবেগ নেই, এখানে আলো নেই,
আছে নিঃশব্দ অন্ধকার।
নগরবালার ইয়াবা হাতে জিউসকে আহ্বান।
এখানে নগ্ন সুখের ফোয়ারা,
কামাতুর অসুরের আনাগোনা,
টিউব লাইটের কষ্ট নামের নীল আলোয়
প্রসব করে মেকী সুখের ফোয়ারা!
ওহ্‌! নিঃশ্বাসের কি যন্ত্রণাময় ঘ্রাণ!
অ্যালকোহলের কড়া ঝাঁঝে
সে কী চিতার সুখ!
অনন্ত জ্বালাময় সুখ...
আর সুখ।

____________________________________________________________
গল্প
____________________________________________________________

ঘাসপাড়ে বৃষ্টি নেমে কাদা
আশরাফ মাহমুদ

১.
কপালে নয়ন তুলে আকাশ পানে তাকালেই বৃষ্টি থেমে যাবে না। জ্বি। আজ আমাদের মনের পুষ্করণীতে বৃষ্টি-মাদলে তবলার সুর তোলার দিন, মিছে চোখ রাঙাচ্ছেন কেন? আপনার জন্য ভিন্ন কিছু হতে পারে বৈকি; মাঘ মাস সবার শরীরে এক প্রকারে ধরা দেয় না। মাঘ মাসের চিলেকোঠা শীতে কেউ শীতস্তম্ভের কম্বল গায়ে শুয়ে থাকে, কেউ ফি রবিবারে হাঁসের মাংশ ভোজনের উৎসব করে। আপনার জন্য আজ সব-কিছু-চুলোয়-যাক দিন হতে পারে, আমাদের বিবিধ আনন্দের দিন। ঘাসপাড়ের পুরুষ কিংবা মানুষদের সাথে আপনাদের স্বয়ংক্রিয় নাগরিক জীবনের ব্যস্ত পার্থক্য থাকা অপ্রিয় কিছু নয়। 

আপনি নাকের লোম ছিঁড়ে অফিসের টেবিল কুরুক্ষেত্র করে ফেলেন নির্বিষ দুপুরে ভাতঘুম না দেয়ার কষ্ট ভুলতে। সেটুকু ব্যর্থ আস্ফালন আপনাকে উৎসুক করে রাখে তা মুখ দিয়ে খিস্তি আকারে বের হয় বিকালের বাস ধরার সময়, আমি জানি। আপনি বিরক্ত মনে হয়ত বানরের সাথে মানুষের বিবর্তন-যোগসূত্র অনুসন্ধান করেন; কিংবা নিয়ম বহির্ভূতভাবে সিগারেট ধরিয়ে জাতির হাত-পা লুলা করে দেন। আমরা যারা ঘাসপাড়ের লোকজন তারা নিরসবদনে উন্নাসিকতার কোরাস গাই, আমাদের প্রথাগত জীবনের জন্য ঈশ্বরের শ্রাদ্ধ করি!

চোখ লাল করেছেন কেন? কথা কানে না দেয়া তো আপনাদের কাছে ভোজনপর্ব শেষে ন্যাপকিনের শরীর বিষাক্তকরণের মতন ব্যাপার। আমাদের কথায় মনকষ্ট পাবেন না। ঘাসপাড়ের লোকদের চামড়া ভারী হয়। অন্যের দুঃখ, কষ্ট তাদের কাছে তুচ্ছমূল্য। 

২.
ঘাসপাড়ের চরে নতুন যাত্রীবাহী লঞ্চ এসেছে। পালা করে নামছেন অভিজাত শ্রেণীর রঙ প্রতিফলন করা সাদা লোকেরা। বাতাসে, পাড়ার চায়ের দোকানে শোনা যাচ্ছে বনভোজনের কাজটি সাহেবরা এবার ঘাসপাড়েই করবেন। 

কিন্তু নির্বিচারি বৃষ্টি তাদের আয়োজনে জল ঢেলে দিয়েছে। জলের প্রবাহ সবার সহ্য হয় না, জলে কেবল নবীন মীনদের উল্লাস মানায়! স্থলের বাঘদের সাথে জলপ্রবাহের মৌন আড়ি অটুট আছে। 

৩.
কায়েস সাহেব রোদ-চশমার মধ্য দিয়ে তাকালেন। এবং তার চোখে ঘোর লেগে গেল। হাসির মতো ঘোর-ও সংক্রামক জিনিস, তবে ঘোর ভঙ্গ হয় হঠাৎ। ঘোর ভাঙানোর জন্যই কিনা তিনি রোদ-চশমা খুললেন, আশপাশে ব্যস্তদৃষ্টিতে তাকালেন। কিশোর বয়সে ঘন ঘন প্রেমে পড়ার মতন তিনি বিহ্বল চোখে সবকিছুর দিকে তাকাচ্ছেন। এই চরে একটা জায়গা কিনে ফেললে কেমন হয়? বছরে একবার এলেও সুদাসল অর্জিত হয়ে যাবে। না, কায়েস সাহেব ব্যবসাসংক্রান্ত ভাবনাকে তালাক দিয়েই ছুটিতে এসেছেন; চিন্তার ডালপালা দ্রুত বেড়ে ওঠে- তিনি মূলুচ্ছেদ করে দিলেন। 

কে যেন ছুটে আসছে। কায়েস সাহেব শব্দের উৎপত্তি-স্থলের পানে চাইলেন; লুঙ্গি কোমরে বাঁধা একটা লোক! না, একজন না, আর-ও অনেকে। 
"আপনেরা কারা?" হাতে বাঁশের লাঠি ধরা লোকটা বলল। মনে হচ্ছে সেই সর্দার। 
"আমরা ছুটিতে এসেছি।" 
"কয়জন?" 
"পঁচিশ জনের মতো হবে। আমার বন্ধুরা, তাদের পরিবার।" তখনই কায়েস সাহেব ভুলটা বুঝতে পারলেন। তিনি লোকটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন অবলীলায়। "আপনারা কারা?" কায়েস সাহেব সরু চোখে তাকালেন। 
"এটা আমাগো চর। এখানে আমরাই থাকি। আপনেরা কয়দিন থাকতে চাইলে থাকেন, মাগার ফাল দিয়েন না।" কথাটা বলেই যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেল লোকগুলো। 

৪.
ঘাসপাড়ের মানুষদের অর্থাৎ নারী, পুরুষদের মাঝে নতুন হুজুগের সঞ্চারণ হয়েছে। পুরুষরা বেলে মাথায় শৈত্যরোদ উপভোগ করার আয়োজন করছেন, সবাই ন্যাড়া হওয়ার জন্য ঐক্যহন্টন করে সমাবেত হচ্ছেন পাড়ার নাপিত দোকানে। সেখানে নানাবিধ মহাপোন্যাস কিংবা মহাকাব্য প্রসবিত এক দিনরাতে। পুরুষদের শীত-নিবারণ-জিনিস নারীরা এবারের শীতে আরো তাপ ধরে রাখার প্রতীচ্ছা রাখছেন। নারীগণ কাঁথায় জীবনসংগীতের সুর তুলছেন প্রথাগত উৎকর্ষতায়! 

ঘাসপাড়ের সবখানে প্রাণের জাগরণ এই শীতে! বসন্তবিলাসী মানুষদের একহাত দেখিয়ে দেয়া বীরত্বের প্রদর্শনী বৈকি। 

৫.
রাতে কায়েস সাহেব তার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। তিনি এই চরে বিলাসঘর নির্মাণ করবেন। নিগূঢ় কারণ কেউ না জানলেও সবাই প্রতিবাদ জানাল, প্রত্যেক বছর এখানে পদচিহ্ন রাখতে আসা অসম্ভব। রাগমোচন বারবার হওয়া সন্দেহজনক।

প্রতিটি জিনিসের অবতারণার সাথে সাথে দু'টি পক্ষ সৃষ্টি হয়ে যায় অবলীলক্রমে। কায়েস সাহেবের পক্ষে ক্ষীণ সমর্থন জানাল তার কন্যা বৃষ্টি। পিতারা একচোখা হন- কায়েস সাহেব মেয়ের এই সমর্থনে বলশালী হলেন এবং অটুট থাকলেন সিদ্ধান্ত ব্যস্তবায়নে। 

কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলেন এখানকার জায়গা, জমি সমবায়ের মাধ্যমে বণ্টন করা। কিনতে হলে পুরো চর কিনতে হবে, নতুবা কিছুই নয়। আর সেটা সম্ভব হবে না, যারপরনাই সন্দেহ প্রকাশ করলেন কায়েস সাহেব; কারণ, উচ্ছেদের সূক্ষ একটা সীমা আছে। 

তিনি সেই সর্দার লোকটিকে বললেন তাকে এক টুকরো জমি ছেড়ে দিতে, টাকাপয়সা কোন ব্যাপার না। তাছাড়া, তিনি এখানে অনেক কর্মসংস্থান করবেন, দুবেলা পেটপুরে খাবে মানুষগুলা; নবান্ন-উৎসবে শুধু ভাত খেলে চলে না। 

মানুষের একটা বিচিত্র অভ্যাস হল সহজাত শ্রেণীবিন্যাস করা। ফলস্বরূপ, সেই সর্দার লোকটির কাছে কায়েস সাহেব কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে ধরা পড়েছেন। তিনি জমি পাবেন না। 

৬.
হয়ত শুক্রবারে শ্বশুরবাড়ি-দর্শন করার মতো অফিস ফেরত আপনার মনে উদয় হয় সপ্তাহান্ত উদযাপনের বিবিধ চিন্তা, আপনি উধ্বর্তন কর্মকর্তার আগ্রহ টানতে আয়োজন করেন ভোজন-উৎসবের; যেখানে উদীয়মান কথাশিল্পী হয়ে উঠেন স্বয়ং কর্মকর্তা, আপনি হয়ে উঠেন গোসলখানার নিরাপদ কবি, কিংবা কর্ম-কর্তার স্ত্রী হয়ে যান রাগ-বেরাগের এক টুকরো শিল্পী। আপনি উল্লাসে-কামে-আনন্দে বিমোহিত হয়ে যান এবং আপনার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে এক-একটি ধর্ষণিক বাংলাদেশ। 

৭.
কায়েস সাহেব পরদিন সমবায় সর্দার রণবীরকে ডেকে পাঠালেন। তিনি কতিপয় বাসন্তী উপঢৌকনসম টাকা ও শহুরে আবাস-স্থানের বড়শী ফেললেন, আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল রণবীর ধরা দিল না; অপারগ হয়ে কায়েস সাহেব দ্বিগুণ লোভ হাঁকালেন, এবার-ও খেয়েদেয়ে মাছ পালাল। কায়েস সাহেব এইবেলার জন্য ক্ষান্ত দিলেন। 

বৈকালিক উজ্জ্বল আকাশের নিচে তিনি দ্বিতীয় নাক্ষত্রিক মেয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে দ্বীপাঞ্চল দেখতে বের হলেন; সারি সারি কাশবন দেখে আনন্দে আত্মহারা হল বৃষ্টি। তার মায়ের একটা হলদে পাড় দেয়া সুবজাভ সাদা শাড়ি ছিল, তবে সেই শাড়ি দিলখোলা উড়তে পারতো না বেখেয়ালি বাতাসে; কাশবন দোল খায়, বৃষ্টি দোল খায় মনমন্দিরে। দক্ষিণ দিকে সারিবন্ধ ঘর, অনেকটা বর্গাকারভাবে; মাঝখানে মানানসই উঠান। বৃষ্টি দেখল অনেকেই খেলছে- চোখ বাঁধা একজনের, অন্যরা তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি বাবার আদুরে ধমক উপেক্ষা করে ওদের সাথে খেলতে গেল। অথচ পোনামাছের মতো জলে আলোড়ন শুনে ভীষণ আত্মমগ্ন বালকবালিকারা খেলা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টি ভগ্ন হৃদে সরে আসে। মাটির দাওয়াই বসে কতিপয় নারীরা চুল বাঁধছে পরস্পরের, কেউবা স্বামীর মাথা থেকে পক্ক-অর্ধপক্ব চুল তোলার মতন ডাল-শস্য থেকে ময়লা বেছে ফেলে দিচ্ছেন। বৃষ্টি সাময়িক অতিথির দোহাই দিয়ে মেজবানদের কাছ থেকে নিজের সংসারিক চুল বেঁধে নিল, বলা চলে সে শিখে নিল। 

কায়েস সাহেব বাঁশগাছ-লম্বা-দূরত্বে দাঁড়িয়ে সবকিছু অবলোকন করলেন, তার ঠোঁটের কোণে সহজাত ব্যবসায়িক হাসি ফুটে উঠল! 

৮.
আপনার বগলে মানুষ্যত্বের বাল জমে, অপবিত্র জিনিস বেশি দিন শরীরভিটায় রাখতে নেই; আপনি চেতনার উৎপত্তিস্থল ঠিক রেখে মানুষ্যত্বের সব ধুলা ঝেঁড়ে ফেলেন। ঘাসপাড়ার মানুষ উল্টোটা করে; বৃষ্টির জলে ভিজে তারা শরীরের ময়লা ধুয়ে ফেলে, মনুষ্যত্বের উৎপত্তিস্থল বগল নয়- নীতিধারক মস্তিষ্ক। আপনার উচ্চমধ্যবিত্ত মেজাজের সূচনাস্থল ইংরেজ সাহেবের গোমস্তা আপনার দাদামশাই চৌধুরী সাহেবের কাছ থেকে; আপনি জানেন না যে বিবর্তন কোনকিছু ধ্বংস করে ফেলে না এক পলকেই, ক্রমশ পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে। 

আপনি নিজের গায়ে হাত বোলাতে ভালবাসেন না, আমরা জানি; নতুবা বাক্সবন্দি স্বপ্ন নিয়ে পথে নামা মীনাক্ষীর গায়ে আপনার অবাধ্য হাত উঠতো না; আপনি দেবতার শরীরে আঙুল বুলাতে আগ্রহী এবং দেবতাদের উন্নাসিক বলেই জানি আমরা। 

৯.
পরদিন সকালে ঘাসপাড়ার লোকদের ঘুম ভাঙল ভীষণ কলরবে। বাতাসে গুজবের হাত-পা-ডানা। কালরাত্রে রণবীরকে কয়েকজন আক্রমণ করেছিল বাঁশঝাড়ের কাছটায়। বাঁশঝাড় জায়গাটা নিরীহ হলে-ও এখানে এসে মানুষজন দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে, এটা প্রচলিত সত্য। রণবীর মধ্যাকাশে করূপুরুষ থাকা সময়ে মিরাজের দোকান থেকে সিগারেট কিনে বাড়ি ফিরছিল, অতর্কিত হামলা করে জনা তিনেক  লোক, তাদের মুখমণ্ডল মুখোশে ঢাকা ছিল। উত্তম-মাধ্যম মার খেয়ে মাটিতে ঢলে পড়ার আগে রণবীর শুনেছিল একটি বাক্য- 'শালা, আপোষ মানতে শিখ।' 

বস্তুত, রণবীর এখন জীবনাত্মার সাথে আপোষের চেষ্টায় আছে, থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠছে তার বেলেমাটিসদৃশ শরীর। ডাক্তার নেই এই দ্বীপে- মাইল পঞ্চাশেক দূরে বাওতালি গাঁয়ে মতলব ডাক্তারের চিকিৎসালয়; নওজোয়ান মাঝিরা অবিশ্রান্ত দাঁড় টানলে-ও সাঁঝের আগে ডাক্তারের টিকিটি মিলবে না। এখন জলচিকিৎসা ও ভেষজচিকিৎসা চলছে। 

দুপুরের দিকে টের পাওয়া গেল রণবীর এবার হয়ত পটল তুলবে। কায়েস সাহেব এলেন বৃষ্টিকে নিয়ে। বৃষ্টিকে দিয়ে তিনি প্রস্তাব দিলেন যে তার লঞ্চ ব্যবহার করে দ্রুত সদরে যাওয়া যাবে, তিনি সোহার্দ্যের খাতিরে এইটুকু করতে দ্বিধাবোধ করবেন না; মানুষকে তিনি কাছে রাখতে চান। 

সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে রণবীর সাহায্য নাকচ করে দিল। সে দাওয়াই’তে শীতলপাটি পেতে শুয়ে থাকল। উঠোন লাগোয়া অশ্বথ গাছে পাখিদের আনাগোনা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে পাখিসকল পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে; রণবীরের চোখে নেমে আসে রাজাপ্রজাঘুম। 

১০.
'বাজান, ভাত খ্যাইয়া যা।' রাতের শরীর ছিঁড়ে আপনি বাড়ি ফিরছেন রূপবতী রিকশায় করে আপনার গ্রামীণ মায়ের কন্ঠস্বর কলনা করে, আপনার গাড়ির কাঁচ ভেঙে গেছে বছরের প্রথম শিলাবৃষ্টিতে! অন্ধকার ডাস্টবিনগলি পার হওয়ার সময় আপনি ডুঁকরে কেঁদে উঠলেন; অন্ধকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে আপনার জীবনে এল প্রথম শুভ্রবৃষ্টি। 

১১.
রণবীরের স্ত্রী পাঁচ মাসের পোয়াতী, কাজেকর্মে ভীষণ রকম জড়তা এসে গেছে। রণবীর মাঝরাতে শায়লার পেটে হাত বুলায়, মৃদু চাপ দেয়; তার হর্ষ লাগে। একটা ছেলে তার দরকার। পাড়ার অনেকেই তাকে সর্দার হিসেবে মাছ-শস্য ইত্যাদি থেকে কিছুটা ভাগ দেয়, কিন্তু শরীর নরোম হয়ে এলে কে পুষবে তাকে। মেয়েটা এমন সরল হয়েছে কথা বলতে গেলে মরমে মরে আসে। 

রণবীর আনমনা জেগে থাকে। মাঝে মাঝে কলতলায় গিয়ে মাটির পিঁড়িতে বসে থাকে, আকাশ দেখে, তারাফুল দেখে। শায়লা আধ-ঘুমন্ত বিছানায় হালকা নড়াচড়া করে, ক্যাঁচ-ম্যাঁচ শব্দ হয় বেতের খাটে। 

রণবীর বসতে আসে কলতলায়, আজ আকাশ শূন্য। চারধারে গহীন অন্ধকার। কলতলায় কে যেন বসে আছে, পানির শব্দ হচ্ছে। রণবীর সতর্ক পায়ে কাছে যায়। শিউলি, লোকমানের বউ। 

"শিউলি, কী কর রাতবিরাতে।" রণবীর বলল।

"সিনান করি।" খিলখিল শব্দে হাসে শিউলি, রণবীর গভীর চমকে উঠে। 

"লোকমান কই?" "তিনি ঘুমাছেন।" শিউলি ঠোঁট কাটে দাঁতে। 

রণবীর শায়লার কথা ভাবে। শায়লা দিনেদুপুরে স্নান করতে আসে না, রণবীরের চোখে ঘুম আসে না। 

রণবীর শায়লার অটুট শরীরে চোখ রাগে, তার ম্যায়াও বিড়ালটা ঠিকরে আসে। তার নিশপিশ করতে থাকা শরীর পোষ মানে না, সে শিউলির হাত ধরে। 

সকালে রণবীরের যখন ঘুম ভাঙল তখন আলো আসে নাই পৃথিবীতে। রণবীর কলতলায় দাঁত মাজতে এসে লোকমানের ঘরে শোরগোল শুনে। রণবীর এগিয়ে যায়। আধ-খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে লোকমান শিউলিকে মারছে। রণবীরের মায়া লাগে, সে গলা-খাঁকারি দেয়। 

লোকমান রণবীরের দিকে তাকাল। লোকমানের চোখ লালচে। 

"লকু, বউ মারো ক্যান?" রণবীর নিম বাকল দিয়ে দাঁত মাজন করতে করতে অস্পষ্ট গলায় বলে। 

"ছিনালি করে বেটি।" রণবীর কিছু বলে না। ছিনালি করা বউদের মারা জায়েজ আছে, মসজিদের হুজুর গেল সপ্তাহে বলেছিলেন। রণবীর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। 

"লকু, এবেলা ক্ষান্ত দে', নামাজ পড়তে যা; বেলা তো শেষ হয়ে যাবে।" 

লোকমান ক্ষান্ত দেয়, গামছা নিয়ে গরগর করতে করতে বের হয়ে যায় রণবীরের সামনে দিয়ে। রণবীর শিউলির দিকে তাকায়; এককোণে উবু বসে আছে শিউলি। শিশিরের আঘাতে ঝরে আসে শিউলিরা। 

অতিথিমশাইদের প্রস্থানের কোন ইঙ্গিত না পেয়ে রণবীর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কায়েস সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলেন। লঞ্চের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে, সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কোন সুযোগ না থাকলে-ও রণবীর তাদের দু'দিন সময় দিল দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার। কায়েস সাহেব কিছু বললেন না, তবে তার মতিগতিতে বোঝা যায় তিনি দু'দিনে দ্বীপ ছাড়বেন না, রণবীর অন্য ব্যবস্থা নেয়ার পরিকলনা নেয়। 

রণবীর জামসেদকে নিয়ে বাঁশঝাড়ের কাছটায় অনেক গুললতা, ঝোঁপঝাড় কেটে একটা সুন্দর শ্রী দিল জায়গাটার। তারা গোখরা সাপের আস্তানা আবিষ্কার করে, ইয়া বড় বড় ডিম আর কয়েকটা মাসুম পিচ্চিসাপ; রণবীর আগুন জ্বালায় বৃত্তাকারে, তারপর বৃত্তের মাঝখান থেকে খুঁচিয়ে মারে একটা বাচ্চা সাপকে; মা সাপটা ছোবল মারে, কাছে আসতে চায়, আগুনের জন্য পারে না। জামসেদ একটা ডিম ভেঙে দেয়, ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে জমাট জীবন। মা সাপটা কিছুক্ষণ ছোবল-টোবল মেরে বাকি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পালায়। রণবীর তাকিয়ে থাকে। 

রণবীর জামসেদের সাহায্য নিয়ে কাটা ঝোঁপঝাড়, কঞ্চি সংগ্রহ করে, উদ্দিষ্ট ঝোঁপঝাড় জ্বালানির প্রয়োজন মেটাবে, বাঁশ-কঞ্চিতে ভাত রান্না হয় তাড়াতাড়ি। 

বিকালের দিকে রণবীর ছোট মেয়েকে নিয়ে বড়শি ফেলতে গেল। 

কৃত্রিম খোরাকের আশায় আসা মাছের আলোড়ন দেখে মেয়ে কুয়াশার মুখ যখন চন্দ্রবদন হয়ে যাচ্ছে তখনই শোরগোল শুনে মাথা তুলে তাকাল রণবীর। লোকমান আর কাসেম মিয়া ছুটে আসছে। 

'ভাইজান, ভাবীজান আপনারে ডাকে।' লোকমান উত্তেজিত স্বরে বলে। 

'ক্যান?' 

'সেই লোকটা আইছে, সাথে মেয়েটা। মেয়েটার যায় যায় অবস্থা। সবাই পাড়ার উঠানে জমাট দিছে।' 

রণবীর ব্যস্ত হাতে বড়শি ঘুটিয়ে পা চালাল বাড়ির দিকে। 

উঠোন ভর্তি মানুষ, গোল করে দাঁড়িয়ে আছে; রণবীর ভিঁড় ঠেলে এগিয়ে গেল। কায়েস সাহেব মাটিতে কন্যার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছেন, দ্বিধাযুক্ত মুখমন্ডল; বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে- মৃদু বাতাসে উড়ছে তার মেঘরাজিকুন্তল। 

'কি হইছে?' রণবীর হাঁটু গেঁড়ে বসল। 

'বিকালে হাঁটতে গিয়ে ...কথা বলছে না, আপনাদের একজন লোক পথের ধারে পেল।' 

'কোনায়?' 

'বাঁশঝাড়ের কাছে।' 

'কই, আমি তো আজ সারাদিন ওখানটায় ছিলুম।' 

‘জানি না। আপনি কিছু করতে পারবেন? কোন রকমের প্রাথমিক চিকিৎসা? আমার লঞ্চের অবস্থা তো জানেনই; আমি অবশ্য নৌকায় করে লোক পাঠিয়েছি ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য’। আধ-ভাঙা কণ্ঠে বললেন কায়েস সাহেব। 

'আমরা ভেষজ চিকিৎসা করি। আপনার মেয়ের সইবে তো? গিলতে পারলেই হল।' রণবীর লোকমানকে বন্দোবস্ত করতে বলে। 

আস্তে আস্তে ভিড় কমে আসে, বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টির কই মাছের প্রাণ; এই যাত্রায় হয়তো পারাপার হবে না- মৃত্যুর মাঝে বিদ্যমান সূক্ষানন্দ দেখার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে মন চাইছে না মোরগ-স্বভাবি মানুষগুলো; তারা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন। 
হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে বৃষ্টি। উৎকন্ঠিত লোকদের মাথা আর-ও নিচু হয়ে আসে; ছায়া পড়ে বিবিধ। 

বিকেল মরে আসছে। ঘাসপাড়ের সবুজরা এবেলা ঘুমুতে যাবে, আজকের সূর্যাভিসার শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কায়েস সাহেব আকাশের দিকে তাকালেন, মাটিকে তার অচেনা মনে হল- এক-টুকরো জমি। রণবীর হৃদশূন্য মানুষের মতো উঠে দাঁড়াল, শীতের শেষের এই বিকেল-সন্ধ্যা ক্ষণে সে জল হওয়ার স্বপ্ন দেখে; উজানে ভেসে কতো সহজে শহরে চলে যেতে পারতো! 

ঘাসপাড়ে সন্ধ্যা নামে, জলঘোরসন্ধি আঁধার। ঘাসপাড়ের পুরুষদের শরীরে জন্ম নেয়  কতিপয় জোনাক, নারীদের চোখে বিষুবীয় সূর্যকথার রাত। 

১২.
এই বারের গ্রীষ্মে ঘাসপাড়ের পুরুষদের মাঝে নব উদ্যোগের ডাক পড়েছে- মাথাভর্তি লম্বা লম্বা চুল রাখা শুরু করেছে সবাই- বৃষ্টির কবরে এখনো ঘাস জন্মেনি।

____________________________________________________________

একটি শর্করা উপাখ্যান
(অকালপ্রয়াত গল্পকার শহীদুল জহির’কে)
কায়সার হেলাল

হাজিপাড়ার যারা পুরনো অধিবাসী কিংবা প্রবীণ, তাদের মাঝখান থেকে হাতেগোনা দুয়েকজন বিস্মৃতপ্রায় কাহিনিটি ইনিয়ে বিনিয়ে অথবা জোর করে হলেও মনে রাখে। কেউ বলে আসলে এই কাহিনি হাজিপাড়ার তখনকার বাসিন্দাদের একধরনের সংকটের কাহিনি। তারা বলে আবুর মা শ্যামাসুন্দরী এবং কিছুটা পলকা হলেও অন্যের ঈর্ষার চোখ তার গায়ের কাপড় ভেদ করত। তার বাড়ি ছিল রাস্তার ধারে, যেখানে তেলীকোনা থেকে হাউজিং এস্টেট পর্যন্ত লম্বালম্বি রাস্তার পেট চিরে আরেকটি পূর্বমুখী রাস্তা সৃষ্টি ঠিক সেখানটায়। তার স্বামী যখন তাকে বিয়ে করে তখন গ্রামের সর্দার আইজুদ্দি মিয়া তাকে ভূমিহীন বলে রাস্তার পাশে ঐ ঘরটি তুলে দেয়। ঘর উঠানোর কাজে বারবার শ্রমিকেরা যখন বাঁধার সম্মুখীন, অর্থাৎ ঘর উঠাতে গেলেই ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টি অথবা অন্যান্য কারিগরি সমস্যা যখন দীর্ঘসূত্রিতার সূচনা করে তখন তারা, লোকে বলে, আইজুদ্দিকে এই ঘটনা জানায় এবং আইজুদ্দি বলে-“ শালার অভাইগ্যা, ঘর উডাইয়া দিতে চাইলাম এইহানেও গ্যাঞ্জাম; বিয়া করাইয়া কি মুসিবতেই না পড়লাম, ওফ!”

এরপর আবুর মার কোল জুড়ে আবু আসে। আবু খেলাধুলা অথবা ধুলাখেলা করে দিন কাটায়। যেহেতু আবুর সঙ্গী-সাথীরা গ্রামে খেলার মতো কোন মাঠ নির্বাচন করতে পারে না, তাই তারা রাস্তার ছাইরঙ্গা পিচের উপর লাফালাফি কিংবা দাপাদাপি করে। পাড়ার লোকেরা বলে, ঠিক এই জায়গা থেকেই আবুর মার মুসিবত শুরু হয়। যৌবনের উঠতি প্রেম, অথচ তার স্বামী জগলুল হায়দার কি কারণে যেন আর ঘরে ফেরেনা। তখন একাত্তরের সময় ছিল এবং হাজিপাড়াবাসীর একমাত্র মসজিদের ছাদে পাক-হানাদার বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। পট পরিবর্তনের এই হুজুগে সর্দার আইজুদ্দি সহ অধিকাংশ পাড়াবাসী নূরপুর অথবা তেলীকোনা হয়ে বিবির বাজার পেছনে ফেলে সোনামূড়া চলে যায়। পাড়ার লোকেরা বলে যে তারা ঐখানে রিফুজি ক্যাম্পে উঠে এবং জগলুল হায়দারও এ প্রবাহে গা ভাসিয়ে সোনামূড়া কিংবা আগরতলা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পে যায়, জগলুল হায়দার মুক্তি হয় অথবা কেউ কেউ বলে সে আগরতলা কিংবা সোনামূড়া যাবার আগেই পাকবাহিনীর হাতে মারা পড়ে এবং আবুর মার মুসিবতের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। পাড়ার বাসিন্দারা একে একে চলে গেলেও আবুর মা জগলুল হায়দারের অপেক্ষায়  হাজিপাড়ায় থেকে যায়।

আবুর বয়েস ক্রমে সাত কি আট হলে সে আবারো ছাইরঙ্গা পিচের উপর খেলাধুলা কিংবা ধুলাখেলা করে এবং ঘরে ফিরে আসে এবং তার মাকে বলে- “মা, বন্দুকঅলারা ক্যাম্প থেইকা খাড়ায়া মুতে কেন?” তার মা চুপ করে থাকে এবং গুনগুনিয়ে কান্দে। পরদিন চৌদ্দই মার্চ রবিবার বিকেলে অথবা সকালে পাকবাহিনীর জলপাইরঙ্গা সাঁজোয়া যানের তলে পড়ে আচমকা আবু মারা যায়। আবুর মা বিলাপ করে, তার চোখে কালি পড়ে এবং এর ধারাবাহিকতায় তার  চোখে অশ্রুজনিত ঘা দেখা দেয়। এবং এই বিলাপের সুর ক্যাম্পে পৌঁছালে পাকি ক্যাপ্টেন আবুর মাকে তুলে আনতে তার অনুগত, একান্ত বাধ্যগত সিপাহিকে নির্দেশ দেন অথবা হতে পারে কোন রাজাকার বিলাপের সুরে বিরক্ত হয়ে এমনি এমনিই আবুর মাকে তুলে আনে এবং এতে করে আবুর মার নিত্য দুঃস্বপ্ন হঠাৎ করেই দর্শনযোগ্য হয়ে পড়ে। ষোলই ডিসেম্বরের পর অথবা এর কিছুদিন আগে পাকবাহিনী হাজিপাড়া ছেড়ে চলে গেলে আবুর মা সূর্যের আলোয় চোখ কচলায় এবং দেখে সে আর সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না, হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে হয় এবং সে হামাগুড়ি দিয়েই হাঁটে। এভাবে বছরের পর বছর চলে যায়, যদিও আবুর মা মনে করে তার সময় থেমে গেছে, তারপরও সময় চলে যায়। নিজঘরে ফেরা হাজিপাড়ার আদি বাসিন্দারা নতুন করে সবকিছু শুরু করলেও আবুর মার নির্লিপ্ততা তাদের ভেতর এক প্রকার শোকের জন্ম দিতে থাকে। আবুর মাকে হয়তো তারা কিছু খেতে দেয় অথবা তাকে দিয়ে এটা সেটা কাম করায়। কিন্তু এভাবে যখন সময় চলে যায় পট আবারো কিছুটা ধীরে পরিবর্তীত হতে থাকে। গণতন্ত্র থেকে সমরতন্ত্র, সমরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র করতে করতে দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশ ছোঁয় অথবা কেউ কেউ বলে যে পশ্চিমা জৈব জ্বালানীর চাহিদা পূরণে ব্যাপক খাদ্য শস্যের প্রয়োজন পড়াতে তৃতীয় বিশ্বে দ্রব্যমূল্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। ফলে এই পর্যায়ে হাজিপাড়ার বাসিন্দাদের দুয়ার একটু একটু করে বন্ধ হতে শুরু করে এবং আবুর মা অদূরবর্তী হাউজিং এস্টেটে সদ্য নির্মিত আলুর কোল্ডস্টোরেজ-এ আলু বাছুনিতে বেগার খাটে।

কেউ কেউ বলে আবুর মা তখন আধা পঁচা আধা ভালো আলুর পঁচা অংশ ফেলে বাকীটা পুড়িয়ে খায়। তারা আরো বলে মুসিবতের শুরু আসলে জগলুল হায়দারের রেখে যাওয়া কাঁসার বাটি থেকেই এবং তখন তারা বলে যে- “সে আরেক কাহিনি”। ... কেননা আবুর মার তখন ক্রমাগত স্মৃতিভ্রংশ হতে থাকে এবং একদিন সে তড়িঘড়ি করে অথবা এমনিতে হাত ধুতে অথবা জল নিতে ঘরের পাশের কলতলায় আসে। কাঁসার বাটিটা কলতলায় দেখে সে ভাবে এটা তার কেন ঘরে নিয়ে যেতে মনে ছিল না অথবা সে ভাবে আবুর বাপের একটা স্মৃতি মাত্র, বিলাই নিয়ে গেলে অথবা কাউয়ার দল যে হারে বেড়েছে ঠোঁটের আগায় করে নিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কাঁসার বাটি হাতে নেয়ার পর গোধূলির লাল আভার প্রতিফলন ঠিকরে পড়লে আবুর মার নাকে এক প্রকার গন্ধ ঠেকে। নাক কুঁচকে গন্ধ খুঁজতে গিয়ে লুলা হাত পা নিয়ে আবুর মা কুকুরের মত কলতলায় হামাগুড়ি দিয়ে এদিক-ওদিক কিছু মরে পড়ে আছে কিনা শুঁকতে থাকে। না পেয়ে বিড়বিড় করে। বৃষ্টির পানি, হয়তোবা কলের পানিই জমেছিল কলতলার সরু বাধেঁর আশেপাশে, আবুর মার হাঁটু অথবা কাপড়ের আঁচল অথবা হাতের তালু নোংরা হয়ে যায়। আবুর মা ভাবে-“মাডি ফঁচা গন্ধ!” ঘরে ফিরে অথবা ঝুপড়িতে ফেরার পর পুনরায় গন্ধ পেলে আবুর মা পিন্দনের কাপড় খুলে শুকতে থাকে-“নাহ্‌, গন্ধ এইডাত্‌ না” বলে পুনরায় কাপড়ের ভাঁজ শরীরে ফেলে রাখে। হাত শুঁকে গন্ধের আবিষ্কার তাকে কাঁসার বাটির দিকে নিয়ে যায় আবার। বাটিখানা তুলে গন্ধের তীব্রতা পেট মুচড়িয়ে, গুলিয়ে গলা অব্দি নিয়ে আসে তার। আবুর মার পলিথিন চালা ঘরে অথবা ঝুপড়িতে ঈষৎ লাল সূর্য ক্রমান্বয়ে ধুলিশব্দ তুলে তার চুলের আগা স্পর্শ করে মগজে ঢুকে পড়ে। তার মনে পড়ে কাঁসার বাটিতে কাল রাত্তিরে কোল্ডস্টোরেজ থেকে আনা আধা পঁচা আধা ভালো আলুর পঁচা অংশটুকু ফেলে বাকিটা পুড়িয়ে খেয়েছিল। সে ফের ভাবে-“ফঁচা আলুতো হালাই দিছিলাম, কিন্তু গন্ধ আইয়ে কোয়ানথাইক্কা”?

রাত গভীর হতে শুরু করলে অন্ধকারের রং আলকাতরার দেয়ালের মতো সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, আবুর মা শুয়ে শুয়ে হাত বাড়িয়ে রোজদিনকার মতোন দেয়াল ছুঁতে চেষ্টা করে। গন্ধের কথা তার পুনরায় মনে পড়লে সে বলে-“গন্দ আইব ক্যা, গন্ধ না, অন্য কিছু মুনে হয়”। ঠিক তখনই তার হাতের আঙ্গুলে অথবা চেটোতে কিছুটা আঠা আঠা তরল পদার্থ লেগে যায় বলে তার মনে হতে থাকে। সে ভাবে-“হুদাই, কিছু না”। কিন্তু হাতের পাঁচ আঙ্গুল একসঙ্গে করলে তার কাছে মনে হতে থাকে রাতের ঘন অন্ধকার বুঝি তার হাতে লেগে গেছে এবং সে বলে-“কি মুছিবতেই না পড়লাম একবার দেহি গন্ধ লাগে, আবাত্তি দেহি আডা আডা লাগে।” পাড়ার লোকেরা বলে, আবুর মার মুছিবতের শুরু কাঁসার বাটি থেকেই এবং তারপর আবুর মা শোয়া থেকে উঠে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় অথবা ভরাট চান্দের আলোয় অথবা মসজিদের ভেতর থেকে আসা আলোর সামনে হাত মেলে ধরে। চান মিয়া না মধু অথবা সাদ্দামের বাপ ওই  পথে যেতে থাকলে আবুর মার হাতের কসরত কিংবা বিশেষ মুদ্রা দেখে থামে। আবুর মা চান মিয়া না হয় মধু না হয় সাদ্দামের বাপকে বলে-
দেহ তো মিয়া আতে কি লাগলো?
-আলকাতরা নিহি?
দূর মিয়া আলকাতরা আইব কইত্থাইক্যা?
-তয় পঁচা পাতা নাইলে মুরগার গু লাগছে মুনে অয়!
দূর, আমার কি মুরগা আছে নিহি যে গু লাগবো?
আবুর মা কিংবা চান মিয়া না হয় মধু অথবা সাদ্দামের বাপ অথবা উভয়েরই মনে হতে থাকে এটা একটা ধন্দ বটে, কিন্তু পরক্ষণে আবুর মা অথবা পথচারী অথবা আবুর মা-ই বলে উঠে-
ফঁচা আলু অইতে পারে!
-হ, অইতে পারে!
আবুর মা ঘরে অথবা ঝুপড়িতে ফিরে আসে এবং বলে- “কি মুসিবতেই না পড়লাম”! 

এভাবে নিত্যদিনকার মতো মরহুম মকবুল মিয়া অথবা মরহুম ছফর আলীর চৌচালা ঘর ঠেলে সূর্য পুবাকাশে উঠে এলে আবুর মার পেটে খিদা লেগেছে বলে মনে হতে থাকে। শামসু অথবা আলী মিয়া অথবা শামসুই হবে, তাকে দেখে হোটেলের বেড়ার পাশে কল্লা তুলে তেহারীর ডেকচির দিকে তাকিয়ে আছে। বলে- “আমার দোয়ান ছাড়া অইন্য দোয়ান দেহ না? যাও এইখান থাইক্কা” বলে কি মনে করে যেন হোটেলের বয় জসিমুদ্দিকে দিয়ে আবুর মার কাছে পলিথিনের ঠোঙ্গা ভরে অথবা ঠোঙ্গা অর্ধেক খালি রেখে তেহারী পাঠায়, সেখানে বসেই আবুর মা তা খেয়ে নেয়। হোটেলের খদ্দেরেরা বলে এ প্রক্রিয়া আবহমান কাল ধরে চলে আসছে, পাড়ার প্রাপ্তবয়স্ক বাসিন্দারাও এ কথার সত্যতা প্রকাশ করে এবং তাদের বাপেরাও আবুর মার এই ঊষাভোজন পর্ব দেখে আসছে বলে স্বীকার করে। এভাবে রোজদিনকার মতো আবুর মা রফিকের দোকান, হাফেজ সাবের বাড়ি পিছনে ফেলে, নমঃশুদ্র পাড়া পার হয়ে হাউজিং এস্টেটের কোল্ডস্টোরেজে যায়। সরাসরি আলুর বস্তার গায়ে আলুর ফুটে উঠা চিত্র দেখে আবুর মার শৈশবের স্মৃতির কথা মনে পড়ে এবং ইতিউতি করে সে আলু বাছতে বসে যায়। দুপুর পর্যন্ত আলু বাছতে বাছতে সে আলুর কয়েকটা তার ছেঁড়া পুঁটলিতে ঢুকিয়ে ফেলে। তারপর কোল্ডস্টোরেজের গুমোট হাওয়ার অদৃশ্য প্রাচীর আর সদৃশ্য চৌকাঠ ডিঙিয়ে সূর্যের উলম্ব কড়া আলোর মাঝে চোখ কচলায় এবং প্রতিদিনের মতো মাদকাসক্ত পুর্নবাসন কেন্দ্র, সেলিম কমিশনারের বাড়ি, গ্রিন হাউজ নার্সারি পেছনে ফেলে আপন ঘর কিংবা ঝুপড়িতে ফিরে আসে। আলু কেটে উনুনে পুড়ানোর আগে সে আবার ধন্ধে পড়ে অথবা অপরাধবোধে ভুগে। “ফঁচা আলুর লগে ভালা আলু আইলো ক্যামনে? আইচ্চা আনন কি খারাপ? নাহ গরিবের অত কিছু চিন্তা করন নাই, গরিবগো হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্দ, খিরিষ্টান সব এক”! আলু পোড়ানোতে ব্যস্ত থাকাতে কিছুটা জুড়িয়ে নিয়ে একমাত্র কাঁসার বাটিতে নিয়ে খায় এবং খাওয়া শেষে কলতলায় যায়, বাটি ধুয়ে মন ভুলে ফেলে আসে। মনে পড়লে কাঁসার বাটি আনতে আবার কলতলায় যায়  এবং আগের দিনের মত নাকে গন্ধ টের পায়, কাঁসার বাটি হাতে নিয়ে তখুনি নাকে গন্ধ নিতে নিতে ঘরে কিংবা ঝুপড়িতে ফিরে আসে এবং বিড়বিড় করে অথবা উচ্চৈঃস্বরে বলে-“কি মুসিবতেই না পড়লাম”। পাড়ার লোকেরা হয়তো এ চিৎকার শোনে অথবা শোনে না, হয়তো বা শুনলেও গা করে না এবং সবকিছুই আগের মতো চলতে থাকে। প্রতিদিনের মতো আবুর মা দেখে সূর্য মগজে ঢুকছে এবং গন্ধের উৎস যে পঁচা আলু অথবা অন্য কিছু এ নিয়ে ক্রমাগত বিভ্রান্ত হতে থাকে। ঘোরে নিপতিত হতে হতে বেঘোর আবুর মা স্বপ্নে দেখে সারি সারি পাহাড়সম আলুর বস্তার নিচে সে রক্তের মন্ড অথবা রক্তমাখা আলু নাড়াচাড়া করছে। ফলে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে একপর্যায়ে  সামনের দিকে হাত বাড়ালে হাতে আঁঠালো পদার্থের মতন কি যেন লেগে যায়। আবুর মা ভাবে মনের ভুল। এ দ্বিধাদ্বন্দ্বে আবুর মা ঘরের বাইরে আসে। মসজিদের আলোয় অথবা চান্দের আলোয় অথবা ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমা ষাট পাওয়ারের বাত্তির নিচে হাত নাড়তে দেখে চান মিয়া না হয় মধু অথবা সাদ্দামের বাপ বাড়ি ফেরার পথে নামে, বলে-
আইজও কি আতে আলকাতরা লাগ্‌চে তুমার?
-হ, না, এমুনই মনে অয়!
তয় কি মুরগার গু?
-না, আমি কি মুরগা পালি?
পঁচা পাতা অইতে পারে!
-পাতা পামু কই?
তয় কি পঁচা আলু? 
-অইতে পারে; বলে আবুর মা ঘরে অথবা ঝুপড়িতে ফিরে আসে এবং বলে-“কি মুসিবতেই না পড়লাম”! নিয়মিত সূর্য পূবদিকের মরহুম মকবুল কিংবা ছফর আলীর বাড়ি ঠেলেই উঠে এবং আজও তার ব্যতিক্রম হয় না। আবুর মাকে সামসু কিংবা আলীর হোটেল বয় প্রতিদিনের মতো পলিথিনের ঠোঙ্গায় তেহারী দেয় এবং সে তেহারী খায় এবং শোনে হোটেলের ভেতর থেকে কে যেন বলে, হতে পারে পোংটা কোন পোলা অথবা হতে পারে সাদ্দাম, বলে উঠে- “আবুর মা তুমি যে রাইতে আতের আডা লয়া রোডে আহো, আর মাইনষেরে বিরক্ত কর, তুমি মুনে হয় জান না এই আডা কিয়ের আডা?” বলার সাথে সাথে যখন পুরো হোটেল হেসে উঠে তখন আবুর মা -“তামানডি মাগির পুত” বলে কোল্ডস্টোরেজের দিকে যায় এবং যেহেতু যাওয়ার পথে রফিকের দোকান অথবা হাফিজ সাবের বাড়ি অথবা গোলমার্কেট পড়ে সেহেতু এগুলো পেছনে পড়ে যায়। আবুর মা আলু বেছে বেছে যখন ক্লান্ত তখন অজান্তে অথবা সজান্তেই ভালো আলুর কয়েকটা পুটলিতে পুরে ফেলে এবং আবুর মার চোখ এদিক ওদিক তাকালে আলুর পাহাড়ের উপর থাকা ছদরুল কি যেন আঁচ করে; সে বলে অথবা বলে না, আবুর মা হয়তো ভুল শোনে অথবা সে হয়তো বলেই-“আবুর মা সাবধান”!!!

এবং পূর্ব নিয়মে সূর্য উঠলে অর্থাৎ সূর্য মরহুম মকবুল মিয়া অথবা ছফর আলীর চৌচালা ঘর ঠেলে উঠলে আবুর মা পাড়ার সকলের বিমর্ষ কিংবা অতঙ্কিত চেহারা দেখে আঁৎকে উঠে এবং সে তেহারী খায়। পাড়ার বাসিন্দারা বলে-“আবুর মার আতে কিয়ের আডা না কিতা লাগে, আবাত্তি কয় গন্ধ লাগে, বেডি মুনে হয় পাগল অইছে এবার”। এসব বলাবলির পরও পাড়ার বাসিন্দাদের নিস্তার মেলে না এবং তারা ক্রমাগত এক বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে যেতে থাকে। তারা ভাবতে থাকে অথবা বলাবলি করে এটা আসলে আবহমান কাল ধরেই ঘটতে থাকে এবং এতে নতুনত্ব বলে তেমন কিছু নেই! আবার কেউ কেউ আঁড়ালে সন্দেহও পোষণ করে, যদিও ঠিক কি ধন্দে তারা বিভ্রান্ত তা নির্ণয় হয় না এবং সমাধান না হতে হতে আবুর মা পুনরায় কোল্ডস্টোরেজে যায় এবং পুনরায় বলে-“কি মুসিবতেই না আছি” এবং তখনি ছদরুল ইচ্ছে করেই অথবা তার হাত ফসকে একটি আলুর বস্তা আবুর মার পিঠে পড়ে যায়, তারপরও আবুর মাকে বেঁচে গেছে বলে মনে হয় এবং তার কোমর আলগা হয়ে গেলে হাঁচড়ে পাঁচড়ে ঘরে অথবা ঝুপড়িতে ফিরে আলু পুড়িয়ে খায় অথবা মরহুম মকবুল মিয়ার বাড়িতে যায় এবং মকবুল কন্যা তাকে মুরগীর গোশত হয়তোবা মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ায়। তারপর ঘরে অথবা ঝুপড়িতে অথবা অন্য কোথাও সে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে অথবা বিকালে পাড়ার বাসিন্দাদের অথবা হোটেলের খদ্দেরদের মনে হয় তারা বহু যুগ ধরে আবুর মাকে দেখে না এবং বিভ্রান্তির এক ঘোরময় গোলক ধাঁধায় তাদের মনে হতে থাকে তারা যেন আবহমান কাল ধরেই পাঁক খায় এবং এর কিছু দিনপর, হয়তো সাথে সাথেই হাউজিং এস্টেটের আলুর কোল্ডস্টোরেজের আশপাশের এলাকায়, নমঃশুদ্র পাড়ায়, হাজিপাড়ায়, কাঁটাবিল ও তেলীকোনায় এক প্রকার তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং এ সকল এলাকার বাসিন্দারা বলে যে তারা সবাই এ গন্ধ টের পায়। চান মিয়া না হয় মধু অথবা সাদ্দামের বাপ এই গন্ধ সন্ত্রাসে সবচেয়ে বেশি র্জজরিত হয়, যদিও পাড়াবাসীরা বলে যে এমনটি নাও হতে পারে, হয়তোবা চান মিয়া না হয় মধু অথবা সাদ্দামের বাপ এক ধরণের গন্ধ বাহক হিসেবে সক্ষম থাকে এবং পাড়াবাসীরা আরো বলে যে তারা এই গন্ধ অন্যকে শুঁকতে উৎসাহিত করে, ফলে অন্যরা এই গন্ধ টের পায় এবং বলে-“এইটা কোল্ডস্টোরেজ না হয় অন্য কোন জায়গার আলু পঁচা গন্ধ অইতে পারে।” এভাবে হয়তো সপ্তাহের পর সপ্তাহ, হয়তো মাসের পর মাস, হয়তো বছরের পর বছর ধরে এই গন্ধ এমন ভাবে ছড়িয়ে যায় যে তা মানুষের মগজে একেবারে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে এবং ক্রমান্বয়ে তা সয়ে আসে। সময়ের চাকা যেহেতু পেছনে গড়ায় না, সামনেই গড়ায় সেহেতু পাড়ার উৎসুক কেউ কেউ অথবা নতুন কোন আগন্তুক এলে পাড়ার বাসিন্দারা স্মৃতি থেকে এই গন্ধ এনে তাদের শুঁকায়, অথবা হয়তো শুঁকায় না,তারা নিজেরাই বিস্মৃত হয়ে গেলে নিজেদের স্মৃতিকোষ থেকে এক চিমটি, দু চিমটি বা তিন চিমটি করে, হতে পারে এক মুঠ করেই এই গন্ধ নাকের কাছে এনে নিজেরা শুঁকে এবং হাজিপাড়ার ঐ সকল নতুন আগন্তুক অথবা যারা অতিথি হিসেবে আসে হাজিপাড়ায় কিংবা কাঁটাবিল অথবা তেলীকোনায়, হয়তো এরা সবাই ভ্রমনোৎসুক আগন্তুক, তাদের কেউ কেউ নিজ পাড়ায়, শহরে অথবা পরিবারে ফিরে এসে কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, তারা অন্যদের জিজ্ঞেস করে যে-

এক. বলেনতো এইটা কিসের গন্ধ?
দুই. বলেনতো এই গন্ধ ছড়ায় ক্যামনে?
তিন. বলেনতো কোল্ডস্টোরেজে আলু পঁচতে থাকলেও মাইনষে ক্যান না খায়া মরে?

...অনাদিকাল ধরে এইসব র্চচা নতুন কোন আগন্তুক কিংবা হাজিপাড়ার বাসিন্দাদেরকে ছাড়েনা এবং তা তারা জারি রাখতে বাধ্য হয়ে পড়ে, হয়তো এরা এসব জারি রাখতে চায়না, গন্ধই তাদেরকে এই ধারা জারি রাখতে বাধ্য করে...


____________________________________________________________

হুইসেল, ঝিকঝিক এবং অতঃপর
খালেদ চৌধুরী

দশটার ট্রেন কয়টায় আসে? অন্তত দশটায় আসে না। একদিন ট্রেন ঠিক দশটায় আসলে যাত্রীরা বিষম খুশি হয়। খবর নিয়ে জানা যায় এটা আজকের ট্রেন না। অনিয়মের মধ্যে থেকে থেকে নিয়ম জন্ম দেয় বিশৃঙ্খলা। যা পরে দেয়ালে শেওলার মতো স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে অহরহ নিয়ম ভাঙ্গে শৃঙ্খলার গোপনে কিংবা সহজ প্রকাশ্যে।

গোমট আবহওয়া। মনে হচ্ছে কেউ যেন পৃথিবী নামক কড়াইয়ে উনুনের হালকা তেজে প্রিয় স্বাদ রান্না করছে। রেল স্টেশনটার অবস্থা পাগল কুকুরের মতন ভয়ংকর। নির্মাণ কাজ চলছে তাই সুন্দরের পরিবর্তে কুৎসিত। ধরি স্টেশনটার নাম ‘সি’। এখানে চিটার মানুষ থাকা খুব স্বাভাবিক। যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয় অথবা না - চাইতে প্রেম বাগানে ফুলন দেবী। যদিও এখন পর্যন্ত কেউ জানেনা ফুল কামড়াতে পারে। অথবা ঘ্রাণ যদি এরকম বলে, আমি খারাপ তুমি চাও অথবা না চাও তোমাকে স্পর্শ করব। এরকম পরিস্থিতিতে কিছু বলার থাকে না। কিছু বলার থাকলেও মোবাইল কোম্পানির গ্রাহক বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাসপাতালের গ্রাহক হয়ে আত্মীয়ের বিশাল বিস্তৃত রোগ নামক আবাসিক, বিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করছে অথবা অসরল সম্পর্কের মোম নির্মাণে পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করছে। ব্যবসায় গ্রাহকের মত স্থায়ী কাস্টমার সংগ্রহ হালে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এখানে অনেকের নাম সংযোজন করা যেতে পারে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার কিংবা আমলা  শ্রেণীর নাম থাকতে পারে। তাছাড়া ডাক্তারতো সেবার বদলে ছল-চাতুরি শুরু করে নি। তাছাড়া সে যখন ছল-চাতুরি করে তখন তার নাম ডাক্তার থাকে না। দেয়া আছে তার নাম ‘র’ দিয়ে হবে।

স্টেশনের সামনে তুলনামূলক সস্তা ভাড়ার তিন চাকা থামলে সুঠাম দেহের অধিকারী নামে  ওমেন হলে তার নাম চামেলি বেগম খুব মানাইতো। বয়স কত হবে চল্লিশ কি পয়তাল্লিশ যেহেতু তার নাম ‘র’ দিয়ে। সুতরাং রেজাউল করিম অধিকতর যুক্তিযুক্ত। রে. করিম কাউন্টারে  এসে বলল
‘কু’র একটা টিকেট দিন?
টিকেট নেই।
আপনাদের কাছে টিকেট থাকেনা। যদি একটা ব্যবস্থা করে দেন বিশেষ উপকার হয়।
বিশ টাকা বেশি লাগব।
আরে কি বলছেন, আপনি আমার বিশেষ উপকার করবেন বিশ টাকা কেন ত্রিশ টাকা বেশি দেব।
এজন্যই বলছি টিকেট নেই।
জনাবের বোধ হয় বংশালি রাগ। সরকার রাগ দেখায় বোঝলাম। কিন্তু আপনার জারজ রাগ জনম্মুখে প্রকাশ করতে ভয় লাগেনা?

লোকটার মুখ বিবর্ণ করতে কথাটা লাল থাপপড়ের মতো কাজ করে। টিকেট কেনার সময় রে.করিম এক বাণ্ডেল শত্রু বের করে তার থেকে পাঁচশ দিলে কাউন্টারের লোকটা এমন ভাবে পরখ শুরু করে যেন সে সরকারের জাল নোট ধরার বিশেষ নির্বাহী।

টিকেট হাতে পাওয়ার পর প্রথম কাজ হল ট্রেন কখন আসবে দেখা। টিকেটের গায়ে ১৬.৩০ দেখে ভদ্রলোকের মতোন দেখতে রে.করিম ছোট বেলার যোগ অংক শিক্ষা কাজে লাগায় এবং নির্ণয় করে এতটার সময় ট্রেন আসবে। ট্রেন আসতে এখনো দু’ঘন্টা বাকি। হয়তো স্টেশন, হাসপাতাল জাতীয় জায়গায় ঘড়ির কাঁটা ধীরে চলে কিংবা অলসতায় আক্রান্ত হয়। রে.করিম পত্রিকা খরিদ করে দুটাকার বাদাম খাওয়ার মতন পড়া শুরু করলে- চোখ কোন অজ্ঞাত কারণে বঙ্গোপসাগরের ডাকাতি বিষয়ক রিপোর্টের দিকে আগ্রহী হয়। ‘গত পরশু রাত আনুমানিক দু’টার দিকে জলদস্যুরা গভীর সমুদ্রে এম.ভি মুহিত নামের ট্রলারে অতর্কিত হামলা চালায়। জেলেদের চোখে চুন মেখে সাগরে ফেলে দেয়। পরে ট্রলার নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়।...’ খবরটা অসম্পূর্ণ রেখে পাশে বসা লোকটাকে রে.করিম বলতে শুরু করে।

চোখে চুন মেখে যাদের সাগরে ফেলে দিল। তাদের কি হবে? তারা আর চোখে দেখতে পাবে?
আগেতো বাঁচা। তারপর না হয় দেখা-অদেখা।

বেচারা হাত বাড়িয়ে পত্রিকা নিয়ে নিউজটা পড়া শুরু করে। এক সময় ভদ্রলোক অথবা মন্দলোক অথবা উভচর রে.করিমকে জিজ্ঞেস করে অথবা রে.করিম জিজ্ঞেস করে।

কোথায় যাবেন?
আখাউড়া।
আপনি কোথায়?
‘কু’ যাব।
আরে আপনিতো দেখছি আমার দেশি। তা এখানে কোথায় থাকেন?
সদর হাসপাতালের পেছনে।

ওরা কে, কি করে? কেউ কাউকে জিজ্ঞেস করেনা। তারপরও দুজন তাৎক্ষণিক কথাবার্তায় পরস্পর পরস্পরের ওপর অস্থায়ী আস্থা স্থাপন করলে বিশ্বাসের সহোদরা একের পর এক চলতে থাকলে কখনো বাংলাদেশের দূষিত রাজনীতি, কখনো উন্নয়নশীল ক্রিকেট, কখনো উচ্চপদস্থ সরকারি আত্মীয়ের সাথে ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ অতীত রোমন্থন প্রকাশিত হয়। হঠাৎ ভাললোকটা অথবা মন্দলোকটা অথবা উভচর বলল-

এতক্ষণ ধরে আমরা একসাথে আছি অথচ আপনার নামটা জানা হল না।
রে.করিম হেসে বলল-
আমি রেজা। আপনি?
আজগর ভূঁইয়া।

তখন স্টেশনে হাই ভলিয়মে “যাত্রী সাধারনের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে ‘কু’গামী কুহক এক্সপ্রেস ‘সি’ স্টেশনে ২১ ঘটিকায় পৌঁছবে। যাত্রী সাধারনের এই সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিক দুঃখিত। ” আজগর বলল- দেখেন এই দেশের উন্নতি ৭টার ট্রেন এখনো আসবার নাম নেই আবার সৌজন্য দেখাচ্ছে।

চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। ট্রেনের দেরি হলেও রাতের দেরি সয় না। তাছাড়া নিয়ম ভাঙ্গার সত্তা তার অনুপস্থিত। আজগর, রে.করিমকে চা অফার করলে সে বিনয়ের সাথে বলে আমি স্টেশনে কিছু খাইনা। এ আচরণের বিপরীতে আজগর কার্যকারণ জানতে চায়নি। বরং ফুরুত ফুরুত শব্দে চা পানের ব্যস্ততা দীর্ঘতর করতে লাগে। ট্রেন দেরি করছে তাই তার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে এরকম একটা মুখাবয়ব রে.করিমকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

অবশেষে হাইড্রলিক হর্নের বিশাল সাউন্ড কান দিয়ে মগজে প্রবেশ করলে ট্রেন আসে। আজগরকে তখন অধিকতর শান্ত মনে হয়। তারা পরস্পরকে বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠে যায়।

রে.করিম তার সিটে ঠিকঠাক মতই আসন গ্রহণ করে। অন্ধকার ঘন থেকে ঘনতর  হতে থাকলে কোন কারন ছাড়া বাড়ির কথা মনে পড়ে। ছোট ছেলেটা কেমন আছে? ঠিক মত পড়াশুনা করছে কিনা? শুনেছে মেয়েটার অসুখ। এত কথা একসাথে মনে পড়লে রে.করিম সবাইকে সুষম সময় দিতে পারেনা। তাছাড়া সারা দিনের ক্লান্তি ঘুমে রূপান্তরিত হয়ে সন্ত্রাসীর মতন মগজের মাধ্যমে চোখে আক্রমণ করলে অথবা চোখের মাধ্যমে মগজে আক্রমণ করলে রে.করিমের সমর্পণ ছাড়া উপায় থাকেনা। সরলরেখায় ভাল ছাত্রের মত ট্রেন ছুটছে। ইচ্ছে হলে কোন স্টেশনে একটু দম নেয়। ইচ্ছে না হলে দম নেয়না। রে.করিমের ঘুমে স্বপ্নের অত্যাচার আসলে...

“বউয়ের জন্য হলুদ রঙের শাড়ি কিনেছে। অনেক দিন তার অমৃত সমান কথা শোনা হয় না। শরীর, স্পর্শ, দৃষ্টির অনুভূতিতে স্থিরতার ছবি স্পষ্ট অভাব অঙ্কন করে তাকে উত্তেজিত করে। বাড়িতে চলে এসেছে। সোনা বউয়ের মুখ দেখে একজন খুনিকে ক্ষমা করে যেইনা স্ত্রীকে স্পর্শ করতে যাবে সেই মুহূর্তে শোনে তার চাকরি নেই। দুর্ঘটনার মত জীবনকম্প হলে ঘুম গুড়াগুড়া হয়ে যায়।” টিকেট...টিকেট...। হ্যালো, টিকেট দেখি? রে.করিম টিকেট চেকারকে টিকেট দেয়। চেকার টিকেটে আঁক কেটে দায়িত্ব পালন করে।

রে.করিম বাড়িতে গেলে তার সন্তানদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ট্রেনের টিকেট কে নেবে? টিকেট জাতীয় কাগজ দিয়ে ছোট ছেলেমেয়েরা টাকা বানায়। আসলে মূল্যহীন কাগজকে টাকার মর্যাদা দিয়ে তাদের কোমল মূল্যবোধে অজান্তেই সিরিস কাগজ ঘষা শুরু করে। রে.করিম ঠিক করে টিকেটটা তার মেয়েকে দেবে।

রে.করিম সহজ লোকের সরল নেতা নির্বাচন করলে দুষ্টলোকেরা খুশি হয়। পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাবার আশা করে। তাদের পাশ করার কোন সম্ভাবনা না থাকলেও তারা ‘এ’ পাবার প্রত্যাশা নিয়ে প্রশ্নপত্র হাতে নেয়। 

ট্রেন শায়েস্তাগঞ্জ এসে থামে। এ সময়টা হকারদের জন্য মুখ্য। তার সাঁজানো বিভিন্ন ধরণের পশরা যাত্রী সাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভিক্ষুকরাও এ সময়টা নষ্ট করতে চায়না। সমস্ত সত্তা দিয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করে। কিন্তু রাতের বেলায় ভিক্ষুক কিংবা হকার কাউকেই দেখা গেল না।

পাঁচশ টাকার নোটের মতন আকাশে কড়কড়ে চাঁদ। তার রূপালি আলো ট্রেনের শরীর ছুঁয়েছে আশেপাশের সবুজকে স্পর্শ করেছে। এখন অবশ্য চাঁদের কলঙ্কের এক ইঞ্চি ব্যর্থতা বেড়েছে। সে মানুষের শরীর ছুঁয়ে কিন্তু স্পর্শ করতে পারে না অথবা স্পর্শ করতে দেয়না।

ট্রেন আখাউড়া এসে থামে। ইচ্ছে করলে যাত্রীরা স্টেশনের রেস্টুরেন্ট হতে খাওয়া শেষ করতে পারে। রে.করিমের ক্ষুধা বিদ্রোহী হয় কিন্তু স্থির করতে পারেনা কি খাবে?

তখন আজগর ভূঁইয়া অথবা অজগর ভূঁইয়ার অনুপ্রবেশ ঘটলে তাদের মধ্যে কথোপকথন শুরু হয়।

করিম ভাই! আপনি দেখছি ঝিমুচ্ছেন।

কিছু কথা বলার পর আজগর বলে- গন্ধেতো থাকা যাচ্ছেনা। আমার সাথে আসেন ভালো সিট দেখে বসিয়ে দেই। এই কথার বিপরীতে রে.করিম কিছু বলতে পারেনা। তাছাড়া এরকম সেবায় না - বলার সুযোগ কোথায়!

এয়ারকন্ডিশন যুক্ত আসনে রে.করিমের পরবর্তী আসন হয়। কিন্তু আজগরকে এ জিজ্ঞাসা করতে ভুলেনা-
আপনারতো আখাউড়া নেমে যাবার কথা। ট্রেন ছেড়ে যাবে নামবেন না?
এসব আপনি বুঝবেন না। চট্টগ্রাম যাব। এখন আর টিকেট চেক করবেনা। কম টাকায় চট্টগ্রাম যাওয়া এই আর কি।

আখাউড়া হতে ‘কু’ যেতে বড়জোড় সোয়া একঘন্টা থেকে দেড় ঘন্টা লাগবে। এর আগেই অজগর ভূঁইয়াকে কাজটা শেষ করে ফেলতে হবে। অজগর রে.করিমকে জিজ্ঞেস করে-

কিছু খেয়েছেন?

রে.করিমের পক্ষে তার শুকনা মুখ সংক্ষিপ্ত হেসে জবাব দেয়।

অজগর বুঝতে পারে এই হাসির অর্থ রাতের বেলা ট্রেনে আমি কিছু খাই না। অনির্দেশক। অজগরের হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এক প্যাকেট বিরানি এনে স্বাদযুক্ত সুবাস করিমের বিদ্রোহী ক্ষুধাকে আন্দোলিত করার চেষ্টা করে। সৌজন্যের খাতিরে অথবা ক্ষুধার দুর্বলতায় করিম বারণ করতে পারেনা। খাওয়া শুরু করে। খাবারের মধ্যে কিছু একটা আছে তার ভুলেও মনে হয়না। তাছাড়া ঘুমের ঔষধ মেশানো খাবারের স্বাদ অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। বিরানি খেতে খেতে আজগরের সাথে কথা হচ্ছে-
খাবারটা আসলেই অন্য রকম। বাড়িতে গিয়ে এর গুণ গাইতে হবে।
আচ্ছা গাইবেন আর কি।
রে.করিম আপনি খাবেন না- জিজ্ঞেস করলে আমি একটু আগে খেয়ে এসেছি উচ্চারিত হয়।
তা আজগর সাহেব এমন বিরানি তাও আবার এরকম জায়গায় কিভাবে আবিষ্কার করলেন?
একবার চট্টগ্রাম যাচ্ছিলাম। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির। চা খেতে গিয়ে সেই প্রথম খেয়েছিলাম।
আরেকবার বাড়িতে যাওয়ার সময় পরিবারের জন্য কয়েক প্যাকেট নিতে হবে। রেস্টুরেন্টের নামটা?
মিল্লাত ভাতের হোটেল। স্টেশনে দক্ষিণ পাশে।

সুনশান নিরবতায় রে.করিমের জন্য নির্ধারিত ঘটনা ঘটে। সে আর নড়তে পারেনা। নিজেকে সজাগ রাখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। স্পষ্ট দেখছে তার পকেট থেকে হৃদপিন্ডটা একটানে ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে অথবা টাকার বাণ্ডেলটা অজগর নিয়ে নিয়েছে। র‌্যাকের ওপর থেকে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত চলে যাচ্ছে রে.করিম কিছু বলতে পারেনা। ক্রমশ তার পরিস্থিতি ইন্তেকাল প্রাপ্ত মরহুমের ধারে চলে যেতে লাগে। ট্রেন ‘কু’ স্টেশন থামলে অজগর নেমে যায়। রে.করিমের গন্তব্য এখানে। তাকে কে বলবে? তোমার গন্তব্যে এসেছ।

এ ঘটনায় অনেককে নীরব থাকতে হয়। হয়তো পড়া না- পাড়া লাস্ট বেঞ্চের ছাত্রের মতন অথবা রমণীর দামি চায়ের কাপের জীবন্ত পিঁপড়ার মতন। গত ছয় ঘন্টা ধরে একটা অচেতন দেহ চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের পরিত্যক্ত স্লিপারে পরে আছে। মানুষটার সারা শরীর খোলা। তার মুখের ওপর মাছি ভনভন করছে। মানুষের এ রকম দুর্দশা দেখলে মাছি শ্রেণি পতঙ্গের আনন্দের সীমা থাকেনা। আনন্দের সীমা থাকবেইবা কেন? এলাকাটা প্রতিনিয়ত গাঁজার গন্ধ ও অন্যান্য গন্ধে মাতাল থেকে নিষ্ঠুরে অথবা নিষ্ঠুর থেকে মাতালে পরিণত হতে থাকে। এমন কি মাছিগুলি পর্যন্ত মাতাল। বিশ মিটার দূরে জীবিত মাতালেরা নেশার আয়োজন করছে। আজকে এই মাতাল অথবা পরিত্যক্ত এলাকাটার অঘোষিত প্রধান অতিথি জনাব রেজাউল করিম।

____________________________________________________________

ক্ষত আত্মার বিজ্ঞপ্তি
পিয়াস মজিদ

রাতভোরের গল্প

আরেকটি রাত। আর আগের দিন রাশেদ পড়ছিল সোপ অপেরার জন্মবৃত্তান্ত। খানিকটা ভেবেছিল ম্যাডনেস নিয়ে। সুস্থতার পক্ষে দাঁড় করিয়েছিল হাজারটা যুক্তি। শেষ পর্যন্ত বাঁচতে হবে মানুষকে। লড়তে হবে, পৌঁছতে হবে গন্তব্যে। আর আর কি কি যেন। কুন্ডেরাতে ঢুকে দেখি দুই পৃষ্ঠা অর্গাজম। কিন্তু গত পরশুর ভাবনাটা ছিল পাতাল রেল বিষয়ক। তুমুল তর্ক হল স্বাতীর সাথে। কার কবিতায় যেন ‘ফেয়ারিটেল’ শব্দটা দেখে ভাল লাগল। আচ্ছা ‘মনোযৌনতা’ শব্দটা কিভাবে আনা যায় কবিতায়। কবিতায় না পারলে তাকে আনব গল্পে। ব্যর্থ কোন গল্পে। গল্পে গল্পে কাটিয়ে দেব একটি জনম। পাগলি, তোমার সঙ্গে কিন্তু ভয়াবহ জনম কাটাব। একটু লিটলম্যাগ, একটু বড়কাগজ, একটু লালন, একটু ফ্রয়েড, একটু বুশ, একটু রিয়াদ, একটু চরম, একটু নরমে মিলে ভালই চলতে পারে একটি জনম। ও বাসু ভাই, দুটো চা বানাও গরম গরম। ক্লাসে যাই গরম চা খেয়ে। ক্লাসে গিয়ে নামিয়ে আনি ক্লান্ত দুপুর। জানতে থাকি আলেকজান্ডারের বিবির নাম রোকসানা। ন্যায়-অন্যায় কিছুই জানিনে। আমি রাশেদ বলছি, শ্যামা, শুধু তোমাকে জানি। জানি তুমি ছাড়া আর সব অশ্যামা। এই যে গ্রামায়ন, নাগরিকতা, এত আলো ঝলমল, এত টুইস্টে ভরা দুনিয়া। এর মধ্যে জায়গা কোথায় আমার। আমি যে কিনা রাশেদ। রাশেদ যে কিনা শ্যামার। শ্যামা যে কিনা পার্সোনার, পিৎজাহাটের, বসুন্ধরার আর যেন কিসের কিসের?
নৃতত্ত্বের গোড়ার কথাটা নিল কে? ভেবেছিলাম রাতটা যাবে ফুকো, দেরিদা, আর স্যুসরে। না শেষমেষ চৌষট্টি পৃষ্ঠার রনজিৎ দাশ। হাল্কা সাদায়, গাঢ় লালের মলাটে কিভাবে শুয়ে আছে-
ভোর-
চড়ুই পাখির ঝগড়াটে সংসার
অতিথি সূর্য, কুয়াশা বিলীয়মান;
বৃক্ষ আকাশ খড়কুটো হাতে দ্বারে
ছটফটে কিছু স্বপ্নকে সামলান
বন্দরের কথ্য ভাষা
আরে আরে মাছির মত গল্পটা আটকে যাচ্ছে পুষ্পচক্রে। 

অল্প একটু মেরি আপা

আমাদের অনেক দিনের খরা চোখে কিছু কান্নার জন্ম দিয়ে মেরি আপা মারা গেলেন ডিসেম্বরে। শীতে। সেই মেরি আপা, বিমল মিত্রের প্রতি ছিল যার অন্ধ মুগ্ধতা। বলতেন, তোমার আছে মার্কেজ, নিস্তব্ধতা। আমার শুধু কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম। গ্রহান্তরের শ্রী যেন ভর করেছিল মেরি আপার উপর। আর তার সব অসুখের নিদান ছিল নূরজাহানের গান। কোমল ভারি সব রাগ। মেরি আপা যে বইয়ে কিংবা গানেই ভাসতেন শুধু তা নয়। ভালবাসতেন কাউকে কোনকালে। আমরা জানতাম না। কারণ তার কথা হত কেবল তারার সাথে, পশুর সাথে, পাখির সাথে। তবে এক সময় আমার সাথেও হত তার কিছু কথা। কিন্তু তার নৈঃশব্দের শ্রোতা হিসেবে, নিভৃতির দর্শক হিসেবেই আমাকে মানাত বেশি। একদিন মেরি আপা বলে উঠলেন, ‘দ্যাখ। আমি তো জীবনভর পাপের বোঝা বড় করলাম; তুই যেন আমার কনফেশন’। তখন আমার সামনেই দপ মোমটা নিভে গেল। জ্বলে উঠল অর্ধশত হিমবাতি। গলতে থাকা তুষারে ভেসে যেতে দেখলাম পিকাডর, ম্যাজিক লণ্ঠন কিংবা কিছু অন্ধকার। মেরি আপা কেন বলত অমন উল্টাপাল্টা কথা?

...না ওসব গল্পেই হয়। আজকাল গল্পেও তো আর ছিচকাঁদুনে বিষয়ে জায়গা নেই। যা হোক আমি কি বলতাম কিছু মেরি আপাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ, একবার বোধ হয় বলেছিলাম- ‘পৃথিবীটা একটা সোনালী হিংস্র ভালুক। গিলে খাবে আমাদের, তারপর উগরে ফেলবে। আমরা একটু আধটু বদলে যাব। ভালুক হব, মানুষ হব। ভালুক মানুষ। মানুষ ভালুক। ভালুক ভালুক। মানুষ মানুষ।’ আচ্ছা মেরি আপা কেন তখন সেন্ট অগাস্টিনের কথা তুলেছিলেন। জানি না এমনিতেই হবে। কেউ মরে গেলে আমরা তার মধ্যে দেবত্ব খুঁজি। সাধারণ কথাবার্তার ভেতর রহস্য সৌন্দর্য সন্ধান করে আনি।

আদতে হয়তো ধর্তব্য কিছু নয়। এমনিতেই সেন্ট অগাস্টিনের কথা বলেছিলেন মেরি আপা। পরজনমে মানুষটা সাধনা বোস হতে চাইতেন। ঠিক মধ্যরাতে তিনি নাকি শহরময় সাধনা বোসের মত নেচে বেড়াতেন। তার পা দুটো উড়ে যেত। রক্তস্রোতে ডুবত ঘর-দোর বিছানা। হায়রে সাধনা বোস। হায়রে মেরি আপা! সাধনা বোস হলেন কিনা মেরি আপা! নষ্টালজিয়ায় পুড়ে গেল আরিফ। মৃত্যুর নয়দিন পর মেরি আপা কুস্বপ্নে এলেন। বললেন, এই যে আরিফ। তোকে অনেক ভালবাসতাম। তাই তোর হাতেই দিলাম আমার সিজোফ্রেনি সব।’ আজ রাতে নাচের মজলিশে আমিও থাকব। মেরি আপার উড়ন্ত পা দেখে ভাবতে থাকব সত্যিই কি আমি তার কনফেশন। গত রাতে মেরি আপা আমাকে এই জটিল জিজ্ঞাসার জন্যে প্রস্তুত হতে বলে গেলেন। তার সবকিছু ছিল আবৃত কিংবা অনাবৃত। তাকে খুব সুন্দর অথবা কুৎসিত দেখাচ্ছিল। 
মেরি আপা...

গল্প জাগছে

সমস্ত সিডারবৃক্ষ পতিত হইয়াছে। আমরা আবার তাহা নতুন করিয়া রোপণ করিব। বাইবেল এমত বলিলেও রক্তে কেবল পতনের প্ররোচনা। তবু এই পতনই আমার শ্রেষ্ঠ বিনোদ। ও নিৎসে, এভাবেই তবে বার্থ অব ট্রাজেডি! পতনকে উদযাপন করে আমরা টেক্সটকে পাল্টাই। কিসের নির্বান, কিসের পতন? ও মেয়ে কিসের ঘুমঘোর জাগরণঘোর? তুমি শুধু পাঠক হও। আমার মনের পাঠক। সোনালি-রূপালি ভাবনার পাঠক। পাঠক থেকেই তুমি আমার দরবারি কানাড়া। কাসাব্ল্যাঙ্কা ভেঙ্গেচুরে তুমিই দিবস, তুমিই রাত্ির। তোমাতেই কাম তোমাতেই শুদ্ধিস্নান। তুমি তুমি তুমি, মৃত্যুর বান্ধবী। সুস্থ সাইকি। মধুর পাগল। সমস্ত মাধুর্য অবসিত। শুধু রোদনভরা বসন্ত। বসন্ত এক দুঃখী রাজকন্যা। বেনজিরের মত। আমরা সব ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্তরা শুষে নেই বসন্তকে। একটা রেণু পর্যন্ত অবশিষ্ট রাখি না। তবু ফিরে ফিরে আসবেই চৈত্র ও ফাল্গুন। দেবার যা দিবেই। রিক্ত হওয়াতেই আনন্দ তার। আমি বাঁধ সাধার কে? কেউ না। আমি কারো কেউ না। না রাজনীতির না ধর্মনীতির না অর্থনীতির না সুনীতির। নাড়ার আগুনে পুড়িয়ে খাব ভুট্টা। খাব বন্ধন  খাব মুক্তি। তারপর ছাইভস্মের দিকে চোখ রেখে গল্প লিখব। দেখব প্লট নেই, পাত্র নেই, পাত্রী নেই তবু গল্পের আকাঙ্ক্ষাটা থাকবে। এই হিংস্রপ্রহর তবু ফিরে ফিরে সেই শ্রমণগৌতম। দ্বিভুজ, ত্রিভুজ, বহুভুজ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে। জীব ও জড়ের বেঁচে থাকার সুরসূত্র তার জানা। হিমা, চলো পাগলামি ছেড়ে সন্ন্যাসের সাথে মিত্রতা করি। তারপর নাশকতা করি। দু’জন মিলে জাগাতে থাকি প্রতিবুদ্ধের ধ্যান। ওই তো বামদিকে কাজল, ফরহাদ ডানদিকে শিপ্রা, মাহমুদ। কিন্তু আমাকে যেতে হবে গহন কোন বনের ধারে। খুঁজে পেতে বের করতেই হবে-মিথ এন্ড মিনিং, সিলভিয়া-আনা সেক্সটন- রবার্ট লাওয়েল, শিল্প ও পুরস্কারের দ্বন্দ্ব, স্বচ্ছ ভোটার আইডি, চলতি দু’দিনের ভয়াবহ শৈত্য।   

গল্পকার, আবেগ পরিহার করে যুক্তিতে যাও। যুক্তির সীমাবদ্ধতা এই যে সে অযুক্তির প্রতি সহিষ্ণু না। 

উত্তরবঙ্গে পরপর কয়েক সন মঙ্গার পরও গল্প জাগার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

____________________________________________________________
অনুবাদ গল্প
____________________________________________________________

স্যান্ডি লেনে ভালবাসা
মূল: সেমবেনে আউজমেন
ভাষান্তর : জাকির তালুকদার

(সেমবেনে আউজমেন সমকালীন সাহিত্যের পরিচিত নাম। ১৯২৩ সালে সেনেগালের এক জেলে পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রধান শিক্ষকের সাথে সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর অমসৃণ পথ চলতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স আর্মিতে যোগ দেন। দেশে ফিরলে রেল ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে প্রথম উপন্যাস God's bits of wood লেখেন। প্যারিসে অবস্থান কালে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। অসীম সাহসী এই সৈনিক ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণের পক্ষে কাজ করে গেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন একজন চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, অভিনেতা এবং সর্বোপরি একজন লেখক। Niaye, Ceddo,Guelwaar তার উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। Los Angels Times এর মতে তিনি আফ্রিকার অন্যতম সেরা লেখক। তাকে আফ্রিকার চলচ্চিত্রের জনক বলা হয়। ২০০৭ সালে ৮৪ বছর বয়সে তিনি সেনেগালে মারা যান।)

 রাস্তায় কোনো নামফলক নেই, কিন্তু প্রত্যেকেই জানে এটা স্যান্ডি লেন। বেশি দীর্ঘ নয়- লম্বায় খুব বেশি হলে দুইশ গজ- শুরু হয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি ‘মারিয়াম বা ’ থেকে, এসে মিশেছে মেইন রোডে, সেটা চলে গেছে জেলার মধ্য দিয়ে। 

নামকরণের অনেকগুলো কারণ আছে।

স্যান্ডি লেনের মাথায় গর্বিত ও কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে হলুদ-নীলে রাঙ্গানো প্রাসাদোপম ভিলা ‘মারিয়াম বা ’। জরাজীর্ণ কুটিরগুলোর মধ্যে এই বাড়িটার আছে রাজকীয় আভিজাত্য। ধূসর জানালার ফাঁক দিয়ে তিনটি ঘর দেখা যায়, মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ফটোগ্রাফে ঢাকা। কোনো কোনো ফটো কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো। মিটমিস বা সূর্যাস্তের প্রার্থনার পরে আলহাজ মার সচরাচর ব্যালকনিতে পায়চারি করতে করতে রাস্তায় তাকিয়ে থাকেন। তার পায়ের নিচে এলোমেলো ছাদ- কোনাটি সমতল, কোনোটি কৌণিক, কোনোটি শুধু খড়ে ছাওয়া কুটির। স্যান্ডি লেনের অধিবাসীদের মনে করা হয় তাদের ভিলা নিয়ে খুবই গর্বিত, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই উপনিবেশিক যুগের এই সরকারি কর্মচারির প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করে, কারণ সে খোলাখুলি তার দম্ভ প্রদর্শন করে তার সামনে।

লেনে ঢুকতেই হাতের ডানে প্রথমেই পড়ে পুরোগনের কুটির, সামনের দিকে নিচু বালিতে শক্ত করে পোঁতা তিনটি খুঁটিতে ঠেস দেওয়া। নিচের তক্তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, জোড়া দেওয়া হয়েছে লোহার পাত দিয়ে। লাল রঙের বার্নিশটাও রোদে পুড়ে মলিন। তারপরে আছে সাধারণের জন্য কলঘর যা এখন পরিত্যক্ত। (জেলার লোকেরা বলাবলি করে যে, ১৯৫৮ সালের রেফারেন্ডামে আলহাজ মার ছাড়া সবাই ‘না’ ভোট দিয়েছিল। তাদের প্রতিবাদী চরিত্রের কারনে পানির জন্য তারা যে কোনো স্থানে চলে যেত।) এর পরে আছে ইয়ে হাদির প্রাঙ্গন, বাঁশের বাখারি দিয়ে ঘেরা। তিনি স্যান্ডি লেনের স্থানীয় সদস্য হবার ইচ্ছায় পুরনো প্রবেশমুখ বন্ধ করে দিয়ে স্যান্ডি লেন যাতে মেইন রোডের সঙ্গে মিলতে পারে সেজন্য জায়গা ছেড়ে নতুন পথ করে দিয়েছিলেন। প্রাঙ্গণের গায়ে লাগানো নিয়াং কারখানা। নিয়াং পরিবার এখনো তাদের পৈত্রিক কামারের পেশা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সূক্ষ্ম কাজের নাম-ডাক আছে। স্যান্ডি লেন প্রসিদ্ধ হবার ক্ষেত্রে তাদের অবদান যথেষ্ট। সারা শহরের মহিলারা তাদের কাছে আসে কাজ করিয়ে নিতে। বুড়ো নিয়াং বিশালদেহী, তার পশ্চাদ্দেশও বিশাল। হাসিমুখে, ভূঁরুহীন বড় বড় চোখ নিয়ে ওয়ার্কশপের বাইরে বসে থাকে। স্যান্ডি লেনের যে কোনো পথচারীকে সে সালাম দেয়, শুধু আলহাজ মারকে বাদে। তারপরে আছে সালিফের ছুতার-কারখানা। সে খুব চটপটে, গাঢ় বর্ণের মানুষ, মুড থাকলে খুব আমুদে। তবে সার্বক্ষণিক গায়ক। সে কোনো কারণে নিশ্চুপ থাকলে স্যান্ডি লেনের অধিবাসীরা চিন্তিত হয়ে পড়ে। সে কারণেই যখন সালিফের গান বন্ধ থাকে, বলা হয় ‘স্যান্ডি লেনের মানুষের’ দিনকাল এখন খুব খারাপ। সবশেষে বিশাল ‘মারিয়াম বা ’ ভিলার ঠিক আগেই বড় চালাঘরে থাকে মেইজা-পরিবার। মেইজা খুবই ধর্মপ্রবণ মানুষ। তসবিহ্‌ ছাড়া তাকে কখনো খালি হাতে দেখা যায় না। 

স্যান্ডি লেনে বামদিকের সারির প্রথমেই গ্রানি আইতা-র মাতৃকুলের বাড়ি। ইটের ভিতগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। বড় বড় ফোঁকড় দিয়ে হাঁস-মুরগি অনায়াসে চলা-ফেরা করতে পারে। তিনটি কাঠের পিলারের মাথা পরিনত হয়েছে পাখিদের বাসভূমিতে। সন্ধ্যা হলেই বাবুই পাখিরা ঝাঁক বেধে আকাশে উড়তে থাকে, ডাকে ‘ফ্যাচো-ফ্যাচো’ বলে। তাদের ডাকের জন্যই এই পাখির স্থানীয় নাম- ফ্যাচো। তাদের কালো বাসাগুলো দোল খায় অন্ধকারের মধ্যে। তারপরেই আসে মাফদো-র গুদামের কথা; সে কয়লার ব্যবসায়ী, তার বাড়ির সামনে থাকে কুটিরের সমান উঁচু কয়লার স্তুপ। এর পরেই ইয়ুথ ক্লাব। এর দরজায় চক দিয়ে লেখা ‘ইউ.এন.ও প্যালেস’। কয়েকজন ছেলে সেখানে আড্ডা দেয়, ওদের বেশিরভাগই বেকার। তবে তারা জানে না কেন তাদের কর্মস্থল থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে। দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখা যাবে ক্লাবঘরের পুরনো পত্রিকার স্তূপ, দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের ছবি। আলোচনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে যুবকেরা তাদের রাজনৈতিক আবেগ ঢেলে দেয় চায়ের কাপে। সবশেষে, ভিলা ‘মারিয়াম বা’-র উল্টোদিকে একটি অসমাপ্ত দালান। অনেক আগে একজন পুলিশ দালানটি তৈরি করতে আরম্ভ করেছিল। এখনো সেখানে পাঁজা পাঁজা ইট। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা সেখানে লুকোচুরি খেলে।

এই ছিল স্যান্ডালিনের বাইরের চেহারা, যাকে বলে বস্তুগত অবস্থা। এসব সাধারণ বাড়ি নিয়ে বেশি কিছু লেখার নেই। কিন্তু ঐ লেনের অধিবাসীরা একটা বিশেষ সম্পদের অধিকারী ছিল, যা সর্বত্রই আলোচিত হতো।

প্র্রতি সপ্তাহে এলাকার সব গৃহিনী একযোগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে লেন পরিষ্কার করত। ভোরবেলা তারা নিজ নিজ দরজা খুলে রাস্তায় দাড়াতো একটু ঝুঁকে, হাতে ছোট ছোট ঝাড়ু; তাদের ভঙ্গি দেখে মনে হতো দলীয় নৃত্য শুরু হতে যাচ্ছে। দুই লাইনের মেয়েরা এগিয়ে এসে মিলিত হত রাস্তার মাঝখানে, মনে হতো বাজনার তালে তালে, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে রাস্তা ঝাঁট দিতে দিতে চলে যেত মেইন রোডের দিকে। দূর থেকে দেখে মনে হতো মৃদু মানবী তরঙ্গ। তারপর গর্ত খুঁড়ে তারা পুঁতে ফেলত সমস্ত ময়লা আবর্জনা। লেনটা তৈরি হয়েছিল মিহি বালু দিয়ে। ফলে পায়ের তলায় মচমচ শব্দ উঠত না। এই পরিচ্ছন্নতার কারণে অধিবাসীরা তাদের প্রতিবেশী লেনের মানুষদের অনুমতি দিত এই রাস্তায় ঢোলক-উৎসব উদযাপনের। বিশ্বাসীরা পালন করত তাদের পয়গম্বরদের জন্মদিন এই লেনেই।

এটা ছিল শহরের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ লেন। এটাই শহরের একমাত্র লেন যেখানে বাস করে বিচিত্র ধরনের মানুষ, অথচ গভীরভাবে তারা একতাবদ্ধ। কিন্তু একটি সাধারণ ঘটনার জন্য, যা এই সময়ে খুবই সাধারণ এবং অহরহ ঘটছে, এই রকম একটি সম্পর্কের জন্য এই সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল...। স্যান্ডি লেনের অধিবাসীরা কেউ কারো দুর্নাম ছড়াতে অভ্যস্ত নয়, কিন্তু এবং এটাই হচ্ছে সমস্ত সমস্যার মূল- তারা একে অপরকে বিশ্বাস করত না।

আলহাজ মারের দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম কন্যার নাম কিন। তার সৌন্দর্যের খ্যাতি ছিল শহরময়। ক্লাবের ছেলেরা যেসব গান গাইত, সেগুলোর প্রধান বিষয় ছিল কিনের দেহ-সৌন্দর্যের বর্ণনা। যখন সে বাজার থেকে কেনাকাটা করে ফিরে আসত, তার ঈষৎ চ্যাপ্টা মাথাটি থাকত খোলা, তার চমৎকার সুগঠিত কাঁধ সামান্য হেলানো, বোরখার ওপরে বেরিয়ে থাকা তার ভেলভেটের মত মৃসণ গ্রীবা, এবং তার সোজাসোজি হাঁটার ভঙ্গি দেখে পথচারিরা তার দিকে তাকিয়ে বারবার মুগ্ধ চোখে না তাকিয়ে থাকতে পারতনা। কেউ কেউ তাকে লক্ষ্য করে বাতাসে ছুঁড়ে দিত কিছু শব্দ, চেষ্টা করত উত্যক্ত করতে। আর কিন হেসে ফেলত তার ঝকঝকে দাঁত বের করে।

স্যান্ডি লেনে কিছুই গোপন থাকে না, কিন্তু এ বিষয়ে কেউই কোনো কথা বলত না। সবাই জানত, কিনের হৃদয় ইয়োরোর কাছে বাঁধা। কয়লা ব্যবসায়ীর ছেলে ইয়োরো ছিল লাজুক প্রকৃতির কিন্তু সে ‘কোরা’ বাজাত খুব ভালো। মাঝে মাঝে সে ক্লাবের আড্ডা থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যেত। ‘মারিয়াম বা’-র জালানার সামনে গিয়ে কোরা বাজানো শুরু করত। কিনের সঙ্গে মুখোমুখি হলে, কিংবা দুজনের চার চক্ষু একত্রে মিলিত হলে দু’জনেরই রক্তের মধ্যে মধুর একটা স্রোত বয়ে যেত,  মিষ্টি রক্তের স্রোত, স্রোতটি পায়ের আঙ্গুল থেকে শিরা বেয়ে উঠে যেত উপরের দিকে, তারা অনুভব করত এক ধরণের উষ্ণতা; যে কোনো কিছুর চেয়ে বেশি উষ্ণ।

স্যান্ডি লেনের অধিবাসীরা ছিল সরল-সহজ। তারা এই জুটিকে পছন্দ করত। এই প্রেম তাদের নিজেদের বিগত প্রেমের কথা মনে করিয়ে দিত বলে ওদের জন্য একটু ষড়যন্ত্রমাখা আশীর্বাদ করত তারা। তারা সোজাসোজি মনে করত যে, যদি একজন ছেলে ও একজন মেয়ের মধ্যে প্রেম হয়, তাহলে কোনোকিছুই সেই প্রেমকে রুখতে পারে না।

স্যান্ডি লেনের অধিবাসীরা কথা বলাবলিতেও তেমন পটু নয়, তারা বাক্যবাগিশ নয়, তবু তারা গোপনে, নিজেদের ধরণে একটা বিবাহ উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। পুরুষ বা মহিলা যে কেউ কিনের সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করত- ‘ইয়োরো কেমন আছে?’

আবার ইয়োরোকে জিজ্ঞেস করত- ‘কিন কেমন আছে?’

দুপুরে এবং  সন্ধ্যে ছয়টায় কাজ শেষ করেই ইয়োরো চলে যেত পোরোগ্‌নে-র দোকানে, যেখান থেকে ভিলাটাকে পরিষ্কার দেখা যায়। সে সবগুলি জানালায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বারবার। কিন জানে, একসময় তার কাজ শেষ হবার কথা। যদি সে দাঁড়ায় জানালায় এসে! স্যান্ডি লেনের সবাই জেনে গেছে এই যুগল কী পদ্ধতিতে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে। তারা কোনদিনই বেশি কথা বলত না। অবশেষে কচ্ছপ-কবুতর এই মূকভাষা পরিত্যাগ করল। রাত্রে, শেষ প্রার্থনার পরে প্রত্যেকেই ঘরের বাইরে এসে বসে এবং রাত যখন নক্ষত্রখচিত চাদর গায়ে জড়িয়ে নেয়, ইয়োরো তখন অন্ধকারে বসে কোরা বাজানো শুরু করে। ঐ সময় কিন-ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে ভিলার বাইরে বসে থাকে। কোরা-র মাধ্যমেই যেন ইয়োরোর হৃদয়ের বার্তা পৌছে যায় কিনের কাছে।

স্যান্ডি লেন এমনিতেই সুপরিচিত। এর কথা লোকগীতিতেও স্থান পেয়েছে। আলহাজ মার নিজের ভিলাতে মাঝে মাঝেই আমন্ত্রণ জানাত লোককাহিনির কথকদের। কিন ও ইয়োরোর নিঃশব্দ প্রেমের কথা ছড়িয়ে পড়ল মুখে মুখে। কিন্তু তখনো দুজনের কেউই চোরাদৃষ্টি বা কটাক্ষ, কিংবা কোরা-র সুরের গন্ডির বাইরে পা বাড়াতে সাহসী হয়নি।

একদিন অধিবাসীরা দেখল দেশের প্রভাবশালী লোকদের আগমন  ঘটছে স্যান্ডি লেনে। তাদের মধ্যে ছিলেন একাধিক মন্ত্রী, কয়েকজন সচিব এবং আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা উঠলেন আলহাজ মারের ভিলায়। সারাদিন ধরে চলল অঢেল খানা-পিনা। এভাবে তারা কয়েকবার আসা-যাওয়া করলেন। প্রত্যেক সপ্তাহে ভিলার সামনে গর্ত খুঁড়ে বিশাল চুলা জ্বালানো হয়, আগুনে ঝলসে তৈরী হয় আস্ত ভেড়ার রোস্ট। স্যান্ডি লেনের মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে বড় অফিসারদের বিলাসবহুল গাড়ি।

ক্লাবের সদস্যরা ইয়োরের পক্ষে ছিল। তারা হতাশ হয়ে পড়ল। অন্য অধিবাসীরা যেহেতু অভিজ্ঞ, অপমানে নিজেদের মধ্যে গজগজ করত। প্রত্যেকদিন, দুপুরে এবং সন্ধ্যা ছয়টায় তাদের দৃষ্টি থাকে মাটির দিকে নিবদ্ধ; রাত্রে কোরা-র ঝংকার শোনা যায় না। এক মাস পর স্যান্ডি লেনে একটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হলো-এবং ইয়োরো উধাও হয়ে গেল। তিন মাস পরে কিনকেও আর দেখা গেল না। (জনশ্রুতি আছে প্রেমিকযুগলের অন্তর্ধানের পরে দুইটি গাছ লাগানো হয়েছিল- একটা পুরুষ, একটা নারী।) এরপরে স্যান্ডি লেন তার গৌরব হারাল। রাস্তায় ময়লার স্তূপ, গৃহিণীরা তাদের ময়লা ছুঁড়ে দেয় ‘মারিয়াম বা ’ ভিলার সামনে। এই লোকগুলো আগে কখনো কসম পর্যন্ত কাটতো না, তারা হয়ে পড়ল কটু-বক্তব্যের আধার। যুবকরা ছড়িয়ে পড়ল এদিক-সেদিক। এখন আর এলাকায় ধর্মীয় উৎসব পালিত হয় না, ড্রামের শব্দও শোনা যায় না।

স্যান্ডি লেন পরিণত হলো পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখময় স্থানে।

এবং আমি ডাকার যাবার পথে ভাবলাম, সমস্ত শহর না আবার একই অভিশাপে আক্রান্ত হয়।


____________________________________________________________
ফিরে দেখা কবিতা
____________________________________________________________

শামীম কবীরের অগ্রন্থিত কবিতা

শামীম কবীরের জন্ম ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল  বগুড়ার কাহালু গ্রামে নানা বাড়িতে। শৈশব থেকেই শামীম কবিতা অনুরাগী। রংপুর ক্যাডেট থেকে মাধ্যমিক এবং রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর প্রথাগত পদ্ধতির পড়ালেখার প্রতি অনীহার কারণে একাডেমিক পড়াশোনার সাথে সম্পকের্র ছেদ ঘটে। কিছুদিন বিরতির পর বগুড়ার আজিজুল হক কলেজে গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হলেও তা শেষ করেননি শামীম এবং সেসময়ে লেখালেখির সাথে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত সময়ে লিটল ম্যাগাজিনকেন্দ্রিক ঢাকার সাহিত্য জগতের সাথে শামীম   প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। নদী, প্রান্ত, দ্রষ্টব্য, রূপম, একবিংশ ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিনে তাঁর কবিতা প্রকাশিত হত। ব্যক্তিগত জীবনে শামীম খুব শান্ত প্রকৃতির হলেও ভেতরে ভেতরে ছিলেন প্রচন্ড অস্থির। কবি বন্ধুদের সাথে তাঁর  বোহেমিয়ান জীবন-যাপন  পরিবার ও সামাজিক দৃষ্টিকোণে অগ্রহণযোগ্য ছিল। শামীমের কবিতা নব্বই দশকের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক। নিজস্বতায় ঋদ্ধ নাগরিক ব্যক্তির-নৈঃসঙ্গ, যন্ত্রণা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি আর বিচ্ছিন্নতাবোধের চর্মহীন কঙ্কাল যেন শামীমের কবিতা। তবে লোকজ ও স্থানিক উপাদানও তাঁর কবিতায় অনুষঙ্গ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। তিরিশের কবিদের ধারাবাহিকতায় বাংলা কবিতায় আধুনিক নিঃসঙ্গ মানুষের যে নৈর্ব্যক্তিক উপস্থিতি; শামীম কবিতায় তারই ব্যবচ্ছেদ করেছেন মর্গের দমবদ্ধ ঘরে। সাড়ে চব্বিশ বছরের স্বল্পায়ু  জীবনের প্রায় অনেকটা সময়জুড়ে কাটিয়েছেন কবিতার অনুষঙ্গে। লেখার পাশাপাশি শামীম ছবি আঁকতেন এবং চমৎকার গান গাইতেন।

দ্রষ্টব্য থেকে শামীম কবীর সমগ্র বের হয় ১৯৯৭ সালে। ২০১০ এর বই মেলায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে -নির্বাচিত কবিতা: শামীম কবীর।

এই ঘরে একজন কবি

এই ঘরে একজন কবি আছে রক্তমাখা গালিচায় শুয়ে
কুয়াশার মতো-তার নিদ্রামগ্ন ভাসমান চোখে ধীরলয়ে
শীর্ণ এক নদীর প্রতিমা ফ্যালে সুরময় ছায়া, শতাব্দীর
শুদ্ধতম শিলাখন্ড শিয়রে তার-ঠিক একগুঁয়ে
ধীবরের মতো: ছিন্নভিন্ন-ছেঁড়া জালে কৌশলে মরা নদীর
শ্রোণী থেকে অপরা রূপালি ইলিশ ছেঁকে নেবে;পঁচা ঘা-য়ে
গোলাপের মধু ঢালা-অভ্যেসে দাঁড়িয়েছে য্যান। ভীষণ অস্থির
হাতে সে ক্যাবল বিষন্ন খুঁড়ে চলে শব্দের গোপন তিমির।

কবির আঙ্গুল থেকে অনর্গল রক্ত ঝরে আর মূর্তিবৎ
অন্ধকারে প’ড়ে থাকে সে-ক্যামন মর্মন্তুদ অদৃশ্য বল্কলে
ঢেকে অস্তিত্বের ক্ষত। অবশ্য মাঝে মাঝেই বদ্ধ ঘরময়
গলিত বাতাস কাঁপে-অন্তর্গত সজীব গর্জনে:বাঁধা গৎ
ভুলে গিয়ে-নিদ্রিত কবির বীণা সহসা কী প্রখর আদলে
গড়ে সুরের প্রতিমা, অথচ খোলে না তার অন্ধ চক্ষুদ্বয়।।


মালিনীকে জল তুলে দিতে হলে বাগানেই রাত্রপাত হবে 

কয়েকশো হাজার আর আরও একটি
করাতের মধ্যে শুয়ে
ঠ্যাং তুলে কে আবার গান গায়

তবে সোমবারে গায়
(তখন অনেক রাত যখন দুপুর)

সৌরালোকে মধ্যে মধ্যে
ছিটকে আসা গোলার্ধগুলিই
সাথে সাথে মিলবার সময়
যখন তখন কেউ পা-হারার বন্ধনীতে
রং নয় রং নয় রক্ত ঝরিতেছে

নভেরা একদিন রাতে উপরোক্ত করাত দিয়ে
পা কাটবার দৃশ্য স্বপ্নে দেখলাম
তারপর জেগে উঠে জ্ঞান হাতড়ে পেলাম যে
I have been bitten
O the sickness of mine is a cosmic
event.
ফের বলি :
অগ্রাহ্য করি না তবু তবে
মালিনীকে জল তুলে দিতে হলে বাগানেই রাত্রপাত
                                                             হবে
যেহেতু পাদুকা আছে জেনে
চলে যাই 


এইখানে থামো ট্রেন

এইখানে থামো ট্রেন মাঠের পাশেই
একটু হিজলতলা একটু কাঁঠাল বন
তারপর খেলা শেষে পঙ্গপাল 
গৃহে ফিরে যায় ধুলা মেখে
একে একে ছুটে আসে স্টেশনেরা
কিছুক্ষণ থেমে থাকে ফের ছোটে দূরে
আবছা দ্যাখার কথা খালি
জেগে জেগে থাকে
দ্রুতষ্মান আগের স্টপেজে
সোনাভান


জুয়া

এখন আমরা আকাশের কাঠে সাদা দাঁত খোদাই করা নস্যির ঘোরে
বারবার হাঁচি দিয়ে খুব হাসছি (এরচে-বাতাসের প্রধান গন্ধ 
অথবা দিনভর নিরালায় স্বপ্নের ঢেউ গোনাও ভালো ছিলো ঢের)-

ইদানিং, তরল হবোনা বোলে মুখ কাঁচুমাচু কোরে থাকলেও হামেশাই
আমাদের কেউ কেউ নানাবিধ কর্মকান্ড কোরে যাচ্ছে সুবিখ্যাত বোকার
ধরণে। য্যামন - সেদিন মধ্যরাতে জনৈক প্রৌঢ় মধ্যবিত্ত রাস্তায় হাঁটতে
গিয়ে পেয়েছেন অর্জুনের তীর ডাস্টবিনে : এসে খুব চিন্তাগ্রস্তের 
মতো আমাদের বোল্লেন, ধবধবে টার্কিশ তোয়ালেয় তাকে জ’ড়িয়ে 
খুব-রেখেছেন উটকুঁজো বালিশের তলায় লুকিয়ে; চুপি চুপি 
ডেকে নিয়ে আমাদের দ্যাখাবেন বোলে। এ-সময় হাতে একটা 
গন্ধলুপ্ত অর্জুনের ডাল ছিলো তাঁর, আর দীর্ঘখন অর্জুনের গন্ধহীন 
লঘুতাপ ঠোঁটের কোণায় কোরে, শ্যাওলা-পিচ্ছিল - তাঁর চৌচালা 
ঘরের ভিটেয় ঢুকে,স্প্যানিয়েল কুত্তার একরাশ লোম ওঠা ছাল 
ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পাইনি আমরা-আর। ফিরবার মুখে-চোখ
পড়লো উঠোনের মধ্যিখানে - তরুণ অর্জুন গাছের মগডালে অদ্ভুত 
বে-কায়দা ঝুলছেন প্রৌঢ় অর্জুন। সেখান থেকেই তিনি ভেংচি কেটে -
বোল্লেন,ও ব্যাটা কুকুর ছিল ঢের বেশি মানবিক প্রাণী-অথচ মরার 
আগে বোলে গ্যালো, “আমার বাকল খুলে চটপট ঝুলে পোড়ো বাছা।”
তাঁর কথাগুলো ক্যামোন-হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট ছেলের অভিমানী 
ফোঁপানো কান্নার মতো শোনাচ্ছিলো।

তারো আগে, সেবার নগরীর নামকরা বেশ্যাটা ম’রে গ্যালো-নিতান্ত 
অনিচ্ছায় সকলের আর বড্ড অসময়ে, বলা যায়। মৃত্যুর পর তার 
(অবিকল স্বর্গায়িত)-আনন্দ ভবন-এ আমরা ঢুকেছিলাম সদলে-
অপার্থিব দ্যুতিময় প্রাসাদের প্রধান কামরায় গণিকার সুশোভিত দগ্ধ 
দেহের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটালাম মোহাবিষ্টের মতো; অতঃপর 
প্রাথমিক বিমূঢ়তা কাটাতেই দেখি-স্থির, অংশীহীন শিকারী একজন 
ব্যাপক -পাখি হত্যার আয়োজন কোরছেন গণিকার কামদগ্ধ খাটিয়ায় বোসে।
 আমরা বোল্লাম, “ হে নিপুণ ব্যাধ, চাদ্দিকে অতিদ্রুত ক্ষয়িষ্ণু 
পক্ষীকুল,তাই- বরঞ্চ এসময় হাতিই হবে খুব যোগ্য শিকার...”
শিকারি ঈষৎ হেলিয়ে মাথা-বোল্লেন, “রাত বড্ড গাঢ় হে! কী- হবে 
শিকারে আর-তারচেয়ে চলো দেখি-শেষকৃত্য সারি এইবেলা।”
তারপর, কী অবাক। -দেখি, চারপাশে বহুমিশ্র সামাজিক ছাই আর
তার মাঝে-আলোকিত যজ্ঞমঞ্চে বোসে, গণিকার গোপন ত্যানার 
স্বাদ চাটতে চাটতে নীলচক্ষু বিনাশী নিষাদ-অকস্মাৎ হোলেন 
সন্ন্যাসী। আমরা ধ্যানীর মতো(বিহ্বল) নতমুখে সারি সারি-
হাঁটু গেড়ে বোসলাম গণিকার প্রাসাদ প্রাঙ্গনে। যজ্ঞ শেষে, ফিরে 
আসবার মুখে-কী ভেবে বেশ্যার তাপহীন নরোম উরুর জোড়ে 
আলগোছে উঁকি দিয়ে দেখলাম, নগ্ন দেহ সন্ন্যাসীবর ত্রস্তহাতে 
পরিধেয় বাঘের ছালে মুদ্রা বাঁধছেন,-আর সুনিশ্চিত মৃত্যু নিয়ে
যাবতীয় সাদা পাখি প’ড়ে আছে পাশেঃ আমরা কী ভীষণ নারকীয় 
ক্রোধে-একে একে খুঁজে পেতে সমস্ত সাদা হাতি মারলাম বিষমাখা 
তীরে। প্রহরান্তে -কী বিশাল নাগরিক সম্মিলনে সর্ব-সম্মতিতে 
নিশ্চেতন সাদা বৃংহতির দাঁত খুলে-অতি যত্ন সহকারে, একাগ্র 
শিল্পীর মতো, গণিকার পাশে-খোদাই কোরলাম তাতে-অভিশপ্ত-
মোহময় সন্ন্যাসীর শব।

অবিরাম নস্যির তোড়ে- এখন কিন্তু, মৃত হাতি জ্যান্ত হোয়ে গ্যাছে।


(কবিতা সংগ্রহ ও ভূমিকা লিখেছেন: নভেরা হোসেন)
____________________________________________________________

সাবদার সিদ্দিকি
অক্ষরগণ শব্দ হন/ শব্দগণ বাক্য হন

মস্তিষ্কে শূন্যতা জমে আছে। আমরা সেই শূন্যতার সমাধান খুঁজে না-পেলেও সাবদার সিদ্দিকি ভাগ্যের মত অনিশ্চিত জীবনের রেখা এঁকেছেন। যা প্রতিষেধক স্পর্শ। ঝাপসা দৃষ্টির সামনে তার কবিতা চশমা বা লেন্স। চারপাশে স্পষ্ট দেখতে সাহয্য করে।
‘অক্ষরগণ শব্দ হন/ শব্দগণ বাক্য হন/ ব্যকরণ ধ্বনি হন/
ধ্বনিগণ হন প্রতিধ্বনি’ অতএব-
শুদ্ধ জীবন হন
জীবনকে জাপটে ধরে/ কবি হন সাবদার সিদ্দিকি।’
১৯৫০: সাবদার সিদ্দিকি কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ তে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা পরিবার সমেত পিতার সঙ্গে চলে আসেন সাতক্ষিরায়। ‘১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর সাতক্ষিরা থেকে প্রকাশিত দেশাত্মবোধক কবিতা সংকলন ‘অনন্য স্বদেশ’ এ প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। পরে কবিতা সংবলিত দু-তিনটি ছোটো পুস্তিকা বা সংকলন প্রকাশিত হয় পা, গুটিবসন্তের সংবাদ, সোনার হরিণ প্রভৃতি। সব দেশ সব ভাষার সব কালেই এ রকম দু-একজন সৃষ্টিছাড়া কবি-শিল্পী থাকে। সাবদার সিদ্দিকি প্রকৃত বোহেমিয়ান। তার পোষাক ছিল নিজস্ব পরিকল্পনার। স্বনির্বাচিত ছালা বা তোষকের কাপড়ের তৈরি আলখাল্লা পরা লম্বা চুলের তাকে দেখে যখন মনে হতো প্রায় উন্মাদ, তখনই তার মুখ খুললে ঝরে পড়তো বিশুদ্ধ বাংলা ভাষার মনিমুক্তা-দর্শন, কবিতা বা ক্রোধে রঞ্জিত বা জারিত।
১৯৯৪ঃ জীবনের শেষ পর্বে দিল্লিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পরেও বাংলাদেশে আসার জন্য ব্যকুল হয়েছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে ফিরে আসতে গিয়ে সাতক্ষিরার কাছে বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে এসে মৃত্যু ঘটে।

কয়েকটা শব্দ

১.একজন পুলিশ একটি রাষ্ট্র।

২. কাক ও সাম্রাজ্যবাদ মূলত জ্ঞাতিভাই।

৩.গৌতমবুদ্ধ কয়েক কোটি লোককে
গৃহহারা করেছেন এটা সুমহান
সত্য।

৪.মিসেস ইসাবেলা পেরন একজন
মহিলা ফ্যাসিস্ট।

৫.গোলাপ মূলত চরিত্রহীন ফুল
গোলাপের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণ
করা যাক।

৬.শান্তির পিকাসো পারাবত
এযাবত কোন ডিম্ব প্রসব
করেননি, একথা জেনে
দুঃখ পাওয়া ভাল।

৭.জাতিসঙ্ঘের বদলে
একটি কম্পিউটার যথেষ্ট।

৮.মানুষ মহাশূন্য করায়ত্ত করেছে
এ কথা যেমত সত্য সেমত
মানুষের সাথে মানুষের ব্যবধানগত
মহাশূন্যতা আজও করায়ত্ত
করতে পারিনি।

৯.মাও সেতুঙ একটি মাংস
উপগ্রহ।

১০.একজন গেরিলা ও সন্নাসীর
মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই
যেহেতু উভয়েই
মূলত ভ্রাম্যমাণ।

কবি ও নির্দিষ্ট ভূখন্ড
কেনানা একজন কবি কোন রাষ্ট্র নন।
নির্দিষ্ট সুনির্দিষ্ট কোনই ভূখন্ড নেই একজন কবির
সৌর সংসারেও নয়
পৌর সংসারেও নয়।
একজন কবি, কম্পাসহীন কলম্বাস।

যেরকম ধর্মের নিজস্ব নির্দিষ্ট কোন ভূখন্ড নেই
সে রকম ধর্মের কবিতার নেই কবির নেই
সৌর সংসারেও নেই
পৌর সংসারেও নেই।
কবি ও কবিতার তাই নিজস্ব ভূখন্ড নেই
ধর্মেরও তাই নিজস্ব ভূখন্ড নেই
একজন কবি তাই চতুর্থ বিশ্বের নিঃসঙ্গ নাগরিক।

স্বায়ত্তশাসিত সভ্যতা চাই
এই গহন দহন এই শীত এই তাপ উত্তাপ নিয়ে
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সভ্যতার কাঁচের পিরামিডে
আছি আমি, স্ফিংসের মতো বসে আছি।
অথচ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রিত এই অসভ্য সভ্যতা
আমার চিন্তার রথের- উল্টোরথের ঘর্ঘর গর্জন নিয়ন্ত্রণ
করতে জানি, জানি পারিনিকো পারলো না পারবে না কোনদিন।
আমি নিয়ন্ত্রিত হয়ে নয় নিয়ন্ত্রিত করতে ভালোবাসি
অর্থাৎ আমি নিয়ন্ত্রিত করতে চাই সব কিছু   যা কিছু
আছে আর যা কিছু ছিল
এই অমানবিক পারমানবিক সভ্যতা শুধু জানে
জন্ম ট্রাফিক আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ
কম্পিউটারের অনুকম্পাগামী কম্পিত প্রকম্পিত
ক্লীবজীব
এই ক্রন্দন এই নিয়ন্ত্রণ এই বন্ধন কবে
ছিন্নভিন্ন বিচ্ছিন্ন

ষোলো পক্তি শব্দ
বিয়ার যেমন তরল তরুণ উচ্ছ্বাস
সঞ্চারিত হয়ে যায়
এক ভিন্ন ইলেক্ট্রনিক জোসনায়
মাথা যখন কখনো কখনো কারো কাছে পা
কখনো কখনো তখন মাথা হয়ে যায় পা।
তরল উচ্ছ্বাসে তবু ফেনিল কণ্ঠ হাতুড়ি ঘা মারে
ইথারে আয়নোস্ফেয়ারে।
চিৎকৃত তরুণ কণ্ঠ যেখাবে ইথারে

কে কার বিচার করে?
আদালত সময়ে বিচারক অবশেষে
পরচুলা শাদাকালো পোষাক তুলে নেয়
কাঠের হাতুড়ি হাতে।

কাব্যের নর্তকী উলঙ্গ হতে হতে
ক্লান্ত হয়ে যায়
প্রতিফলিত প্রৌঢ় রেটিনায়।
মস্তিষ্ক ধুতে ধুতে হয়ে যায়
কাগজ সাদা হয়ে যায়।

____________________________________________________________

সৈয়দ আহমাদ তারেক
[বিজ্ঞাপিত প্রকাশ বা খ্যাতি সচেতন ভাবেই এড়িয়ে চলেন তিনি। ষাটের দশক থেকে কবিতা চর্চা করছেন। পাবলিক লাইব্রেরিতে দৈনিক বাংলার পুরনো সংখ্যায় হঠাৎ করেই খুঁজে পাওয়া গেল তার কিছু কবিতা। হারিয়ে যাওয়া এ সব কবিতার ধার কবির সেসময়কে আমাদের মনে করিয়ে দেয়। আপাদমস্তক এ কবির একমাত্র প্রকাশিত কবিতার বই  ‘শোকসভা বিকেল পাঁচটায়’]

পাঠক, শুনুন
পাঠক, শুনুন- একজন ঐকান্তিক মহিলার সাক্ষাৎকার
নিতে গিয়ে আমি বাসের হাতলে ঝুলতে ঝুলতে যখোন
বাড়ি ফিরি, তখোন আকাশের নিষ্ফল নক্ষত্রগুলোতে
বেঁধে দিই আমারই মতো আমার একান্ত প্রার্থনার প্রতিকৃতি,
     আমি হবো সকাল বেলার পাখি।

এবং বিশ্বাস করুন, সেই দিন থেকে - আমি মৃত্যুকে
ঘেন্না করতে শিখেছি; যেদিন সেই মহিলার আহ্লাদিত
সময়ের কাছে গিয়ে আমার ব্যক্তিগত শব্দাবলী হারিয়ে
ফেলি, জীবনকে দেখার অপরূপ আতস আলোকে প্রার্থণা
      আমি হবো সকাল বেলার পাখি।

২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪



পউষ এলো যুবরাজ
কখনো কোনদিন দেখছি শৈশব
পেরিয়ে কৈশোর এলেই কেউ-কেউ বিকেলের ট্রেনের কথা
ভুলে যাচ্ছে, দেখছি হাসুর ছায়া মেঘে মেঘে
বৃষ্টি এনে দিলে কোথাকার আলী হোসেন খুশি হচ্ছে-

কখনো কোনদিন দেখছি একজন
পঙ্গু, সাবেক মুক্তিযোদ্ধা নিজের বিপন্ন অস্তিত্বের কথা
ভেবে ভেবে কেবলই ক্লান্ত হচ্ছে,
রেণু কে ভালোবাসতো বলে যে তরূণ যুদ্ধে গিয়েছিলো
একলা উদাস সে এখোন
আকাশ নীলিমা ভালোবাসে, ক্রাচকে সাথী করে
হাসপাতালের সাদা করিডোর পেরুচ্ছে,
মৃত্যু প্রার্থনা করছে, দেখছি।

কখনো কোনদিন এতোসব দেখতে দেখতে
এই আমি চোখের ভেতর ভালোবাসার
সতেজ ফুল, শীতল নিঃশ্বাস
প্রহরে প্রহরে আতর মাখা গন্ধ উদাস
রৌদ্র ঝড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বেশ আছি,
শান্ত সুবোধ কণ্ঠ নিয়ে কেবল বলছি
পউষ এলো যুবরাজ, এবার তুমি-উঠে দাঁড়াও।

১০ ডিসেম্বর, ১৯৭২


____________________________________________________________
মুক্তগদ্য
____________________________________________________________

সময়ে শিল্পীর প্রতিকৃতি ভাবনা
যামিনী কবিয়াল

সৃজনশীলতা মানুষের স্বভাবজাত। পাথরকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার অথবা পাথরের ঘর্ষণে আগুনের আবিষ্কার। এসবই মানুষের শিল্পী স্বভাবেরই পরিচায়ক। প্রকৃতিতে টিকে থাকার বাসনাই শিল্প সৃষ্টির মূলে। বলা যায় মানুষের সব কাজই শিল্পের অন্তর্ভূক্ত। সুন্দর করে কথা বলা থেকে সুস্বদু রান্না সবই শিল্প।

মানুষের যেসব শিল্পকলা চর্চার ধারা আমরা সময়ে প্রভাব বিস্তারি হিসেবে দেখি; সেইগুলোর মধ্যে আছে সঙ্গীত, নৃত্য, সাহিত্য, চিত্র, ভাষ্কর্য, স্থাপত্য, চলচ্চিত্র এসব। সময় পরিক্রমায় এসব শিল্প মাধ্যম বিবর্তিত হয়েছে; মানুষের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে। এসব শিল্প ধারণ করছে সময়কে, সময়ের মানুষকে, তাদের বিশ্বাস, বিধি-ব্যবস্থাকে। যার ফলে, এক সময়ের সাধারণ বস্তুও অন্য সময়ে এসে দাঁড়াচ্ছে অসাধারণ শিল্পবস্তুতে।

প্রতিকৃতিতে প্রতিভাত সময়ের স্বরূপ:
প্রতিকৃতি বলতে সাধারণত কারও দেহের ছবিকে বোঝানো হয়। শিল্পের সূচনা থেকে আমরা প্রতিকৃতির নিদর্শন পাই। বাইসনের প্রতিকৃতি পাই গুহা যুগে; যা সেই সময়ের প্রতিভু। রাজা-বাদশা তথা পৃষ্ঠপোষকশ্রেণি, ফরমায়েসি ছবিসহ বহু ধরণের প্রতিকৃতি চিত্র আমরা দেখি শিল্প ইতিহাসে। রানী নেফারতিতি, মোনালিসা এগুলো বিখ্যাত প্রতিকৃতি চিত্র। 

মানুষের দর্শনগত বিবর্তনের সাথে সাথে তার রচিত বা নির্মিত প্রতিকৃতিতে শুধুমাত্র বাহ্যিক অবয়বের বাইরে ব্যক্তির মনোজাগতিক চিত্র ও মূর্ত হতে থাকে। মূলত বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সমান্তরালে ব্যক্তি জীবনের বহুবিদ জটিলতা আরো সরাসরি শিল্পের বিষয় হিসেবে ধরা দেয়।

ব্যক্তির ভাব, কল্পনা, বোধ, বিশ্বাস এসব মূর্ত হয় প্রতিকৃতিতে। সমাজ-রাষ্ট্রীয় তথা বৈশ্বিক ভাবনায় ব্যক্তি মানুষ উঠে আসে চিত্রে। এভাবে বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতি মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইন্টারনেট, মুঠোফোন এসব প্রযুক্তির ব্যবহার; এর সাথে সাথে পৃথিবীর জাতি, রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মতভেদ আরো প্রকট হওয়া, পৃথিবীটা আরো জটিল যুদ্ধাবস্থার দিকে ধাবিত হওয়া, এসব বিষয়ের সাথে প্রকৃতির আরো বিরূপ হয়ে ওঠা। এসব মানব সভ্যতার ক্রম বিপন্ন অবস্থার কথা স্মরণ করায়। শিল্পে ওঠে আসে এসব চিত্র।

গত শতাব্দী জুড়ে যে সব শিল্প প্রচেষ্টার নিদর্শন পাই, সেখানে পূর্ববর্তী সময়ের সরল, এক রৈখিক ভাব হারিয়ে যায়। দুটো বিশ্বযুদ্ধ পার করা শতাব্দীর শিল্পরূপ দাঁড়ায়; মানুষের জীবনের মতো জটিল, প্রতিবাদী, বিক্ষুদ্ধ। 

ব্যক্তির সংকট বৈশ্বিক হলে, ব্যাক্তির বীক্ষণ বৈশ্বিক হলে; ব্যক্তির আত্মপ্রতিকৃতিও বিশ্বের প্রতিকৃতি হয়ে ওঠে।
এক্ষেত্রে শিল্পী একহয়েও বহু মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। যা প্রতিকৃতির ধারণাই পাল্টে দেয়। এভাবে যে কোন সার্থক শিল্পই শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি হয়ে ওঠে।  অর্থাৎ শিল্পী নিজেরই প্রতিকৃতি নির্মাণ করেন।

জীবন যাপন করতে গিয়ে মানুষ নিজের প্রয়োজনে নিজের আচরণের রূপরেখা নির্মাণ করে চলে প্রতিনিয়ত। সেই রূপরেখা সময়ের নিরিখে অন্য মানুষের কাছে কখনো শিল্প হিসেবে ধরা দেয়।

২৩/০১/২০১০ ইসায়ি।

____________________________________________________________

একটি প্রাচীন ইস্তাহার 
রণজিৎ দাশ 

[বাতিল কথার সংগ্রহশালা থেকে প্রাপ্ত এই প্রাচীন ইস্তাহারটি আধুনিক ভাষায় এবং উপাদানে পুনর্লিখিত। এই ইস্তাহার কবিতা-বিষয়ক এবং এটির বিষয় কবিদের যোগাভ্যাস ও তৎসংক্রান্ত কৌতুক। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই ইস্তাহার কবিদের উদ্যম, উন্নতি এবং উচাশার পক্ষে ক্ষতিকর।]

১. সঙ্ঘমানসে কবিদের কোনো ইস্তাহার হয় না, যেমন সমুদ্রগর্ভে ডুবুরিদের কোনো ভাষণ হয় না। 

২. কবিতা লেখা একটি গোপনীয় এবং নিষিদ্ধ কাজ, পরিত্যক্ত সরাইখানার চোরাকুঠুরিতে বসে গুপ্তধনসন্ধানীর মানচিত্র আঁকার মতো। কাজেই আশেপাশে যেন কোনো ছন্দমুগ্ধ ছোটমাসী বা উৎসাহদাতা খুল্লতাত না থাকেন। কবিতা লেখা শুরুর পর প্রথম দশ বছর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতবাসে থাকাই শ্রেয়, এই অজ্ঞাতবাস তিরিশ বছর অব্দি পালন করতে পারলে একটি ক্লাসিক লেখার সম্ভাবনা জন্মায়। 

৩. ভালো কবিতা এবং খ্যাতি সমার্থক। খারাপ কবিরাই কেবল খ্যাতির জন্যে আকাশপাতাল ছুটে বেড়ান, এবং আরো খারাপ কবিতা লিখতে থাকেন। 

৪. শুধুমাত্র ভাব এবং শব্দ দিয়ে কবিতা লেখা হয় না, সঙ্গে চাই নৈঃশব্দ এবং উইঢিবি। 

৫. বুকে বালিশ দিয়ে কবিতা লেখা বিপজ্জনক। সে কবিতা পরতে গিয়ে পাঠকের হাই উঠতে পারে। 

৬. কবিত্বের পৃথিবীব্যাপি অনেক সংজ্ঞা আছে, সে-সবের মধ্যে রবিন্দ্রনাথের সংজ্ঞাটিই শ্রেষ্ঠঃ “নিজের প্রাণের মধ্যে, পরের প্রাণের মধ্যে ও প্রকৃতির প্রানের মধ্যে প্রবেশ করিবার ক্ষমতাকেই বলে কবিত্ব।” 

৭. একটি বাক্যে কী-করে কবিতা হয়, তা বোঝার মাপকাঠি হিশেবে কিছু পূর্বতন পংক্তি মাথায় রাখা প্রয়োজন। এরকম একটি সহজ পংক্তি এখানে উদ্ধৃত হলঃ ‘বিকেলবেলা অকস্মাৎ লাল শাড়ির অতলতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।’ (অরবিন্দ গুহ) 

৮. দিবসরাত্রির প্রতিটি প্রহরে নিসর্গের যে বিশিষ্ট সুর, এবং সেইসব সুরের সমন্বয়ে নিসর্গের যে বিশাল রাগমালা, সেই রাগমালাই কাব্যের উৎসধ্বনি। এই নিসর্গসুর সূক্ষ্মতম মূর্ছনায় কবির মনের ভেতর ধ্বনিত না হলে কাব্যভাষার সৃষ্টি হয় না। 

৯. পূর্বসূরীরা কেউ বলেছেন, কবিতা গনিতের সঙ্গে সঙ্গীতের কলহ; কেউ বলেছেন, কবিতা নিজের সঙ্গে নিজের কলহ; কেউ বলেছেন, কবিতা জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম। লক্ষ্য রাখতে হবে যে এই প্রতিটি উক্তিই ধার্য হয়ে উঠেছে শুধু এ-কারনে যে, এই প্রতিটি উক্তিই কবিতা। কবিতার সংজ্ঞা কবিতাই, এবং কবিতার সঙ্গী-ও কবিতাই, অন্য কিছু নয়। এই অর্থে, কবিতার জগৎ স্বয়ংসম্পূর্ণ, ঐন্দ্রজালিক, এই জগতের প্রতিটি বস্তু ও ভাব কবিতায় রূপান্তরিত, এবং সে-কারনে এই জগৎ ভীতিপ্রদ ও নিঃসংগ। 

১০. বিরূপ পরিস্থিতি কাব্যরচনার পক্ষে সহায়ক। যদি সেই পরিস্থিতি না থাকে, তবে তা সৃষ্টি করে নিতে হয়। 

১১. পাখির গান বলে যা মনে করা হয় তা যেমন আসলে পাখির গান নয়, পাখির জীবনসংকেত, তেমনি কবিতাও কবির গান নয়, কবির জীবনসংকেত। 

১২.একটি কবিতা কিভাবে একটি কচ্ছপের সমান আয়ুলাভ, তা বুঝতে গেলে বালি, বর্ম, কুশ্রীতা এবং লোনা জলের রহস্য বুঝতে হয়।

১৩. কোনো প্রকৃত কবি কখনো বৃদ্ধ হন না। কবিরা মদের মতো, যত পুরনো হন ততই মধুর হতে থাকেন। 

১৪. ব্যাক্তিজীবনে মিথ তৈরি করে যারা সেই মিথ তাদের কবিতায় লগ্নি করেন, পরে তাদের কবিতাকে বড় চড়া সুদে সেই ঋন শোধ করতে হয়। 

১৫. হাইকু থেকে হারাকিরি-এই পথটুকু কবিতার পথ। কবিতার জাপানি ফুটব্রিজ। ক্রোধ ও রিক্ততা ছাড়া এই পথ পাড়ি দেওয়া ভীষণ কঠিন। 

১৬। কবি নির্বাসিত প্রাণী; যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর তার। তার অপরাধ-জৈবপ্রকৃতির ভিতর তার এক অন্তর্ঘাতমূলক কল্পনাশক্তি এবং সেই শক্তির গেরিলা প্রকাশ তার কবিতায়। কবিতা এই দ্বীপান্তরের চিঠি, যা পড়ে কারারক্ষীরা ভুতগ্রস্ত হয়, এবং কবির নির্দেশে তারা সেই চিঠি, অত্যন্ত যত্নে এবং সতর্কতায়, বোতলে পুরে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়। 

১৭. জ্যোতিষজগতে কবিরা দুরতম নক্ষত্রশ্রেণীর। তারা সাহিত্যের আকাশে যে যেখানে পুর্নভাবে উদিত হন, সেই স্থানেই অধিষ্ঠান করেন। কখনো, বিশেষ উপলক্ষে, তাদের কারুর প্রতি মানমন্দিরে দূরবীন এবং কৌতুহল নিবদ্ধ হয়। অন্যথায় তারা নির্জনতার ভিতর স্বস্থানে বিরাজ করেন। ঋতুভেদে যে-সব কবিদের স্থান পরিবর্তন ঘটে বলে মনে হয়, তারা আসলে গ্রহ, নক্ষত্র নন। কবিদের পজিশনাল এস্ট্রোনমির এটাই হল মূলসূত্র। 

১৮. কবিতার সবচেয়ে বড় শত্রু একটি ফুল-নাম নার্সিসাস। 

১৯. কথা উঠেছে কবিতা আর লেখা হবে না, কবিতার অবলুপ্তি আসন্ন। এই প্রসঙ্গে, স্বপ্নে দেখতে হবে এক কালনিক জার্মান পন্ডিতকে-টাকমাথা, বাঁচোখে চশমা, সাক্ষাৎ লাইব্রেরির ব্রম্মদৈত্য-তিনি হাতে ধরে আছেন তার লেখা দুনিয়াকাঁপানো নতুন বইটি, যার নাম-এন্ড অব পোয়েট্রি (ইংরেজি অনুবাদে); তাকে ঘিরে অসংখ্য টিভি ক্যামেরা আর কর্পোরেট লোগো। এমনকী, স্বপ্নে দেখতে হবে সেই কালনিক বইটির প্রথম বাক্যটিওঃ “এভরি ওয়ার্ড হ্যাজ লস্ট ইটস মিষ্ট্রি-ইনক−ুডিং দ্য ওয়ার্ড ‘মিস্ট্রি’ ইটসেলফ-বিকজ গড’স ফিঙ্গার প্রিন্ট কুড নট বি ফাউন্ড ইন দ্য বটম কোয়ার্ক।” এবং স্বপ্নেই, তৎক্ষনাৎ, ভেবে নিতে হবে এই বাক্যটির একটা আবছা প্রত্যুত্তর, যেমন ধরা যাকঃ ‘ঘুমন্ত ভিখিরি আর মন্দিরের মাঝখানে ছায়াপথ, অনুতপ্ত আলো।’ 

২০. যুগের দাবিতে, পশ্চিমে, এবং সে-সুত্রে কিছুটা এদেশেও-নানারকম কবিতার উৎপত্তি ঘটেছে, যেমন, গ্রিন কবিতা, পোস্টমডার্ন কবিতা, এথনিক কবিতা, ফেমিনিস্ট কবিতা, সাবঅলার্ন কবিতা, ইত্যাদি। সভ্যতার সংকট এবং প্রগতির প্রত্যয় থেকে উদ্ভুত এই প্রতটি কাব্যাদর্শই অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং শ্রদ্ধেয়। এদের প্রত্যেকটির তত্ত্ব, উদ্দেশ্য, উদ্বেগ, মহত্ত্ব, যুক্তি ও ভাববিভ্রম, সীমাবদ্ধতা, দর্শনজিজ্ঞাসা এবং আবেগ-উৎস স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে হবে। এবং হঠাৎ রাস্তার মোড়ে, এ-সব আদর্শের যে-কোনো একটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে, শ্রদ্ধেয় অভিভাবককে দেখে হাতের সিগারেটটি লুকিয়ে ফেলার মতো, তৎক্ষনাৎ লেখার কলমটি লুকিয়ে ফেলতে হবে। কারন, এক প্রাচীন কবির চিত্রকল ধার করে বলতে হয়, কবিতা সেই নিশুতি রাতের চলাচল, যখন সিংহ জল খেতে নদীর ধারে আসে। 

২১. মনে রাখতে হবে, কবিতা বলে কিছু নেই, পাঠকই কবিতা। 

মূলঃ রণজিৎ দাশ (খোঁপার ফুল-বিষয়ক প্রবন্ধ)

____________________________________________________________
পুস্তক পর্যালোচনা
____________________________________________________________

রক্তাভ মৃণালের গান
শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন

নাচপ্রতিমার লাশ॥ পিয়াস মজিদ ॥ প্রকাশক: অস্ট্রিক আর্যু ॥ বাঙলায়ন॥ পৃষ্ঠা ৪৮ ॥ মূল্য:৭৫ টাকা ॥ প্রচ্ছদ: শিবু কুমার শীল

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যাদের বলেছেন আরণ্যিক নির্বোধ, তারা অজস্র দেবতা উদ্ভাবন করেছিলো; এবং যুগে যুগে নিজেদের রুচি আর স্বার্থ অনুসারে স্বর্গচ্যুত করেছিল অজস্র দেবতাকে। কোনো দেবতাই অবিনশ্বর নয়; দেবতারা জন্ম নিয়েছে আর রাজত্ব করেছে তাদের ভক্ত বা উদ্ভাবকদের পরিকল্পনা অনুসারে। গত ফেব্রুয়ারিতে পিয়াস মজিদ’র প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরুবার পর এই কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে ইতোমধ্যে ডজনখানেক সমালোচনা জাতীয় দৈনিক ও ছোটকাগজে আমার চোখে পড়েছে। সে পত্রপত্রিকাগুলোতে এ পুস্তকের সমালোচনায় সম্মানিত সমালোচকেরা যে আলোচনা করেছেন এই প্রথাভাঙা কাব্যগ্রন্থটি নিয়ে, সেসবের কিছু আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে পিয়াসকে, পিয়াসের কাব্যজগতকে চিনি বলেই আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে। মনে হয়েছে, এ কোন আরণ্যিক নির্বোধদের রাজ্যে এসে পড়লাম। যে রাজ্যে কবিতার এমন একটি প্রথা দাঁড়িয়েছে যেখানে প্রথাবদ্ধতা আর প্রথাগত ছন্দসাচ্ছন্দ্য দুই-ই অলিখিত দেবপ্রতিমা। কেউ কেউ পিয়াসের এই বইটিকে দেখেছেন নেতিবাচক দৃষ্টিতে এবং একটি জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী মারফত পরামর্শ দিয়েছেন ছন্দ নতুন করে শিখে নিতে হবে পিয়াসকে। তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই অধমের বলতে চাওয়া, কবিই নতুন তৈরি করেন, নতুন সুর-ছন্দ-লয়। কখনো কখনো পুরনোকে আঁকড়ে না ধরেও। পিয়াস তাই করেছেন। 

এমনিতেই এই আকালে যেদিকে তাকাই পুনরাবৃত্তের ভার। ছন্দ ছন্দ ছন্দ, টোনালিটি, সুর, গীত করে চেঁচিয়ে মিডিয়াস্টার আমাদের তথাকথিত আলোচিত কবিগণ উৎপাদন করছেন উৎকৃষ্ট কবিতার বাতাবরণে পুরনো আর নিকৃষ্ট কবিতা। সেখানে পিয়াস মজিদের এই কাব্যগ্রন্থ নাচপ্রতিমার লাশ যখন মূল পাণ্ডুলিপি থেকে কম্পোজ করছিলাম আমি, তখন থেকেই আমার হৃদগভীরে ধরেছিল অরূপ মায়ার নবফুল্লকারুকাজ হয়ে। কিন্তু গত কয়েক মাসে এই বইটির আলোচনায় আমাদের দেশের সমালোচকরা পিয়াসের প্রতি অন্যায় ই করেছেন। খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, সকল নন্দন সমালোচকদের, প্রিয় সাহিত্যবোদ্ধাদের, গত কয়েক দশকে একজন কবিকে কি কেউ দেখাতে পারবে যাঁর প্রথম পুস্তক পূর্ববর্তী কোন কবির কবিতাপ্রভাবহীন ছিলো কি না! পিয়াসের এই কাব্যগ্রন্থ, পিয়াসের কবিতা বাংলা সাহিত্যে নিশ্চিতভাবেই এক নতুন মাত্রা নিয়ে এসেছে, এ কথাটি এ-দেশের বোদ্ধামহলের কারো কাছ থেকেই শোনার সৌভাগ্য হয়নি বলে নিজেকে খুব দুর্ভাগা মনে হলো। আমি নোট করি, নিশ্চিত ভাবেই লিখি, প্রথাবদ্ধতার বিরুদ্ধে পিয়াসের এই যাত্রার গন্তব্য নতুনত্ব। দুর্বোধ্যতা যারা বলছেন আমি তাদের বিপরীতে বলি এ কবিতাগুলো অবোধ্য নয়, যদি অভিনিবেশ দিন আপনি। ঊচ্চাঙ্গগীতের জন্য প্রয়োজনীয় অভিনিবেশ আর পপুলার কালচারের অঙ্গ হয়ে ওঠা লোকগীতির রস উপভোগের জন্য অভিনিবেশ নিশ্চয়ই সমান হবে না। উৎকৃষ্ট কবিতার রসাস্বাদনের জন্যও চাই সেই অভিনিবেশ। পিয়াসের কবিতায় ধোঁয়াশা আছে তবে দৃশ্যগুলো অবোধ্য নয়। 

বাংলা কবিতার পরিধিতে আধুনিকতার লক্ষণগুলি একরকম আসন গেড়ে বসছে। বদলে যাচ্ছে তার ভাষা ও শিল্পকৌশল, ছন্দ ও ভাবগত চেহারা। সংবেদী ও সচেতন মানুষ মাত্রই জ্ঞানের বহুধা ফেনিল বেলাভূমি ছুঁয়ে যেতে উন্মুখ। আমাদের শিল্পের বেলায় বাইরে থেকে এস যেটুকু আত্মীকৃত হয়েছে তা এর বৈভবকে বাড়িয়েছে বৈ কমায়নি। তবে পিয়াস এর অর্ন্তমুখী স্বভাব শৈশব থেকে এই পর্যন্ত তাকে ভয়ংকর একাকীত্বের মুখোমুখি করিয়েছে। বোধহয়, এই নৈঃসঙ্গ্যই তাকে দিয়ে রচনা করিয়ে নিয়েছিল এমন কিছু কবিতা যা একজন পাঠক হিশেবে আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করে। একজন কবির কাজ তাঁর সমকালীন সাহিত্যে ব্রেক-থ্রু তৈরি করা। পিয়াস এ কাব্যগ্রন্থে সেটি প্রচণ্ড সফলভাবে পেরেছেন বলেই আমি মনে করি। 

মনে হয় পিয়াস তাঁর শৈশবের পোড়া গীর্জাবাড়ির ভূতকে পেছনে ফেলে হাঁটছেন, এই ভূত যেন বাংলা কবিতার বিগত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস। পেছনে ভয়ে না তাকিয়ে পিয়াস আবিষ্কার করছেন একটার পর একটা রূপহারা রাজহাসের নিরুপম কবর; চন্দ্রমন্থনের রাত। নাচপ্রতিমার লাশ। 

আমি এই আলোচনায় পিয়াসের কোন কবিতা উদ্ধৃত করতে চাই না। পিয়াসের কবিতার জগৎ, দৃশ্য, পিয়াসের একই সাথে সুন্দর ও কুৎসিত দেখবার ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে। পিয়াস নিজের ভেতরে, নিজের রক্তমাংস খুঁড়ে তৈরি করছেন তার পথ, করছেন যে এর স্পষ্ট ছাঁপ আমি দেখি নাচপ্রতিমার লাশ-এ। এ কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় নতুন এক যুগ শুরু করলো। শুরু করলো কবিতার নতুন অভিজ্ঞান কাল। নতুন প্রবণতা। নাচপ্রতিমার লাশের কবিতাগুলো যে প্রবণতা রেখে যেতে চায় তা খুবই সাহসী, বিধ্বংসী, শিল্পিত, নবচর্চিত। সময়ই বাতলে দেবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন পিয়াস আরণ্যিক নির্বোধদের রাজত্বের অমাবস্যা অন্ধকারে। আমাদের সময়ের কবি পিয়াস নব-সংজ্ঞায়নের কালমানের প্রতিক, আত্মজ্ঞ, বৈশ্বিক চৈতন্যময়তার প্রতিভূ। বাংলা কবিতার প্রথাগত ভূতেরা, পিয়াসের কুমিল্লায় ফেলে আসা গীর্জায়, অন্ধকারেই করুক রক্তকেলীরত আয়না-আত্মঘাতি চেহারায় মিশে যাবে কালস্রোতে। জীবনানন্দ বা কাফকার মতো একই ভাবে সমসাময়িকদের বিষমাখা তীরবাণে বিদ্ধ পিয়াস, আমি জানিবাগদেবীর চাওয়া, চাওয়া প্রত্যেক সাহিত্যবোদ্ধার সৎ মননের কাছে চারপাশে ছড়ানো আরণ্যিক ভ্রান্তস্বপনগুলো, ধারণাগুলো ভেঙে নব ধ্যানে পিয়াসের মতো স্রষ্টা তৈরি হোক। কী সব অলংকারে রাতের গলায় অমিতাভ মৃত্যুর হার, তা তো পিয়াস জানেন ই। আমি এ-ও জানি, ভয় নেই তাঁর।

শিমুল সালাহ্‌উদ্দিন : কবি, আবৃত্তিশিল্পী ॥ প্রাক্তন সভাপতি: জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট, ধ্বনি ॥ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি: অস্তিত্ব (ছোটকাগজ ও সাহিত্যসংগঠন)॥ 

____________________________________________________________
____________________________________________________________